প্রজাপতি মন (পর্ব-18)

0
718

#প্রজাপতি মন (পর্ব-18)

♡আরশিয়া জান্নাত

নিশিথার খুব সুন্দর একটা ছেলে হয়েছে। গায়ের রংটা নিশির মতোই ফর্সা, শ্বশুরবাড়ির সকলেই উচ্ছাসিত এমন রাজপুত্রের মতো প্রদীপ পেয়ে। নিশির শাশুড়ি তো কোল ছাড়াই করতে চান না। এতো সুন্দর বাচ্চা তার ইমরানের ঘরে হবে এ তিনি কল্পনাই করেননি যেন। নদী রোজ নিয়ম করে কাজল কালি দিয়ে চোখ ভ্রু আর টিপ আঁকে পাছে কারো নজর লাগে যদি! বাচ্চাকে নিয়ে সবারই একটু বেশিই আহ্লাদ। নিশির মনে হয় ছেলেটা তার বাবার মতো হয়েছে। সেই নাক, সেই চোখ, নিশি তাঁকে বুকের মাঝে নিয়ে বাবা বলে কেঁদে ফেলে। সে বরাবরই তার বাপসোহাগী মেয়ে। এই পৃথিবীতে সে তার বাবার চেয়ে বেশি কাউকে ভালোবাসেনা। অথচ কি যে হলো! সেই বাবার মনে কষ্ট দিয়েই অদূরে অনাথের মতো দিনাতিপাত করছে। এখানের সবাই যেমন আদর করছে ছেলেটাকে তার বাবা মাও নিশ্চয়ই করতো। তাদের পরিবারের প্রথম নাতি বলে কথা! নিশির বুক ভার হয়ে আসে, কেন যে পালিয়ে এসেছিল এর চেয়ে ভানের জলে ভেসে যাওয়া কম কষ্টের হতো।
তবুও বাবার রাগ কিছুটা যদি কমে সেই প্রত্যাশায় ছেলের অনেকগুলো ছবি হোয়াটস এপে পাঠিয়ে দেয়।
আনহা গেছে আজ প্রায় পাঁচ মাস, হাসিব এই শহরে বেড়ে উঠেছে আনহার সাথে। যতো বন্ধুবান্ধবই থাকুক আনহা ছিল ওর অক্সিজেনের মতো। সবসময় ওর আশেপাশেই রেখেছে। অথচ সেই মানুষটা এখন এই শহরে নেই। হাসিবের কিছু ভালো লাগেনা। মনে হয় পুরো পৃথিবীর সবাই কঠিন ষড়যন্ত্র করেছে। আনহাকে তার থেকে দূরে সরিয়ে কারাবাস যাপনে দন্ডিত করেছে। আনহা যদিও ফ্রি হলেই কল করে, ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে বসে থাকে হাসিবের সামনে। কিন্তু হাসিব বর্ণচোরার মতো মুখ লুকিয়ে ব্যাক ক্যামেরা অন করে রাখে। ও দেখাতে চায়না আনহাকে দেখলেই তার কেমন চোখ ভিজে আসে। ছেলের এমন দেবদাস রূপ থেকে হাসিবের বাবা আরিফ সাহেব অধৈর্য হয়ে হাসনাকে বলেন ওকে পাঠিয়ে দাও ওখানে। এই ছেলে এভাবে মরে যাবে!
হাসিবের মা তবুও অনড়। তিনি মোটেও মত দেন না। আরিফ সাহেবের বুঝে আসেনা তার স্ত্রী কেন এই নিষ্ঠুরতা করছে। এইসব করার মানেই বা কি!

হাসনা তার ছেলেকে আদর করে পাশে বসালেন, গাঁয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বাবা মানুষ যা বিনা পরিশ্রমে এচিভ করে সেটাতে বেশিদিন আকর্ষণ থাকেনা। এক সময় গিয়ে অবহেলা চলে আসে। আনহাকে তুই পেয়েছিস ভাগ্যের জোরে বিনা কষ্টে। ওর কদর করতে হবে তোকে। এই দূরত্বটা ভালোভাবে কাজে লাগা। ওর শূন্যতা উপলব্ধি কর, ওর জন্য নিজেকে যোগ্য করে তোল। এমন উন্মাদ প্রেমিকের মতো ঘুরলে চলবেনা। আমি চাই আমার ছেলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ স্বামী হোক। সাথে এটাও চাই আনহাও সেইম ফিল করুক। তোরা দুজন একটা পরীক্ষা দিচ্ছিস ধরে নে। সেই পরীক্ষার পরবর্তী জীবনটা মিষ্টিময় হোক

হাসিব কঠিন কথাবার্তার মর্ম বোঝেনা। তার শুধু মনে হয় মা ভাবলো কিভাবে কখনো আনহার কদর সে দিবেনা অবহেলা করবে? ওকে মন ভরে ভালোবাসতে কোন যোগ্যতা লাগবে?

সময় বয়ে যায়, দিন পেরিয়ে মাস; মাস পেরিয়ে বছর।
পড়াশোনার পাট চুকিয়ে নিজের বিজনেসটার বেশ শক্তপোক্ত অবস্থান দাঁড় করিয়েছে হাসিব।ছেলেটার বিজনেস আইডিয়া তাক লাগানোর মতো। ওয়েল সেটেলড ফ্যামিলি বিজনেস রেখে সে কলেজ থেকেই নিজের বিজনেসে কন্ট্রিভিউট করেছে। কতবার লসের মুখ দেখেছে হিসেব নেই। তবুও লেগেছিল তার স্বপ্নের পথে। বলতে গেলে মোটামুটি সাড়া ফেলে দিয়েছে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল সোসাইটিতে। আয়নায় দাঁড়িয়ে পেছনের দেওয়ালে টানানো বিয়ের ছবিটার সাথে বর্তমান হাসিবের চেহারার মিল খুঁজছে। তখন কেমন বাচ্চা বাচ্চা লাগতো! এখন সে পরিপক্ক পুরুষ। গলার টাইটা বাঁধতে বাঁধতে ভাবছে, আজকেই শেষ দিন এরপর থেকে এই টাই আর আমি বাঁধছি না। রুমটা ভালোমতো দেখে নিলো। এই নির্জীব ঘরটা আজ বহু মাস পর ধন্য হবে আনহার উপস্থিতিতে। আনহার জন্য জমানো গিফট সব পাশেই সাজিয়ে রেখেছে। ওর জন্য লেখা ডায়েরিটা ইচ্ছে করে সাইড টেবিলে রেখেছে। ও চায় আনহা পড়ুক ওর ভেতরটায় কি কঠিন অগ্নিদাহ চলেছে তার সম্পূর্ণ বর্ণনা।
চুলগুলো আরেকবার ঠিক করে বেড়িয়ে পড়লো এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।

হাসিবকে দেখে আনহার কেমন লজ্জা অনুভব হলো। হাসিব কেমন মুগ্ধ দৃষ্টিতে এক ধ্যানে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আনহার মনে হলো সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে এইটুকু পথ হাঁটার সাধ্যি নেই তার।
স্কাই ব্লু শার্টটাতে কি দারুণ মানিয়েছে হাসিবকে! এভাবেই বুঝি সবসময় অফিসে যায়? কত মেয়ে ঘায়েল হয়েছে নতুন করে?

“তুই আমাকে ফের আশাহত করলি আনু! ভেবেছিলাম সিনেমার নায়িকার মতো দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে চুমু খাবি। চারদিকে সবাই ড্যাব ড্যাব করে দেখবে বহুদিন স্ত্রীবিয়োগে থাকা ছেলেটা কত শক্ত করে বৌকে জড়িয়ে ধরেছে। কিন্তু তুই সবাইকে এমন দামি এক্সপিরিয়েন্স হওয়া থেকে বঞ্চিত করলি! দিস ইজ নট ফেয়ার”

আনহা খিলখিলিয়ে হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতেই হাসিবের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দিলো। হাসিব ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, আচ্ছা মেয়ে তো তুই। হাসতে হাসতে এভাবে কেউ কেঁদে ফেলে! লোকে কি ভাবছে বল তো।

আনহা ওর কথায় কর্ণপাত করলো না। চোখের পানিতে হাসিবের বুক ভিজিয়ে মন দিয়ে শুনতে লাগলো দ্রুতগতিতে স্পন্দিত হওয়া হাসিবের হৃদকম্পন। যার সবটা জুড়ে কেবল আনহার কর্তৃত্ব। এখানে আর কেউ নেই,আসতেও পারবেনা। আনহা কাউকে এর বিন্দুমাত্র ভাগ দিবে না মরে গেলেও না।

এখানেই থেকে যাবি? বাসায় সবাই অপেক্ষা করছে চল?

আমি এক কদম ও হাঁটতে পারবোনা। আমার গায়ে এক বিন্দু শক্তি নেই।

হাসিব মুচকি হাসলো। মাথা চুলকে আনহাকে কোলে তুলতেই আনহা সন্তুষ্ট চিত্তে হাসিবের নাক টেনে বললো, স্মার্ট জামাই।
???????
আমি জানতাম তুমি অনেকের সাথেই বিয়ের আগে কথা বলতে। সত্যি বলতে যতবার তোমার সঙ্গে আমি মিট করতে গেছিলাম আমি তোমার হাত ধরতে চেয়েছি। তখন যদি তুমি হাত ধরতে দিতে এক আল্লাহ জানেন আমি কখনোই তোমাকে বিয়ে করতাম না। কিন্তু তুমি আমাকে কখনোই সেই সুযোগ দাও নি নিশি। আমি বুঝেছিলাম এই মেয়ে ফুলের মতোই নিষ্পাপ। ওকে আমার লাগবেই। কিন্তু তুমি আমাকে ভুল প্রমাণ করলে। আমি তোমাকে অর্থের দিকে সুখী করতে পারিনি মানছি কিন্তু ভালোবাসার কমতি রাখিনি। কিন্তু তুমি বুঝিয়ে দিলে শুধু ভালোবাসা এনাফ না!

তুমি অযথাই এসব বলতেছ। যা ভাবছো তেমন কিছুই হয় নি।

সিরিয়াসলি? বিয়ের পরো তুমি বহু ছেলের সাথে কনট্যাক্ট রেখেছ এটা সাধারণ কথা?

কথা বলা মানেই খারাপ?

কথা বলা মানেই খারাপ বলছি না আমি থাকতে তুমি কেন অন্য ছেলের সাথে কথা বলবা?

তো কি বোবা হয়ে যাবো? আমি কথা বলা মেয়ে ইমরান। আমি চুপ থাকতে পারিনা। কিন্তু এখানে এসে আমাকে চুপ করিয়ে দিয়েছ। সারাদিন সংসারের কাজ নয়তো বাচ্চা সামলানো। তুমি এই বাচ্চার দোহাই দিয়ে আমার জবটা পর্যন্ত বাদ দিয়েছ। আমাকে তুমি সংসার নামক জেলখানায় বন্দী করছো। নিজেই ভেবে দেখো তো লাস্ট কবে রাত জেগে গল্প করেছ? যখনই বলি চলো না আজ একটু গল্প করি তোমার শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি ভর করে। আমার মেন্টাল পিস তুমি দিছো? আমার নিজেকে এখন জাস্ট একটা প্রয়োজনীয় মেশিন মনে হয়। যাকে দিনে ঘরের কাজ করতে , আর রাতে তোমার প্রবৃত্তি মেটাতেই রাখা হয়েছে। এমন জীবন তো আমি চাই নি ইমরান। এসব তো তুমি জানতে আগেই তো বলেছিলাম, বলি নি? আমি ওদের সাথে কথা বলি এজ এ ফ্রেন্ড নাথিং ইলস। ওরা কেউ বলতে পারবেনা আমার সাথে কারো আদার এফেয়ার আছে।

স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ককে তুমি এভাবে বললে নিশি? আর পাঁচটা মেয়ে কি এভাবে সংসার করছেনা? আমি কত পরিশ্রম করি সেটা তুমি টের পাও না? তোমার মতো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাই নি। না ভাগ্য সহায় আমার। আমাকে গাঁয়ে খেটে সব করতে হয়। আর জবের কথা বলছো! আমি তোমার উপর প্রেশার দিতে চাইনি বলেই জবটা,,,,

নিশি হেসে বললো, আমার বাবা দীর্ঘ দিন আমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখেছে। সেই অনুযায়ী আমি নিজেকে তৈরি করেছিলাম। আমাদের দুজনের পরিশ্রমকে তুমি জাস্ট একটা অজুহাতে নষ্ট করেছ। আসলে তোমার ইগোতে লেগেছে তুমি সরকারী জব করতে পারোনাই আর আমি তোমার স্ত্রী হয়ে সেটা করছিলাম। এটা তুমি মানতে পারো নি।
ইমরান রেগে নিশির গালে চড় দিলো। নিশি একটুও কষ্ট পেলো না। ও আগের মতোই হাসতে হাসতে বললো, থাপ্পড়টা দিয়ে প্রমাণ করলে এটাই সত্যি। শোনো চাইলেই তুমি তোমার ছোট মন বড় করতে পারবে না। আমি বেকুব ছিলাম বলেই তোমার মতো লো ক্লাসের ছেলেকে বিয়ে করেছি। আর এটা আমার জীবনের একমাত্র চরম ভুল। এর জন্য আমার সব শেষ হয়েছে একদম সব,,,,

ইমরান কাঁচের গ্লাসটা ফ্লোরে ছুড়ে মেরে বেরিয়ে গেল। নিশিথা রেগে সেই ভাঙা কাঁচের উপর ইচ্ছে করে হাঁটতে লাগলো। তার রক্তে পুরো ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে, তবুও তার মনের ঝাঁজ মিটছেনা।

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here