প্রজাপতি মন (পর্ব:6)

0
1830

#প্রজাপতি মন (পর্ব:6)
♡আরশিয়া জান্নাত

নিশিথা অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলো ওর এক কাজিনকে তিতলি বানিয়ে হাসিবের সাথে দেখা করাবে। যেহেতু ওর কাজিন গ্রামে থাকে তাই সহজে ওর পরিচয় পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। যেই ভাবা সেই কাজ; আনহাকে কিছু না বলে তামান্নাকে তিতলি সাজিয়ে হাসিবের সঙ্গে মিট করালো। সে দূর থেকে বসে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিল।
দেখা করানোর পর যখন আনহা কে বললো, আনহা তখন সহ্যের চরম পর্যায়ে, রেগে বোনকে বললো, তোর সবকিছু আমি চুপচাপ সহ্য করেছি। তোর কি মনে হয় না তুই হাসিবের বেলা অন্য সবার চেয়ে বেশি আলাদা ট্রিট করেছিস? আর যদি আমার ধারণা ভুল হয় তাহলে তো এ দাঁড়ায় প্রতিটা ছেলে তোর জন্য জীবন দেয় টাইপ মরিয়া হয়ে আছে! আপু এই পৃথিবীতে টাইম পাস করার অনেক ওয়ে আছে, মানুষের মন নিয়ে খেলা করার মানে হয় না। তুই যা করছিস এর পরিণাম ভালো হবেনা। হাসিব তোকে চিনেনা, দেখেনি তারপরো ও তিতলির জন্য পাগল হয়ে আছে, এখন যখন মিট করেছে মেয়েটা যেমনি হোক ও তার কল্পনাতেই আরো বেশি মরবে। প্লিজ এই গেইম এখানেই শেষ কর। আমি আর পারছিনা এই অপরাধবোধ বয়ে বেড়াতে।
নিশিথা বিরক্ত গলায় বললো, তুই চুপ কর তো। বেশি বুঝোস আমার থেকে? এখন তিতলির মৃত্যু ঘটবে। তামান্নাকে দিয়ে বলাবো কয়দিন পর তিতলি মারা গেছে। ব্যস ঘটনা এখানেই শেষ এতো প্রেশার নেওয়ার কিছু নাই।

সবকিছু এতো সহজ? তিতলি মরবেই যখন দেখা না করে মরতে পারে নাই? নাকি ওর গিফটের লোভে তুই এমন,,,

কথাটা শেষ হবার আগেই নিশিথা আনহার গালে ঠাটিয়ে চড় দিলো। আনহা চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেল। এই মূহুর্তে নিশিথাকে তার পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য মেয়ে মনে হচ্ছে। তার ইচ্ছে করছে হাসিবকে গিয়ে সবটা বলে দেওয়ার। কিন্তু এতে যদি ওদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়? নিজের উপর প্রচন্ড রাগ নিয়ে জোড়াদিঘীর পাড়ে গিয়ে বসলো আনহা।
কাকতালীয়ভাবে সেখানে কাইয়্যুমও ছিল। অনেকদিন পর কাইয়্যুমের সাথে দেখা হওয়ায় অবাক হয়ে গেল সে। চেহারা কেমন বদলে গেছে ছেলেটার।

আস্সালামু আলাইকুম ভাইয়া। কেমন আছেন?

আরেহ আনহা যে! ওয়ালাইকুমুস্সালাম ভালো আছি তোমার কি অবস্থা?

এই তো ভালোই। আপনিতো ভুলেই গেছেন আমাদের। কতদিন বাসায় যান না। মা কত করে বলেছিল বাসায় আসতে এলেন না!

আসলে ব্যস্ততা অনেক। তবে আমি অনেক খুশি হয়েছি তোমার এডমিশনের খবর পেয়ে। আন্টি আমার বাসায় দুইবার মিষ্টি পাঠিয়েছে। স্বল্প দিনের টিচার হলেও তোমার সফলতা আমার জন্য অনেক বড় ব্যাপার।

ভাইয়া আপনি কি কোনো কারণে টেনশনে আছেন? আপনাকে দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি। এতো চেইঞ্জ হয়েছেন আল্লাহ!

কাইয়্যুম হেসে বললো, নিশিথা ফিরেছে না? জয়েন করবে কবে?

এইতো কয়দিন পর, দেখা হয় নি আপুর সাথে? ও তো ক্যাম্পাসে গেছিল!

আমি যাই নি। বলা হয় নি আমি কানাডা চলে যাচ্ছি।

গ্র্যাজুয়েট শেষ করবেন না? ও ওখানে বাকিটা করবেন?

হ্যাঁ। তুমিতো জানোই আমার ফ্যামিলির বেশিরভাগ সদস্য ওখানে আছে। আমিই এতোদিন মাকে নিয়ে রয়ে গেছিলাম। এখন এখানে আর মন টিকছেনা তাই ঠিক করেছি চলে যাবো।

আর কখনো ফিরবেন না?

বোকা মেয়ে! ফিরবোনা কেন? ফিরবোই তো তবে কবে ফিরবো জানিনা। আনহা একটা কথা বলি,,

বলেন ভাইয়া?

নিশিথার বিয়ে হলে খবর জানিও, আমার খুব শখ ওকে বৌ সাজে দেখার!

আনহার বুঝতে বাকি রইলো না কাইয়্যুম কেন চলে যাচ্ছে।

কয়েকদিন পর,

হাসিবের মা হন্তদন্ত হয়ে আনহাদের বাসায় এসে আনহাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতভম্ব। একটা পর্যায়ে তিনি থেমন ভাঙা গলায় বললেন, মা রে আমার ছেলেটারে তুই বাঁচা। ও যা শুরু করেছে আর বোধহয় বাঁচবেনা। তুই তো ওর বেস্টফ্রেন্ড তুই ই পারিস ওকে সামলাতে। তোর পায়ে পড়ি মা তুই আমার ছেলেকে বাঁচা।

কি হয়েছে আন্টি বলবেন তো? কি করছে হাসিব?

কি করেনাই তা বল। সারাদিন কান্না করে, খাওয়া দাওয়া ছেড়ে রুমে শুয়ে থাকে। কিছু বললেই হাউমাউ করে কাঁদে। আমি মা হয়ে কিভাবে এসব সহ্য করি বল? ওরে কতবার জিজ্ঞাসা করছি বাপ তোর পছন্দের কেউ আছে? তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? আমারে বল আমি গিয়ে ওরে নিয়ে আসমু তবুও তুই এমন কইরা কান্দিস না। কিন্তু আমার পোলা কিচ্ছু কয় না।

আনহা নিশিথার দিকে চেয়ে রইলো। তারপর বললো, আন্টি আপনি শান্ত হোন কিচ্ছু হবেনা। আমি হাসিবের সাথে কথা বলবো। চলেন আপনি আমি যাবো আপনার সঙ্গে।
_______________

২০১৪,,,

সময় অনেক ভালো প্রতিষেধক বলা চলে। প্রবাহমান সময় ধীরে ধীরে সব ক্ষত সারিয়ে তোলে। তিতলির মৃত্যুর পর হাসিবের পৃথিবীটা যেন থমকে গিয়েছিল সহস্রকালের জন্য। সেই সময়টাতে আনহা যেভাবে বন্ধুত্বের দায়িত্ব পালন করেছে তা আসলেই প্রশংসার দাবিদার।
হাসিব দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে ভালো রেজাল্ট করে। পড়াশোনায় সম্পূর্ণভাবে ডুবে যায় তিতলিকে ভুলে থাকতে। তিতলির শেষ কথা রাখতে জীবনটাকে সে সুন্দর করে গুছিয়ে তুলছে। এই জীবনে তিতলির স্মৃতি যেন চোখের জলের কারণ না হয় সেজন্য তার প্রচেষ্টার খামতি নেই।
পড়াশোনার পাশাপাশি সে টুকটাক বিজনেস করাও শুরু করেছে। আজেবাজে কোনো নেশাতেই তার মন নেই। প্রতি ওয়াক্ত নামায শেষে তিতলির জন্য প্রাণভরে দোআ করে, আল্লাহ যেন তাকে জান্নাত নসীব করেন এই দোআতে তার চোখ ভিজে যায়।

কথায় বলে সত্য তীব্রতা সূর্যের আলোর মতো, একে যতো চাপিয়ে রাখা হোক না কেন এর দ্যুতি ঠিকই ছড়িয়ে পড়ে। সত্য কখনো লুকিয়ে রাখা যায় না।
একদিন ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরবার পথে দেখে রিকশায় করে তিতলি আর নিশিথা যাচ্ছে! তিতলিকে দেখে সে যতোটা না অবাক হয়েছে তার চেয়ে বেশি অবাক হয়েছে আনহার বোনকে পাশে দেখে। তিতলির সঙ্গে নিশিথা কি করে !!

হাসিব পাগলের মতো তাদের রিকশার পেছনে ছুটতে লাগলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর নাগালে পেল না। সবকিছুই তার কাছে কেমন ধোঁয়াশা হয়ে গেল। যে মেয়েটা মারা গেছে ভেবে জীবনটা এমন রঙহীন হয়ে গেছে, সেই মেয়ে দিব্যি হেসে হেসে রিকশায় ঘুরে বেড়াচ্ছে? এটা কি করে সম্ভব? তাও আবার আনহার বোনের সাথে? তার কি কোথাও ভুল হচ্ছে?
এমনি নানা প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে আনহাকে ফোন করলো হাসিব।
কিন্তু আনহা রিসিভ করলো না। পরে সময়ের দিকে তাকিয়ে বুঝলো আনহা এখন ক্লাসে। অস্থিরতায় সে পাগলপ্রায় হয়ে তিতলির নাম্বারে ডায়াল করলো বহু দিন পর। কিন্তু সুইচড অফ দেখালো।
জীবনটা তার সঙ্গে এ কোন নাটক শুরু করলো কিছুই বুঝতে পারছেনা সে।



অসময়ে কলিংবেল বাজতেই তামান্না গিয়ে দরজা খুলে দিলো। রান্নাঘর থেকে আনিসা বেগম “কে এসেছে তামান্না” বলে দরজার কাছে আসতেই দেখলেন হাসিব দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে তামান্না হাসিবকে দেখে বাকশূন্য হয়ে গেল।

আরেহ হাসিব যে। এসো ভেতরে আসো। আমিও তো বলি এই টাইমে কে আসবে! তামান্না যা তো আনহাকে ডাক দে। এ কি এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন ভেতরে আসো? ও আমার বোনের মেয়ে তামান্না গ্রামের থেকে বেড়াতে এসেছে। কিরে যা আনুকে ডাক?

তামান্না একছুটে নিশিথার ঘরে গেল।

নিশি আপা অনেক বড় কেলেঙ্কারি ঘটে গেছে।

নিশিথা কিছুক্ষণ আগে ডিউটি থেকে এসে ঘুমিয়েছিল তামান্নার এমন ডাকে ধড়ফড়িয়ে উঠে বললো, কি হয়েছে? কোথায় পজিশন নিতে হবে?

আপা হাসিব ভাইয়া আমাকে দেখে ফেলেছে। উনি বাসায় আসছেন আমি দরজা খুলেছি! এখন কি হবে আপা? মরা মানুষরে জীবিত দেইখা উনি হার্টফেল করলো না এটাই বড় ব্যাপার। আপা কিছু করেন নাহয় সর্বনাশ হইয়া যাইবো।

নিশিথা তখনো ঘুমের ঘোরে বলে যাচ্ছে Yes Sir I’m on position.

চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here