প্রজাপতি মন (পর্ব-5)

0
1668

#প্রজাপতি মন (পর্ব-5)
♡আরশিয়া জান্নাত

নিশিথা ট্রেনিং এ যাওয়ার প্রায় দুই মাস পর,
আনহা মেডিক্যাল এ ভর্তিপরীক্ষার জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছে। কোচিং এর জন্য ঢাকায় ছোট মামার ওখানে শিফট করেছে। ওদিকে হাসিব তিতলির জন্য মরিয়া হয়ে গেছে। নয়ছয় করে এইসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, পাশ করবে কি না ঐটুকু ভরসাও নেই। ভার্সিটির জন্য কোচিং পর্যন্ত করছে না। সারাক্ষণ এক কথা তিতলি সুস্থ হয়ে ফিরবে তো!
আনহা যতোদিন ছিল সে অনেককিছু বুঝিয়েছে কিন্তু হাসিব কিছু কানে তুলেছে বলে মনে হয় না। আনহা নিজেকে নিজে দোষী ভাবতে শুরু করলো। না সে নিশিথার কাছে সাহায্য চাইতো না আজ হাসিবের এই করুণ দশা হতো! অবশ্য তখন তো ভাবেনি হাসিব এতোটা উইক হয়ে পড়বে।
আনহা ঠিক করে রেখেছে নিশিথার এই নাটকটা শেষ করবেই।নিশিথা ফিরলেই এ নিয়ে কঠিন বোঝাপড়া হবে।

কাইয়্যুম সিগারেট হাতে নিয়ে পুরো রাত কাটিয়ে দেয়। যে ছেলেটা আগে সিগারেট এর ধোঁয়া সহ্য করতে পারতোনা সে এখন কয়েক ঘন্টায় এক প্যাকেট নিকোটিন পোড়ায়। নিশিথাকে সেই প্রথম দেখা থেকে পছন্দ করা, বন্ধুত্বের গন্ডি পেরিয়ে অনুভূতির ঘনীভূত হওয়া সবটাই যেন ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। তার চেয়ে বড় পরিহাস হলো এই কেন সে সেদিন আবেগের বশে নিশিথাকে মনের কথা বলতে গেল। সেই দিনের কান্ডের পর নিশিথার সামনে পড়ার স্পর্ধা সে দেখায় নি। নিশিথা এতোদিনের জন্য ট্রেনিং এ গেল অথচ যাওয়ার আগে তার সঙ্গে দেখা করার প্রয়োজনবোধ করলো না। কাইয়্যুম বুঝতে পারে বন্ধুত্বটাই নষ্ট হয়েছে ভালোবাসার প্রকাশ করতে গিয়ে! নিজেকে খুব শূন্য লাগে।

–হ্যালো আনহা। কেমন আছিস?
–ভালো তুই?
–এই তো। শোন তুই কি মাজার বিশ্বাস করিস?মানে মাজারে মানত করলে পূরণ হয় এই টাইপ কিছু?
–আমার বিশ্বাস অবিশ্বাসে কাজ কি তোর?
–দোস্ত আমি ঠিক করেছি সিলেট যাবো। শাহ্ জালাল মাজারশরীফ জিয়ারত করে তিতলির সুস্থতার জন্য দোআ করবো। আচ্ছা আনহা এমন কোনো ওয়ে আছে যাতে কেউ সুস্থ হয়?
–তুই এতোকিছু ভাবছিস কেন বলতো? রোগ যেমন আছে চিকিৎসাও আছে। আচ্ছা হাসিব একটা অচেনা মেয়ে যাকে তুই দেখিসনা পার্সোনালি চিনিসও না। তার বলা কথা সত্যি কিনা তাও জানিস না অথচ অন্ধের মতো বিশ্বাস করে পাগলামি করছিস। এসব কি ঠিক? সেদিনো আন্টি ফোন করে বলছিল তোকে বলতে কোচিং করার জন্য। তুই যে পরীক্ষা খারাপ দিয়েছিস তা তো আন্টি জানেনা! জানলে কি হবে ভেবেছিস? একটা মেয়ের জন্য নিজের সব বরবাদ করার মানে কি?

–একটা মেয়ে একটা মেয়ে করিস না ওর নাম তিতলি। আচ্ছা তোর সব কথা মানলাম এখন তুই বল কোনো একটা মানুষ তার অসুস্থতার মিথ্যা গল্প আমাকে শোনাবে কেন? যদি এমন হতো সে এই গল্প বলে টাকা চাইছে মানতাম সে ভন্ড। কিন্তু সে তো এমন কোনো ডিমান্ড করেনি। আর তুই বলছিস ওকে পার্সোনালি না চিনে এসব করছি। শোন কথায় মানুষের ভেতরটা পড়া যায়। না চিনলেও খুব চেনা মনে হয়। তুই ওসব বুঝবিনা কখনো। প্রেমে পড়লে বুঝতি এ কেমন যন্ত্রণা!

–এমন জীবন নষ্ট করা প্রেম আমার চাই ও না। তুই থাক এটা নিয়ে।

— একটা কথা বলি রাগ করিস না। সেদিন বডিগার্ড মুভিটা দেখলাম বুঝলি! মাঝেমাঝে আমার ভয় লাগে। মনে হয় তিতলি নামের মেয়েটা তুই না তো!!

— এমন মনে হবার কারণ কি?

–জানিনা। এটা শুধুই ভাবনা বুঝলি সলিড কোনো প্রমাণ নাই।

–আর যাই ভাবিস এটা ভাবিস না। আমার এতো সময় নাই তিতলি সেজে তোর সাথে প্রেমের আলাপ করবো।

–শোন একদিন সকালে তিতলিকে কল করেছিলাম, ও যখন ঘুম ঘুম গলায় কথা বললো আমার মনে হলো তুই কথা বলছিস! শুধু এটাই না মাঝেমধ্যে সে এমন কিছু তথ্যবহুল কথা বলে যা আসলে তুই ছাড়া কেউ জানার কথা না!

আনহার তখন মনে পড়লো শুধু একদিন প্রায় দিনই তাকে বাধ্য হয়ে তিতলি সেজে কথা বলতে হয়েছিল। ভোরে নিশিথা কল রিসিভ করে ওর কানে তুলে দিয়ে জগিং এ চলে যেত এমন ঘটনা কম নয়।আনহা নিজেকে সামলে বললো, তোর পাশে বসে থাকা অবস্থায়ও তো কতবার কথা বলেছিস ওর সাথে। আমি যদি তিতলি হতাম তাহলে কল দিতো কে?

–বলেছিই তো হিসেব মিলেনা। যাই হোক রাগ করিস না। আনহা আমি ঠিক করেছি তিতলি ফিরলে মিট করবো যেভাবেই হোক। ওর হাতে যদি একদিনও সময় থাকে আমি ঐ একদিনটা ওর পাশে থাকতে চাই। কি বলছি বুঝছোস?

আনহা টের পায় হাসিবের গলা কাঁপছে। সে নিশ্চয়ই আবার কাঁদছে!

২০১২ সাল,,,,

হ্যালো ডাক্তার আপা। ভালো আছেন?

আনহা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিশিথা দাঁড়িয়ে আছে। গায়ের রং তামাটে হয়ে গেছে, চোখমুখ কেমন শুকিয়ে গেছে যেন। এতো ক্লান্ত অথচ ঠোঁটে সেই চিরচেনা হাসি! আনহা বোনকে জাপটে জড়িয়ে ধরে বললো, আপু তুই এসেছিস। কত্ত মিস করেছি তোকে জানিস?

নিশিথা হেসে বললো, ওরে ছাড় এতো জোরে ধরেছিস আমিতো দম ফেলতে পারছি না।

আনহা চোখের পানি মুছে বললো, আরো শক্ত করে ধরবো তোকে। কিভাবে পারলি এতোদিন কল না করে থাকতে! আমি রোজ তোর কলের অপেক্ষা করেছি জানিস রেজাল্ট যেদিন এলো আমার এতো আনন্দের দিন ছিল অথচ তুই পাশে ছিলি না। তোর সাথে আমার কত গল্প করা বাকি!

এসেছি তো এখন সব বলবি। জানিস তো ট্রেনিং এ কত প্রেশার থাকে। এখন আমি প্রস্তুত বুঝলি! আব্বুর স্বপ্ন পূরণ করতে পেরে অনেক শান্তি লাগছে। মনে আছে ছোটবেলায় আব্বু আমাদের খাবার মুখে তুলে কি বলতো? বলতো নিশিথা হবে পুলিশ অফিসার, আর আনহা হবে ডাক্তার। আমার দুই কন্যা হবে দেশের রত্ন।

হুম। মনে আছে বলেই তো ছোট থেকেই দুজন এই মিশনে নেমেছি!

আচ্ছা আনু হাসিবের কি অবস্থা? ও নিশ্চয়ই তিতলিকে ভুলে অন্য রিলেশনে গেছে?

আনহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, তুই কি যাদু করেছিস জানি না। ও এখন তিতলি ছাড়া কিচ্ছু বোঝেনা।

নিশিথা হাসতে হাসতে শাওয়ার নিতে ঢুকলো।
হঠাৎ দরজা খুলে বললো, তিতলি মারা গেছে শুনলে কি হার্ট ফেইল করার পসিবিলিটি আছে?

আনহা আৎকে বললো, নির্ঘাত মারা যাবে আপু! এটা বলিস না।

নিশিথা ভাবতে লাগলো কি বলা যায়!!
________________

একটা কথা বলি রাখবেন?

কি কথা?

ধরুন আমি যদি আর না থাকি, এই পৃথিবীর কোথাও আমার অস্তিত্ব না থাকে। আপনি ভেঙে পড়বেন না। সবকিছু পারফেক্টলি চালাবেন। ক্যারিয়ারে ফোকাস দিবেন। একটা সুন্দর জীবন অতিবাহিত করবেন। আমার স্মৃতি আপনার জীবনে যেন অভিশাপ না হয় সেই অনুযায়ী সবটা করবেন। পারবেন না?

হাসিব স্তব্ধ হয়ে রইলো। তিতলি ফের বলতে লাগলো, আমরা সবাই এসেছি ফিরে যাওয়ার টিকিট সঙ্গে করে। কেউ আগে কেউ পরে। মৃত্যু খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এই পৃথিবীতে কেউ কারো জন্য থেমে থাকেনা। আমি চাই আপনিও থেমে থাকবেন না। সবটা সুন্দর হবে। কোনো এক বিকেলে কফিতে চুমুক দিতে দিতে যখন আমার কথা মনে পড়বে সেদিন যেন কষ্টের বদলে সুখটাই অনুভব হয়। আপনি কি বুঝতে পারছেন কি বলছি?
হাসিব এবার কেঁদে ফেলল। নিজেকে সামলানোর বৃথা চেষ্টা করে বলল, তিতলি আপনার হাতে বেশিদিন সময় নেই তাই না? আপনি চলে যাচ্ছেন তাহলে সত্যিই?! একটা রিকোয়েস্ট করলে রাখবেন? আপনি একটি বার দেখা করবেন প্লিজ? আমি কথা দিচ্ছি আমি একদম ঠিক থাকবো। শুধু একটাবার দেখা করুন। আমি চাইনা আপনার দেখার তৃষ্ণা বুকে নিয়ে আজীবন থাকতে। প্লিজ এই অনুরোধ রাখুন।

তিতলি তখনই হ্যাঁ না কিছু বললো না। এমন করুণ করে কেউ বললে তাকে না বলা যায়? কিন্তু হ্যাঁ বলারো যে পথ নেই!

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here