প্রণয়ের_তৃষ্ণা (২৩)

0
394

#প্রণয়ের_তৃষ্ণা (২৩)
অলিন্দ্রিয়া রুহি
_____________
হঠাৎ করেই বাতাসের দেখা মিলেছে। শাঁ শাঁ গতিতে বাতাস বয়ে চলেছে। ঝড়ের আশংকা। পারুল হাঁক ছেড়ে স্বগতোক্তি করলেন,

‘বজ্জাত ছেড়ায় গেছে কই কে জানে! ও পুতুল, মা দরজা জানলা গুলি লাগাইয়া দে। সব ভাইঙ্গা চুইরা আইতেছে।’

পুতুল ততক্ষণে ঘরের দরজা আঁটকে দিয়েছে। এবার উঠে গিয়ে জানালা গুলো আঁটকে দিলো। দক্ষিণের কোণের জানালাটা আঁটকে দিতে গিয়ে ওর চোখ পড়ল সামনে, কাঁটাবহরীর বড় ঝোপটার দিকে। ওটা টপকে গেলে শাপলাদের বাড়ি চোখে পড়ে। মেয়েটা কী তীব্র রাগটা নিয়ে বাড়ি ছাড়ল! শাপলার বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস ছিঁটকে বেরোয়। জানালা আঁটকে পেছন ফিরতেই দেখে পারুল এসে দাঁড়িয়েছেন। তার এক হাতে আরেকটা কুঁপি, অন্য হাতে পিঠার প্লেট।

‘রাইতের রান্না শ্যাষ। পিঠাও বানানো হইছে। এহন আহুক ঝড় বৃষ্টি। চিন্তা নাই।’

বলতে বলতে তিনি কুঁপিটি ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলেন। পরক্ষণেই চিন্তিত স্বরে বললেন,

‘প্রিন্স কই? দেখছোস ওরে?’

পুতুল এপাশ ওপাশ মাথা নাড়লো।

‘নাহ।’

‘এই ছেড়াডা ঘরে না আইয়া কই ঘাপটি মারছে কে জানে! মা-রুক। বৃষ্টিতে ভিজ্জা গায়ে জ্বর বান্ধাইলে তহন বুজামু ওরে।’

বলতে বলতে দাঁত দিয়ে দাঁত কা-টলেন পারুল। তার হুট করে খেয়াল হলো শাপলা এ ঘরে নেই। ওদিকেও কোথাও শাপলাকে দেখেনি সে। তাহলে কোথায় গেল এই মেয়ে? পারুল পুতুলের চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করেন,

‘কীরে, শাপলা কই? তোর লগেই না আছিলো?’

পুতুল ফাঁকা ঢোক গিলে। চোখে ভীড় জমানো অশ্রু ফোঁটা গুলি লুকোতে মায়ের থেকে দৃষ্টি সরায়। হালকা গলায় বলে উঠে,

‘বাড়ি গেছে গা। কী বলে কাম আছে। জরুরি।’

সাফ মিথ্যে কথা, পারুল স্পষ্ট টের পেলেন কোথাও একটা গড়বড় আছে। নইলে পুতুলকে পেয়েও এভাবে বাড়ি চলে যাবে শাপলা! তবে তিনি মেয়েকে আর কিচ্ছুটি জিজ্ঞেস করলেন না। প্রত্যুত্তর না করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

__________

ঝড় ওঠেনি। তবে শুরু হওয়া গুড়িগুড়ি বৃষ্টি এখন বড় বড় ফোঁটায় পরিণত হয়েছে। প্রিন্স গুণগুণ করছে কানের কাছে মশার মতো। পুতুল বড় বিরক্তি নিয়ে তাকাল। পারুল খেঁকিয়ে উঠে বললেন,

‘বাইর হ, বাইর হ ঘর থেইকা। চোরের বাচ্চা চোর। এই তুই কী আকাম করলি?’

কথার মাঝখানে পুতুল বলে উঠল,

‘আম্মা, আব্বা কী চোর?’

পারুল থতমত খেলেন। তিনি কথার কথা বলেছেন। তবে নিজের ভুল স্বীকার না করে মেয়ের কাছে আরও একবার বিচারের ভঙ্গি করে বলতে লাগলেন,

‘কত জ্বালায় যে আছি আমি! দুইদিন পর পর এইডা ওইডা রাস্তা দিয়া টোকাইয়া নিয়া আহে। তোর বিয়ার পরদিন একটা স্বর্ণের চেইন নিয়া আইছিলো। কইছে রাস্তায় পাইছে। আমিও তাই ভাবছি। বিকাল হইতেই মনুর বাপ আইসা সে কী হাউ কাউ। কয় হের মাইয়ার গলার থন খেলার ছুতা দিয়া লইয়া আইয়া পড়ছে পলাইয়া। ভাগ্যিস চেইনটা ঠিকঠাক আছিলো। নাইলে কী হইতো একবার ভাব! আজকে আবার এই কানের দুলজোড়া নিয়া আইছে। এইডা কার কে জানে!’

একটু থেমে অদূরে দাঁড়ানো প্রিন্সের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘এই রাইতের বেলা যদি এডি লইয়া কোনো কাইজ্জা হয় তাইলে তোরে পুইতা থুমু জা-নোয়ারের বাচ্চা! তুই আমারে চিনোস না?’

প্রিন্স খ্যাঁকখ্যাঁক করে কাঁদতে শুরু করল। পুতুল একটা রাম ধমক দিয়ে ওকে ও ঘরে পাঠিয়ে মায়ের হাত থেকে কানের দুল জোড়া ছিনিয়ে নিলো একপ্রকার। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক ওদিক ভালো করে দেখে বলল,

‘এইডা স্বর্ণের না। খামাখা চিন্তা নিও না আম্মা।’

‘স্বর্ণের না?’

মনে হলো, পারুল সামান্য মনঃক্ষুণ্ন হলেন। ছেলেকে বকলেও যদি সত্যিই স্বর্ণ হতো এবং কেউ এসে দাবী না করত তবে তিনি বিক্রি করার কথাও একবার মাথায় এনেছিলেন। এতবড় দুল জোড়া, বিক্রি করতে পারলে বেশ মোটা অংকের টাকা ঘরে আসতো! পুতুলের বাপকে শহরে নিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাতেও সমস্যা হতো না। ঘরের বাজারঘাট হতো। আরও যাবতীয় কিছু প্রয়োজনীয়তা মিটতো। সত্যি অভাবে মানুষের স্বভাব নষ্ট হয়ে যায়!

পুতুল যেন মায়ের মন বুঝতে পারল। সামান্য হাসল ও। বলল,

‘অভাব কপালে লেহা মা। কোনো কালির ক্ষমতা নাই এই লিখন মিটাইবো।’

পারুল চুপ করে রইলেন। পুতুলের হাত থেকে দুল জোড়া নিয়ে বললেন,

‘ফালাই দিমু?’

‘না। রাইখা দাও। দেহো কেউ আহে কীনা দাবী লইয়া।’

‘না আইলে?’

‘নিজে পইরো। দুইডা ছোডো পাথর উইঠা গেছে। এছাড়া তো ঠিকই আছে। তোমার ছেড়ারে ডাকো। জিগাই কই পাইছে।’

পুতুল ডাকার আগেই প্রিন্স ঘরের ভেতর উঁকি দিলো। ও বোধহয় বাইরেই দাঁড়িয়ে কান পেতে ছিল এ ঘরে কী কথাবার্তা হয় তা শোনার জন্য। পারুল কটমট করে ছেলের দিকে চেয়ে রইলেন। পুতুল নরম কণ্ঠে ডাকল,

‘এদিক আয়।’

মায়ের চোখজোড়া উপেক্ষা করে ভয়ে ভয়ে বোনের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই পুতুল ওর হাত টেনে ওকে নিজের কোলের ভেতর আসন করে দিলো। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে মমতার স্বর নিয়ে বলতে লাগল,

‘তুই বড় হইতাছোস না? এহনো এইরকম করলে চলে ক? বড় ভাই দুইডা তো ম’রছে। আব্বার শরীরের অবস্থা ভালো না। আমি আর আপায় থাকমু শ্বশুর বাড়ি। আমাগো ক্ষমতা নাই এই সংসারের হাল ধরার। সব দায়িত্ব কিন্তু তোর ঘাড়ের উপর। তোরে এহন থেইকাই বুঝদার হইতে হইবো। শক্ত হইতে হইবো। আর যেন কোনোদিন তোরে চুরি করতে না দেহি।’

প্রিন্স সহসা প্রতিবাদ করে উঠে,

‘চুরি করি নাই। রাস্তায় পাইয়া..’

পুতুল ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

‘এইডাও একপ্রকার চুরিই। রাস্তায় সোনা পইড়া থাক। তাও ধরবি না। বুঝলি?’

প্রিন্স চুপ থাকে। ঘাড় বাঁকিয়ে হ্যাঁ জানায়। পুতুল কোমল গলায় বলে,

‘আমাগো ক্ষমতা নাই ভালো পড়াশোনা করার। শিক্ষিত হওয়ার। তাই বইলা কী মানুষ হইবার পারুম না?’

প্রিন্স এই কথার গভীরতা বোঝে না। পারুল বোঝেন, হা করে তাকিয়ে থাকেন। ক’দিন আগেও আম পেড়ে খাওয়ার অপরাধে যে মেয়েকে তিনি বকেছেন আজ সেই মেয়েই কত জ্ঞানের জ্ঞানের কথা বলছে। হুট করে তার মেয়েটা যেন খুব বড় হয়ে গিয়েছে। সবকিছু বুঝতে শিখেছে। তার চাইতেও বেশি জ্ঞানের অধিকারীনী হয়ে উঠেছে।

__________

দুমড়ে মুচড়ে যাওয়ার বুকের র-ক্তাক্ত কামড় গুলো নীরবে হজম করে শাপলা। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে। আবার অবিশ্বাস ও করতে ইচ্ছে করে না। পুতুল তার ছোট্টবেলার বান্ধবী, প্রাণের সই। অপরদিকে শাহিন তার জীবনের প্রথম এবং একমাত্র ভালোবাসার মানুষ, প্রেমিক পুরুষ। ওরা দু’জনই শাপলার জীবনে গুরুত্বপূর্ণ। কারো জায়গা কেউ দখল করতে পারবে না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। শাহিন এবং পুতুল- দু’জন দু’জনের বিরুদ্ধে কথা বলছে। কে সঠিক আর কে বেঠিক- তা বোঝার ক্ষমতা শাপলার নেই। একবার ইচ্ছে করে পুতুলকে বিশ্বাস করতে। পরক্ষণেই ভাবে, শাহিনকে ছাড়া তার চলবে না। কিছুতেই না। তাতে যদি পুতুলের সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ করতে হয় সে করবে। তাও তার শাহিনকেই চাই। আবার মনটা কেঁদে উঠে। পুতুলকে ছাড়া কী সত্যিই থাকতে পারবে!

ভাবনার গতিপথ থামিয়ে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শাপলা। মনের গোপনে চলা ঝড়টাকে আঁটকে দেয় ক্ষণিক সময়ের জন্য। বাতাসে কুঁপি নিভে গেছে। পুরো ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার। বাবা-মা সবাই ঘুমিয়ে আছে অন্য রুমে। এই ঘরে সে একাই থাকে। ম্যাচের বক্সটা কোথায় রেখেছিল এই মুহূর্তে মনে করতে পারে না সে। তাই উঠে গিয়ে অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে লাগল। বিছানার সঙ্গে লাগোয়া জানালা দুটো। এই জানালায় বহুবার শাহিন এসে দাঁড়াতো রাতের আঁধারে। জানালার ওপাশে থাকতো সে। আর এপাশে শাপলা। চুপিচুপি কথা হতো ঘন্টার পর ঘন্টা। মাঝে মাঝে শাপলার হাতজোড়া টেনে নিয়ে দৃঢ় চুমুও খেতো ও। হুট করে সেসব ভেবে লজ্জায় কেঁপে উঠল শাপলা। নিজের কাছেই কেমন কুঁকড়ে গেল। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল এক পলকেই, দরকার পড়লে পুতুলের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে দিবে। তবুও শাহিনকে ছাড়তে পারবে না। শাহিন তার, শুধুই তার, অন্য কারো নয়। এছাড়াও আরও একটি সিদ্ধান্ত নিলো, শাহিনের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করবে পুতুলের বলা প্রতিটি কথা নিয়ে।

মনের ভেতর এসব ভাবছে তার ম্যাচ খোঁজার জন্য হাত হাতড়ে চলেছে। হঠাৎ জানালার নিচে বিছানার কাছটায় একটা কাগজের মতো কিছু হাতে এসে ঠেকলো। শাপলা ছোঁ মেরে তুলে নিলো। অন্ধকারে ভালো বোঝা যায় না। তবে একটা সাদা কাগজ, কিছু লিখা আছে। কেউ ফেলে গেছে জানালার অল্প ফাঁকা দিয়ে। কে এসেছিল, শাহিন? তবে ডাকলো না যে! নাকি যখন পুতুলদের বাড়ি ছিল তখন এসে ডেকে শাপলাকে না পাওয়ায় এটা ফেলে গেছে? হয়তো মন খারাপের কারণে এতক্ষণ খেয়ালই হয়নি তার। কাগজটা বাম হাতে রেখে আরেকটু খোঁজাখুঁজির পর বিছানার উপরেই এক প্রান্তে ম্যাচ পাওয়া গেল। দ্রুত কুঁপি জ্বালিয়ে আগুনের একদম কাছে নিয়ে কাগজের পাতা মেললো। শাপলা ঠিক ধরেছে, শাহিন এসেছিল। চিঠি রেখে গেছে তার জন্য। কাগজে লিখা,

‘কেমনে কমু জানি না। আব্বা তোমারে মানবো না। সম্পর্ক আছে শুইনাই আমার উপর হেব্বি চেতাচেতি করছে। দুইবার থাপ্পড় মা-রছে। আমারে আইজকা রাতের বাসে ঢাকা পাঠাইয়া দিতেছে। আমি তোমার লগে শেষবারের মতো দেখা করবার আইছিলাম। কিন্তু ভাগ্যে লেখা নাই মনে হয়। ভালো থাইকো। তোমার বাপ-মা যেইনে কয় বিয়া কইরা নিও। আমি কবে আমু জানি না। আর যদি আমারে ছাড়া অন্য কারো সাথী না হইবার পারো তাইলে ইলিয়াসরে দিয়া খবর পাঠাইয়ো। আমি তোমারে আমার কাছে ঢাকায় আনানোর ব্যবস্থা করুম। আইবা আমার হাত ধইরা? আমার উপর বিশ্বাস রাইখা? কোন পথ বাইছা নিবা? আমারে নাকি তোমার বাপ-মায়রে শাপলা?
তোমার উত্তরের অপেক্ষায় থাকুম।’

ব্যস, এইটুকুই। শাপলার হাত খসে কাগজটা পড়ল কুঁপির উপর। চোখের পলকে কাগজের মধ্যাংশ পুড়তে শুরু করল। শাপলা নেভানোর তাড়া দেখালো না। পুড়ুক, এরচেয়েও বেশি পুড়ছে তার মনখানা…..

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here