#প্রজাপতি মন (পর্ব-8)
♡আরশিয়া জান্নাত
আনহার মন আজকে অনেক খারাপ। একটু আগেই খবর পেয়েছে আজ তাদের বাসায় কিছু মেহমান আসবে। আনহাকে থাকতে হবে বলায় তার বুঝতে বাকি রইলোনা কেন হঠাৎ মেহমান আসছে। বাবা-মায়ের অবিশ্বাস্য পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ভুগছে মেয়েটা। বাইরে বাসায় কোথাও কেউ কটু কথা শোনাতে ছাড়েনা। তার ইচ্ছে করে নিশিথাকে বলতে, যাওয়ার আগে আমায় মেরে গেলি না কেন। তোর পেছনে যে আমার কি দশা হবে এ কি তুই জানতি না?
কিন্তু ঘেন্নায় কল করেনা তাকে। নিশিথার এমন কিছুই হবে এ শঙ্কা তার ছিলই। কথা বলতে বলতে মানুষের প্রতি মায়া জন্মানোর বহু গল্পই তো সে শুনেছে। কিন্তু সে বুঝেনি সত্যিই নিশিথা নিজেও এমন দূর্বল হবে চলে যাবে। সে তো বরাবরই বোনকে ডোন্ট কেয়ার কেউ ভেবেছে। কাইয়্যুমের মতো মানুষটাও তার মনে জায়গা করতে পারেনি।
ইমরান নামক ছেলেটা কতখানি ভালোবাসা দিয়ে এই মেয়েকে ঘায়েল করেছে সে জানেনা, তবে নিশিথা যতজনের সাথে কথা বলতো তারা সবাই যে মোটামুটি তার জন্য উইক ছিল এ তো হাসিবকে দেখেই গভীর ভাবে টের পেয়েছিল। এই দমবন্ধকর দিনগুলো আরো বেশি যন্ত্রণা দেয় হাসিবের অভাবে। যে ছেলেটার সাথে কথা না বলে একটা দিন কাটেনি সে আজ বহুদিন কথা বলেনা। আনহা কতবার চেষ্টা করেছিল কথা বলতে, কিন্তু হাসিব ভুলেও ফিরে তাকায় নি। ওদের বন্ধুরা পর্যন্ত ট্রায় করেছিল কিন্তু হাসিব সাফ সাফ বলেছে কেউ যদি ইন্টারফেয়ার করে ও কারো সাথেই কানেক্ট থাকবেনা। হাসিব ভালোর ভালো খারাপের খারাপ। ওর রাগ সম্পর্কে সবাই কমবেশি জানলেও আনহা কখনোই টের পায়নি। আনহার সামনে হাসিব সর্বদাই হাসিখুশি স্বাভাবিক থাকতো। এতো প্রায়োরটি দেওয়া ছেলেটার উপেক্ষা সহ্য করা তার জন্য মরণসম।
দুপুরে আনহার ছোট খালা নিপা আসে। তিনিই একমাত্র মানুষ যে নিশিথার জন্য আনহাকে একটা কথাও শোনায় নি। ছোট খালা এসেই খুব জোরে জোরে আনহাকে বললো, পড়াশোনার চাপ কি বেশি নাকি ফ্যামিলির চাপে এমন কাঠ হয়েছিস? যে গেছে তাকে তো কিছু করার মুরোদ নাই যেটা আছে সেটাকে মেরে ফেলতে উঠেপড়ে লেগেছে সবাই! যেন এ থেকে গিয়ে ভুল করেছে।
পাশের রুমেই সবাই যেন শুনতে পায় এমন করেই বলতে লাগলো।
নবীজি সাঃ বলেছেন, বিধবা আর কুমারী মেয়েকে তার অনুমতি ব্যতিত বিয়ে দেওয়া যাবেনা। এখন বড় মেয়ে বদনামী করাইছে বলে ছোটমেয়ের অধিকার ক্ষুন্ন করা যেন না হয়। কারো পালতে সমস্যা হলে যেন বলে দেয়, আমিতো আগেই বলেছিলাম আনহাকে যেন আমাকে দিয়ে দিতে। প্রয়োজনে এখন নিয়ে যাবো আমার মেয়েকে।
আনহা হেসে বললো, খালামণি তুমি রাগ করোনা। বাবা নিশ্চয়ই আমার ভালোটাই বুঝবেন। উনার সিদ্ধান্তের উপর আমার ভরসা আছে।
শোন আনু, আমি বলছিনা দুলাভাই খারাপ কারো কাছে তোকে বিয়ে দিবে। কিন্তু তাড়াহুড়োর ফল ভালো হয় না। আর তিনি কিজন্য এই তাড়াহুড়ো করছেন তা জানি বলেই রাগটা বেশি হচ্ছে। তোকে আজ দেখে আমার কেমন লাগছে তুই বুঝবিনা। মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি বলতেই পারিস কিন্তু আমি তোকে কখনোই বোনের মেয়ে ভাবিনি তুই আমার সোনা মেয়ে। তুই চিন্তা করিস না আমি যদি দেখি ছেলে সুবিধার না আমি বেঁচে থাকতে এই বিয়ে ক্যাশিয়ার সাহেব কোনোভাবেই দিতে পারবেন না।
তারপর ব্যাগ থেকে আনহার জন্য আনা নানা পদের আচার,মোয়া, আর ট্যাপা সন্দেশ বের করলেন। আনহাও যেন বহুদিন পর শান্তি অনুভব করলো।
????
নিশিথার মতো মেয়েকে পুত্রবধু হিসেবে পেয়ে ইমরানের বাবা-মার আহ্লাদের শেষ নেই। তারা নিশিথাকে নিজের মেয়ের মতোই যত্ন করেন। ইমরান তো নিশিথাকে পেয়ে দেশ জয় করার মতো অনুভব করে। ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়া যে কতোটা আনন্দের এ আসলে বোঝানোর মতো নয়। ইমরানের ঘাড়ে এখন অনেক দায়িত্বের বোঝা থাকলেও আপাতথ সে নিশিথার সান্নিধ্যেই সুখে আছে। কিন্তু নিশিথার এখানে এডজাস্ট করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। ইমরানের বাবা সরকারী কর্মকর্তা, সেই সূত্রে কোয়ার্টারে দুই রুমের একটা বাসায় থাকে। এই দুই রুমের ছোট্ট বাসায় দেবর ননদ সহ সবাই থাকে। ইমরান নিশিথাকে আনার পর পাশের বাসায় একটা রুমের ব্যবস্থা করে তার বাবা। কিছুদিন পর ইমরান তাকে নিয়ে ঢাকায় চলে যাবে এমনটাই প্ল্যান করা ছিল। কিন্তু আপাতত এভাবে থাকাটাও কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। আসবার আগে ট্রান্সফারের জন্য গোপনে এপ্লাই করেছিল। এখন অপেক্ষা করা ছাড়া কিছুই করার নেই।
সন্ধ্যায় অনেক মানুষ আসবে এমনটা ভাবলেও আসলো মাত্র চারজন মানুষ। আনহাকে যখন সাজিয়ে গুছিয়ে তাদের সামনে নেওয়া হলো চিরচেনা গলার স্বর শুনে আনহা মাথা তুলে দেখে তার সামনে তার অতিপ্রিয় হাসনা আন্টি বসা!
আনহা সবাইকে সালাম দিলো।
হাসনা বললেন, আয় আমার পাশে বস। আমি এই প্রথম তোকে সরাসরি শাড়িতে দেখলাম। অবশ্য আগে ছবিতে দেখেছি। দেখেন ভাইসাহেব আনহাকে নতুন করে দেখার তো কিছু নাই, ওকে ছোট থেকেই দেখে আসছি। তুই ভালো আছিস তো মা?
আমার বহুদিনের ইচ্ছে ছিল ওকে আমাদের পরিবারে নিবো। এ বিষয়ে আপনাকে তো আগেই বলে রেখেছিলাম। তবে ঘটনাটা যে এতো তাড়াতাড়ি ঘটবে এ আমরা কেউই ভাবিনি।
আপা আল্লাহপাকের মর্জিমাফিক সব হয়। আমার নিজেরো এতো তাড়াতাড়ি কিছু করার ইচ্ছে ছিল না আপনারা তো সব জানেনই। বিয়ে যখন দিতেই হবে ফরজ কাজ আদায়ে দেরী করতে চাচ্ছিনা। ওদের বিয়ের কাবিন টা করে রাখি, আনহা এখানে থেকেই পড়াশোনা শেষ করুক। ততোদিনে ছেলেও লাইন হোক। বলতে পারেন এটা আমি নিজের শান্তির জন্য করতে চাইছি। আমি চাইনা আমার বড় মেয়ের জন্য ছোটটাকে নিয়ে কেউ কটু মন্তব্য করুক। ওর বিয়েটা হলে যদি সবাই রেহাই দেয় আর কি!
আরিফ সাহেব সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, আহা ভাই ছাড়ো তো এসব কথা। ছেলেমেয়ের সামনে বারবার এসব বলতে হবেনা। আমার আনহা মায়ের মত নিয়েছে?তার কোনো আপত্তি নেই তো?
আনহা এতোক্ষণ কোন দুনিয়াতে ছিল সে নিজেও জানেনা। এখানে কারো কথাই যেন তার কানে যাচ্ছেনা। সে এখনো বুঝতে পারছেনা এখানে ছেলেটা কে! হাসনা আন্টি আর আরিফ আঙ্কেল হাসিবের বাবা মা হলেও পাশে আরো দুজন বসে আছে এনাদের ও চেনে না। তাই সে কনফিউজড হয়ে আছে কার সঙ্গে ওর বিয়ের কথা চলছে। সে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারছেনা।
ওর মনের ভাব যেন আরিফ সাহেব বুঝতে পারলেন। তিনি বললেন, দেখো কান্ড আমরা যেন পুতুল বিয়ে দিচ্ছি। হাসনা ও কই? আসেনাই যে এখনো? ইব্রাহিম ফোন কর ওকে।
একটু পরেই হাসিব আর আরাফ রুমে প্রবেশ করলো। হাসিব সালাম দিয়ে বললো, কেমন আছেন আঙ্কেল?
নাফিজ সাহেব হেসে বললেন, আলহামদুলিল্লাহ তুমি কেমন আছ বাবা? এতোক্ষণ কোথায় ছিলে?
হাসিব, রাস্তায় পরিচিত একজনের সাথে দেখা হয়েছিল কথা বলতে বলতে লেট হয়ে গেছে। স্যরি।
আনিসা– ওহ সমস্যা নেই বসো তোমরা শরবত নাও। আপা আপনারা এখনো কিছু মুখে তুলছেন না!
আনহা মাথা নীচু করে বসে রইলো। হাসিবের পাশের ছেলেটাই কি তবে ওর হবু বর? কষ্টে তার চোখ ফেটে আসছে যেন। শেষে কি না হাসিবের ভাবী হয়ে থাকবে সে? এই দিন দেখার ছিল? কিন্তু এখানে না বলার কি কোনো পথ আর থাকবে!!
ওদিকে হাসিব একদৃষ্টিতে আনহার দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে বললো, আমাকে না বলে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিয়ে করতে যাচ্ছে। কেমন মেয়ে ফোন করে বলেনাই পর্যন্ত বাসায় বিয়ের কথাবার্তা চলছে! এই তাদের বন্ধুত্ব? এই সবকিছুর শোধ তুলবো আনু মনে রাখিস। একবার বিয়েটা হতে দে।
চলবে,,,