#প্রণয়িনী,পর্ব:তিন শেষ
লেখনীতেঃ নুসরাত সুলতানা সেঁজুতি
মধ্য দুপুর। সবে ক্লাশ শেষ করে ভার্সিটি থেকে বেরিয়েছি। আশেপাশে একটা রিক্সাও নেই। এদিকে সূর্যের কড়া আলো মাথায় পরছে। গরমে ঘেমে একাকার অবস্থা। অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে অতিষ্ঠ হয়ে হাঁটা ধরলাম। সামনে থেকে রিক্সা বা কিছু একটা পেলে উঠে পরব। হঠাৎই একটি কালো মতো লোক এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন । থমকে দাঁড়াই আমি। লোকটার চোখে কালো চশমা,পড়নে খয়েরী শার্ট। লোকটি হাতের কাগজ এগিয়ে দিয়ে বিনয়ী কন্ঠে বললেন,,
” এই ঠিকানা টা একটু বলতে পারবেন ম্যাম?”
আমি ওনার বাড়িয়ে দেয়া কাগজে চোখ বোলালাম। হিজিবিজি লেখা ভালো করে বুঝতে হাতে নিলাম। ভ্রু কুঁচকে মনোযোগ দিতেই টের পেলাম পাশে শাই করে একটি গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে কেবল। মাথা ঘামানোর মত ব্যাপার ছিলনা বলে তাকাইওনি। গাড়ির দরজা খুলে গেল সেকেন্ডে। আমি কোনও কিছু ভালো করে বোধগম্য করার পূর্বেই গাড়ির ভেতর থেকে কেউ একজন হাত খপ করে ধরল। আমি ভড়কে, ভ*য় পেয়ে তাকানো মাত্রই আগন্তুক ব্যক্তি রীতিমতো টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে নিলো আমাকে। প্রচন্ড আ*তঙ্কে আমার কলিজা ছ*লকে উঠল। হৃদপিণ্ড বিকল হয়ে বিট থামাল। শ্বাস বন্ধ হয়ে ম*রে যাচ্ছি মনে হলো। আগত পরিস্থিতি আন্দাজ করার আগেই দুনিয়া অন্ধকার করে আখিপল্লব বুজে ফেললাম।
জ্ঞান হা*রাতে হা*রাতে টের পেলাম একটি ভারী কন্ঠ কাউকে বলছে,
” স্যার ম্যাডাম অ*জ্ঞান হয়ে পরেছেন।”
মুখে পানির ঝাপটায় চোখ মেলে তাকাই আমি। এইটুকুতেই নিজেকে কেমন দূ*র্বল,আর আধম*রা মনে হচ্ছিল। ঝাপ্সা ঝাপ্সা দৃষ্টি মেলে চাইতেই মুখের সামনে দৃশ্যমান হলো কতগুলো পুরুষালি অবয়ব। সতচকিত হয়ে পূর্ন দৃষ্টিতে দেখলাম। মুহুর্তেই পেছনের সব ঘটনা মাথা চাড়া দিলো। হঠাৎ এক লোকের এসে আমাকে ঠিকানা জিগেস করা,কেউ একজন গাড়ির মধ্যে আমাকে টেনে নেয়া,সবটা মনে পড়তেই তীব্র ভ*য়ড*রে কাঁ*পা-কাঁ*পি শুরু হলো। আমাকে কী কিড*ন্যাপ করা হয়েছে? কিন্তু আমার বাবার তো অত টাকাপয়সা নেই।না আমি ধনীর দুলালি। তবে কেন?
এই কেনর উত্তর জানতে আমি উপস্থিত সবাইকে ভালো করে একবার একবার দেখলাম। কমসে কম সাত আটজন মোটাতাজা লোক দেখে আ*ত্মা শুকিয়ে গেল। এরা কী চায়? কেন ধরে এনেছে আমায়?
আমার অত্যাধিক ঘর্মাক্ত চেহারা,বারবার ঢোক গেলা দেখে একজন প্রশ্ন করলেন,
” পানি খাবেন ম্যাডাম?”
আমি বিস্ময়ে টুপটাপ পাতা ফেললাম চোখের। এত সুন্দর করে প্রশ্ন কোন কিডন্যাপার করে? মনে হয় ওরা কি*ডনি পা*চা*রকারী। তাই জন্যে আমাকে পানি /টানি খাইয়ে সুস্থ রাখতে চাইছে। এই আকাশ কুসুম ভাবনাতেই আমার পিপাসা দ্বিগুন বেড়ে যায়। জোরে জোরে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোঝাতেই,লোকটি অন্য আরেক লোককে ইশারা করলেন। সে তৎপর ছুটে গেল। মিনিটের মাথায় হাতে করে নিয়ে এলো এক বোতল সাদা মিনারেল ওয়াটার। রীতিমতো বোতলের ছিপি খুলে হাতে দিলো আমার। ক*ম্পিত হস্তে বোতল ধরেই চুমুক বসালাম। ঢকঢক করে খেয়ে নিলাম প্রায় অর্ধেকটা।
লম্বা শ্বাস ফেলে মুখ মুছে ফের ওনাদের দিকে চোখ দিলাম। একটু ধাতস্থ হয়ে ভীত কন্ঠে শুধালাম,
” আমাকে এখানে কেন এনেছেন?”
অন্য এক লোক উত্তর দিলো,
” দরকার ছিল ম্যাডাম। আপনার শরীর এখন কেমন লাগছে? দূর্বল লাগছে না তো?”
আমার ভারী মেজাজ খা*রাপ হলো এই লোকের উত্থলানো দরদ দেখে। মানে তোরা হার্ট অ্যা*টাক করার মতো করে অপহরন করে এনে এখন জিজ্ঞেস করছিস,কেমন লাগছে? যা ঝটকা খেয়েছি তাতে তো আমি ম*রেও যেতে পারতাম।
আমি তি*রিক্ষ মেজাজে ভ*য়ড*র ক্ষনিকের জন্যে ভুলে যাই। সরাসরি প্রশ্ন করলাম,
” কী চাই আপনাদের? কত টাকা চাইবেন আমার বাবার কাছে ? ”
এই মুহুর্তে আমি চেয়ারে বসে। বাকী লোকগুলো আমার চারপাশ ঘিরে। প্রশ্নটায় একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। তন্মধ্যে একজন বললেন,
” টাকার জন্যে তো আপনাকে আনা হয়নি ম্যাডাম। ”
আমি ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। টাকার জন্যে আনা না হলে কী আমার চেহারা দেখতে এনেছে? তৎক্ষনাৎ একটু আগের কিডনি পা*চারের কথাটাই ফের মাথা চাড়া দিল। ইয়া আল্লাহ! এর মানে সত্যিই এরা আমার কি*ডনি নিয়ে নেবে? ভয়ে আমার হাটু থ*রথ*র করে কাঁ*পাকাঁ*পি শুরু করল। কাঁ*পা কন্ঠে বললাম,
” তাহলে ককেন এনেছেন?”
” স্যারের অর্ডার ম্যাডাম। ”
আমার সবে সবে শিথিল হওয়া কপাল পুনরায় বেঁকে বসে।
” কোন স্যার?”
অন্য একজন লোক বিনয়ী অথচ মোটা কন্ঠে বললেন,
” ম্যাডাম আপনি একটু চুপ করে বসুন। স্যার এক্ষুনি এসে পরবেন। ”
” আরেহ…..
কথাটুকু সম্পূর্ন না করে নিজেই থেমে যাই। ডুব দিলাম গভীর ভাবনায়। এদের কোন স্যার আমাকে তু*লে আনতে বলেছে,সেই কৌতুহলে সব ভুলে চুপচাপ বসে রইলাম। চোখ বোলালাম চারপাশে৷ দুটো সোফা,একটা চেয়ার আর দুটো ফুলদানি, একটা ড্রেসিং টেবিল, এ ছাড়া ঘরে আর কিছু নেই। দেয়াল গুলোও পুরোনো। জায়গা জায়গা থেকে রং খসে পরছে। আমি ঠিক কোথায়,কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলাম না। তখনি বাইরে থেকে একটি রাশভারি কন্ঠ ভেসে এলো,
” মেহবুব!”
” স্যার এসছেন।”
‘মেহবুব’ নাম যার তিনি দৌড়ে গেলেন দরজার কাছে। ছিটকিনি টানলেন দ্রুত হাতে৷ আমি মেহবুব লোকটার পেটের ফাক দিয়ে উঁকিঝুঁকি দেয়ার চেষ্টা করছিলাম। কন্ঠস্বর কেমন শোনা শোনা লেগেছে। তাছাড়া স্যার টা কে,যে আমার মত এমন অসহায়,অবলা মেয়েকে অপ*হর*ন করাল?
কী আছে আমার কাছে? আমার ব্যাগ হাতালে দশ টাকার ছয়টা নোট ছাড়া কিচ্ছু পাওয়া যাবেনা। ঠিক সেসময় দৃশ্যমান হলো নাম না জানা স্যারের চাঁদ বদন। আমি বেখেয়ালে তাকিয়ে চোখ নামালেও সজাগ হলাম নিমিষে। চট করে মাথা তুলে ফের তাকালাম। চোখের সামনে পরিচিত, সেই মুখখানি দেখতেই সমগ্র শরীর হি*ম হয়ে এলো। রুদ্র রওশন চৌধুরী! উনিই কি*ডন্যা*পড করিয়েছেন আমাকে?
ভাবতেই আমার মাথা ঘুরতে শুরু করে। উনি দরজা ছেড়ে এসে ভেতরে ঢুকলেন। হাতে শপিং ব্যাগ। কিছু বলতেও হলোনা, ঘরের লোকগুলো সবাই একে একে আলগোছে বেরিয়ে গেল। রুদ্র দরজা লাগালেন। উপর নিচ দুটো ছিটকিনিই লাগালেন। এগিয়ে এলেন আমার দিকে। ওনার প্রত্যেকটা শব্দযুক্ত কদম অন্তরাত্মা কাঁ*পিয়ে তুলছিল আমার। সকালবেলা ওনাকে রি*জেক্ট করার ফল যে এইসব কিছু, বুঝতে খুব বেশি দেরি হলোনা। এখন কী উনি প্রতি*শো*ধ তুলবেন?
উনি আর একটু কাছাকাছি আসতেই আমি তড়াক করে উঠে দাঁড়ালাম। লাফিয়ে গেলাম রুমের এক কোনে। আঙুল তুলে শা*সিয়ে বললাম,
” খব*রদার! আমার কাছে আসবেন না।
পরপর ঘটনা গুলোয় ভ্যাবাচেকা খেলেন উনি। হতবুদ্ধি হয়ে চেয়ে রইলেন অল্প সময়। এরপর ঠোঁট এক পাশে বেঁকে গেল ওনার। মাথা নেড়ে সূক্ষ্ণ হাসলেন। স্পষ্ট বুঝলাম,আমার শা*সানোটাকে তাচ্ছিল্য করলেন উনি। খুব রাগ চেপে ধরল আমাকে। উনি আরেক পা বাড়াতেই খিটমিট করে বললাম,
” এগোবেন না বলে দিচ্ছি। খুব খা*রাপ হবে!
উনি ভ্রু নাঁচালেন,
” তাই?”
ওনার ‘ তাই’ বলার ধরনে আমার সবটুকু সাহস,আত্মবিশ্বাস নেতিয়ে গেল। উঁচু করা আঙুল ভে*ঙে এলো। ভ*য় লাগল। উনি আমার ক্ষ*তি করবেন না তো? ক*ঠিন চেহারা নিমিষেই নরম হলো আমার। অনুরোধ করে বললাম,
” আমাকে যেতে দিন না প্লিজ! আমি তো আপনার কোনও ক্ষ*তি করিনি তাইনা!”
উনি হাতের শপিংব্যাগ গুলো সোফার ওপর রাখতে রাখতে বললেন,
” কে বলল করেননি? আপনি আমার যা করেছেন,তা আর কেউ করেনি। ”
” কী করেছি আমি?”
উনি ঘাড় কাঁত করে তাকালেন একবার৷ পরক্ষনে চোখ ফিরিয়ে বললেন,
” এগুলো পরে তৈরি হন। ওদিকে ওয়াশরুম,যান।”
ওনার শান্ত,সুন্দর কন্ঠস্বর শুনে একটু আস্বস্তি হলো। উদ্দেশ্য খা*রাপ হলে এতক্ষন অপেক্ষা করতো না নিশ্চয়ই, এসেই ঝাপিয়ে পরত। না কি ব*লির পাঠার মত আমাকে সাজিয়ে গুছিয়ে তারপর…
তৈরি হতে বললেন কেন নাহলে?
আমি উৎকন্ঠিত হয়ে শুধালাম,
” কী আছে এতে?”
” নিজেই দেখে নিন।”
আমি জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালাম। দাঁড়িয়ে রইলাম তবুও। উনি না সরলে যাব কেন? আশ্চর্য ভাবে, আমার মৌণতা বুঝে নিলেন উনি। সরে দাঁড়ালেন। আমি চটজলদি গিয়েই ব্যাগ হাতালাম।বড়সড় ধা*ক্কা খেলাম মুহুর্তে । ভেতরে বিয়ের বেনারসি,ওড়না,গয়না, আর সাজার টুকিটাকি জিনিসপত্র দেখে মাথায় আকাশ ভে*ঙে পরার অবস্থা হলো। দুচোখ ভর্তি প্রশ্ন নিয়ে ওনার দিকে তাকালাম। উনি আমার দিকেই চেয়ে আছেন। আমার কন্ঠরোধ হয়ে আসছিল কেন যেন। খুব বেগ পুহিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ এগুলো দিয়ে কী হবে?”
উনি টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন,
” বেনারসি দিয়ে কী করে? ”
” কী করে সেটা আমিও জানি। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিনা এসব আমি পরতে যাব কেন? কেন আমাকে পরতে বলা হচ্ছে? ”
আমার কন্ঠে তে*জ। উনি ভণিতা ছাড়াই বলে দিলেন,
” আজ আপনার বিয়ে। আপনি বিয়ের কনে,তাই বেনারসি পরবেন, সিম্পল।
উনি যেভাবে সিম্পল বললেন,আমার কাছে কথাটা ততটাই দুর্বোধ্য ঠেকল। নাকমুখ কুঁচকে বললাম,
” আমার বিয়ে মানে?”
উনি খানিক বিরক্ত হলেন। ফোস করে শ্বাস ফেললেন। ঘোষণা করলেন,
” এটা কাজী অফিস। আজ এই মুহুর্তে আপনার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে আমার। এত কথা না বলে তৈরি হয়ে আসুন।
আমার কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। চোখের সামনে পুরো পৃথিবী দো*দুল্যমান!
আ*র্তনাদ করে বললাম,
” কী? কী বলছেন এসব?
আমি আপনাকে বিয়ে করব না।”
এতক্ষন শান্ত থাকা মানুষটা নিমিষেই হারিয়ে গেলেন। ত*প্ত,জ্ব*লন্ত চোখে চাইলেন আমার দিকে।
খুব ঠান্ডা অথচ ক*ড়া কন্ঠে বললেন,
” এই শব্দগুলো আপনি আর উচ্চারন করবেন না সেঁজুতি। বিয়ে আপনার আমাকেই করতে হবে।
আমি নিভে যাইনি। উলটে তেঁ*তে বললাম,
” মগের মুল্লুক নাকী? আপনি যা বলবেন তাই হবে? এটা আমার লাইফ আমি বুঝব। আপনি ঠিক করার কে? আমি আপনাকে বিয়ে করব না, করবনা, করবনা।
সঙ্গে সঙ্গে উনি কনুই চে*পে ধরলেন আমার। হেচকা টান মেরে নিয়ে গেলেন ওনার কাছে। দন্ত পিষে বললেন,
” আমাকে রাগাবেন না সেঁজুতি। জো*র করে তু*লে এনেছি বলে জোর করে আপনাকে দিয়ে কাগজে সই করাতে ভালো লাগবে না আমার। ভালোয় ভালোয়….
”
আমি মাঝপথেই ক্ষে*পে বললাম,
” কীসের ভালোয় ভালোয়? আপনার লজ্জ্বা করছে না,তুলে এনে আবার সেটা বড় মুখ করে বলতে? এতটা নী*চ একটা মানুষ কী করে হতে পারে? একদিনের দেখায় একটা মেয়েকে প্রেমপত্র দিচ্ছেন,বিয়ের প্রস্তাব পাঠাচ্ছেন,আবার সে বিয়ে না করতে চাইলে তাকে তুলে আনছেন? ছি! ছি!
উনি তীব্র ক্ষো*ভে আমার হাত আরো জোরে চে*পে ধরলেন। কনুইয়ের জায়গাটায় ওনার আঙুল বসে গেল। ব্যা*থায় চোখ খিঁচে ফেলতেই ফের শিথিল করলেন হাত। বললেন,
” হ্যাঁ আমি নী*চ। আপনার জন্যে একবার কেন,প্রতিবার নীচ হতে রাজি আছি। কিন্তু ভুলেও ভাববেন না,এসব বলে আপনি আমার ইগোকে হা*র্ট করবেন,আর আমি রে*গেমেগে আপনাকে ছেড়ে দেব। সেটা কখনোই হবেনা। আমার সাথেই বিয়ে হবে আপনার, তাও এক্ষুনি।
এতক্ষন ভালোভাবে বললাম,আপনার কাছে ভালো লাগেনি। চাইলে আমার দ্বিতীয় রুপটাও আপনাকে দেখাব। আই হ্যাভ নো প্রব্লেম!
আমি বিদ্রুপাত্মক হাসলাম। নি*র্ভীক কন্ঠে বললাম,
” যা ইচ্ছে করুন,যা মন চাইছে বলুন। কিন্তু বিয়ে আমি আপনাকে করব না। আপনার মত এরকম মানুষ কে বিয়ে করার চেয়ে গলায় দ*ড়ি দিয়ে ঝুলে পরা ভালো। ”
উনি প্রচন্ড জোরে ধ*মকে উঠলেন,
” শাট আপ!”
ধমক খেয়ে কেঁ*পে উঠলাম আমি। ধড়ফড়িয়ে উঠল হৃদপিণ্ডটা। উনি চোয়াল ক*টমট করে বললেন,
” বেশ! বিয়ে আপনাকে করতে হবে না। আপনি বাড়ি ফিরে যান। তবে হ্যাঁ, গিয়ে যখন জানবেন,আপনার কারনে আরিশা আর অভ্রর বিয়ে ভেঙে গেছে,তখন?
আমি বুঝতে না পেরে বললাম,
” মানে?”
” মানে সহজ,অভ্র আমার কথায় সব করতে পারে। আমি না চাইলে ও আপনার বোন কে কোনও দিন বিয়ে করবে না। ”
কথাটা আমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো না। একটুও না। বরং হেসে বললাম,
” তাই নাকী? মানুষকে বোঁকা বানানোর আর কী কী পদ্ধ্বতি আপনার রপ্ত আছে মিস্টার রুদ্র রওশন চৌধুরী? থাকলে সেগুলোও এপ্লাই করতে পারেন তবে আমি আপনার কথায় ভুলছিনা ফর শিওওর। ”
উনি সূক্ষ্ণ হেসে বললেন,
” গ্রেট! রুদ্র রওশন চৌধুরীর স্ত্রীর মধ্যে এরকম এটিটিউড না থাকলে চলে? একচুয়েলি আইথিংক উই আর মেড ফর ইচ আদার।
আমি তিঁতি বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে মুখ ঘোরাতেই উনি বললেন,
” আমি মিথ্যে বলিনি মিস সেঁজুতি। প্রমান চাই? ওয়েট আ সেকেন্ড।
উনি পকেট থেকে ফোন বের করলেন। আমি চোখা চোখে চাইলাম। উনি অভ্র ভাইয়ার নম্বরে ডায়াল করে লাউডে দিলেন। রিং হচ্ছিল। দুবারের মাথায় রিসিভ করলেন ভাইয়া।
কিছু বলার আগেই রুদ্র গম্ভীর গলায় বললেন,
” অভ্র,তুই আমাকে ভালোবাসিস?
ওপাশ থেকে ফটাফট উত্তর এলো,
” অবশ্যই ভাই। আমার থেকেও বেশি। ”
” কী করতে পারবি আমার জন্যে?”
” তুমি যা বলবে…”
” ভেবে দ্যাখ,যদি কিছু চাই দিতে পারবি?”
” কেন পারব না? তুমি আমার প্রান চাইলেও আমি রাজি। বলেই দেখো।”
রুদ্র আমার দিক চেয়ে চেয়ে কথা বলছিলেন। অভ্র ভাইয়ার কথায় চিবুক শক্ত করে বললেন,
“আরিশার সঙ্গে তোর বিয়ে হোক আমি চাইনা। এই মুহুর্তে বিয়েটা ভেঙে দিবি তুই।”
ওপাশে ক্ষনিকের নীরবতা। অভ্র ভাইয়া থমকে রইলেন। খানিকক্ষন পর বললেন,
” কিছু হয়েছে ভাই?”
রুদ্র আমার দিক চেয়ে থেকে বললেন,
” কিছু হয়নি। তুই বিয়ে ভেঙে দে।
অভ্র ভাইয়া একটু চুপ থেকে বললেন,
” ওকে ভাই। তুমি যা চাইবে তাই…..
এটুকু শুনতেই আমার পায়ের নিচে জমি কেঁ*পে উঠল। সত্যি সত্যি অভ্র ভাইয়া মেনে নিলেন? ঠিক শুনলাম আমি? এ কেমন ভালোবাসা ওনার? এ অবধি ওনার সঙ্গে আমার বহুবার ফোনে কথা হয়েছিল। দেখা হলো সেদিন। যখনি কথা বলতাম ভাইয়ার জ্বিভের ডগায় আপুর কথা থাকতো। মনে হতো আপুই তার সব। অথচ সেই মানুষটিই ভাইয়ের জন্যে নিজের ভালোবাসার মানুষকে…..
আমার তাৎক্ষণিক আপুর চেহারাটা মনে পড়ল। বিয়ে ভে*ঙে গেলে ও সবার কাছে ছোট হয়ে যাবে। আমিতো দেখেছি কীভাবে ও বাবাকে রাজি করিয়েছিল! আপুরতো বিয়ে ঠিক হয়েছিল অন্য জায়গায়। কত অনুরোধ,কত কিছু সামলে শেষ মেষ বাবা, আম্মু মেনে নিলেন। এ নিয়ে কথাও কম শুনতে হয়নি। সব থেকে বড় কথা আপু ভ*য়ানক ক*ষ্ট পাবে। সইতে পারবে না। সামনের দিন গুলো আমি স্পষ্ট দেখছি যেন,আপু আমার সামনে বসে বসে কাঁ*দছে। অভ্র ভাইয়ের শো*কে হা হু*তাশ করছে। ধুঁ*কে ধুঁ*কে মরছে। না না, আমার জন্যে আপুকে কষ্ট পেতে আমি দেব না। কিছুতেই না। আমি এলোমেলো মস্তিষ্ক নিয়ে রুদ্রর দিকে তাকালাম। ফোনের লাইনে তখনও অভ্র ভাইয়া। ‘ হ্যালো ‘ ‘হ্যালো’ করছেন। রুদ্র নিশ্চুপ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। চিকন,বাদামী চোখ গুলোকে আমার সবথেকে নি*কৃষ্ট চাউনি বলে মনে হলো। ঠোঁট কা*মড়ে জবাব দিলাম,
” আমি রাজি।”
রুদ্রর অধরযূগল বেঁকে গেল ফের। হাসলেন উনি। বিজয়ের হাসি। কু*ৎসিত হাসিটায় গা জ্ব*লে উঠল আমার। চোখ ফিরিয়ে নিলাম। উনি অভ্র ভাইয়াকে তুষ্ট কন্ঠে বললেন,
” থাক। বিয়ে ভাঙার দরকার নেই। মজা করছিলাম তোর সঙ্গে।
অভ্র ভাইয়া হয়ত অবাক হয়েছেন। কথা বললেন না অনেকক্ষন। এরকম লোক মজা করবেন,আসলেই? এ কথা কী মানানসই? শেষে প্রান ফিরে পাওয়ার মত করে শ্বাস টেনে বললেন,” সত্যি বলছো ভাই?
” হু।”
” যাক! আমি তো ভ*য় পেয়ে গেছিলাম। তুমি তো জানো তুমি চাইলে আমি আমার প্রানটাও দিতে পারব। ”
” রাখছি এখন। ”
রুদ্র লাইন কাটলেন। দৃষ্টি তখনও আমার দিকে। ফোন কান থেকে নামিয়ে আমাকে ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
” দাঁড়িয়ে আছেন কেন? তৈরি হন। আমি অপেক্ষা করছি!
বুকে পা*থর,আর মনের মধ্যে ওনার প্রতি অঢেল ঘৃ*না চেপে আমি ব্যাগ গুলো সমেত ওয়াশরুমে ঢুকলাম। কাঁ*দতে কাঁ*দতে শাড়ি জড়ালাম গায়ে। ভারী শাড়িতে দ্বিগুন ফুলে উঠলাম যেন। মনে মনে ঘোষণা করলাম,
” এই লোকটাকে আমি কোনও দিন ক্ষমা করব না!”
দরজা খুলতেই দেখলাম রুদ্র সোফায় বসে। এক পায়ের ওপর তোলা অন্য পা ধীরেধীরে নাড়াচ্ছেন। ফোন ঘাটছেন মনের সুখে। ইচ্ছে করছিল পাশের চেয়ারটা তুলে মাথায় মে*রে দেই। থমথমে মুখ,ভেজা চোখ নিয়ে আমি বাইরে এলাম। শব্দ পেয়ে উনি চোখ তুললেন। চেয়েই থাকলেই কয়েক পল। ওনার দৃষ্টিতে মুগ্ধতা ঝরঝর করে পরলেও আমার সেই মুগ্ধতার প্রতি অনুভূতি জাগেনি। হ্যাঁ অস্বস্তি হয়েছিল,ভীষণ ভীষণ অস্বস্তি।
রুদ্র উঠে এসে কাছে দাঁড়ালেন। ঠিক আমার সম্মুখে। পা থেকে মাথা অবধি চেয়ে বললেন,
” বউয়েরা দেখতে এত সুন্দর হয়?”
আমি উত্তর দিলাম না। অনুভূতি শূন্য হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। উনি আমার নির্জীব মুখশ্রী দেখে অল্প হেসে বললেন,
” এখন রাগ হচ্ছে তো? রাগ করুন যত ইচ্ছে। যখন এই আমিটাকে আপনাকে পুরোপুরি জানবেন,কথা দিচ্ছি আপনার সব রা*গ,ক্ষো*ভ উবে যাবে। আর শূন্য হৃদয় পূর্ন হবে আমার প্রতি ভালোবাসায়। বুঝলেন,আমার প্রণয়িনী!
এই সুন্দর কথাটাও আমার ওপর প্রভাব ফেলেনি। এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে প্রস্থান নিলো। মহাবি*রক্তি ফুটে উঠল চোখেমুখে। উনি তাতে ভ্রুক্ষেপ দিলে তো? খপ করে আমার হাত চে*পে ধরে হাঁটা ধরলেন। যেতে যেতে বলছিলেন,
” এই সুন্দর বউটাকে সারাজীবনের জন্যে নিজের করার সময় এসছে।
উদাস মনে কাবিননামায় সই করেছি আমি। ভেতরে কী লেখা,কাজী সাহেব কী কী বলেছেন কিচ্ছু জানিনা। দেখিও নি। বিয়ে শেষে রুদ্র আমার কাছে এসে আমার পিঠ ছড়িয়ে কাঁধে হাত রাখলেন। আমি রে*গেমেগে তাকাতেই চোখ দিয়ে সামনের দিক ইশারা করলেন। আমি কপাল কুঁচকে তাকালেই ক্লিক হলো ক্যামেরায়। বন্দী হলো রুদ্রর আর আমার প্রথম একসাথে যূগল ছবি।
সেকেন্ডের মাথায় ওনার হাতটা ঝা*ড়া মেরে সরিয়ে দিলাম। ক*ড়া কন্ঠে বললাম,
” বিয়ে হয়েছে বলে যখন তখন গায়ে হাত দেবেন না।”
এরপর হনহন করে বেরিয়ে পরলাম কাজী অফিস থেকে। পা ছু*ড়ে ছু*ড়ে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। কোনও তোয়াক্কাই দেখালাম না রুদ্রর অভিব্যাক্তি জানার। আমার মাথায় তখন চি*ন্তা,অনেক অনেক চি*ন্তা। বাবা মা,আপু এরা জানলে কী হবে? কেমন হবে তাদের প্রতিক্রিয়া। সকালে বড়মুখ করে বিয়ে করবনা বলে আসা আমি এই বিকেলে যখন বধুবেশে ওনাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াব? আত্মীয় স্বজন জানলে ছি! ছি! করবে। বলবে মেয়ে পা*লিয়ে বিয়ে করেছে। আরো কত কী যোগ করবে সাথে কে জানে! আমার এক পৃথিবীর সবটুকু ক্রো*ধ রুদ্রর ওপর চড়াও হলো। সব কিছুর জন্যে এই মানুষটাই দ্বায়ী। আমার তথাকথিত স্বামী!
______
রুদ্র আমাকে নিয়ে সোজা ওনাদের বাড়িতে এনেছেন। সাথে ডেকে পাঠিয়েছেন আমার পরিবারকেও। এতটা তাড়া,আর এতটা সিরিয়াস ভঙ্গি ছিল ওনার,যে বিয়ের আগেই শ্বশুর বাড়িতে হাজির হতে হলো আমার আপু আরিশাকেও। আমাকে বধুর বেশে দেখে সবার মাথায় আকাশ ভে*ঙে পরলো। প্রত্যেকেই যেন কথা বলতে ভু*লে গেল। খানিকক্ষন কেউ টু শব্দ অবধি করেনি। বড় বড় চোখে শুধু দেখছিল আমাদের। আর আমি? আমি শক্ত পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে। জোরপূর্বক এই বিয়ের সামান্য দুঃ*খ যেন নেই আমার। অথচ শুধু আমিই জানতাম,ভেতরটায় কী চলছিল। প্র*কান্ড ঘূ*র্নিঝ*ড় যেন উলটে পালটে দিচ্ছিল সব। এখন এই তিনটি মানুষকে কী জবাব দেব আমি?
এই বিরাট সময়ের নীরবতা ভাঙলেন স্বয়ং রুদ্র। ঘোষণা করলেন,
” আমি আর সেঁজুতি এক ঘন্টা আগে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করেছি। সেঁজুতি এখন শরিয়ত মোতাবেক আমার স্ত্রী৷ আর এটা বলতেই আমি আপনাদের ডেকেছিলাম।
কথাটা উনি বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন। বাবা হ*তাশ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি একবার চেয়েই চোখ নামিয়ে ফেললাম। ওই দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলানোর সাহ*স আমার নেই। আম্মু কেঁ*দে কেঁ*দে বললেন,
” কিন্তু এভাবে বিয়ে করার কী দরকার ছিল বাবা? আমরা তো একদম মানা করিনি তোমাদের বিয়েতে,বলেছিলাম…..
” আপনারা পুরোপুরি নিশ্চয়তাও দেননি আন্টি। তাই জন্যেই আমার এভাবে বিয়েটা করতে হয়েছে। ”
” তুমি নিশ্চয়ই ওকে জো*র করে বিয়ে করেছো রুদ্র?”
রুদ্রর মা ভীষণ রে*গে বললেন কথাটা। রুদ্র একটুও বিচলিত না হয়ে জবাব দিলেন,
” না। ”
” মিথ্যে বলছো কেন? সেঁজুতি তো তোমাকে বিয়ে করতে চায়নি। আজ সকাল অবধিও না। তাহলে ক’ঘন্টায় কী এমন হলো যে….
” সেটা ওনাকেই জিজ্ঞেস করো। উনিতো সামনেই আছেন। জেনে নাও,আমি আসলেই ওনাকে জো*র করে বিয়ে করেছি কীনা!
শেষ কথাটা বলতে বলতে রুদ্র আড়চোখে আমার দিকে তাকালেন একবার। আন্টি সত্যিই এগিয়ে এলেন। আমার দুইবাহু নরম হাতে ধরে বললেন,
” আমার দিকে তাকাও সেঁজুতি।
আমি তাকালাম। আন্টি তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে প্রশ্ন করলেন,
” এই বিয়ে তোমার ইচ্ছেতে হয়েছে?”
আমি এক মুহুর্ত না ভেবে বললাম,
” হ্যা।”
আন্টির হাত শিথিল হলো। পাশ থেকে আপু বিস্ময় নিয়ে বলল,
” তাহলে সকালে মানা করেছিলি কেন?”
” এমনি। ”
আমার সংক্ষিপ্ত উত্তরে খুশি হলোনা কেউ। আম্মু উঁচু কন্ঠে বললেন,
” এমনি? এমনি কেমন কথা? আমরা যখন বিয়ের কথা তুলেছি তুই সাফ সাফ মানা করে সন্ধ্যে বেলা বউ সেজে হাজির হয়ে বলছিস এমনি বিয়ে করেছিস? আমাদের জন্যে ধৈর্য ধরা যেত না? এমন কী হয়ে গেল যে বড় বোনের আগে নিজেই বিয়ে সেড়ে ফেললি?
রুদ্র বরফ স্বরে বলে উঠলেন,
” আজকাল বড় ছোট কোনও ব্যাপার নয় আন্টি। অভ্রও তো আমার ছোট, অথচ ওর বিয়ে আগে হতে যাচ্ছিল। এটা নিয়ে আমাদের তো কোনও সমস্যা হয়নি,আপনাদের কেন হচ্ছে?
” এটাই কী স্বাভাবিক নয় বাবা? আমরা মধ্যবিত্ত মানুষ। তোমাদের মত এত উচু বিত্তবান নই। আশেপাশের সবার কথা শুনে বেঁচে থাকতে হয়।তাছাড়া আমার মেয়ের থেকে এমন ছেলেমানুষী আমি আশা করিনি!
আম্মু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সাথে কেঁ*দে উঠলেন। আমার ভেতরটা ফেঁ*টে যাচ্ছিল তখন। কীভাবে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছি নিজেও দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছি।
রুদ্র ওনার মায়ের দিক ফিরে বললেন,
” তুমিতো কাল অবধি চেয়েছিলে অভ্রর আগে আমার বিয়ে হোক। বড় ছেলের বউয়ের মুখ দেখতে ম*রিয়া হয়ে গেছিলে। তাহলে এখন এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ”
আন্টি চ*টে বললেন,
” তো কী করতে বলছো? ধেইধেই করে নাঁচব আমি? আমার মাথা হেট করে দিলে। সবাই কী ভাবছেন….
এতক্ষনে নীরব অভ্র ভাইয়া মুখ খুললেন। এগিয়ে এসে বললেন,
” কেউ কিচ্ছু ভাববে না মা। তোমরাই সামান্য বিষয় টাকে টেনেটুনে লম্বা করছো। আরে বাবা,ভাই তো নিজেই চেয়েছিল ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ে করবে,সেঁজুতিই রাজি হয়নি তখন। হতে পারে ওদের মধ্যে মনমা*লিন্য হয়েছিল। তাই। এখব মিটে গেছে দুজন খুব খুশিতে বিয়ে সেড়ে ফেলল। হতে পারে না? আর তাই তোমরা অহেতুক নাড়াচাড়া না করে ভাই আর সেঁজুতি কে মেনে নাও। ওদের দেখেই বোঝা যাচ্ছে কত ক্লা*ন্ত! তার ওপর সেঁজুতি কী ভারি একটা শাড়ি পরেছে ওর ক*ষ্ট হচ্ছে না? ওরও বিশ্রাম দরকার।
আমি কটমট করে অভ্র ভাইয়ার দিকে তাকালাম।
আমাকে সব থেকে বড় বাঁশ টাতো এই লোকটাই দিয়েছে। আর এখন দরদ দেখাচ্ছে, হুহ!
অভ্র ভাইয়ার কথাটা আন্টির ওপর প্রভাব ফেলল। তিনি ফোস করে এক নিঃশ্বাস ফেলে বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। বাবা থম মেরে দাঁড়িয়ে, মুখে রা নেই। আন্টি নম্র কন্ঠে বললেন,
” যা হওয়ার হয়ে গেছে ভাইজান৷ ছেলে মেয়ে দুটো ভু*ল করেছে, ওদের হয়ে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।
আন্টি হাত জোর করতেই বাবা ব্যস্ত কন্ঠে বললেন,
” না না আপা আপনি কেন….
রুদ্র প্রতিবাদ করে উঠলেন,
” আমরা ভুল করিনি মা। বিয়ে করা ভুল কাজ নয়।
আন্টি চোখ বুজে ঠোঁট গোল করে শ্বাস ফেললেন। যার মধ্যে ছেলের প্রতি হ*তাশা ছিল। এরপর বাবাকে কোমল কন্ঠে বললেন,
” আপনারা আর রা*গ করে থাকবেন না। ওদের মেনে নিন। আমিতো সেঁজুতিকে নিজের পুত্রবধূ হিসেবে সেদিনই মেনেছি যেদিন রুদ্র জানিয়েছিল ওর কথা। এখন আপনারাও যদি….
বাবা একবার আমার দিক তাকালেন। রুদ্র এ যাত্রায় আমার হাত ধরলেন। মুঠোয় পুরলেন পুরোটা। আমি চেয়েও ছাড়াতে পারলাম না।
” আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন আঙ্কেল,সেঁজুতিকে ভালো রাখার সর্বচ্চ চেষ্টা করব আমি!
ওনার সুন্দর গোছানো কথাটায় বাবা এতক্ষনে মুচকি হাসলেন। আমি প্রচন্ড অবাক হয়ে ওনার দিকে তাকালাম। কথাটা হাস্যকর মনে হওয়ার কথা ছিল,অথচ আমার অদ্ভূত লাগল কেমন। যেন খুব বিশেষ কিছু মিশে ছিল এতে। বাবা এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালেন। রুদ্রর কাঁধে হাত রেখে বললেন,
” ভরসা করছি বাবা, মান রেখো।
উনি ছোট করে বললেন,
” রাখব। ”
এরপর বাবা আমার দিকে তাকাতেই আমি চোখ নামিয়ে ফেললাম। তীব্র অপ*রাধবোধে দেহ মন ছেঁয়ে গেল। টের পেলাম বাবা মাথায় হাত বোলাচ্ছেন। আমি চট করে মাথা তুলতেই বাবা ছ*লছ*ল চোখে হাসলেন। আমার আকাশ ভে*ঙে কা*ন্না পেল। ঝা*পিয়ে পরলাম বাবার বুকে। ইচ্ছে করল গলা ফা*টিয়ে বলতে,
” আমাকে নিয়ে যাও। এই রাক্ষ*সরুপী শয়*তান লোকটার সাথে আমি থাকব না। কিছুতেই না।
শেষ মেষ বাড়ির সবাই মেনে নিলেন। বিয়ে হয়েছে,এখন করার তো কিছু নেই। বাবা, আম্মু সবাই আমাদের মন ভরে দোয়া করলেন। সেদিনের মত ঝামেলা মিটলেও আমার সুপ্ত রা*গটা অবিচল। কারন রুদ্র আবার জিতে গেলেন। এত বড় একটা অ*ন্যায় করেও পার পেলেন। আমি না পারছিলাম কাউকে বলতে,না পারছিলাম সইতে৷ খুব করে চেয়েছিলাম,যেন কেউ মেনে না নেয়। অথচ হলোনা! এখানেও পূরন হলোনা আমার ইচ্ছে।
রুদ্রর মা,মানে আমার শ্বাশুড়ি মা ভীষণ ভালো মানুষ। আমাকে প্রতিটি সম্বোধনে ওনার মা ডাকা চাই। এছাড়া যেন কথাই বলেন না। এই মুহুর্তে আমি বসে আছি বিছানায়। বিশাল ঘরের তুলতুলে বিছানায় শক্ত মন নিয়ে আমি হাটুতে মুখ গুজে বসে। বিয়ের বেনারসি টা ছেড়ে এখন একটু পাতলা সুতির শাড়ি পরেছি। এত এত শাড়ি চোখের পলকে বাড়িতে হাজির হয়েছে। এনেছেন রুদ্র। মেয়েদের শপিং পছন্দ,জামাকাপড়, গয়না এসব তাদের দূর্বলতা হলেও আমার মন কোনও কিছুতেই ভালো হয়নি। আমার থমথমে গোমড়া মুখ পাল্টায়নি। তবে একটা বিষয় সত্যি,আমাকে বউ হিসেবে পেয়ে আন্টি খুশি হয়েছেন। রাতে বাবা মাকে না খাইয়ে ছাড়েননি। খোশগল্পে মেতে ছিলেন। প্রত্যেকটা কথায় ওনার খুশি ঝরে পরছে যেন। হয়ত,গোঁয়ার ছেলে এতদিনে বিয়ে করেছে এই আনন্দেই আটখানা আন্টির মন।
বাবা, আম্মু, আপু বাড়িতে ফিরে গেছেন। তারপর আন্টি আলমারি থেকে তার দুটো বালা,নাক ফুল আর একটা চিকন স্বর্নের চেইব পরিয়ে দিলেন আনায়৷ সাথে বললেন,
” আজ থেকে আমার মেজাজি ছেলেটার সব দায়িত্ব তোমার।”
আমি ওনার পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। উত্তরে চুপ ছিলাম। ইচ্ছে করছিল একটা কিছু বলি। বা ওনাকে সত্যিটা খুলে বলি। বলে ফেলি যে আপনার ছেলে আমায় কী ভাবে বিয়ে করল! কিন্তু পারলাম না। দেয়ালেরও কান আছে৷ বাই এনি চান্স রুদ্রর কানে খবর পৌঁছে যাক,আর বিয়ে ভে*ঙে দিক আপুর। এরপর আর কী কী তুলকালাম ঘটাতে পারেন তাও আন্দাজের বাইরে। এই কদিনে লোকটাকে যেন চিনে ফেলেছি। ওনার প্রতিটি হাড়মজ্জ্বায় শয়*তানের বসবাস।
সত্যি বলতে আন্টি যখন আমাকে এ ঘরে দিয়ে গেলেন আমার হাত পা ছড়িয়ে কা*ন্না পেয়েছিল। লোকটার সাথে এক ঘরে থাকতে হবে ভাবলেই আত*ঙ্কে বিব*শ হচ্ছি। ইজ্জ্বতের ওপর হা*মলা করবেন না তো? যে জো*র করে বউ বানাতে পারে,সে জো*র করে অধিকার ফলাতে কতক্ষন?
আমার ভাবনার মধ্যেই ঘরে এক জোড়া পায়ের শব্দ। চমকে তাকালাম। ভেবেছিলাম উনি এসেছেন। না,অভ্র ভাইয়া। স্বস্তি পেলেও অভ্র ভাইয়াকে দেখে মুহুর্তে মুখ কালো হয়ে গেল আমার। রা*গ হলো। এই মানুষটার ভালোবাসার কোনও মূল্য এখন আমার কাছে নেই। অভ্র ভাইয়া ভীষণ হাসিখুশি মুখ নিয়ে এসে আমার সামনে বসলেন।
” সেঁজুতি তুমিতী আমার ভাবি হয়ে গেলে এখন। কী ডাকব বলোতো,কোন সম্পর্কটাকে জোর দেব? শালি? নাকি ভাবি। শালি হিসেবে দুষ্টুমি করব নাকি ভাবির মতন?
আমি ওনার দিকে না চেয়েই বললাম,
” একটারও প্রয়োজন নেই ভাইয়া। আপনি আমার সঙ্গে কথা না বললেই ভালো হয়।”
আমার কাটকাট জবাবে অভ্র ভাইয়ার হাসিটা দপ করে নিভে গেল। সিরিয়াস হয়ে বললেন,
” মানে? কথা কেন বলব না? এনি হাও তুমি কী আমার সাথে রা*গ করেছ?
আমি কী কিছু করেছি?
আমি তাকালাম। চোখ ছোট করে বললাম,
” করেননি? ”
ভাইয়া মনে করার খুব চেষ্টা করে বললেন,
” না। আমার তো মনে পড়ছেনা এমন কিছু। ”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসলাম। বললাম,
” পড়বে কী করে? আপনার কাছে হয়ত এটা এমন কোনও ব্যাপারই না।”
অভ্র ভাইয়া ভীষণ তটস্থ হয়ে বললেন,
” কী বলছো বলোতো সেঁজুতি? আমার মাথায় কিন্তু কিচ্ছু ঢুকছে না। ”
” আচ্ছা ভাইয়া,আপনি সত্যিই আপুকে ভালোবাসেন তো?”
হঠাৎ এরকম প্রশ্নে ভাইয়া ভ্যাবাচেকা খেলেন। তবে বিলম্ব না করেই জবাব দিলেন,
” অবশ্যই বাসি।”
আমি ভ্রু উঁচালাম,
” তাই? তাহলে আপনার ভাইয়ের এক কথায় বিয়ে ভেঙে দিতে রাজি হলেন কী করে?”
ভাইয়া ধা*ক্কা খাওয়ার মতন করে তাকালেন।
” তুমি কী করে জানলে?”
” কী করে জেনেছি সেটা তো গুরুত্বপূর্ণ নয়। এরকম করেছিলেন তো,তাইনা? ”
ভাইয়া এ পর্যায়ে দৃষ্টি সরালেন আমার থেকে। আমার হাসি পেল। তাচ্ছ্যিলের হাসি।
বললাম,
” আমি অবাক হয়েছি খুব। আপনাদের এতদিনের সম্পর্ক অথচ ভাইয়ের এক কথায় কোনও প্রশ্ন না করেই আপনি বিয়ে ভা*ঙতে হ্যা বললেন। একবারও ভাবেননি এতে আপুর কী অবস্থা হতো? ওর ওপর কী প্রভাব পরত? ওতো শেষ হয়ে যেত ভাইয়া। ভালোবাসার ওপর থেকে বিশ্বাসটাই হারিয়ে ফেলতো। আর আপনি? আপনার ভালোবাসা কী মিথ্যে ছিল? আপনি ক*ষ্ট পেতেন না? ”
ভাইয়া নিচের দিক তাকিয়েই বললেন,
” পেতাম। ওর থেকেও দ্বিগুন ক*ষ্ট পেতাম।”
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললাম,
” তাহলে কী করে মত দিলেন,আপনার ভাইয়ের এমন অন্যায় আবদারে?”
ভাইয়া তাকালেন।
” আমার ভাইকে তুমি চেনোনা সেঁজুতি, আমি ক*ষ্ট পাব এমন কোনো কাজ ভাই কোনও দিন করবেনা। এ বিশ্বাস আমার ছিল।”
কথাটা আমার কাছে যুক্তিহীন ঠেকল। বিরক্তিতে মাথা নেড়ে আরেকদিক ফিরলাম। ভাইয়া লম্বা শ্বাস ফেলে বললেন,
” আমি যখন ছোট তখন বাবা মা*রা যান। ভাইয়ের বয়স কত আর,পনের -ষোল?
বাবার হঠাৎ মৃত্যু মা মেনে নিতে পারেননি। শো*কস্তব্ধ হয়ে পরেন। সংসার,ছেলেমেয়ে,জাগতিক সব তুচ্ছ হলো মায়ের, কা*ন্না আর উদাসীনতার কাছে। বহুদিন আমি মায়ের কাছে যেতে অবধি পারিনি। মা ঘরবন্দী থেকেছেন। সেই সময়টায় আমায় কে সামলেছে জানো? ভাই। দুহাতে তুলে নিয়েছে আমার দায়িত্ব। আমি ব্যাথা পাব এরকম কোনও সংকীর্ণ জায়গা ভাই ছাড়েনি। আমি কাঁ*দব ভাই তা কখনও সহ্য করেনি। এমন অনেক কিছু যা মা দিতে চাইনি, কিন্তু ভাই এনে দিয়েছে আমায়। আমার একবার চাওয়ায় নিজের প্রিয় জিনিস টা দিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয় বার প্রশ্ন করেনি। আর সেই ভাই জীবনে প্রথম বার কিছু চাইলো,হোক আমার জীবনের চেয়েও দামী কিছু আমি কেন দেবনা সেঁজুতি? তুমিওতো আরিশাকে ভালোবাসো,তুমি হলে দিতেনা? ”
আমি নির্বাক হয়ে বসে রইলাম। কথার প্রেক্ষিতে জবাব শূন্য আমি। কী বলব? কী উত্তর দেব? অভ্র ভাইয়া আবার বললেন,
” জানিনা তোমাদের মধ্যে কী চলছে! ভাইয়ের সাথে কবে আলাপ,কীভাবে এই বিয়ে তাও জানিনা। তবে একটা কথা বলব,ভাইকে যদি চিনতে পারো,বুঝবে মানুষটা ভেতরে মোমের মত নরম। ভালোবাসার তাপ পেলেই নির্নিমেষ গলে যাবে। ”
তক্ষুনি অভ্র ভাইয়াকে বাইরে থেকে ডেকে উঠলেন আন্টি। ভাইয়া ” আসছি” বলে উঠে দাঁড়ালেন। আমার মুখের দিক চেয়ে মুচকি হেসে বললেন,
” আসছি। হ্যাভ আ নাইস ড্রিম!
ভাইয়া চলে গেলেন। তারপর অনেকটা সময় পার হলো। হঠাৎ জুতোর শব্দ পেয়ে আমার বুঝতে অসুবিধে হলোনা কে আসছে! তৎক্ষনাৎ শুয়ে পরলাম বিছানায়। ভাণ করলাম আমি ঘুমিয়ে গেছি। কেউ নিশ্চয়ই অকারনে ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তুলবে না।
টের পেলাম পায়ের শব্দটা অতি সন্নিকটে আমার। এরপরে খুব কাছে এসে থামল। আমি চোখ খিচে বুজে কাত হয়ে শুয়েছিলাম। সেই মুহুর্তে হাতে টান পরল। রুদ্র রীতিমতো টেনে উঠিয়ে, বসালেন আমায়। হকচকালাম। জিজ্ঞাসু চেহারায় ওনার দিকে তাকালাম। উনি ঘাড় কাত করে বললেন,
” বাসর রাতে স্বামীকে সালাম করতে হয় জানেন না?”
আমি দাঁত চেপে তাকিয়ে থাকলাম ওনার ফর্সা মুখের দিকে। পরপর খেয়াল করলাম ওনার পড়নের নীল পাঞ্জাবি। মনোযোগী হয়ে নিজের শাড়ি দেখলাম তারপর। একই ডিজাইন,একই নকশা। কাপল সেট? উনি পোশাক মিলিয়ে কিনেছেন?
” কী ব্যাপার? শুনতে পাননি? ”
” শুনেছি।”
আমার সংক্ষিপ্ত উত্তরে উনি বোধ হয় খুশি হননি। ভ্রু কুঁচকে পুরু কন্ঠে বললেন,
” শুনলে বসে আছেন কেন? নিন, সালাম করুন।
ঘাড়ত্যাড়া লোক সালাম না করা অবধি যে আমাকে রেহাই দেবে না আমার বোঝা হয়ে গেছে। ছোট্ট শ্বাস ফেলে নামতে উদ্যত হব ঠিক তখনি উনি ভাব নিয়ে বললেন,
“থাক দরকার নেই।”
কেমন ফাজলামো? সালাম করতে বলে আবার….।
বিরক্তি তখন আমার রগে রগে দৌড়ে ম*রছে। রুদ্র আমার পাশে বসতেই আমি দূরে সরতে গেলাম। ওমনি উনি হাত চে*পে ধরলেন। আমি জ্ব*লন্ত চোখে তাকালাম।
” হাত সরান।”
উনি শান্তভাবে বললেন,
” সম্ভব না। কাছে আসুন।”
আমার কিছু বলার পূর্বেই উনি হ্যাচকা টান বসালেন। হুমড়ি খেলাম ওনার বুকের ওপর। ওনার বুকের ভেতরের ধুকধুক শব্দটা তখন স্পষ্ট কানে বাজলো। আমি সরতে গেলাম। উনি বাধা দিলেন। বরং আরো শক্ত করে চেপে রাখলেন।
আমার মাথায় তখন ঘুরছিল একটি প্রশ্ন,
” একদিনের আলাপে মানুষ কীভাবে এরকম ব্যবহার করতে পারে? নি*র্লজ্জ!
উনি হাত শিথিল করলেন সময় নিয়ে।
সুযোগ পেতেই আমি ছিটকে সরে এলাম। উনি কিছুক্ষন চেয়ে থেকে অন্যদিক তাকালেন। পরপর নিচের দিক চেয়ে মুচকি হাসলেন। আমি ভেতরে কৌতুহল টা চেপে রাখতে না পেরে বলে উঠলাম,
” একটা কথা বলবেন।”
উনি ভ্রু নাঁচালেন,
” কী কথা?”
আমি অনতিবিলম্বে প্রশ্ন ছুড়লাম,
” আপনি এত ভাবওয়ালা একজন মানুষ হয়ে একটা মেয়েকে প্রথম দেখেই কীভাবে ছ্যা*চড়ামো করলেন? প্রেমপত্র,জোর করে বিয়ে আশ্চর্য না? আপনার মত লোক,সে এরকম করতে পারে এ মানুষ কষ্মিনকালেও বিশ্বাস করবে? চেহারার সাথে চরিত্রের মিল নেই। নাকী আপনি এরকমই। যেখানে গিয়েই মেয়ে দেখেন,তাদেরকেই হাতের ফাকে চিঠি দেন,তুলে বিয়ে করেন?
ভেতরের সব রাগ উগড়ে দিলাম আমি। তবুও মনে হলো, যতটা চেয়েছিলাম তার এক আনাও পারিনি। অথচ রুদ্র শান্ত চোখে অনিমিখি চেয়ে রইলেন। আমি থামলাম,শ্বাস নিলাম। তখনও উনি চুপ। বলবেনই বা কী? যা সত্যি তাই বলেছি। এরকম ঘটনাই তো ঘটল আমার সঙ্গে তাইনা?
” কে বলল,আমি কালই আপনাকে প্রথম দেখেছি?”
আমি সদাজাগ্রত হয়ে তাকালাম ওনার দিকে। ওনার বাদামি দৃষ্টিতে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি বুলিয়ে বললাম,
” তাহলে?
গম্ভীর মানুষটা মুচকি হাসলেন। সত্যি বলতে এত সুন্দর করে হাসলেন উনি, আমার চোখ জুড়িয়ে গেল এতে। চেয়েই রইলাম। উনি চুল গুলো ওপরে ঠেলে ভরাট কন্ঠে বললেন,
” আমি আপনাকে আরো আগে থেকে চিনি। ”
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম,
” আগে থেকে? কবে থেকে চেনেন? কী করে?”
আমার উদ্বোলিত প্রশ্নে উনি বাঁকা হেসে ভ্রু গোঁটালেন,
” বলা কী উচিত?”
আমি দিশেহারা হয়ে বললাম,
” বলুন না। আমি নাহলে কথা শুনতে না পারলে ম*রেই যাব। ”
উনি তৎক্ষনাৎ চোখ রাঙিয়ে বললেন,
” এসব কী কথা? ”
আমার উত্তেজনা নিভে গেল। মিনমিন করে বললাম,
” বলুন না! প্লিজ…..”
উনি খানিকক্ষন চেয়ে রইলেন। নিষ্পলক, সুস্থির চাউনী। পরপর একটু এগিয়ে এসে বসলেন। আমি সরতে নিলেই বললেন,
” তাহলে বলব না।”
আমি দমে যাই। বসে রই। কথাটা আমাকে শুনতে হবেই। রুদ্র আমার থেকে চোখ ফিরিয়ে দেয়ালে তাকালেন। বললেন,
” ড্রাইভার ছাড়া খুব কম বের হই আমি,মাঝেমধ্যে বলতে গেলে। সেদিনও বেরিয়েছি। অনেকটা পথ এসে হঠাৎ খেয়াল করলাম গাড়ির ব্রেক কাজ করছে না। কিছুতেই থামছেনা। আর যা হবার তাই হলো। ঠুকে গেল গাছের সঙ্গে। তাও ভালো কারো গায়ে ওঠেনি।
দুপুর বেলা বলে রাস্তাঘাটে লোকজন একদম নেই বললে চলে। আমার গাড়ির ফ্রন্ট কাঁচ ভে*ঙে ভে*ঙে আমার সমস্ত গা,হাত পা কে*টেছে। মাথা লেগেছে স্টিয়ারিংএ। ফোঁটা ফোঁটা র*ক্ত শরীর চুইয়ে সিটে পরছিল টের পাচ্ছি। অসহ্য যন্ত্র*নায় কা*তরে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছিলাম কেউ একজন আসুক।আমাকে বাঁচাক। তার কিছু সময় পর টের পেলাম কয়েকটি মেয়েলী আওয়াজ। আমার হুশ তখন বিপন্ন। দেখছি,শুনছি কথা বলার শক্তি নেই। কলেজ ইউনিফর্ম পরা তিন চারটে মেয়ে এসে ঘিরে ধরেছে আমার গাড়িটাকে। তার মধ্যে একটি মেয়ে দরজা খুলে আমার কাছে এলো। আমাকে “এইযে শুনছেন” বলে ডাকল অনেকবার। আমি কোনমতে তাকিয়েছি কেবল, ভ্রু ভিজে চোখের পল্লব তখন পাথর সমান ভারী। ঝাপ্পসা দৃষ্টিতেও মেয়েটির মুখের আদল বুঝতে পারি। তারপর জ্ঞান হারাই। যখন চেতনা ফিরল নিজেকে আবিষ্কার করলাম হাসপাতালের বেডে। সমগ্র গাত্রে ব্যা*থা,য*ন্ত্রনা চিনচিন করছে। হাত পা নাড়ানোর জো অবধি নেই। অল্প সময় মাত্রই কেবিন ভরে গেল। মা কাঁ*দছিলেন,অভ্র চিন্তিত। আত্বীয় স্বজন,ব্যাবসার লোকজন যে যেখান থেকে পারল দেখতে এলো। খোঁজ নিলো। কথা বলতে পারলাম তারও দু ঘন্টা পরে। আমার বারবার স্পষ্ট সেই মেয়েটির কথা মনে পড়ছিল। সেই মেয়েটি। যে আমার র*ক্তাক্ত গাল চাপড়ে আমাকে ডাকছিল। সেই কন্ঠস্বর,যা ঝংকারের মত বাজছিল আমার কানে। আমি তৎক্ষনাৎ ডাক্তারকে প্রশ্ন করলাম ” আমাকে হাসপাতালে কে আনল?
জানতে পারলাম কতগুলো কলেজ পড়ুয়া মেয়ে সি- এন-জি করে এনেছে আমায়। শুধু তাই নয়,তন্মধ্যে একটি মেয়ে আমাকে র*ক্তও দিয়েছে। খুব আগ্রহ নিয়ে মেয়েটির ডিটেইলস জানতে চাইলে তিনি নাম ছাড়া কিছুই বলতে পারেননি। সেই নাম ” সেঁজুতি!
এটুকু বলে উনি আমার দিকে তাকালেন একবার। আমার ঠোঁট নিজ শক্তিতে আলাদা হয়ে বসে আছে। উনি আবার বলতে শুরু করলেন,
” আমার সুস্থ হতে প্রায় দেড় মাস লেগেছিল। সবল হয়ে সবার প্রথমেই মেয়েটিকে খুঁজব,এ আমার আগে থেকে ঠিক করা। লোক লাগালাম। ওই রোডের আশেপাশের সব কলেজে খোঁজ নিলাম। পাইনি। হঠাৎ একদিন অভ্র আমাকে জানালো ও একটি মেয়েকে ভালোবাসে। আরিশা নাম। মা ছবি দেখতে চাইলেন। ও দেখাল। পরপর নিয়ে এলো আমার কাছেও। আমার মনোযোগ অতটাও ছিল না। আমি তখন বের হওয়ার জন্যে তৈরী। অভ্র আরিশার ছবি দেখাচ্ছিল, এমন কি ওর বাবা, মা, এক পর্যায়ে বলল,
“এটা ওর ছোট বোন, সেঁজুতি। ”
নাম শুনেই চকিতে তাকালাম আমি। তড়িৎ বেগে ফোনের স্ক্রিনে মন দিলাম। আরিশার সাথেই সেই মেয়েটি। যার মুখচ্ছবি আমি দেখেছিলাম। সেদিনের থেকে আজ ভালো করে দেখলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার মস্তিষ্কে গেথে গেল যেন। আমার চিনতে একটুও অসুবিধে হয়নি। কেন হয়নি? অনেক গুলো দিন পেরিয়েছে, ভুলে যাওয়ার কথা ছিল। তবুও হয়নি। আশ্চর্য না?
এটাই সেই মেয়ে,যে আমায় র*ক্ত দিয়েছে।আমায় বাঁচিয়েছে।
কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে খুঁজে পেয়ে আমার আনন্দ বাঁধ ভাঙা। কিন্তু দূ*র্ভাগ্য! প্রকাশ করতে পারিনি। পাছে অভ্র বুঝে নেয়।
শুধু জিজ্ঞেস করলাম, “কোন কলেজে পড়ে? ”
অভ্রর থেকে জেনে
আমি তৎক্ষনাৎ খোঁজ লাগালাম। পেয়েও গেলাম একদিনের মাথায়। মেয়েটি তার বাড়ির কাছের একটা কোচিং সেন্টারে পড়ত। আমি প্রায় প্রত্যেকটা দিন তাকে দেখতাম। কলেজ আর কোচিং শেষের নির্ধারিত সময় তাকে দেখতে যাওয়া, আমার দৈনন্দিন রুটিনে পাল্টাল। কেন যেতাম? কেন দেখতাম?এসব উত্তর আমার কাছে ছিল না। শুধু জানতাম,ছোট্ট মেয়েটাকে দেখতে ভালো লাগছে আমার। শান্তি পাচ্ছি খুব। আমি কাছে যেতে চাইতাম বহুবার। কিন্তু পারিনি। সঙ্কোচ হতো। এর আগে এরকম ঘটেনি কীনা। তার ওপর সে ছোট। আর সেই সংকোচ কাটাতে কাটাতেই এক বছর পার হলো।
এরপর পরই অভ্র এসে জানাল আরিশার বিয়ে ঠিক হয়েছে। মাও আমার সঙ্গে বিয়ের কথা বলে বলে ক্লান্ত,তাই সিদ্ধান্ত নিলেন অভ্রর বিয়েই আগে হবে। আমিও স্বায় জানালাম। সাথে আগ্রহ নিয়ে বললাম,
” কালই প্রস্তাব নিয়ে গেলে কেমন হয়?
দুজনে রাজী হলো। আমার তখন অন্য চিন্তা,ভিন্ন উদ্দেশ্য। কখন মেয়েটির বাসায় যাব,আর তাকে দেখব! একদম সামনে থেকে দেখব।
রাস্তা ফুরোলো বড্ড দেরি করে। গিয়ে দেখলাম, সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত মানুষটি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। হাতে গোলাপ জলের সাদা কৌটো। পড়নে পিংক চুড়িদার। কি অপরুপ লাগছিল!
কিন্তু কী জানেন,আমি রুদ্র রওশন চৌধুরী। নিজের অনুভূতি চেপে রাখার কৌশল রপ্ত ছিল আমার। খুব সুন্দর এলোমেলো মন টাকে গুছিয়ে নিলাম। মেয়েটির সঙ্গে ধমকা ধমকিও করলাম। কেন জানেন?
সেঁজুতি বোকার মত চেয়ে থেকে দুদিকে মাথা নাড়াল। জানেনা সে।
রুদ্র কন্ঠ চেপে বলল,
” আপনার ধৈর্য দেখতে। পরীক্ষা করছিলাম আপনি কতটা হজম করতে পারেন। তবেই না বুঝব, এই মেজাজি রুদ্রটাকে ভবিষ্যতেও আপনি সামলাতে পারবেন।
(একটু থেমে)
আপনাদের বাড়ি থেকে ফিরেই মাকে বিয়ের কথা জানিয়েছি। আপনার প্রতি অনুভূতি তখন রগে রগে বইছে আমার। একটা মুহুর্তে আপনি চলবেন যেন। খুব আশা নিয়ে ছিলাম আমাদের বিয়ে নিয়ে৷ অথচ শুনলাম আপনি বিয়েতে না করেছেন।তাহলে বলুন তো,মেনে নিই কী করে? আমি মেনে নেইওনি। তুলে নিয়ে বিয়ে করেছি আপনাকে।।সম্পুর্ন নিজের করে ছেড়েছি। ঠিক করেছি না?
আমার অক্ষিপল্লব তিরতির করে নড়ছিল। কয়েক পল কথাই বলতে পারিনি। এক বছর আগের সব কথা এক এক করে স্পষ্ট মনে পড়ল। কোচিং থেকে ফেরার পথে আমাদের সামনেই একটা গাড়ির প্রচন্ড জো*রে গাছের সঙ্গে বারি লেগেছিল। আমরা অনেকে ছিলাম। ভয় পেয়ে গেছিলাম প্রত্যেকে। হুশ ফিরতেই তিনজন ছুটে গেলাম সেদিকে। বাকিরা ঝামেলা পোহানোর ভ*য়ে প্রস্থান নিলো। ভেতরের লোকটির সারা মুখ তখন র*ক্তে মাখা। চেহারাটা বোঝা যায়নি ঠিকঠাক। লোকটাকে বাঁ*চাতে হবে ভাবতে থাকা আমার মস্তিস্ক খেয়ালও করেনি ভালো করে। কয়েকজন মিলে ওনাকে হাসপাতালে নিতে সক্ষম হই। ডাক্তার জানালেন ওনার অবস্থা খা*রাপের দিকে। রক্ত লাগবে। আমি চটপট বলে দিলাম ‘আমার থেকে নিন’।
ওইদিন আপুর জন্মদিন থাকায় বাড়ি থেকে একের পর এক ফোন আসছিল। হাসপাতালে আছি বলতেও পারছিলাম না। অথচ সারা জামা ভর্তি লোকটির র*ক্তে। যখন শুনলাম রোগীর অবস্থা ভালোর দিকে, ফিরে এলাম বাড়িতে। র*ক্ত নিয়ে হাজারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছিল।
তারপর দিন লোকটাকে দেখতে যেতে গেলেও শুনলাম ওনার বাড়ির লোক ওনাকে অন্য ক্লিনিকে শিফট করেছেন। যেটা বেশ দূরে। আমি আর যাইনি। ফিরে আসি। পরপর দিন গেলে ভুলে গেলাম সেই ঘটনা। অথচ ওই লোকটাই ছিলেন রুদ্র?
আমি তখনও হা করে চেয়ে। বিস্ময়াভিভূত হয়ে বললাম,
” এক বছর ধরে ভালোবাসেন আমায়?”
উনি মাথা দোলালেন।
আমি ভাবছি।খুব ভাবছি। আড়ালে থেকে একটা মানুষ আমায় ফলো করলো, রোজ দেখল,আর আমি বোকারাম টেরও পেলাম না? কী আশ্চর্য!
আমার ভাবনায় ডুবে থাকা মন নড়ে উঠল ওনার হাতের স্পর্শে। আমি তাকালাম। উনি গভীর চোখে চেয়ে বললেন,
” একটা বছর আপনার কাছে আসার অপেক্ষা করেছি। আপনি আসেননি। এখন আমি এলাম। ফিরিয়ে দেবেন? কাছে টানবেন না?”
আমি তৎক্ষনাৎ কিছু বলতে পারলাম না।চুপ করে রইলাম। উনি কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললেন,
” একবার ভালোবেসে দেখুন,ঠকবেন না। ”
আমি স্থির হয়ে বললাম,
” সময় লাগবে। ”
উনি একটু হেসে বললেন,
” দিলাম সময়। আদৌ সেদিন আসবে কী না কে জানে,যেদিন আমায় কাছে টেনে বলবেন ” ভালোবাসি রুদ্র”।
আজ আমাদের সংসারের তিন বছর। আর এখন আমি ওই মানুষটাকেই পাগলের মতো ভালোবাসি। যত দিন পার হয় আমার ভালোবাসা আকাশের মত সীমা ছাড়ায়,পাহাড় ডিঙায়,পায় সমুদ্র সম গভীরতা।
এখন তার উষ্ণ বুকে মাথা না রেখে ঘুমালে আমার রাত কাটেনা। ভীষণ ভোরে সবার আগে তার নিরেট চিবুক না দেখলে দিন ভালো যায়না। আমি প্রতিদিন একটু একটু করে তার প্রেমে পড়েছি। হয়ে উঠেছি তার ❝ প্রণয়িনী❞। আমার ইচ্ছে,শেষ নিঃশ্বাস অবধি তার অন্তকরনে আমার অস্তিত্ব থাকুক। যেখানে তার প্রণয়রসে আমি সিক্ত হব বহুবার।
লেখা শেষ করে সেঁজুতি দাঁড়ি টানল। একবার তাকাল দেয়ালে টাঙানো বিশাল ফ্রেমের ছবির দিকে। সেই ছবিটা,যেটা বিয়ের দিন তুলেছিল রুদ্র। ক্ষীন হেসে দাঁড়িয়ে সে,আর সেঁজুতির ঠোঁটে হাসি বিলুপ্ত। অথচ এটাই সেঁজুতির সবচেয়ে পছন্দের ছবি৷ এই তিন বছরে তিন লক্ষ ছবির চেয়ে এটাতেই যেন খুঁজে পায় মিশ্র অনুভূতি। ভাগ্যিশ সেদিন উনি বিয়েটা করেছিলেন,নাহলে এই চমৎকার মানুষটা মিস হয়ে যেত। সেঁজুতি প্রসন্ন শ্বাস টানল।ডায়েরীটাকে ড্রয়ারে রেখে উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই পেছন থেকে দুটো শক্ত হাত জড়িয়ে ধরল। স্পর্শ পেতেই সেঁজুতি বুঝে ফেলল এটা কে!
মুচকি হেসে বলল,
” কখন এলেন?”
রুদ্র তার চুলের ভাজে নাক ঘষে জবাব দেয়,
” এক্ষুনি।”
” ফ্রেশ হবেন না? ”
” তুমিই আমার ফ্রেশনেস।”
সেঁজুতি লজ্জ্বা পায়। একটু চুপ থেকে বলে,
” শুনুন?”
” হু।”
” ভালোবাসি।”
” আমিও ভালোবাসি। তবে তোমার থেকেও বহুগুন বেশি।”
” কেন এত ভালোবাসেন?”
রুদ্রর হাতের বাঁধন দৃঢ় হয় আরো। সেঁজুতির কাধে থুত্নী গুঁজে উত্তর দেয়,
” কারন তুমি আমার সন্ধ্যাপ্রদীপ, আমার সেঁজুতি, আমার প্রণয়ে আসক্ত ‘ প্রণয়িনী’।”
সমাপ্ত।