#প্রজাপতি মন (পর্ব-4)
♡আরশিয়া জান্নাত
নিশিথা কিসের উপর দিয়ে বাসায় ফিরেছে জানে না। তার পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে, কপাল গলে ঘাম ঝরছে। আনহা ছাদ থেকে কাপড় নিয়ে রুমে ঢুকে বোনের চেহারা দেখে ভীত গলায় বললো, কি হইছে আপু? তোকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
নিশিথা বেসিনে গিয়ে মুখে পানি দিলো। বললো, বাইরে যা রোদ গরমে অস্থির হয়ে গেছি। আনু আমার জন্য পানি আন তো। ঠান্ডা গরম মিক্সড করে আনবি।
আনহা পানি আনতে যেতেই নিশিথা বিছানায় শুয়ে পড়লো। আনহা এসে দেখে নিশিথা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে!
হাসিব সারাটা দিন এক অজানা অপেক্ষায় একটু পর পর ফোন দেখছে। সে জানে এটা অহেতুক প্রত্যাশা। তিতলি কেন অযথা তাকে কল করতে যাবে? সেদিন ভুলক্রমে এসেছিল কিন্তু এখন তো আর ভুল হবে না! নিজ থেকে ফোন করার দুঃসাহস ও হচ্ছে না পরে তিতলি যদি তাকে লোফার ভাবে? না না তিতলির সামনে সে নিজেকে খারাপ উপস্থাপন করবে না। কিন্তু কোন ছুতোয় কল দেওয়া যায়? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে নাম্বার ডায়াল করলো মনে মনে বললো, যদি প্রথমবার রিসিভ করে তবে ভাববো এটা আমার লাকি চান্স। আর যদি না ধরে তবে আর কখনওই কল দিবো না।
প্রতিটা রিং হবার শব্দে তার বুকের ভেতরটা কাঁপতে লাগলো।
কল রিসিভ হতেই তার গলা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। তিতলি ফোন রিসিভ করে বললো, হ্যালো আস্সালামু আলাইকুম।
ওয়ালাইকুমুসসালাম। মিস তিতলি?
জ্বি বলুন?
আমাকে চিনতে পেরেছেন?
নাহ ঠিক চিনলাম না কে আপনি?
হাসিব আহত গলায় বললো, আমি হাসিব সেদিন ভুলে কল করেছিলেন যে।
ওহ হ্যাঁ চিনতে পেরেছি! কেমন আছেন আপনি?
এই তো ভালোই আপনি?
আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
তা আপনার মায়ের কি অবস্থা এখন?
বেশ ভালো। আপনি আমায় ফোন করবেন এ আমি কল্পনাই করিনি। স্যরি আমি চিনতে পারিনি। আসলে কল লিস্ট ডিলেট করে ফেলি তো তাই আর কি।।
ফ্যামিলির ভয়ে সবার নাম্বার ডিলেট করে দেন নাকি এমনিতেই?
নাহ তেমন নয়। এতো নাম্বার রেখে কাজ কি!
বুঝেছি নিশ্চয়ই প্রিয় কেউ আছে?
কি যে বলেন! ভাইয়া কেটে তিতাসে ভাসিয়ে দিবে।
আপনি তিতাসের আশেপাশে থাকেন! What a co- incident!!
আপনিও এখানে?
হ্যাঁ। আমি **পাড়া থাকি আপনি?
বলা যাবে না! আপনার পাড়ার মানুষ তো খুব ডেঞ্জারাস হয়!
আচ্ছা বেশ প্রাইভেসি কনসার্ন থাকা ভালো।
ধন্যবাদ বোঝার জন্য।
আচ্ছা পড়াশোনা করেন?
জ্বি এবার মেট্রিক দিবো।
ওহ! আমার দুই বছরের ছোট তাহলে।
তাই নাকি?
হুম। আচ্ছা আমরা কি ফ্রেন্ড হতে পারি? মাঝেমধ্যে কল করে গল্প করলে সমস্যা হবে?
আসলে আম্মু আর ভাইয়া,,,,
থাক তাহলে বাদ দিন।
আমি আপনাকে সুযোগমত কল দিবো তখন নাহয় কথা বলবেন?
হাসিব আনন্দিত গলায় অবশ্যই। ঐ কথাই রইলো তাহলে। রাখছি এখন ভালো থাকবেন।
তিতলি হেসে ফোন রাখলো। আর মনে মনে বললো, টোপ গিলেছো মনু এবার বুঝবে কত ধানে কত চাল!!
।
।
২০১১ সাল,,,
কিছুদিন পর আনহার এইচএসসি পরীক্ষা। দিনরাত এক করে সে পড়ে যাচ্ছে। পরীক্ষার ডেট যতো ঘনিয়ে আসছে তার ভয় ততো বাড়ছে। আনহার হাড় কাঁপাকাঁপি দেখে হাসিব উপহাস করে বললো, তুই হচ্ছিস গোল্ডেন এ প্লাসের ছাত্রী হুদাই ভং ধরিস না তো। সিওর দিয়ে বলতেছি লিখে রাখ, রেজাল্টের দিন আঙ্কেল যদি মাতৃভান্ডারের ছানামুখি খুশিতে সবাইরে না খাওয়ায় আমার নাম পাল্টাই ফেলমু।
আনহা ভেংচি কেটে বললো, হ এতো সোজা গোল্ডেন পাওয়া। তোর মতো গ্যারান্টি তো সনি টিভির কোম্পানিও দেয় না।
আমি যা জানি তাই ঘটবে। দেখিস। এখন টেনশন না কইরা চল নুডলস খামু।
তুই ঘোড়ার ডিম খাবি। তোর নুডলস খাওয়া মানেই আমার খাটনি। নিজের হাতে তো খাবি না আমারে বলবি খাওয়াই দিতে। পারমুনা এখন এসব করতে আমি বাসায় যাই। তোর বেশি ইচ্ছা করলে তিতলিরে ডাক ওরে ক খাওয়াই দিতে।
হাসিব হেসে বললো, যে কয়দিন ও নাই তুই কর। ও আসলে পরে চান্স পাবি না। তখন এসব মনে করে কান্না করবি বুঝছোস। হাসিবকে খাওয়াইতেও ভাগ্য লাগে।
এহহহ। এতো কনফিডেন্স তোর মারেম্মা!
মাশাআল্লাহ ক ফইন্নি।
রেস্টুরেন্টে বসে হাসিব বললো, জানোস দোস্ত অনেক মেয়ের সাথে কথা বলছি। প্রেম করার ট্রাই করছি কিন্তু তিতলির মতো মেয়েই হয় না। ও যা সুন্দর করে কথা বলে মন জুড়াই যায়। জানোস ও পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ে। আমারে যখন জিজ্ঞাসা করে পড়ছি কি না আমি লজ্জায় পড়ে যাই। এজন্য এখন নিয়মিত নামাজ পড়তেছি। মেয়েটার মধ্যে কিছু একটা তো আছেই।
আনহা স্পষ্ট দেখতে পায় হাসিবের চোখেমুখে সেই অপরিচিতা তিতলির প্রভাব। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে কতোটা বদলে গেছে হাসিব বলা বাহুল্য। এখন সিগারেটটা পর্যন্ত হিসাব করে কিনে। অপ্রয়োজনীয় খরচ বাদ দিয়ে এখন কেবল ফোনে রিচার্জ করে। মিনিট বান্ডেল কিনে কেবল তিতলির সঙ্গে ফোনালাপ। মেয়েটাকে সে দেখেনি, চিনেও না। সে জানেনা তিতলি দেখতে কেমন। লম্বা না বেঁটে? কালো না ফর্সা। হাসলে তার গালে টোল পড়ে? তার কী দীঘল কালো চুল আছে? সে যেমন মিষ্টি করে কথা বলে দেখতেও কি একই রকম?
কিছুই জানেনা সে তবুও অন্ধ উন্মাদের মতো মায়ার শেকলে জড়িয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন।
আনহা ভয় পায় এই নির্ভরশীলতা। সে ভালোভাবেই টের পায় এ অন্য পাঁচটা প্রেমের মতো নয়। হাসিব ঠিকই সিরিয়াস। হাসিবের মন না ভেঙে যায় শেষে এই শঙ্কায় শঙ্কিত থাকে সবসময়।
–বলছি কি আপু অনেক তো কথা বলেছিস তিতলি হয়ে এবার বাদ দে? হাসিব এখন অনেকটা শুধরেছে। ওর মায়া আর বাড়াইস না। ও এমনিতেই তিতলি তিতলি করে ফেনা তুলছে। পরে সত্যিই ভালোবেসে ফেলে যদি!
নিশিথা লিখতে লিখতে বললো, এখন হুট করে আমি কথা বলা অফ করলে ও যদি ফের বিগড়ে যায়? রেগে যায় যদি?
তাই বলে তুই এভাবে চালিয়ে যাবি সবসময়? এটা কি উচিত বল?
উচিত অনুচিত ভাবছি না। আমি সবটাই অনুচিতে ভরপুর। এখানে হুট করে কিছু করা যাবে না প্ল্যান করে এগোতে হবে। আমারে ভাবতে দে তারপর দেখি কি করা যায়।
আনহা জানে তার বোন সহজে এই নাটক শেষ করবে না। ছেলেদের সাথে কথা বলার অদ্ভুত নেশা তার বোনকে বেপরোয়া করে তুলছে। সেখানে হাসিব তো কিছুই না! ও ঠিকই হাসিবের সাথে কথা বলতেই থাকবে। আনহা তার অতি প্রিয় দুই মানুষের মাঝে অদৃশ্য সেতু হয়ে ঝুলতে থাকে অনিচ্ছায়। না পারে হাসিবকে সবটা বলতে না পারে বোনকে নিয়ন্ত্রণ করতে। অথচ সে ঠিকই টের পায় অদূর ভবিষ্যতে এর পরিণতিটা সুখকর হবে না।
________
নিশিথা রিটেনে সিলেক্টেড হয়েছে। কিছুদিন পর তার ভাইবা। ভাইবাতে সিলেক্ট হলেই ছয় মাসের ট্রেনিং। যদিও রেফারেন্স ছাড়া এইসবে খুব একটা সুযোগ মেলেনা কিন্তু হাইটের জন্য তার দিকে সবারই এক্সট্রা নজর। 5’6″ উচ্চতার মেয়ে ডিফেন্সের জন্য পারফেক্ট বলা চলে! তার উপর কয়েক বছর ধরে কঠোর অনুশীলন করিয়েছে তার বাবা। তাই তাকে কোনো ইস্যুতেই ইগ্নোর করা গেল না। ভাইবার দিন যখন বাবার নাম জিজ্ঞাসা করা হলো। নাম শুনে অফিসার বললেন, তুমি ক্যাশিয়ার নাফিজ ভাইয়ের মেয়ে! তাই তো বলি এতো স্ট্যাবল কিভাবে!
সেদিন নাফিজ সাহেব বাসায় ফিরে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আজ অফিসে সবাই আমায় ঝেঁকে ধরেছে জানিস! আমার মেয়ে এবার পরীক্ষা দিয়েছে কেন কাউকে বলিনি। তোর পারফরম্যান্স নিয়ে সকলের মুখে প্রশংসা। গর্বে আমার বুকটা ভরে গেছে রে মা!
সবাই বুঝে নিলো নিশিথার ট্রেনিং কনফার্ম।
নিশিথা ট্রেনিং এ যাবার আগে একটা মিথ্যে নাটক সাজালো। হাসিবকে বললো তার ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়েছে। হয়তো বেশিদিন বাঁচবে না। তবুও শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে বাবা তাকে ইন্ডিয়া নিয়ে যাচ্ছে। দেশে ফিরলে কল করবে!
কথাগুলো বলতে নিশিথার কষ্ট না হলেও হাসিবের জন্য এটা হজম করা সহজ ছিল না। সে সেই রাত পুরোটা জায়নামাজে বসে কাটিয়েছে। তাহাজ্জুদ নামাযের সিজদায় লুটিয়ে পড়ে অঝোরে কেঁদেছে তিতলির জন্য। তিতলি যেন সুস্থ হয়ে উঠে এই প্রার্থনায় মরিয়া হয়ে উঠেছে।
ইশ ছেলেটা যদি জানতো এ কেবল এক নিষ্ঠুর মেয়ের মনের মাধুরী মেশানো গল্প!!
চলবে,,,