#প্রজাপতি মন (পর্ব-20)
♡আরশিয়া জান্নাত
ছোটবেলায় একটা গল্প শুনেছিল ইমরান। ভরা পূর্ণিমায় তাদের গ্রামের বড় দীঘিতে গভীর রাতে পরীরা নামতো। অনেকেই নাকি দেখেছিল তাদের। সেই খবর শুনে এক লোক লুকিয়ে তাদের দেখতে যায়, সব পরীরা গোসল শেষে উড়ে গেলেও একটা পরী উড়ে যেতে পারেনা। কারণ তার ডানা ঐ লোকটা লুকিয়ে ফেলে। শেষে বাধ্য হয়ে পরীকে সেখানেই থেকে যেতে হয় ঐ লোকটার বিয়ে করা স্ত্রী হিসেবে। তাদের ঘর আলো করে দুটো সন্তান আসলেও পরীর মন এখানে টিকে না। সে কৌশলে শাশুড়ির থেকে ডানা নিয়ে উড়াল দেয় পরীর রাজ্যে।
ঘটনাটা কাল্পনিক নাকি সত্যি এই কথা ইমরান জানেনা। তবে তাদের গ্রামে এটা বহুপ্রচলিত গল্প।এখন তার মনে হয় গল্পটা মোটেও কল্পকাহিনী নয়। এই যে তার জীবনে পরীর মতো অনাকাঙিক্ষতভাবে নিশিথা এসেছিল। তার ঘর আলো করেছিল সৌন্দর্য দিয়ে, তাদেরও তো কোল আলো করে ছেলে এসেছে। তবুও বেঁধে রাখতে পারেনি তাকে। ঠিকই উড়াল দিয়ে চলে গেছে পেছনে সব মায়া ভালোবাসা রেখে।
ইমরান বুঝতো নিশির মতো বড় ঘরের মেয়ে এখানে মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু তার কি সাধ্য ছিল কিছু করার? নিশির জবটা যদি করতে দিতো হয়তো এসব কোনো সমস্যাই হতো না। কিন্তু এখানের সবাই যে তাকে যা নয় তাই বলেই ক্ষ্যাপায়। এমনিতেই নিশিথাকে আনার পর থেকে সবাই বলতো, তোর কপাল দেখে হিংসা হয় রে ইমরান। বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা শোভা পায়? কেউ কেউ তো বিদ্রুপের সুরে বলতো, রাজকন্যা তুলে এনে তার চাকরির টাকায় খাবি! বাহ নসীব এটাকেই বলে।
এইসব লাঞ্ছনা বাঞ্ছনা সহ্য করে কিভাবে দিতো নিশিথাকে জব করতে? এমনিতেই তার কষ্টের অন্ত ছিল না। সে জানেনা সে কি করবে, নিশিথাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে নাকি চুপচাপ মেনে নিবে পরীর গল্পের মতো! তার বুকের মাঝে লালিত হবে পরীর সন্তান,,,,,,
হাসিব নিশিথার সামনে বসে আছে। একটু আগে নিশিথা ওকে কল করে বলে দেখা করতে, হাসিব মিটিং ক্যানসেল করে রেস্টুরেন্টে আসে। নিশিথাকে দেখে প্রথমে চেনাই যাচ্ছিল না। নিশিথা একদম বদলে গেছে যেন। চেহারা কেমন বিধ্বস্ত। হাসিব জানতো নিশিথার ছেলে আছে, কিন্তু ওর কোলে তো কেউ নেই, কিছু একটা শঙ্কা করে স্থির ও থাকতে পারছিল না।
আপু কি হয়েছে? আপনি হঠাৎ এভাবে একা! সব ঠিক আছে তো?
নিশিথা ম্লান হেসে বললো, আমার জীবনের সব ঠিক আমি নিজ হাতে বেঠিক করেছি। এখন কিভাবে আশা করি সব ঠিকঠাক থাকবে!
কি অর্ডার করবো আপু? কি খাবেন বলুন? অনেকক্ষণ ধরেই না খেয়ে আছেন নিশ্চয়ই!
নিশিথা সে কথা এড়িয়ে বললো, আনহা ফিরেছে? বাসায় সবাই কেমন আছে?
হাসিব ওয়েটারকে ডেকে খাবার অর্ডার করলো।
তারপর বললো, আপনি নিজেই সব খবর জানবেন। আগে খেয়ে নিন।
তুমি অনেক বড় হয়ে গেছ মনে হচ্ছে! চার বছরে কত কিছু চেইঞ্জ হয়ে গেছে। শহরটা চিনতেই পারছিলাম না। কতো কি বদলেছে!
আপু আপনাকে আমি সবসময় প্রাণোচ্ছল দেখেছি। বিশ্বাস করুন আপনাকে এমন মনমরা দেখবো কখনোই ভাবিনি। আমার খারাপ লাগছে! আপু আনুকে এখানে আসতে বলি?
হাসিব আমি ইমরানকে ছেড়ে চলে এসেছি। সেখানে আমি আর যাবো না। বাসায় যাবো সেই মুখ ও নেই। আব্বুকে ফেইস করার সাহস হচ্ছে না। আর আনুকেই বা কিভাবে মুখ দেখাবো। ও আমার জন্য অনেক সাফার করেছে।
এসব ভাববেন না। আনুর কাছে এই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় মানুষ তার বড় বোন। সে আপনাকে কতোটা ভালোবাসে আপনি হয়তো কল্পনাও করতে পারবেন না। যদিও পরিস্থিতি আগের মতো নেই কিন্তু ও সবসময়ই আপনাকে মিস করেছে।
আমাকে যারা ভালোবাসে তারা অকারণেই প্রচুর ভালোবাসে। এদের ভালোবাসার যোগ্য আমি না! হাসিব এই মুহূর্তে আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তুমি কি আমার কোনো ব্যবস্থা করতে পারবে?প্লিজ
আপু এভাবে বলছেন কেন? আপনি আমাদের বাসায় চলেন?
নাহ। আমি এই অবস্থায় পরিচিতদের সম্মুখীন হতে চাই না। আমার একটু সময় লাগবে নিজেকে প্রস্তুত করতে। সেই পর্যন্ত তুমি আমার থাকার ব্যবস্থা করো।
আন্টি জানে আপনি যে এসেছেন?
নাহ। মায়ের সাথে আমার যোগাযোগ নেই প্রায় ছয় মাস। আব্বু আমার নাম্বার ব্লক করে দিয়েছে।
হাসিব দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে গেল। নিশিথা বহুদিন পর ভালো খাবার খাচ্ছে, কিন্তু চোখের পানি নিয়ে কাউকে খেতে দেখতে হাসিবের একটুও ভালো লাগছেনা। নিশিথার দুঃখের কথা হাসিব না জানলেও এইটুকু বুঝেছে মেয়েটা ভালো ছিল না!
নিশিথার থাকার ব্যবস্থা করে তাকে সেখানে রেখে হাসিব সোজা আনহার হসপিটালে গেল। এই সময়ে একমাত্র আনহাই পারে নিশিথাকে সামলাতে।
?????
কি ব্যাপার তুমি এই টাইমে এখানে?
আনু চটজলদি চল আমার সাথে আর্জেন্ট।
কি হইছে? এনিথিং সিরিয়াস? আম্মু আব্বুর কিছু হইছে? বাসায় সব ঠিক আছে?
আরেহ না। কারো কিছু হয় নাই। প্যানিক হইস না আবার প্লিজ!
তুই সত্যি বল আগে কি হয়েছে?
নিশিথা আপু আসছে!
আপু!!
চল তাড়াতাড়ি। উনাকে দেখে আমার স্বাভাবিক লাগছে না। তুই গিয়ে দেখলে বুঝবি।
আনহা ইমার্জেন্সি বলে লিভ নিলো। কতদিন পর সে নিশিথা দেখবে! ভাবতেই মনটা আনন্দিত হচ্ছে। অপরদিকে ভয় হচ্ছে কি ঘটতে চলেছে আবার?
আনহা রুমে ঢুকে দেখে নিশিথা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
মুখটা শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেছে যেন। চেহারায় অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। শরীরে মাংস নেই বললেই চলে। এতো রোগা হয়ে গেছে তার বোনটা! নিশিথাকে দেখে বোঝার সাধ্য নেই এই মেয়েটা নিজেকে নিয়ে কতো সচেতন ছিল। যে কি না বাসার যাবতীয় কাজ করা স্বত্ত্বেও হাতে একবিন্দু দাগ পড়তে দিতো না, রূপচর্চায় ব্যস্ত থাকতো। তার আঙুলগুলো এমন হয়েছে, কালসেটে রঙের নখগুলো বুঝিয়ে দিচ্ছে কতদিন এদের লেবু দিয়ে ঘষেনি! এই নিশিথাকে কেউ দেখলে বিশ্বাস ই করতে চাইবে না এটা সেই নিশি যার জন্য সব ছেলেরা পাগল ছিল! যার নিত্যনতুন ডিজাইনার ড্রেস দেখে পাড়াতে হৈ চৈ পড়ে যেত।
আনহা বোনের হাত ধরে কেঁদে ফেললো, কোন সুখের আশায় তুই আমাদের কষ্ট দিয়ে গেছিলি আপু? এই বুঝি সেই সুখের নমুনা! তোর কি হাল করেছিস দেখিস না আয়নায়? আমি কখনো ভাবিনি আপু তোকে এমন রূপে দেখবো।
নিশি চোখ মেলে দেখে তার আদরের ছোট্টবোনটা কেমন বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
আনু! এমন ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদিস না তো। তোর চোখের পানিতে তিতাসের আরেকটা শাখা হয়ে যাবে। এ কি করলে ভাই এই কাঁদুনে কে কেন ধরে আনতে গেলে?
কাঁদতে দিন আপু ওকে। আপনি যাওয়ার পর ও একদিনও কান্না করেনি। এতোকিছু ঘটেছে এতো কথা শুনেছে তাও এক ফোঁটা পানি ফেলতে পারেনি। আজ যখন কাঁদছে মানা করবেন না।
নিশিথা আনহাকে জড়িয়ে ধরলো। দুইবোনকে কাঁদতে রেখে হাসিব বেরিয়ে গেল।
নিশান কোথায় আপু ওকে আনিস নি? আমার কত শখ ছিল জানিস ওকে কোলে নেওয়ার। কোথায় ও?
ওকে আনিনি আনু। ও যার সন্তান তার কাছেই রেখে এসেছি!
মানে কি? এইটুকু বাচ্চা কে তুই রেখে এলি!
যে নিজের বাবা মাকে রেখে যেতে পারে তার কাছে কোনোকিছুই কঠিন না।
কিন্তু ,,,
আনু আমি অনেক ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তুই জানিস আমার সিদ্ধান্ত কেউ বদলাতে পারেনা। অযথা এসব নিয়ে কথা না বললেই খুশি হবো।
কি এমন ঘটেছে আপু তুই নিজের সন্তানের মায়া পর্যন্ত ত্যাগ করলি! তোকে বোঝার সাধ্য আমার নেই।
হাহাহা। জানি আমাকে তুই সবসময়ই নির্দয় ভাবিস। এটা নতুন না। কিন্তু তুই কিভাবে নিষ্ঠুর হলি আনু? একটাদিন আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হলো না তোর? মা কে কতোবার বলেছি তোর সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে দিলো না। তুই জানিস একটা রাত কাটে নি যেদিন তোর কথা মনে করিনি আমি। আর তুই,,,,নিশানের জন্য ঠিকই কতো কি পাঠিয়েছিস। অথচ বোনের জন্য একটা সুতাও হাতে উঠেনি তোর। এতো অভিমান এতো নিষ্ঠুরতা!
তোর উপর আমার অনেক রাগ আপু। অনেক রাগ, আমি কখনোই তোকে ক্ষমা করতাম না আপু কখনোই না। কিন্তু তোকে দেখে আমার সব রাগ পানি হয়ে গেছে। জানি না কেন তোকে দেখে আমার আর রাগ হচ্ছে না।
আনু আমার পাশে শুয়ে থাক তো বোন। আমি ঘুমাই। কতদিন তোকে জড়িয়ে ঘুমাই না। বলতে বলতেই নিশিথা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। কতদিনের ঘুম ঘুমাচ্ছে সে??
চলবে,,,