#প্রণয়_কোন্দল
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:০৯
আজ একটা কেস আছে যার কারণে সকাল সকাল উঠে গেল শতাব্দী। গোসল করে এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে মুছতে আবারো মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আসলো।উৎস সোফায় ঘুমাচ্ছে কিন্তু এই শান্তির ঘুমটা শতাব্দীর একদম পছন্দ নয় তাই সোফার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো তারপর হাঁটু মুড়ে বসে নিজের কোমর ছাড়িয়ে যাওয়া লম্বা ঘন ভেজা চুল গুলো সামনে এনে উৎসের মুখের মধ্যে বারি দেওয়া শুরু করলো।উৎসের ঘুম ভেঙ্গে গেল চোখমুখ কুঁচকে তাকালো সামনে কিন্তু কিছুই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না একেই সবেমাত্র ঘুম ভাঙ্গলো তার উপর চোখে চশমা নেই।শতাব্দী উৎসের দিকে চশমা এগিয়ে দিতেই উৎস চশমাটা পড়ে তাকাতেই শতাব্দীকে হাসতে দেখে বিরক্ত হয়ে বলল,
– চুল কি বেশি লম্বা হয়ে গেছে?
– হুম।
– চুল গোঁড়া থেকে কেটে দিব বেয়াদব মেয়ে আমার ঘুম কি তোমার সহ্য হয় না প্রতিদিন কিছু না কিছু করে ঘুম ভাঙ্গাবে।
– আপনাকে ঘুম থেকে তোলা স্ত্রী হিসেবে আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
– একটু আদর করেও তো উঠাতে পারো।
– বন্দুকের গোঁড়া দিয়ে মাথায় বারি মে’রে উঠাবো।
– কোথাও যাবে নাকি?
– হুম কোর্টে যাব।
– কেন?
– একটা কেস আছে।
– ওহ।
উৎস বাথরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে, কিছুক্ষণ পর বাহিরে আসতেই দেখতে পেল শতাব্দী তৈরি হয়ে গেছে কোর্টে যাওয়ার জন্য।সাদা কালোয় চেকচেক একটা শাড়ি মাথায় মেচিং হিজাব আর কালো লম্বা কোটটা হাতের ভাজে। উৎস টি- শার্ট বদলে ঘর থেকে বের হতে যাবে তখনি শতাব্দী প্রশ্ন করলো ,
– আপনি আবার কোথায় যাচ্ছেন?
– হাঁটতে।
শতাব্দী প্রতিত্ত্যুর করলো না, উৎস শতাব্দীর আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শতাব্দীর গাড়ি এসেছে শতাব্দীকে নিতে, ড্রাইভার ভেতরে নিজের চালক সিটে বসে মোবাইলে কথা বলছে।উৎস লুকিয়ে লুকিয়ে গাড়ির পেছনের দিকে গেল, আসার সময় ডাইনিং টেবিল থেকে ফল কাটার ছুরি নিয়ে এসেছে। ছুরি দিয়ে কেটে শতাব্দীর গাড়ির পেছনের দুই চাকার হাওয়া বের করে দিয়েছে উৎস।
শতাব্দী নিচে নামতেই মিসেস উপমা নাস্তা না করিয়ে ছাড়লেন না ছেলের বউকে।উৎস নিজের কাজ সেরে শিস বাজাতে বাজাতে বাড়িতে ঢুকেই শতাব্দীর বরাবর সামনের চেয়ারে বসে পাউরুটিতে জেইল লাগাতে লাগলো। শতাব্দী আড়চোখে একবার উৎসকে দেখে মনে মনে বলল, ‘এত তাড়াতাড়ি হাঁটা শেষ? অলস ছেলে।’
মনের কথা মনেই রাখলো মুখে প্রকাশ করলো না। শতাব্দী খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে মিসেস উপমার উদ্দেশ্যে বলল,
– শ্বাশুড়ি গেলাম।
মিসেস উপমা রান্নাঘর থেকেই হাঁক ছেড়ে বললেন,
– হুম সাবধানে যেও।
শতাব্দী নিজের ব্যাগটা নিয়ে চলে গেল, উৎস নিজের মতো খাচ্ছে একবারও তার দিকে তাকালো না। শতাব্দী গাড়িতে উঠে গেছে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে কিন্তু গাড়ি চলছেই না। শতাব্দী বিরক্ত হয়ে বলল,
– কি হয়েছে? গাড়ি ছাড়ছেন না কেন?
– ম্যাম স্টার্ট দিচ্ছি কিন্তু চলছে না মনে হয় চাকায় সমস্যা হয়েছে।
– তাহলে এখনও বসে আছেন কেন গিয়ে দেখুন কি হয়েছে এমনিতেই আমার তাড়া আছে।
ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির চাকা গুলো দেখে বলল,
– ম্যাম গাড়ির পেছনের দু’টো চাকাই পাংচার হয়ে গেছে।
– হুয়াট! দু’টো চাকা আবার পাংচার হয় কিভাবে? চাকা চেক করে আসতে পারেননি।
– আমি তো গাড়ি চালিয়েই এসেছি তখন তো কোনো সমস্যা হয়নি।
– এখন আমি যাব কিভাবে?এত সকালে বাস তো পাওয়া যাবে না আর রিক্সা করে এত দূরেও যাওয়া সম্ভব নয়।
শতাব্দী নেমে গেল গাড়ি থেকে, উৎস চোখের চশমা ঠিক করে শতাব্দীর কাছে এসে জিজ্ঞেস করলো,
– এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন?
– গাড়ির চাকা পাংচার হয়ে গেছে এখন আমি যাব কিভাবে?
উৎস থুতনিতে আঙ্গুল ঘষে জবাব দিল,
– আমি থাকতে এত চিন্তা কিসের? দুই মিনিট দাঁড়াও রেডি হয়ে আসছি।
– আপনি কোথায় যাবেন?
– তোমাকে দিয়ে আসতে।
– আমার জন্য আপনাকে আবার কষ্ট করতে হবে।
– কি বলো কষ্ট কেন হবে এটা তো আমার দায়িত্ব তুমি একটু দাঁড়াও।
বলেই উৎস দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। কয়েক মিনিট পর গ্যারেজ থেকে গাড়ি নিয়ে শতাব্দীর সামনে আসলো। শতাব্দী গাড়িতে উঠে বসতেই উৎস গাড়ি ছেড়ে দিল। গাড়িতে কেউ কারো সঙ্গে একটা কথাও বলেনি, পুরো সময় শতাব্দী বাইরে তাকিয়ে ছিল আর উৎস আড়চোখে শতাব্দীকে দেখছিল।
গন্তব্যে গাড়ি থামতেই শতাব্দী নেমে গেল উৎস মন খারাপ করে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো, ‘কি পাষান বউরে এত কষ্ট করে গাড়ির হাওয়া বের করে নিজের কাজ ফেলে ড্রপ করে দিতে আসলাম অথচ যাওয়ার সময় বিদায় নিলো না।’
মুখ মলিন করে পুনরায় গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছিল উৎস, শতাব্দী গাড়ির কাছে এসে উৎসের পাশের জানালায় দাঁড়িয়ে বলল,
– আপনার এখন কোনো কাজ আছে?
উৎস ব্রু কুঁচকে তাকালো শতাব্দী পুনরায় বলল,
– কিছু জিজ্ঞেস করেছি।
– আছে কিন্তু কেন?
– না আসলে আমার কাজ শেষ হতে আধ ঘণ্টা লাগবে তারপর আমি ফ্রি।
উৎস শতাব্দীর বাকি কথাটা বলার আগেই বুঝে গেল তাই মুচকি হেসে বলল,
– আমি না গেলেও হবে কাউকে ফোন করে বলে দিলে সে সামলে নিবে।
– আচ্ছা তাহলে আমি আসছি।
– হুম যাও আমি এখানেই অপেক্ষা করছি।
শতাব্দী মাথা নাড়িয়ে চলে গেল।উৎস অনেক খুশি হয়েছে এই ভেবে যে শতাব্দী তার সঙ্গে একান্তই সময় কাটাতে চাইছে।
_________________
একদিন পরে আসার কথা থাকলেও ঊষা আজই চলে এসেছে। তৌসিফ ঊষাকে বাড়িতে দিয়েই নিজের বাড়িতে চলে গেছে। মিসেস উপমা বললেন,
– তোর না কাল আসার কথা ছিল?
– ছিল কিন্তু আজই চলে এসেছি তোমাদের ছাড়া ভালো লাগেনা।
– আমাদের ছাড়া ভালো লাগেনা নাকি অন্য কিছু আছে?
– তুমি সবকিছু নিয়েই সন্দেহ করো আম্মু।
– সন্দেহ কি স্বাদে করি? তোর গুনধর ভদ্র ভাইকে সন্দেহ করেছিলাম দেখ সন্দেহ সত্যি হয়ে গেল মামলা খেয়ে বিরোধী মেয়ে উকিলকে কেমন করে বিয়ে করে আনলো।
– তুমি কি আমাকে নিয়েও এসব সন্দেহ করছো?
– সন্দেহ তো করতেই হবে ওই ভাইয়ের বোনই তো তুই।
ঊষা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
– ভাইয়া কোথায়?
– শতাব্দীকে কোর্টে দিয়ে আসতে গেছে।
– ওহ আমি ঘরে গেলাম ফ্রেশ হতে শেফালীকে দিয়ে আমার জন্য জুস আর হালকা খাবার পাঠিয়ে দিও আম্মু।
– আচ্ছা যা।
.
.
শতাব্দী কোর্ট থেকে বের হয়ে আয়মান আর তন্নীকে বিদায় দিয়ে গাড়ির কাছে এলো।উৎস গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বসে মোবাইলে গেম খেলছে। শতাব্দী গাড়িতে উঠে বলল,
– আর পাঁচ মিনিট গেলেই একটা ক্যাফে সামনে পড়বে ওখানেই যাব আমরা।
উৎস মোবাইল প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে গম্ভীর মুখে বলল,
– আমরা কি প্রেমিক প্রেমিকা নাকি যে ক্যাফেতে যাব? আমরা জামাই-বউ আমরা বাড়িতে আরামছে বসে প্রেম করবো।
– এই আপনার মাথায় কখনো কি ভালো চিন্তা ভাবনা আসে না? ফাউল কথা বলে মুড নষ্ট করে দেয়।
– আমার সব কথাই তো তোমার ফাউল লাগে।
– চুপ করে গাড়ি চালান নয়তো নেমে যাব।
– রাগছো কেন চালাচ্ছি তো।
গাড়ি থামলো একটা ক্যাফের সামনে, ক্যাফটা বেশ বড় ভেতরে যেমন ব্যবস্থা আছে তেমনি ছাদের মতো একটা বড় বারান্দার মতো খোলামেলা জায়গা আছে সেখানেও বসার ব্যবস্থা আছে। শতাব্দী আগেও অনেকবার এখানে এসেছে তাই উৎসকে নিয়ে খোলামেলা জায়গায় গিয়ে একটা টেবিলে বসলো। আবহাওয়া বেশ ভালো রোদও না বৃষ্টিও না মিডিয়াম প্রাকৃতিক বাতাস। শতাব্দী দু’টো কফি অর্ডার করে আশেপাশে তাকিয়ে পরিবেশটা উপভোগ করতে ব্যস্ত। এদিকে উৎস একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শতাব্দীর দিকে, কিছুক্ষণ পর কফি দিয়ে গেল ওয়েটার। শতাব্দী কফির কাপে চুমুক দিয়ে উৎসের উদ্দেশ্যে বলল,
– আপনি খাচ্ছেন না কেন? খেয়ে দেখুন কফিটা অনেক মজার আমি আগেও এখানে অনেকবার এসেছি।
উৎস বাঁকা হেসে বলল,
– মতলব কি উকিল সাহেবা?
শতাব্দী থতমত খেয়ে গেল জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
– কিসের মতলব?
– তুমি তো এমনি এমনি আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করার মেয়ে নও, কি কারণে এখানে এসেছ সেটা বলো কি দরকার?
শতাব্দী হাসার চেষ্টা করে বলল,
– আমি কি এমনি এমনি আমার হাজব্যান্ডের সঙ্গে আলাদা সময় কাটাতে পারি না।
– এহ হাজব্যান্ডের সঙ্গে সময় কাটাতে আসছে তোমাকে আমি হারে হারে চিনি স্বার্থ ছাড়া কোনো কাজ তুমি করো না।
শতাব্দী শুকনো হাসলো মনে মনে বলল, ‘আপনি আমাকে এখনো সঠিক ভাবে চিনলেন না উৎস।’
– কি হলো চুপ করে আছো কেন? কথা এত সাজাতে হবে না যা বলার সরাসরি বলে দাও।
– রুহির কেসটা এখনো চলছে পুলিশের উপর দায়িত্ব পড়েছে অপরাধীদের খোঁজে বের করার জন্য। আমি ভিক্টিমের হয়ে মামলা লড়ছিলাম তাই জানা তো দরকার কে রুহিকে মে’রেছে আর আপনার উপর সব দোষ চাপিয়ে দিয়েছিল।
– তুমি কি ভাবছো আমি কিছু জানি? সত্যি বলতে আমি কিছুই জানি না যদি জানতাম তাহলে কি আর কোর্টে ঘুরতাম আর না তোমায় ওভাবে বিয়ে করতাম।
শতাব্দী আর কিছু বললো না কফি খেতে লাগলো।উৎস কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
– তুমি ঊষার সঙ্গে কথা বলতে পারো রুহির বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল ঊষা আবার আমাদের প্রতিবেশীও ছিল সেক্ষেত্রে আমাদের বাড়িতে ওর অনেক যাতায়াত ছিল।
– আপনার বোন আমাকে দেখতেই পারে না কথা বলতে গেলেই চোখ মুখ কুঁচকে রাখে।
– তুমি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছ বলে সেও তোমার সঙ্গে এমন করছে তবে তুমি একবার ওর সঙ্গে মেশার চেষ্টা করে দেখতে পারো ও কিন্তু অনেক মিশুক আর হ্যা সরাসরি কোনো প্রশ্ন করো না কৌশলে জেনে নিও।
– হুম।
– একটা সত্যি কথা বলো তো।
– কি?
– আমার নামে এতগুলো ভুলভাল প্রমাণ কে দিয়েছে তোমায়?
– আসিফ ইসলাম।
উৎসের মুখটা মলিন হয়ে গেল চিন্তিত কন্ঠে বলল,
– আসিফ ইসলাম! দেখতে কেমন? ছবি আছে?
– ছবি নেই উনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল একবার, দু’বার ফোনেও কথা হয়েছিল কিন্তু আপনার কেস শেষ হওয়ার পর থেকে নাম্বার বন্ধ।
– কিভাবে দেখা হলো?
– রাতে কল দিয়ে বলেছিল আমার সঙ্গে একটা কেস নিয়ে কথা বলতে চান তারপর আমি উনাকে সময় ঠিক করে দিলাম পরেরদিন আমার চেম্বারে এসেছিলেন রুহির কেস নিয়ে, রুহির বিষয়টা সম্পর্কে আমি শুনেছিলাম। উনার কথা শুনে প্রথমে কেসটা আমি নিতে চাইনি কিন্তু মি.আসিফ অনেক জোরাজুরি করলেন সব প্রমাণ দেখালেন তাই বাধ্য হয়েই নিয়েছিলাম এর পর উনার বাকি কথা আয়মানের সঙ্গেই হয়েছে।
– ওহ।
শতাব্দীর সামনে স্বাভাবিক দেখালেও উৎসের মনে অন্য কিছু ঘুরছে সবকিছু গোলমাল লাগছে কিছু একটা আঁচ করতে পারছে।
______________
শতাব্দীকে বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে উৎস গাড়ি নিয়ে চলে গেল। ইসতিয়াক আহমেদ অফিসেই ছিলেন উৎসকে দেখে বললেন,
– তুই অফিসে! আজ তো আসবি না বলেছিলি।
– তোমাকে মিস করছিলাম।
– বউয়ের হাতে আবার মা’ইর খেয়েছিস নিশ্চই?
– উহু আজকে বউ মারেনি মনে হয় ভালো হয়ে গেছে।
ইসতিয়াক আহমেদ বড় বড় দু’টো নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
– তাহলে এখানে কেন?
– কেউ আমাকে ফাঁসানোর জন্যই রুহির সঙ্গে এমন একটা কাজ করেছে বুঝলে।
– আমার এটা আগেই সন্দেহ হয়েছে,কিন্তু কে করেছে এটা কিভাবে জানবো?
– আমার উপর ছেড়ে দাও একবার যদি তাকে হাতে পাই রুহিকে যেভাবে মে’রেছে তার থেকেও নৃশংসভাবে মা’রবো।
– যাই করিস না কেন সাবধানে করিস যাতে ফেঁসে না যাস।
– ফাঁসবো না বাবা লোকটা নিজের বিপদ নিজে ডেকে এনেছে।
চলবে……….