#প্রজাপতি মন (পর্ব-17)
♡আরশিয়া জান্নাত
হাসিবের বড় বোন মিলি স্বভাবতই স্পষ্টভাষী। ওর মুখে কোনো কথাই আটকায় না। এখন সামনের জন সেটাতে হ্যাপি হোক বা স্যাড। ছোট থেকেই আনহাকে নিয়ে ওর ফ্যামিলিতে আলাদা আদিখ্যেতা ছিল। যেটা ও পাত্তা দিবেনা বললেও অনেক পাত্তা দিয়েছে। তাছাড়া নিশিথার সবকিছুতেই ট্যালেন্ট থাকাটা মিলির জন্য ছিল মরার উপর ঘাঁ এর মতো। তার মা সবসময় নিশি আর আনহার গুণগান করতেন আর ওকে বলতেন ওদের মতো হও। এইজন্য সে ওদের কিছুটা অপছন্দ করে বলা বাহুল্য। যেদিন শুনেছিল নিশি পালিয়ে গেছে ও ফোনে কিছু না বললেও মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল এই বিষয়ে মায়ের উপর ঝাঁজ তুলবেই সাথে আনহাকে কঠিন করে কথা শোনাবে।
আনহাদের বাসায় একটু আগেই এসেছে শপিং এ যাবে তাই ওকে নিতে। আনিসা ওর জন্য নাস্তা তৈরি করতে ব্যস্ত হতেই মিলি বললো, নিশি যেটা করেছে এটা কেউ কল্পনা না করলেও আমি অবাক হইনি। বেশি গুণী মেয়েদের কপাল এমনই হয়। খেয়াল করলে দেখবি ক্লাসের সবচেয়ে ট্যালেন্ট ছেলেমেয়ে শেষ পর্যন্ত সাকসেস পায় না। তাছাড়া নিশির যে রংঢং ছিল, কতো ভালো ভালো প্রপোজালকে পায়ে ঠেলে দূরে সরিয়েছে। কাইয়্যুমের কথাই ধর! কানাডায় স্যাটেলড ফ্যামিলি, এতো হ্যান্ডসাম ছেলে ক্যাম্পাসের সবাইকে বাদ দিয়ে তোর বোনের পিছে সুপারগ্লু হয়ে ছিল। অথচ নিশি ওকে পাত্তাই দেয় নাই। তো এখন গিয়ে পড়লি কই? ছেলে বুঝি হৃতিক রৌশন? শুনেছি দেখতেও বিশেষ না টাকাপয়সাও নেই কি দেখে পাগল হইছে আল্লাহ জানে! ওর চয়েজ এতো খারাপ হবে আমিতো ভাবিই নি।
আনহা চুপচাপ রেডি হচ্ছিল, বোনের সম্পর্কে এমনসব কথা শুনতে খারাপ লাগলেও কিছু বললো না। মিলি আপন মনেই বলে যাচ্ছে, এই কুশিকাটার টেবিল ম্যাট টা ও বানিয়েছিল না? যা বুঝলাম আল্লাহ মানুষকে ট্যালেন্ট দেয় ওসব দিয়ে দুনিয়াতে চষে বেড়ানোর জন্য। নিশির নসীবে গ্রামের গৃহবধূ হবে লেখা ছিলো বলেই ও সংসারের কাজে পারদর্শী ছিল। তা পুলিশের জবটা এখনো করে নাকি মাটির চুলোতেই জীবন পার করছে?
আপু মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছে, সামনের মাসে ডেট।
বাপরে! এক বছরেই বাচ্চা। হাহাহা ছেলের বুদ্ধি আছে। বাচ্চা ছাড়া এই বৌ রাখতে পারবেনা তাই এই ফন্দি এটেছে। বড়লোক মেয়েদের বেঁধে রাখার এই এক ফর্মূলাই তো জানে এই ক্যাটাগরির ছেলেরা। তুই আবার মনে কষ্ট পাস না যেন। শুনতে খারাপ লাগলেও মিথ্যা বলছিনা।
আনহা হেসে বললো, মিলি আপু আমি জানি তুমি সত্যের পূজারি, সত্যি বলাতে মানুষের মন রক্তাক্ত হলেও তোমার বিশেষ কিছু যায় আসে না। এমন মানুষ হওয়া কিন্তু সহজ না!
মিলি ওর কথা বিন্দুমাত্র গাঁয়ে না মেখে বললো, তোর গাঁয়ের রংটা দিনদিন কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যাচ্ছে। পার্লারে না যাস ঘরোয়া কিছু করতেই পারিস।
আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল তখন আনিসা নাস্তা নিয়ে ঢুকলো সাথে হাসিব আর মিলির ছেলে মুহতাসিম ও এলো। মিলির হাজবেন্ড দেশে ফিরলেও সারাক্ষণ ল্যাপটপেই মুখ গুঁজে রেখেছে। শপিং এ তার বিশেষ আগ্রহ নেই বলে অযথা সময় নষ্ট করতে আসেনি।
আনহা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। শপিং এ ঘোরাঘুরির ফাঁকে সুযোগ পেয়ে হাসিব বললো,আপা তোকে কথা শুনিয়েছে তাই না? তোর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে পারলে এখুনি কেঁদে ফেলবি!
আরেহ না তেমন কিছু না!
একদম মিথ্যা বলবি না। আম্মু ওকে কতবার করে বলে পাঠিয়েছে যেন তোকে বা কাউকেই কিছু না বলে তোর আইডিয়াও নেই। কিন্তু আপাকে তো চিনোসই সে ঠিকই সুযোগে কথা শোনাবেই। মন খারাপ করিস না। আর শোন!
বল
তোর মুড অফ দেখলে আমার ভাল্লাগেনা!
জানি।
আর কি জানোস?
তুই এখন একটা শয়তানী করার মতলবে আছোস। খবরদার করবি না।
হাহাহা,,, তুই আসলেই আমার কলিজার দোস্ত। আমারে হাড়ে হাড়ে চিনোস,
বলেই টুপ করে আনহার গালে চুমু দিলো। আনহা ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল!
??????
আনহার গায়ে ওয়াইন কালারের উপর পার্ল ওয়ার্ক করা গর্জিয়াস গাউন। চুলগুলো অসম্ভব সুন্দর করে হোয়াইট স্টোনের পিন দিয়ে সেটাপ করা হয়েছে। প্রায় চার ঘন্টা পার্লারে বসিয়ে ঘষামাজা করিয়েই দম নিয়েছে মিলি। আনহার দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হেসে বললো, এই না হলে মিলির ভাইয়ের বৌ! এখন তোকে একদম প্রিন্সেস লাগছে। আজকে হাসিবও তোকে চিনতে পারবেনা, বাদড়টা জ্ঞান হারায় কি না সন্দেহ!
আনহার মনে হলো ভাগ্যিস বিয়ের সময় মিলি ছিল না! ওর যে কি হাল হতো! নিজেকে দেখে নিজেরই অদ্ভুত লাগছে, এমন ভূত সাজানোকেই মিলি আপু এতো পছন্দ করলো?
হাসিবকে ফর্মাল লুকে বরাবরই খুব হ্যান্ডসাম লাগে। গেস্টদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে, এই কিছুক্ষণের মধ্যেই আনহার কতগুলি ছবি তোলা হয়েছে হিসাব ছাড়া। মিলি ঢাকা থেকে নামী ফটোগ্রাফার আনিয়েছে, কানাডায় সবাইকে দেখাতে হবেনা? তাছাড়া একটা মাত্র ভাই তার ওর বিয়ে নিয়ে কল্পনা জল্পনার তো শেষ ছিল না।
আনহা মেকি হাসি দিতে দিতে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। বিয়ে করা এত্তো প্যারা জানলে সে বিয়েই করতোনা। অথচ তার নিজেরো শখ ছিল বৌ সেজে ছবি তুলবে, সবাই শুধু তাকেই দেখবে! কিন্তু এখন যখন এসব হচ্ছে ওর রীতিমতো শরীর খারাপ লাগছে। এসব আর কতক্ষণ চলবে কে জানে!
নিশিথা ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখছে তার ছোট্ট বোনটাকে কি সুন্দর লাগছে। পরিবারের সবাইকে দেখে ওর যেমন ভালো লাগছে তেমনি কষ্ট হচ্ছে। ঝাপসা চোখে আনহা আর হাসিবের রিসিপশনের ভিডিও ফুটেজ লাইভ দেখছে। হাসিব সেই ব্যবস্থা করেছে। যদিও হাসিবের ইচ্ছে ছিল সে নিজে গিয়ে নিশিকে আনবে। কিন্তু নিশির কন্ডিশন এখন খুব ক্রিটিক্যাল বলে লং জার্নি করানোর সাহস হয়নি।
আনহা যে তার বোনকে মিস করছে এটা আর কেউ না বুঝলেও হাসিব ঠিকই বুঝে।
।
।
আচ্ছা মা তোমরা হাসিবকেও কেন আনহার সাথে পাঠাচ্ছো না বলোতো? ওকেও ঐখানে পাঠাও বাকি কোর্স সিঙ্গাপুর করুক!
হাসিব কেন হঠাৎ সিঙ্গাপুর যাবে! তাছাড়া ওর বিজনেস তো এখানেই। ও ওখানে গেলে হবে নাকি!
বুঝতে পারছো না। আনহা ওর ওয়াইফ ওর দায়িত্ব আছে না? তাছাড়া এতো দিনের জন্য যাচ্ছে একা মেয়ে। ব্যাপারটা কিন্তু ডালভাত না।
হাসনা হেসে বললেন, আনুর উপর ভরসা আছে আমার। আর শোন হাসিবকে ওর সঙ্গে পাঠানো কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু আমি চাই ওরা দুজন একটু ম্যাচিওর হোক। বিয়ে হয়েছে মানে এই না এখনই সংসার পেতে বসতে হবে। দুজনেই পাকাপোক্ত হোক, কখনো যাতে এটা ভাবার ফুরসত না আসে যে বাপ মা জোর করে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে কাঁধে বোঝা চাপিয়েছে। এখন বলথে পারিস আনহার বয়সী অনেকেই মা হয়ে গেছে ওর বেলা সমস্যা কি! সমস্যা আনহার না। আমাদের দেশে বাইশ বছরের মেয়েরা যতোটা পরিপক্ক বাইশ বছরের ছেলেরা ততোটা না! তাই আমি এই গ্যাপটা ইচ্ছে করেই রাখছি। তোর ভাইকে বুঝদার হতে দে
তোমার কত দূরদর্শী চিন্তাভাবনা। যাক যা ভালো মনে করো। তবে দু দিকেই লক্ষ রেখো। কেউই যেন খেই না হারায়।
কে হারাবে খেই তোর ভাই?
আনুও হারাতে পারে! তবে আমার ভাই যে আনুর জন্য উন্মাদ এ তো নতুন না।
দেখি না! নসীব তো বদলানো যায় না। যা হবার তাই হবে।
কাল ভোর চারটায় আনহার ফ্লাইট। জিনিসপত্র প্রায় গোছানো শেষ। আজ বিকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে বেরোবে। হাসিব সারাটাদিন ছটফট করছে। আনহা চলে যাচ্ছে ভাবতেই ওর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে যেন। কিন্তু মুখে কিছুই বলেনা। একটু পরপর এই রুম ওই রুম ঘুরে ঘুরে আনহার সামনে আসে।
কি রে এমন করছিস কেন? স্থির হয়ে বস
হাসিব পায়চারি করতে করতে বলতে থাকে,
শোন আনু ঐখানে কোনো ছেলের সাথে ফ্রেন্ডশীপ করবি না। করলেও জানিয়ে রাখবি তুই ম্যারিড। আর তোকে না বলেছি হাতে চুড়ি পড়তে নাকে নাকফুল পড়তে?! তুই কি আমার কোনো কথাই শুনবি না?
আনহা হাসিবের দিকে তাকিয়ে দেখে হাসিব পাগলপ্রায় হয়ে আছে। কিসের এতো টেনশন তার? সেও কি ভাবছে আনহা দূরে গিয়ে অন্য কারো প্রেমে পড়বে? আনহা উঠে হাসিবের বুকের বাঁ পাশে হাত রাখলো। তারপর শান্ত গলায় বললো, ভরসা নেই তোর আনুর উপর? এতো অশান্তি কেন এখানে?
হাসিব ওর হাতটা শক্ত করে চেপে বললো, আনু আমাদের বাসর হয় নি কিন্তু। তুই আমার আমানত। মনে রাখিস। হাসিব নিজের ভাগের জিনিস সবাইকে বাটলেও তার আনু একান্তই তার। এর এক বিন্দুও অন্য কেউ পাবেনা।
বাপরে! কঠিন কথাবার্তা। তা এসব কি শুধুমাত্র স্বামীর অধিকারের দায়ে ?
হাসিবের ইচ্ছে হলো বলতে, না এটা তোকে ভালোবাসার অধিকারে। আমার মনের সবটা জুড়ে যেমন তোর অবস্থান আমিও চাই তোর মনের সবটায় যেন আমি থাকি। এই তোলপাড় করা অনুভূতির দহনে আমি একা পুড়লে হবেনা। বিশ্বাস কর শুধুমাত্র খাঁচায় বন্দী করে রাখার অপরাধটা নিতে চাইনা বলে যেতে দিচ্ছি। নাহয় তোকে এই বুকের পিঞ্জরে লুকিয়ে রাখতাম। সেখানে কতোটা ভালোবাসা জমেছে দেখলে বুঝতি।
কিন্তু বলা হলো না।
আনহা প্রথমবারের মতো লাজলজ্জা ভুলে নিজেই হাসিবকে জড়িয়ে ধরলো। হাসিবের মনে হলো তার অস্থিরতা সব চোখের কার্ণিশ বেয়ে গলে পড়ছে। একটা মানুষের আলিঙ্গনে এতো শান্তি থাকতে পারে? সময়টা থমকে যেতে পারছে না? আনহা এভাবেই তার বুকে লেপ্টে থাকুক না সহস্রাধিক বছর।।।।
চলবে,,,,,