#প্রণয়ের_ঢেউ (২য় খন্ড)
#Part_ 10 (প্রথম অংশ)
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
[গত পর্বের নিচের খানিকটা অংশ বিয়োজন করা হয়েছে। তাই ওই পর্বের শেষ থেকে আজকের পর্ব শুরু হয়নি।]
সময়ের চক্র ঘুরতে ঘুরতে কখন যে দিন, মাস পেরিয়ে বছরে বছরে চলতে শুরু করেছে বহু আগেই। সকলেই সময়ের স্রোতের সাথে গা ভাসিয়ে চলতে চলতেই নিমিষে হারিয়ে গেল তাদের জীবন থেকে তিনটি বছর। হারিয়ে গেল কিছু স্মৃতি, মূহুর্ত, আবেগও। সম্পর্কের মান হলো পরিবর্তন৷ খারাপ-ভালো মিলেই গড়ে উঠলো নতুন প্রহরের যাত্রা।
মৃদু মৃদু বাতাসের ধাক্কায় দুলছে জানালার আকাশি রঙের পর্দাগুলো। কর্ণকুহরে এসে বারি খাচ্ছে উইন্ড চিমের টিংটিং শব্দ। মিঠা রোদ্দুরের সরু রশ্মি জানালার কাঁচ ভেদ করে দ্যুতি গায়ে পরশ বুলাচ্ছে। দ্যুতি আনমনে বইয়ের পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে আর কলম দিয়ে খাতায় ঘর্ষণ চালাচ্ছে। মিনিট দুয়েক না পেরুতেই দ্যুতির ফোনে হোয়াটসঅ্যাপের রিংটোন বেজে উঠলো। দ্যুতি সচকিত দৃষ্টি মোবাইলের দিকে তাকায়। চোখের চশমা নাকের দগায় উঠিয়ে হাত উঁচিয়ে খাটের উপর থেকে মোবাইলটা হাতে নিল। মুঠোফোনের কৃত্রিম আলোয় ভাসছে দিহানের নাম, ভিডিও কল করেছে সে। দিহানের নাম দেখে দ্যুতি কিঞ্চিৎ হাসলো, ফট করে রিসিভ করলো কলটি৷ সাথে সাথে প্রদর্শিত হলো দিহানের বিমর্ষ মুখখানাটি। দ্যুতি তা দেখে কিছু বলতে যাবে তার আগে দিহান কর্কশ কন্ঠে বলে উঠলো,
— আসলি না আর তাই না? ভিনদেশে গিয়ে তোর দাম এত বেড়ে গেল যে নিজের ভাইয়ের বিয়েতে আসাটা পর্যন্ত একবার দরকারবোধ করলি না? এই তোর ভালোবাসা আমার প্রতি? থাক, আর আসা লাগবেও না তোর৷ সেখানেই থেকে পঁচে গলে মরে যা তুই। একবারে মিশে যা ওই মাটির সাথে।
দ্যুতি স্মিত স্বরে বললো,
— নিজের ভাইয়ের বিয়ে কোন বোন মিস করতে চায় বলতো? কেউ কি আদৌ চায়? ভিসার প্রবলেমের জন্যই তো আটকা পড়ে গেলাম। সেটা ঠিক হতো এখনো আরও দুই মাসের মত লাগবে৷
— সব তোরই দোষ। তুই কেন আগে ভাগে সব ডকুমেন্ট চেক করিস নি? আগে সব ঠিকঠাক দেখে রাখলে লাস্ট মোমেন্টে এসে এই ঝামেলা হতো না।
— আজব তো! আমি কি জানতাম নাকি যে এমন হবে?
দিহান অকপট রাগ দেখিয়ে বলে,
— জানিসটা কি তুই?
— বাদ দাও না, যা হওয়ার তো হয়েছেই। আমি নেই তো কি হয়েছে, বাকিরা আছে না? এমনেও আজ না তোমার বিয়ে? কই হাসিখুশি থাকবা তা না, বাংলা প্যাঁচার মত মুখ করে রেখেছ। নট ডান ব্রো!
— সবই তোর ডান৷
দ্যুতি কিঞ্চিৎ হেসে বলে,
– ভুলে যেও না এইটা তোমার প্রেমের বিয়ে। তোমার জন্য বিয়ের ফটোসুট খারাপ হলে ফাইজাপু তোমাকে বাসর রাতে ডিটার্জেন্ট ছাড়াই ধুয়ে দিবে কিন্তু, মনে রেখ৷ এমন নাহয়, রুমের বাইরেই সারারাত কাটাতে হয়।
কথাটা বলে দুটি ঠোঁট চেপে হাসলো। তা দেখে দিহান চোখ গরম করে বলে,
— বড় ভাইয়ের সাথে এইভাবে কথা বলতে লজ্জা করে না তোর? বিদেশ গিয়ে কি সব আদব-কায়দা খেয়ে হজম করে আছিস? এই তোকে এই জন্য আমি বিদেশ পাঠিয়েছিলাম? বেদ্দব মেয়ে।
— তা আপনি মনে হয় ভদ্র মশাই?
— অবশ্যই! আমার মত ভদ্র ছেলে আর দু’টা পাবি এই গ্রহে?
দ্যুতি কিঞ্চিৎ হেসে মাথা দুই দিকে দুলিয়ে না সূচক উত্তর দেয়। অতঃপর বলে,
— বরযাত্রী বেরুবে কখন?
— এইতো, আধা ঘন্টার মাঝে৷
দুটি কিছুটা সময় চুপ থেকে মিনমিনে বলল,
— আমাকে কিন্তু বিয়ের সকল ছবি ভিডিও দিতে ভুলবা না।
দিহান হালকা হেসে বললো,
— আচ্ছা।
— রেডি হয়ে নাও, নাহলে পরে দেরি হয়ে যাবে৷
— আমি রেডিই আছি, শুধু শেরওয়ানিটাই পড়া বাকি।
— তাহলে এখন একটু পড়ো না, আমিও তো দেখি আমার ভাইকে বর বেশে কেমন লাগে। পরে তো তোমরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়বে, তখন আর দেখার সুযোগ হবে না।
কথাটা দ্যুতি একটু বিষন্ন গলাতেই বললো। দিহান তা বুঝতে পেরে বলে,
— আচ্ছা, তুই লাইনে থাক। আমি রেডি হয়ে তোকে দেখাচ্ছি৷
দ্যুতি মুখে কিছু না বলে খালি মাথা নাড়লো। দিহান মোবাইলটা টেবিলের উপর রেখে শেরওয়ানিটা পড়তে শুরু করলো। দ্যুতি একপলক দিহানকে দেখে নজর বুলাতে থাকলো বইয়ের পাতার উপর। হঠাৎ কর্ণকুহরে অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর এসে বারি খেতেই দ্যুতির বুকটা ধক করে উঠে, মনটা হয়ে উঠে বিচলিত। কিছুটা সময় স্থির থেকেই দ্যুতি সচকিত দৃষ্টিতে তাকায় মোবাইল স্ক্রিনের দিকে। ক্ষণেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটির মুখশ্রী মোবাইলের পর্দাতে ভেসে উঠতে দ্যুতির মনের মাঝে বয়ে যায় শীতল হাওয়া। আনমনে দেখতে থাকে মানুষটিকে। আজ প্রায় তিন বছর পাঁচ মাস উনিশ দিন পর সে দেখছে মানুষটিকে। দেশ ছাড়ার পর পরই তো সকল যোগাযোগ ছিন্ন করেছিল সে তার থেকে,দেখবেই বা কিভাবে সে? দ্যুতি একমনে দেখছে অরণ্যকে। অরণ্য দিহানের সামনে দাঁড়িয়েই কথা বলছে।
— এই নে, জুসটা খেয়ে নে।
দিহান শেরওয়ানিটা হাতে নিতে নিতে বললো,
— সাইডে রাখ, পরে খাচ্ছি। আপাতত আমাকে শেরওয়ানিটা পড়তে হ্যাল্প কর।
— এখনই শেরওয়ানি গায়ে দিচ্ছিস যে? যেতে তো আরেকটু দেরি আছে।
— দ্যুতি দেখতে চেয়েছে তাই, কলেই আছে।
দ্যুতির নামটা শুনেই অরণ্য থমকে দাঁড়ায়, চোখের দৃষ্টি আপনা-আপনি শীতল হয়ে আসে। হৃদস্পন্দনের গতি বেড়ে যায় ক্ষণেই। দিহান মোবাইলের দিকে ইশারা করতেই অরণ্য ধীর গতিতে তাকায় সেদিকে। দ্যুতি অরণ্যের পানেই তাকিয়ে ছিল বিধায় পরস্পরের দৃষ্টি মিলিত হয় এক সুতোয়। দ্যুতি অপ্রস্তুত হয়ে স্মিত হেসে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। কিন্তু অরণ্য তখনও তাকিয়ে দ্যুতির পানে। একমনে,এক দৃষ্টিতে। তৃষ্ণা মিটাতে থাকে নয়ন দু’টির ও মনের। কিন্তু আদৌ কি এই তৃষ্ণা মেটার? হঠাৎ দিহানের কন্ঠে অরণ্যের ঘোর ভাঙ্গে,সচকিত দৃষ্টিতে তাকায় দিহানের দিকে।
— শেরওয়ানিটা ধর পড়ব আমি।
অরণ্য মাথা হেলিয়ে দিহানকে শেরওয়ানিটা পড়তে সাহায্য করে। শেরওয়ানি পড়া হতেই দিহান পাগড়িটা পরে মোবাইল হাতে নিয়ে বলে,
— দেখ কেমন লাগছে?
দ্যুতি ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,
— একদম হিরো আলম লাগছে৷
দিহান ফুঁসে উঠে বলে,
— আহা! কত ভালো মন্তব্য দিলি রে। আমার তো পরাণ-মন সব জুড়িয়ে গেল। ইচ্ছে করছে এখনই তোর গলাটা হাতের মাঝে নিয়ে চেপে ধরে উপহার দেই।
দ্যুতি দিহানের কথা শুনে নিঃশব্দে হেসে উঠে। অতঃপর বলে,
— ইশশ! আমার কত ভাই রে তুই।
— আর তুই বেদ্দব একটা।
দ্যুতি স্মিথ হেসে বলে,
— সুন্দর লাগছে। এখন সোজা হয়ে দাঁড়াও তো, পুরো দেখি তোমায়।
— এহ মামা বাড়ির আবদার। যাহ ফুট।
কথাটা শুনে দ্যুতি মুখ ঘুচে নিতেই দিহান ইশারায় অরণ্যকে ফোনটা ধরতে বলে। অরণ্য ফোনটা হাতে নিয়ে সেটিং চেঞ্জ করে ব্যাক ক্যামেরা দিয়ে দিহানকে দেখাতে থাকে আর নিজে প্রাণভরে থাকে তার চাঁদকে। হঠাৎ বিরবির করে সে বলে উঠে,
— চাঁদ!
অরণ্য কথাটা আস্তে বললেও দ্যুতি ঠিকই সেটা শুনে নেয়। ক্ষণেই তার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে, এক অজানা শিহরণ খেলে যায় সর্বাঙ্গে। হঠাৎ দিহান চেঁচিয়ে বলে,
— কি দেখা হয়েছে?
দ্যুতি কোনমতে বলে উঠে,
— হ্যাঁ হয়েছে৷
দিহান অরণ্যের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে কথা বলতে যাবে তার আগেই শাহিদা বেগমের ডাক দিতে দিতে রুমে চলে আসে৷ দিহানকে দ্যুতির সাথে কথা বলতে দেখে সে এগিয়ে যায় সেদিকে। ফোনটা দিহানের থেকে নিয়ে বিষাদময় কন্ঠে অভিযোগ করতে থাকেন এইটা সেটা নিয়ে। তার চেয়েও বেশি দ্যুতিকে বকছেন, এইখানে না থাকার জন্য। এক পর্যায়ে এসে তার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ে দুই ফোটা নোনা জল। দিহান কোনমতে শাহিদা বেগমকে থামায়, বুঝায় তাকে। শাহিদা বেগম আরও কিছুক্ষণ দ্যুতিকে বকে শান্ত হন, অতঃপর দিহানকে জানান তারা পাঁচ-দশ মিনিটের মাঝেই বের হবে৷ বের হওয়ার আগে কিছু কাজ আছে, তাই দিহান যাতে তার সাথে আসে। দিহান সম্মতি জানাতেই শাহিদা বেগম রুম থেকে চলে যান। দিহান একবার দ্যুতির দিকে তাকিয়ে বলে,
— আচ্ছা, আমি যাই। পরে কথা বলবো নে তোর সাথে।
কথাটা বলে দিহান অরণ্যের দিকে ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
— তোর কাছেই ফোনটা রাখ। নাহলে পরে কে না কে ফোন তুলে নেয় ঠিক নেই।
অরণ্য সম্মতি জানিয়ে ফোনটা নেয়। দিহান আর এক মূহুর্ত বিলম্ব না করে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। দিহান চলে যেতেই অরণ্য মোবাইলের দিকে তাকাতেই দেখে দ্যুতি এখনো ফোন কাটেনি। অরণ্য ফোনটা উঁচিয়ে ধরতে দুইজন দুইজনকে দেখতে পায়৷ দ্যুতি তখন ফোন কাটতেই নিচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ অরণ্যকে দ্বিতীয় বারের মত মোবাইলের পর্দায় দেখতেই স্থির হয়ে যায়। অরণ্যও স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দ্যুতির পানে। দ্যুতি ইতস্তত কন্ঠে ‘রাখি’ বলতে যাবে তার আগেই অরণ্য বলে উঠে,
— কেমন আছিস চাঁদ?
#চলবে