#প্রণয়ের_তৃষ্ণা (২৪)
অলিন্দ্রিয়া রুহি
_____________
মেঘলা আকাশ, ঝিরিঝিরি বাতাস, সঙ্গে এক মগ ধোঁগা উঠা কফি হাতে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটি পাশে দাঁড়িয়ে। অর্ক’র হঠাৎ করেই মনটা অসম্ভব রকমের ভালো হয়ে গেল। চট করে ঠোঁটের কোণে একটা নাই নাই হাসি ফুঁটে উঠল। একটুক্ষণের জন্য। অয়ন্তের নজর এড়ালো না। সে কফি মগ অর্ক’র দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল,
‘তুই কী মেয়েদের মতো মুড সুইং করতে শুরু করলি নাকি!’
অর্ক এবার উচ্চ শব্দে হেসে উঠল।
‘যাহ! আজেবাজে বকিস না।’
‘দেখ দেখ, কেমন হা হা করে হাসছিস। মেয়েরা সদ্য প্রেমে পড়লে এরকম কথায় কথায় হাসে। আনমনে হাসে। তুই কী জেন্ডার টেন্ডার বদলে ফেলার কথা ভাবছিস অর্ক?’
অয়ন্তের গলা ভীষণ সিরিয়াস, অর্ক’র রাগ তো হলোই না বরং ভীষণ ভীষণ মজা পেল। হাসির দমক কমাতে এক চুমুক কফি মুখে পুড়ে সঙ্গে সঙ্গে তা গিলে ফেলল। ভীষণ গরম, জিভে লেগে গেছে।
অর্ক বলল,
‘এত গরম!’
অয়ন্ত ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘তো কী তুই ঠান্ডা শরবত আশা করছিলি?’
‘আজকে সব কথার পিঠে এমন বাঁকা বাঁকা জবাব দিচ্ছিস কেন? সোজা করে কথা বলতে ভুলে গেছিস?’
‘তুই যদি পুরুত্ব বিসর্জন দিয়ে দিতে পারিস তাহলে আমার বাঁকা কথায় দোষ কোথায়!’
অর্ক’র এবার আর হাসি পেল না। সে কপট রাগ নিয়ে বলে উঠল,
‘ধুর! কী যা তা বলছিস?’
অয়ন্তও সমান ঝাঁঝের সঙ্গে জবাব দিলো,
‘যা তা না সত্যিইই! নইলে একটা মেয়ে তোকে বিয়ে করার জন্য সমানে মেন্টালি টর্চার করে যাচ্ছে। আর তুই কিছুই না করতে পেরে দৌড়ে আমার কাছে এসেছিস ফ্যাচফ্যাচ করতে। তোর চাইতে একটা মেয়ে মানুষেরও বুদ্ধি বরং ভালো। গ্রামের হাওয়া খেয়ে হাঁটুর তলায় বুদ্ধি নেমে গেল নাকি?’
অর্ক জবাব দিলো না। গ্রামের কথা মনে করিয়ে দেওয়ায় ওর হুট করে একটা মুখ মনে পড়ে গেছে। গোলগাল, ঘর্মাক্ত চেহারা, পাতলা ঠোঁট দুটি ওকে দেখলে কাঁপা-কাঁপি শুরু করে দিতো। আর ওর নাকটা- অসম্ভব রকমের লাল হয়ে থাকতো প্রায় প্রায়। তবে সবচেয়ে সুন্দর ভ্রু যুগল। জোড় বেঁধেছে। অন্যদের চেয়ে আলাদা। গাঢ় কালো। সচ্ছ চোখ দুটি সবসময় যেন কথা বলতেই থাকে। অর্ক হঠাৎ করে বুঝতে পারল, পুতুলের প্রায় সবকিছু ওর মুখস্থ হয়ে গেছে ইতোমধ্যেই। অথচ ও কখনো খুব মনোযোগ দিয়ে মেয়েটাকে তো দেখেনি। দেখার মতো কিছু নেইও তো! তবুও কেন মেয়েটার মুখের সমস্ত অলিগলি, মানচিত্র এত ঠোটস্থ! মৃদুমন্দ বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যায়। অথচ অর্ক ঘেমে উঠল। কফি মগটা ঠেলে রাখল পাশে। খেতে ইচ্ছে করছে না। কেমন অস্থির হয়ে উঠল ওর তনুমন। অয়ন্ত নীরবে কফির মগে চুমুক দিতে দিতে সবটা লক্ষ করল। তারপর ধীরস্বরে প্রশ্ন করল,
‘মেয়েটা কে?’
অর্ক যারপরনাই চমকে কেঁপে উঠল। পরক্ষণেই নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়ে বুকে আঁটকে থাকা নিঃশ্বাসটা বাতাসে মিলিয়ে দিলো।
অয়ন্ত আবার প্রশ্ন করল,
‘উত্তর দে।’
স্তিমিত গলায় অর্ক বলল,
‘তুই ইথিকে চিনিস না!’
‘আমি ইথির কথা জানতে চাইনি।’
‘তা..তাহলে?’
‘তোর বুক পকেটে এবার অন্য বসন্তের ঘ্রাণ আমি টের পাচ্ছি। এই বসন্ত কে ছড়িয়েছে? সেই মহারাণীর নাম কী? কোথায় থাকে?’
অর্ক বিব্রত নিয়েই হাসার চেষ্টা করল।
‘আবার আজেবাজে কথা তোর! ছাড় তো। আমাকে একটা বুদ্ধি দে। ইথিকে কীভাবে পিছু হটাবো সেই বুদ্ধি। ও তো রীতিমতো এক্ষুনি আমাকে বিয়ে করার জন্য জানপ্রাণ সব লাগিয়ে দিচ্ছে।’
অয়ন্ত নিজের কফি মগে এক চুমুক দিলো। দূর আকাশে চাঁদের আলো নেই। তবে আকাশ যে মেঘলা হয়ে আছে তা বুঝতে একটুও কষ্ট করতে হলো না। সেই অদূরে তাকিয়ে থেকে জবাবটা দিলো,
‘বিয়েটা সারাজীবনের ব্যাপার। যাকে মন চায় তাকেই বিয়ে করবি। জোর করে আর যাইহোক, বিয়ে, সংসার, এমনকি ভালোবাসাও হয় না।’
অর্ক বলল,
‘এই কথাটা আমি ইথিকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি। ও একটুও ধৈর্য্য রাখতে চায় না।’
‘তাহলে ওর সঙ্গে সবকিছু একেবারেই মিটমাট করে ফেল।’
অয়ন্ত তাকাল অর্ক’র দিকে। অর্ক কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল,
‘এত সহজ?’
‘এতই সহজ! ইথি যে তোর কাছে মায়া ব্যতীত অন্য কিচ্ছু না তা কী তুই এখনো বুঝতে পারছিস না অর্ক?’
অর্ক’র চোখজোড়ায় বিস্ময় উঁকি দেয়। নিজের মনকে সে এখনো চিনতে পারল না। অথচ তার পাশে বসা ছেলেটা তাকে ঠিক ঠিক চিনে ফেলেছে। এই জন্যেই বোধহয় এই ছেলেটা ওর জীবনের সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং কাছের বন্ধু!
অয়ন্ত ফের বলল,
‘যেটা হতে চলেছে সেটা হতে দে। যেটা করতে চাস না সেটা করিস না। নিজের উপর বিন্দু পরিমাণ জোর খাটাবি না। মনে রাখবি, আমরা মানুষ, কোনো তরল পদার্থ নই যে জোরজার করে একটা আকার দেওয়া যাবে! নিজেকে জোর করে কখনো ভালো রাখা যায় না। ভালো থাকাটা মানসিক তৃপ্তিতে খুঁজে নিতে হয়। আর তোর মানসিক তৃপ্তিটা কে অর্ক? নাম কী ওর? লুকোবি আমার থেকে?’
ধরা পড়ে যাওয়া চোরের মতো মুখটা কেমন অপরাধী হয়ে উঠে ছেলেটার। বুক পাজরের প্রত্যেকটা দন্ড যেন চিৎকার করে অনেক কথা বলতে চাইছে। কিন্তু কিছু একটা বারবার তার কথাগুলো আঁটকে দিচ্ছে। সে কিছুতেই মন এবং মস্তিষ্কের যুদ্ধের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। মানসিক অশান্তি হচ্ছে। অস্থির লাগছে। কোন পথ, কোন পথ বেছে নিতে চায় সে? যে পথ বেছে নিতে চায় সে পথ কী সত্যিই ভীষণ সহজ-সরল? মেয়েটি যে অন্য কারো মালিকানাধীন। কী করে ওকে নিজের মালিকানাভুক্ত করবে অর্ক? আর ওর বাবা-মা! তারাও কী মানবে গণ্ডগ্রামের একটি নিম্নমুখী মেয়েকে নিজেদের ছেলের পুত্রবধূ হিসেবে?
অনেকগুলো প্রশ্ন একসাথে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মনবাড়িতে। অর্ককে আবারও চুপ থাকতে দেখে তেতে উঠে অয়ন্ত। অর্ক’র পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
‘চললাম আমি। যখন বলবিই না তখন আমারও থাকার প্রয়োজন নেই।’
অর্ক মৃদু স্বরে ডাকল,
‘অয়ন্ত, প্লিজ বস।’
‘কেন, কেন বসব? জিজ্ঞেস করলেই একদম রোবট হয়ে যাস!’
‘একটু বস। বলছি।’
অয়ন্ত রাগ নিয়েই বসল। একেবারে অর্ক’র মুখোমুখি। অন্ধকারে এক বন্ধু আরেক বন্ধুর অবয়ব ব্যতীত চেহারাটা ভালো ভাবে দেখতে পাচ্ছে না। সেই অবয়ব দেখেই অয়ন্ত বুঝতে পারল, অর্ক’র মন পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। সে এমন একটা প্রশ্ন করে বসেছে যার ভার অর্ক বইতে পারছে না। আবার ফেলতেও পারছে না। নিজেই নিজেকে দগ্ধ করে তুলছে। অয়ন্ত অর্ক’র ঘাড়ের উপর একটা হাত রেখে নরম গলায় বলল,
‘খুলে বল দোস্ত। দেখবি মন হালকা হয়ে গেছে।’
অর্ক সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলতে লাগল,
‘ওর নাম পুতুল। বয়সে আমার চেয়ে অনেক অনেক ছোট। ইনফেক্ট এইটুকু মেয়েটা বিবাহিত। গ্রামে যার বাড়িতে উঠেছিলাম, তার স্ত্রী হয়ে এসেছে ২ দিন আগে। যদিও এই বিয়েটা পুতুলের মর্জির বাহিরে ছিল। ইথি এই মেয়েটাকে নিয়েই এত বেশি ইনসিকিউর হয়ে পড়েছে। কিন্তু আমি…আমি বারবার ওকে ছোট ছোট বলে ইগনোর করতে করতে কখন যে ওকে মনের ভেতরেই বসিয়ে ফেলেছি, আমি আসলে নিজেও বুঝতে পারছি না অয়ন্ত। আমি কী করব কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। পুতুল কে আমি কথা দিয়েছি, ওকে ওই জাহান্নাম থেকে মুক্ত করার জন্য আমি আবার গ্রামে ফিরবো। সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না, আমার কী সত্যিই ফেরা উচিত?’
অয়ন্ত চোখ বড় বড় করে বলল,
‘মেয়েটাকে তোর অনুভূতির কথা বলে দিয়েছিস?’
‘না! ও কিচ্ছু জানে না। আমি নিজেই তো ওকে নিয়ে কিচ্ছুটি শিউর ছিলাম না। ওকে ফেলে চলে আসার পর আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি, ওর অনুপস্থিতি আমাকে পোড়াচ্ছে। ওকে অনাগ্রহ করতে করতে কখন যে সবচেয়ে আগ্রহের জিনিসে পরিণত করে ফেলেছি তা আমি ওর থেকে দূরে এসে বুঝতে পারছি।’
অয়ন্ত হালকা গলায় বলল,
‘তুই ঢাকায় এসেছিস কবে?’
‘আজকেই।’
‘মাত্র কয়েক ঘণ্টায়ই সবকিছু বুঝে ফেলেছিস! আরে বাহ!’
এই সামান্য কথায় অর্ক লজ্জা পেয়ে গেল। অয়ন্ত কটাক্ষ করেই কথাটা বলেছে যে তা বুঝতে অসুবিধে হলো না ওর।
অর্ক বলল,
‘তুই আমাকে নেগেটিভ মার্কিং করছিস তাই না? গার্লফ্রেন্ড থাকা সত্ত্বেও অন্যদিকে ঝুঁকে যাচ্ছি, এটা তো নেগেটিভই।’
অয়ন্ত এপাশ ওপাশ মাথা দুলিয়ে বলল,
‘উঁহু, মোটেও নেগেটিভ মার্কিং করছি না। বরং এটাই স্বাভাবিক। তোর আর ইথির সম্পর্কের সব কথাই আমার জানা কিন্তু। তোদের পরিচয় হয়েছিল ফেসবুকে। ইথিই তোকে নানারকম ম্যাসেজ দিতো, তোর তরফ থেকে প্রথম প্রথম আগ্রহটা কম ছিল। তারপর দেশে ফিরলি। ইথির জোরাজুরিতে ওর পরিবারের সঙ্গে দেখা করলি। নিজের পরিবারে ওকে একটা স্থান দিলি। মোট কথা, একটা সম্পর্ক হয়েছে, এখন সেটাকে বয়ে বেড়াতেই হবে, এমন একটা মেন্টালিটি তোর ভেতর তৈরি হয়ে গেল ইথিকে নিয়ে। তাই তো ইথি বারবার ভুল করার পর, ছেলেমানুষি করার পরও তুই একবারও এই সম্পর্কটাকে ত্যাগ করতে চাসনি। তোর কাছে রিলেশন ব্রেক করা ব্যাপারটাই ভীষণ অপরাধের। অথচ যে সম্পর্কে সত্যিকারের মনের টান থাকে না, সে সম্পর্ক সরল রেখার মতো জীবনটাকে দিন দিন জটিলতর করে তোলে। তা কী তুই বুঝিস না অর্ক?’
অর্ক ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে বলে উঠে,
‘এখন আমাকে কী করতে বলিস তুই? কীভাবে আমার জীবনে শান্তি ফিরে আসবে এইটা বল।’
‘একটা অপরাধ করেছিস বটে! মেয়েটা বিবাহিতা জেনেও তার উপর ফিলিং চলে আসাটা মোটেও ভালো নয়। যাইহোক, এবার অপেক্ষা কর। প্রথম প্রথম সবকিছুই ভালো লাগে বুঝলি? ইথি এবং পুতুল- দু’জনকে নিয়েই সমান ভাবে ভাবতে থাক। দেখবি,যে তোর মনের কাছে,তার প্রতি অনুভূতি টা দিন দিন বাড়বে, একটুও পানসে হবে না। আর যে মনের দূরে, তাকে নিয়ে ভাবনাই আসবে না কোনো। জোর করে ভাবতে হবে।’
‘আমাকে ধৈর্য্য ধরতে বলছিস?’
‘হ্যাঁ, আপাতত এইটুকু ছাড়া আর তো কোনো উপায় দেখছি না।’
‘আর আমি যে কথা দিয়ে এসেছি…’
‘তুই কী জোর করে একটা সংসার ভাঙতে চাচ্ছিস?’
অর্ক হৈহৈ করে উঠল,
‘মোটেও না। ওটা কোনো সংসারই না। মেয়েটাকে জোর করে..’
অয়ন্ত কথা কেড়ে নিয়ে বলে,
‘যদি সত্যিই মেয়েটা ওই সংসার থেকে বেরিয়ে আসতে চায় তবে ও-ই বের হওয়ার রাস্তা খুঁজে নেবে। তখন তোর দরকার পড়লে তোর দিকে হাত বাড়িয়ে দিবে। তুই তখন ওর হাতটা ধরিস। আপাতত একদম ঠান্ডা থাক। সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। ভাব, আরও ভাব, ভেবে ভেবে বের কর, কাকে চায় তোর মন? এতদিনের ইথিকে, নাকি দু’দিনের ওই মেয়েটাকে?’
অর্ক চুপসে বসে রইলো। কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। খেতে পানসে লাগছে। ওর জীবনটাও কেমন যেন পানসে হয়ে গেছে, ঠিক এই ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফির মতোন।
_________
‘কীরে, কী পুড়তাছে?’
ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে করতে মেয়ের উদ্দেশ্যে কথাখানা ছুঁড়ে দিলেন গুলবাহার বেগম। শাপলার মা। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে উঠেছিলেন তিনি। তখনই নাকে একটা পোড়া গন্ধ এসে ঠেকলো। একেবারেই সূক্ষ্ম গন্ধটা। মেয়ের রুমের ভেতর থেকে আসছে। তিনি কৌতুহলী হয়ে উঁকি দিলেন।
মায়ের উপস্থিতি টের পেয়ে শাপলা সম্বিৎ ফিরে পেল। দ্রুততার সঙ্গে নিজের অবস্থান ঠিক করে বলল,
‘ক…কই? কিছু না!’
কুঁপির চারপাশে কাগজখানা পুড়ে ছাঁই পড়ে গেছে ইতোমধ্যে। গুলবাহার সেদিকে তীক্ষ্ণ নজরে চাইলেন। আঙুলের ইশারা করে বললেন,
‘তাইলে ওইডি কী?’
শাপলা বুঝলো, কথা যত ঘোরাবে ততই তার বিপদ। তার চেয়ে যুক্তিসঙ্গত কিছু একটা বলে মায়ের হাত থেকে রেহাই পাওয়া উত্তম।
সে বলল,
‘তেমন কিছু না আম্মা। একটা কাগজ। হাতে নিছিলাম, হাত ফসকায়া পইড়া জ্বইলা গেছে।’
‘ওহ।’
গুলবাহার পুনরায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার জন্য শাপলার রুম ছাড়তে গিয়েও থেমে দাঁড়ালেন। শাপলার দিকে আরেকবার চেয়ে বললেন,
‘তুই কী কিছু লুকাইতেছোস আমার থেইকা?’
শাপলা ফাঁকা ঢোক গিলে,
‘কই মা! না তো।’
‘তোর বাপের বড় আদরের মাইয়া তুই। যেইডা কস, হেইডাই মাইনা নেয়। হের কলিজায় দাগ দিস না কহনো শাপলা।’
গুলবাহার বেরিয়ে গেলেন। শাপলার চোখ ভেঙে কয়েক ফোঁটা উষ্ণ জল গড়িয়ে পড়ল চিবুকে। তবে কী ইহজন্মে শাহিনকে আর পাওয়া হলো না! বুকের ভেতর উথাল-পাথাল করা প্রেম এখন আগুনে রূপ নিয়েছে। প্রতিমুহূর্তে শাপলাকে পোড়াচ্ছে। এই পোড়ানোর লীলাখেলা চলবে আজন্ম। শাপলা জানে। শাহিনকে ছাড়া বাকী জীবন টা কেমন করে কা-টাবে!
___________
সাত সকালে আখতারের আগমন ঘটলো। তিনি পুতুলকে নিতে এসেছেন। গতকালকের মতো আজও পুতুল বায়না করল, এখন না, বিকেলের দিকে যাবে। সামান্য রাগও করল। পরে যখন শুনলো, শম্পা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তাই আখতার তাকে সকাল সকাল নিতে এসেছে, তখন আর না যাওয়া ছাড়া উপায় রইলো না। বাধ্য হয়ে পুতুল নিজের ব্যাগ গোছাতে শুরু করল।
পারুল মেয়ের ঘরে প্রবেশ করলেন। তার চোখজোড়া ছলছল করছে। বুকে শূন্যতা চেপে বসেছে। মেয়েটা ছিল, মনে সাহস-জোরও বেড়ে গিয়েছিল। ও চলে গেলে তারা দু’জন আবারও একলা হয়ে পড়বে। ভাগ্য করে তিনটা ছেলের জন্ম দিলো ঠিক ঠিক, তবে সব ক’টা হয়েছে অমানুষ। ওরা থাকা না থাকা সমান কথা। এর চেয়ে আরও তিনটে মেয়ে জন্ম দিলেই বোধকরি ভালো হতো।
পুতুল বোরকা পরে নিলো। নেকাব লাগানোর আগে একবার মা’কে বুকে জড়িয়ে ধরে। তারপর মায়ের হাতজোড়া শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
‘আব্বারে তুমি হাসপাতালে নিয়া যাইবা কিন্তু। আর আমারে খবর দিবা। ওই বাড়ি কিচ্ছু নিয়া যাওয়া লাগবো না তোমগো। আমি হেরে বুজাইয়া কমু। তাও আইসো। আমারে পর কইরা দিও না একবারে।’
পুতুলের বাম চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। পারুল মেয়ের চোখের পানি মুছে দিলেন। মেয়েকে কথা দিলেন, তিনি খবর জানাবেন। তার বাবা সুস্থ হলেই মেয়ের শ্বশুর বাড়ি যাবেন। পুতুল একটু খুশি হলো। প্রিন্সকে আশেপাশে কোথাও পাওয়া গেল না। আবার বেরিয়েছে। বিছানায় শয়নরত পিতার সঙ্গে কিছু কথা বিনিময় করে নেকাব লাগিয়ে আখতারের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে তারপর। পথে যেতে যেতে আখতার বার কয়েক পুতুলের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। পুতুল অবশ্য জবাব দেয় না। চুপ করে রয়। তার চিন্তাচেতনায় অন্য কারো উপস্থিতি। আখতারকে তার ভালো লাগে না। আখতারও আজ পুতুলকে ঘাটাঘাটি করেন না আর। চুপ করে যান। পুতুলের মনে প্রশ্ন জাগে, আখতার এতোটা চুপচাপ হয়ে গেলেন কেন এক রাতের ব্যবধানে!
সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় বাড়ি ফেরার পর। শম্পা অসুস্থ হননি, তাকে মে-রে অসুস্থ করা হয়েছে। আর এই মহৎ কাজটা সম্পন্ন হয়েছে আখতারের দ্বারা।
পুতুল বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘আপনি ভাবীরে এমনে মা-রছেন কেন?’
আখতার কাচুমাচু ভঙ্গিতে উত্তর দিলেন,
‘বড় ভাই দেশে নাই দেইখা হের পাখনা গজাইয়া গেছিল। বাইরের বেডা মানুষের লগে ফিসাফিসি করে। আমি মেলা দিন ধইরা ওর নামে বিচার পাইতেছিলাম। কাইলকা হাতে নাতে ধরছি। পরে রাগের মাথায়..’
পুতুল একটুও বিশ্বাস করল না। নিশ্চয়ই কারণ অন্য যেটা তাকে বলতে চান না আখতার। বলতে গেলে হয়তো আখতার আর শম্পার গোপন রঙ্গ তামাশা গুলোও খোলাসা হয়ে যেতে পারে। অবশ্য তারা কী আর জানে, পুতুল ইতিমধ্যেই তাদের ব্যাপারে সবকিছু জেনে গেছে।
(চলবে)