গল্প- প্রণয়ের তৃষ্ণা
পর্ব- ১
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহ
বাচ্চা না হওয়ার অপরাধে শ্বশুর বাড়ি থেকে বিতারিত হতে হলো রুজিনাকে। দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে সে ব্যাগ গোছাচ্ছে। স্বামীকে ছেড়ে চলে যেতে হবে,এটা ভেবে খুব বেশি কষ্ট লাগছে না তার। তার স্বামী আখতার মিয়া বদরাগী, মেজাজী এবং পিচাশ স্বভাবের মানুষ। প্রতি রাতে বউ পি’টা’নো তার কাছে মহৎ কাজ যেন। তবে রুজিনার খারাপ লাগছে এত বছর ধরে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা সংসারটার জন্যে। সে যখন এই বাড়িতে বউ হয়ে আসে তখন তার বয়স উনিশ। চারিদিকে তখন লজ্জা আর লজ্জা। উনিশ বছর হয়ে গেছে তবুও মেয়ের বিয়ে হয় না এখনো- এর চেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় যেন দ্বিতীয়টি নেই পৃথিবীতে। তার চেয়েও ছোট বয়সের মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়, সংসার হয়, বাচ্চাও হয়। রুজিনা দিনরাত চোখের পানি ফেলে সেসব দেখে আর কাঁদে। অবশেষে আল্লাহ তার দোয়া কবুল করে নিয়েছিলেন। এক ভাদ্রের কাঠফাটা দুপুরে হুট করে তিনজন মুরুব্বি আসেন। রুজিনাকে ভালো পোশাক পরিয়ে তাদের সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। খানিক বাদে একটি নাকফুল নাকে পরিয়ে,হাতে একশো টাকার তিনটা নোট গুঁজে দিয়ে তিন কবুলের মাধ্যমে রুজিনাকে সেদিনই নিয়ে যাওয়া হয় শ্বশুর বাড়ি। স্বামীকে তখনো দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তবুও রুজিনা খুশি ছিল এই ভেবে,অবশেষে সমাজের শত শত কথার কাঁটা থেকে নিজেকে তো মুক্ত করা গেল। কিন্তু নিশিতে যখন স্বামীর চেহারা দেখার সৌভাগ্য হয়, রুজিনার মাথা ঘুরে উঠে। তার চাইতেও দ্বিগুণ বয়সী একজন! চেহারায় মায়াদয়ার ছিঁটেফোঁটা নেই। কেমন কর্কশ কণ্ঠস্বর। রুক্ষ চাউনি। তার বলিষ্ঠ পেশী রুজিনাকে কাঁপিয়ে তুলল। বউয়ের সঙ্গে দুটো আলাপচারিতার সময়টুকু হলো না আখতারের, ঝাপিয়ে পড়ল বাঘের মতো। ছিঁড়েছুঁড়ে খেয়ে সে তলিয়ে গেল গভীর নিদ্রায়। ঘুম কেড়ে নিলো রুজিনার চোখ থেকে। তারপর…কেটে গেছে আটটি বছর। আজ রুজিনার বয়স সাতাশ। শহরে এই বয়সে অনেকেরই বিয়েও হয় না হয়তো। অথচ সে এই বয়সেই তালাকের ট্যাগ গায়ে লাগিয়ে যাত্রা করেছে নিজের বাপের ভিটায়। যদিও সে জানে না,সেখানেও তার জায়গা হবে কী না। অথবা হলেও কী কী অপেক্ষা করছে সামনে! গরুর গাড়ি ছাড়ার সময় বড় নারকেল গাছটা চোখে ভাসে রুজিনার। অস্পষ্ট চোখ মেলে তাকিয়ে রয় সে। আর কোনোদিন দেখা হবে না তাদের। এই গাছপালা, উঠোন, বাড়িটা, কলপাড়ে অবহেলায় পড়ে থাকা বদনীটা, ওই দূরে কককক করে ঘুরতে থাকা বড় মোরগটা, পুকুরে ঝিম ধরা হাসের পাল, চালের উপরে কবুতরের ঘর- সবই যে প্রিয়, চেনা। সব ফেলে চিরদিনের জন্য চলে যেতে হচ্ছে। হায়! এ কষ্ট কাকে বোঝাবে সে? আরেকখানি অদ্ভুত বিষয়, এই বাড়িতে সে প্রথম এসেছিল এক ভাদ্রে, যাচ্ছেও আরেক ভাদ্র মাসে!
নেকাবের তল দিয়ে চোখজোড়া ভিজে চলে অবিরত। ধীরে ধীরে বাড়ি দৃষ্টি সীমানার দূরে চলে যায়। রুজিনা চোখ ঘুরিয়ে নিলো। পথেই যদি মালাকুল মউত দেখা দিতো, তবে কী খুব ক্ষতি হতো?
_____
‘মা** টারে বাইর কইরা দিয়া কী যে শান্তি পাইতাছি মনু মিয়া। আর কইয়ো না।’ এক দলা থুতু উঠোনে ফেলে কর্কশ কণ্ঠটি নাড়ালেন আখতার।
মনু মিয়া চালের ব্যবসায়ী, আখতারের বন্ধু মানুষ। গালের ভাঁজে পান গুঁজে আছে। চিবাতে চিবাতে উত্তর এলো, ‘তোমারে তো বহুত আগেই কইছিলাম মিয়া। ছাইড়া দেও। এতদিন যে এই বাড়িত থাকবার পারছে এইডাই ওর কপাল। মাইয়াডা কেমন ছতরবতর, ভালা না। আমার তো মনে অয়,দোষও আছে।’
‘অখন ওইডি ভাইবা আর কাম নাই গা। আমার আবার বিয়া করা লাগবো। মাইয়া দেহো।’
মনু মিয়া নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে বললেন, ‘আমরার উপর ছাইড়া দাও। তুমি আমার বন্ধু মানুষ। তোমার লইগা আমি আরও আগে হইতেই মাইয়া পছন্দ কইরা রাখছি। এহন কথা হইলো হেই ছেড়ি তোমার পছন্দ হইবো কী-না, এইডা দেহার বিষয়।’
আখতার উৎসুক কণ্ঠে বললেন, ‘কেডা? কার কথা কও? আমি চিনি?’
‘হুম, চিনো।’ মাথা নাড়লেন মনু। ‘ওয়াক থু’ করে পানের চিপটি মাটিতে ফেলে হাত দিয়ে মুখ মুছে নিলেন। বললেন, ‘হাসমতের ছোডো মাইয়াডার কতা কই।’
আখতার চমকে উঠলেন। হাসমত আলী এলাকার সামান্য এক দরিদ্র কৃষক। দিন এনে দিন খায় অবস্থা। তার দুই মেয়ে, তিন ছেলে। বড় দুই ছেলের পর এক মেয়ে,তারপর এক ছেলের পরে সবার শেষে ছোট একটা মেয়ে। মেয়েটা ভালোই। রূপেও আছে,গুণেও আছে। গায়ের রংটা ফ্যাকাশে ফর্সা। শারীরিক গঠন পাতলা। তোতা পাখির মতো কথা বলে সারাক্ষণ। আখতারদের দোকানে প্রায়ই আসে।
‘চাচা, এক পোয়া তেল দিয়েন, আর পাঁচ টাকার লবণ’ কী সুন্দর রিনরিনে সুরে বলে। কিন্তু কখনো এভাবে ভাবা হয়নি। ওই চোখে দেখাও হয়নি। মনু মিয়া বলায় কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগলো আখতারের কাছে।
আখতারের মুখের চাপা হাসি মনু মিয়ার চোখ এড়ায় না। বিদ্রুপ কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘কী মিয়া, স্বপ্নে হারাই গেলা নাকি?’
ঠেস খেয়ে আখতার হো হো করে হেসে উঠলেন।
‘কিন্তু মাইয়াডা বেশি ছোডো হইয়া যায় না ভাই?’
প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন তিনি। মনু মিয়া মশা তাড়াবার মতো অঙ্গভঙ্গি করে বললেন, ‘বয়স বাদ দাও। সতারো তো হইছেই ছেড়ির। দামড়া হইয়া গেছে আরও দুই বছর আগেই। যৌতুক দিতে পারে না দেইখা মাইয়া বিয়াও দিতে পারে না ওর বাপে। আর হুনো, ছোট ছেড়িই ভালো। বিয়া কইরাই বাচ্চা লইয়া লইবা। কম বয়সে বাচ্চা হওয়ার চান্স ভালো থাকে মিয়া। তোমারে কী বুঝাইয়া কইতে হইবো আরও?’
‘ন..না। আমি বুজছি। ওর বাপের লগে কতা কইবো কেডায়?’
‘আমি আছি কী করতে ভাই? আমি কতা কমু। তুমি কইলে আজকেই কমু।’
আখতার ভেবেচিন্তে বললেন, ‘বিয়া যখন করতেই চাই,তহন দেড়ি কইরা লাভ কী? তুমি আজকেই কতাডা তোলো ভাই। দরকার পড়লে হাসমতরে আমার কাছে নিয়া আহো। আমি তারে বুঝাইয়া কই।’
‘মিয়া, হাসমত আবার কী? শ্বশুর আব্বা কও।’
মনু মিয়া সব গুলো দাঁত বের করে হেসে উঠেন। আখতারও হাসেন। তিনি স্বপ্নলোকে দেখতে পান, তার উঠোনে রিনঝিন শব্দ তুলে এক জোড়া আলতা মাখা পা ছুটে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। দিনের বেলার চঞ্চল কিশোরী রাতের বেলায় তার নারী হয়ে উঠবে!
_____
দশটাকা দিয়ে কেনা সস্তা নূপুর জোড়া ঝুনঝুন করে বাজছে। উঠোন দাপিয়ে ঘরে প্রবেশ করে পুতুল। দেখতেও পুতুলের মতো। তার সর্বাঙ্গে যৌবনের ঢেউ। বাতাসের দাপটে এলোমেলো চুলগুলো আরও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। হাতে কাঁচা আম, আয়েশ করে তাতে কামড় বসিয়েছে কী বসায়নি, ওমনি রান্নাঘর থেকে একটা বাটি উড়ে এসে পুতুলের পায়ের কাছে পড়ল।
‘নটির সময় হইছে বাসায় আসোনের?’ পারুল চিল্লিয়ে উঠে। পুতুল মাথা হেট করে দাঁড়াল। হাতের আমখানি নিজের পিছনে লুকিয়ে নিলো দ্রুত। কেন যেন গাছ থেকে কাঁচা আম পেড়ে খাওয়াটা তার মা একদমই পছন্দ করেন না। দেখলেই চিল্লাচিল্লি টা আরও বেড়ে যাবে। বাড়িতে বাবাও নেই। পিঠে তাল পড়লে কেউ আসবে না ধরতে। এরচেয়ে চুপচাপ থাকাটাই শ্রেয়।
পারুল হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন। দাঁত খিটমিট করে মেয়ের কান পাকড়াও করলেন। বজ্রকণ্ঠে বললেন, ‘কই ছিলি? বাজে কয়টা? আমি কী তোগো বান্দী লাগি? পুকুর ঘাটে এহনো ভেজা কাপড় গুলান পইড়া রইছে। কেডায় ধুইবো? আমি রান্ধুম নাকী কাপড় ধমু?’ একাধারে গজগজ করে চললেন। এক ফাঁকে পুতুল মিনমিনে কণ্ঠে বলল, ‘আমি এক্ষনি করতাছি আম্মা।’ তারপর ছুটে পালালো। কিন্তু বিধিবাম। দৌড়ের সময় হাত ফসকে আধখাওয়া আমখানা পড়ে নিচে গড়াগড়ি খেলো বার তিনেক। পারুলের দৃষ্টি এড়ায় না। তিনি তেড়ে গেলে পুতুল ভো-দৌড়ে পুকুর পাড়ে এসে থামল। বার কয়েক দম নিয়ে একটু জিরোয়। ছোট্ট পুকুরটি প্রায় পয়তাল্লিশ বছর আগে তার বাবা-দাদারা মিলে খনন করেছিল। কথা ছিল ইট,বালু,সিমেন্ট৷ দিয়ে শান বাঁধানো সিড়িঘাট দেওয়া হবে পরে। কিন্তু টাকার অভাবে কোনোকালেই তা সম্ভব হয়নি। আজও খেজুর গাছের বাকল এবং মোটা শক্ত বাঁশ দিয়েই ঘাট বাঁধা। ঘরের যাবতীয় পানির কাজ এখান থেকে পানি নিয়েই সমাপ্ত করা হয়। শুধু খাওয়ার পানি আনা হয় আখতার চাচাদের বাড়ি থেকে। কাছাকাছির মধ্যে তাদের বাড়িতেই চাপকল আছে। প্রায় পনেরোটা বাড়ি তাদের কাছ থেকেই প্রতিদিন পানি নেয়। বিনিময়ে মাসে দুইশো টাকা করেও দিতে হয়। পুতুলদের থেকে অবশ্য একশো করে নেয়। তার বাবার দুইশো টাকা দেওয়ার ক্ষমতাও নেই।
পুতুল ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে। বাঁশের হাতলে শক্ত হাত রেখে সাবধানে নামতে লাগল। পুকুরের ওপাশে নারিকেল পাতার ছাউনি। ওখানে খুঁচখুঁচ আওয়াজ হয়। পুতুল তাকিয়ে জোর গলায় ডেকে উঠল, ‘কে রে?’
‘আমরা..’ বলে তিন চার জোড়া চোখ উঁকি দিলো। রতন, কালু, শাপলা আর গোলাপী। পুতুলের চেয়ে বয়সে অনেকটাই ছোট কিন্তু বন্ধু। শাপলা আঁচলের তলা থেকে ছোট ব্যাঙের বাচ্চা বের করে দাঁত খিলিয়ে হাসে। পুতুলের চোখ চকচক করে উঠে। কালুর বড় ভাইটা ভীষণ পাজি। কালুকে সবসময় ধরে ধরে মারে৷ কিচ্ছুতে ভয় পায় না। শুধুমাত্র এই ব্যাঙের বাচ্চা দেখলেই হাউ হাউ করে লাফিয়ে উঠে। গতরাতেও কালুকে ভীষণ কেলানি দিয়েছে। শোধ হিসেবে তাকে ব্যাঙের বাচ্চা দিয়ে ভয় দেখানোর বুদ্ধিটা পুতুলই দিয়েছে। সেই ব্যাঙের বাচ্চার খোঁজ করতে গিয়েই সকাল থেকে বাগানে বাগানে সময় কাটাতে হয়েছে তাদের। খেয়ালই ছিল না,বাড়িতে এত কাজ পড়ে রয়েছে। যাইহোক, অবশেষে কাঙ্ক্ষিত জিনিস পাওয়া গেল। কালুর বড় ভাই আলুর ভয়ার্ত মুখখানা মনে মনে ভাবতেই পুতুলের ঠোঁট চিঁড়ে খিকখিক করে হাসি বেরোয়। সাঙ্গ-পাঙ্গরাও বোধহয় একই জিনিস ভাবছিল। তারাও হেসে উঠল। ঠিক তখনই পারুলের বজ্রকণ্ঠ শোনা যায় হেঁশেল ঘর থেকে, ‘কেডারে? কেডায় হাসে?’
পুতুল দ্রুত হাসি থামাল। ঘাট থেকে উঠে কালুদের পাশে এসে দাঁড়ায়। ফিসফিস করে বলল, ‘তোরা যা। বিকালে আইতাছি। সন্ধ্যার পর তোর ভাই যখন দোকান দিয়া ফিরবো, ডর ডা তহন দেহামু। রাইতের অন্ধকারে গায়ের উপরে ব্যাঙের ছাও উইঠা আইবো। কেমনে চিল্লাইবো দেহিস।’
শাপলা প্রফুল্লচিত্তে বলল, ‘ইশরে, আমগো যদি একটা ক্যামেরা থাকতো, তাইলে ভিডিও কইরা রাখতে পারতাম। পরে জিনিসটা দেহাইতাম আর মজা লইতাম।’
‘সাব্বিরের ক্যামেরা আছে।’ ফট করে বলে উঠে রতন।
‘অয় দিবো না। ওর ক্যামেরার দাম আছে। আমগো তো ঠিক মতো ধরতেই দিলো না, আর দিবো ছবি তুলার লইগা? বাদ দে। লাগবো না ছবি তুলা। আমাগো মিশন আলু ভাইরে ডর দেহানো। হেইডা দেহাইতে পারলেই হইলো।’ বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে নেড়ে কথাগুলো বাকিদের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিলো পুতুল। তার কথায় বাকি সবাই একমত হলো। আলু ভাইকে ভয় দেখিয়ে ছেড়ে দিলেই হবে। তবে ভয়টা এমন ভাবে দেখাতে হবে যেন ভয়ের চোটে প্রস্রাব করে ফেলে। আগামী কয়েকদিন ঘর থেকে বাহির হতেই দুই তিনবার ভাববে আশা করা যায়। আলু ভাইয়ের এরকম করুণ অবস্থা বানাতে পারলেই ওরা খুশি। আর কিচ্ছুটির দরকার নেই। আলু ভাইয়ের ভালো নাম আলাল হোসেন। কালুর ভালো নাম কালাম হোসেন। তবে ওরা কালু আর আলু নামেই গ্রামে পরিচিত বেশি।
পুতুল বলল, ‘তোরা এখন যা। আমার অনেকডি কাজ পইড়া আছে। মায়ে এট্টুপর আইয়া দেখবো। আমি বিকালে আহুমনি।’
‘এইডারে কই রাহুম ততক্ষণ?’ ব্যাঙের বাচ্চাটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে প্রশ্ন ছোঁড়ে শাপলা। পুতুল ভেবে উত্তর দিলো, ‘রতনের বাড়িত রাখা যাইবো?’
রতন ঘাবড়ালো। সে নিজেও এসব ভয় পায় একটু একটু। কিন্তু মনে সাহস জোগাড় করে বলল, ‘খড়ের গাদায় লুকাইয়ে রাখা যাইবো।’
‘নে শাপলা, ওরে দিয়া দে। বিকাল পর্যন্ত ও-ই রাখুক। এহন যে যার বাড়িত যা। বিকালে দেহা হইতাছে।’
সবাই খুঁচখুঁচ শব্দ তুলে যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই আবার ফিরতি যাত্রা করল। পুতুল ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঘাটে ফিরে এলো। পানিতে পা ছড়িয়ে দিয়ে বসল কাপড় গুলো ধুয়েমুছে পরিষ্কার করার জন্য।
_____
বেলা পড়ে গেছে। কতগুলো কাক একযোগে কা কা করতে করতে উড়ে চলল দক্ষিণ দিকে। হাসমত আলী বা হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন। ‘হুফ’ শব্দে একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের কোঁচের দিকে তাকালেন। চারশো টাকার একটা নোট সেখানে পড়ে আছে। বাড়িতে চাল নেই। অল্প কিছু চাল আর ডাল নিয়ে যেতে হবে আখতারদের দোকান থেকে। সবজিটা পারুল নিশ্চয়ই এখান ওখান থেকে জোগাড় করে ফেলবে। কালকের দিনটা হয়ে যাবে। একদম বড় ছেলেটার খোঁজ নেই প্রায় তিন মাস হতে চললো। মেজোজন কোনো কাজে কামে মন দেয় না। সারাক্ষণ ঘুরঘুর করছে। ছোট ছেলেটাও বড় ভাই দুটোর মতো বখাটে হয়ে যাচ্ছে। বড় মেয়েটাকে এক মিস্ত্রির কাছে বিয়ে দিয়েছে অনেক কষ্টে। সেখানে যেমনই হোক, ভালো আছে বলা যায়। এখন তার সব চিন্তা ছোট মেয়ে পুতুল টাকে নিয়ে। এত সুন্দর মেয়ে,তাও কেউ বিয়ের জন্য এগিয়ে আসে না। আজকাল কী সৌন্দর্যেরও দাম কমে গেছে? যে-ই আসে বিয়ের প্রস্তাব, সবাই যৌতুক চায়। সর্বশেষ যে এসেছিল, সেও এক লাখ টাকা নগদ এবং একটি টিভি আর একটি ফ্রিজ চেয়েছে। বিনিময়ে মেয়েকে এক ভরি স্বর্ণ দিয়ে তুলে নিয়ে যাবে। হাসমত আলীর বুকে ব্যথা ব্যথা লাগে। যখনই এসব ভাবনায় বসে তখনই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠে। তার মাঝে মাঝে মনে হয়, খোকনের বড় মেয়েটার মতো কারো সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নিলেও বোধহয় সে বেঁচে যেতো। কন্যাদায় যে বড় দায়! পিতা হয়ে সে এইধরনের কথা ভাবছে, ভেবে কিছুটা ধিক্কার ও জানায় নিজেকে। মাথা গোঁজ করে হাঁটা লাগায় সম্মুখ পানে, আখতারদের দোকানে…
‘আরে চাচাজান আপনে? আহেন আহেন, দোকানের ভিতরে আহেন। এই একটা চেয়ার মুইছা দে চাচারে। হেরে বইতে দে।’ আখতার হাঁকডাক পাড়তে লাগল। হাসমত আলী চমকে উঠলেন। জীবনেও তাকে ঠিক ভাবে লক্ষ্য না করা মানুষ টা আজকে এত খাতির যত্ন করছে কেন? নিশ্চয়ই এর ভেতরে কোনো কিন্তু আছে! তার উপর তাকে সবসময় ভাই বলে ডেকে আসা লোক, নাম ধরে ডেকে আসাও লোক, সে আজ হঠাৎ চাচা বলে কেন সম্বোধন করছে! হাসমত আলী জুবুথুবু কণ্ঠে বলেন, ‘থাক, আমি এইহানেই ঠিক আছি।’
‘তা তো হয় না। আপনে ভেতরে আসেন। আপনার সাথে জরুরি কথা আছে।’
অগত্যা হাসমত আলী ভেতরে গিয়ে বসলেন। জড়তার সহিত এদিক ওদিক চেয়ে রইলেন। একবার চাইলেন, আজ অন্য দোকান থেকে সদাই কিনে চলে যাক, আখতার নিশ্চয়ই পানির বিল নিয়ে কিছু একটা বলতে চায়। আর কতদিন তার একশো টাকা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে সে? নিশ্চয়ই আজ থেকে তাকেও অন্যদের মতো দুইশো টাকা বিল মিটাতে হবে। খানিকটা উৎকণ্ঠা নিয়ে আখতারের মুখপানে চেয়ে রয় হাসমত আলী। আখতার দোকানের বাহিরের কাজ সম্পাদন করে হাসমত আলীর সামনে এসে বসলেন। তার ঠোঁটের কোণায় মুচকি হাসি। বললেন, ‘তা, কেমন আছেন চাচাজান? বাড়িত সবাই ভালো?’
‘ভা..ভালো।’ হাসমতের শুকনো কণ্ঠস্বর।
‘আপনি কী ডরাইতাছেন? আরে ডরাইয়েন না। আমি একটা কথা কওনের লইগা আপনারে ডাকছি।’
‘কী কথা, কও।’
হাসমত আলী গোপনে ঢোক গিলেন। মাস শেষে দুইশো টাকা পানির বিল দেওয়া তার জন্য অনেক কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। গ্রামের বাড়িতে থাকে বলে, বাপ দাদার ভিটাটুকু আছে বলেই এখনো ছেলে মেয়ে বউ নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি। নইলে অনেক আগেই হয়তো পৃথিবী থেকে একটি পরিবারকে অকালে ঝড়ে যেতে হতো। দারিদ্রের অভিশাপ, এর কষ্ট, তিনি চাইলেও কাউকে বোঝাতে পারবেন না যদি না কেউ নিজ থেকে এইরকম পরিস্থিতিতে পড়ে।
কিন্তু আখতার যা বলল, তা শুনে হাসমত আলীর টনক নড়ে উঠল। তিনি ফ্যালফ্যাল করে আখতারের মুখপানে চেয়ে রইলেন। তার সবচেয়ে আদরের ফুলটাকে এই বুড়ো শকুন টা চেয়ে বসেছে! এটা কী করে হয়? তিনি পিতা হয়ে কী পারবেন এই কাজ করতে? কক্ষনো না…
(চলবে)