#প্রণয়ের_ঢেউ (২য় খন্ড)
#Part_05
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
সিগারেটের দগ্ধ গন্ধে পরিবেশ মুখরিত হয়ে উঠতেই দ্যুতি বিমর্ষ দৃষ্টি চারদিকে তাকায়। ক্ষণেই ছাদের উত্তর দিকে নজর যেতেই দৃষ্টি স্থির হয়ে আসে তার। চাঁদের মিছিমিছি আলোয় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি অবয়ব। উল্টো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সে। বা হাতে থাকা জ্বলন্ত সিগারেটটি বার বার ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে চেপে ধরছ সে, কিছু মূহুর্ত বিলম্ব করে শূণ্যে উড়িয়ে দিচ্ছে বিষাক্ত ধোঁয়া। দ্যুতি বেশ কিছুক্ষণ সেদিকেই তাকিয়ে থাকলো। এক ধ্যানে, একমনে। নিজের অজান্তেই অরণ্যের দিকে এগিয়ে গেল দুই-তিন কদম। পরক্ষণেই বাস্তবতা মনে পড়তে নীরবেই থমকে দাঁড়ালো সে। আনমনে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে, সে কার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে? যার থেকে দূরে যাওয়ার জন্য এত কিছু, তার এক ঝলক দেখা মাত্র তার নিকটই আবার মন ও মস্তিষ্ক কেন ছুটে যাচ্ছে? যে প্রণয়ের ঢেউ তাকে আঁচড়ে ফেলেছে বিষাদের রাজ্যে, সেই ঢেউয়ের ক্ষুদ্র ঝলকানিতে আবার কেন বিচলিত হয়ে উঠছে সে? মন এত বেহায়া কেন তার? কেন?
নিজেকে নিজেই এত শত প্রশ্ন করে ক্ষান্ত হয়ে উঠে দ্যুতি। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে উল্টো ঘুরে দাঁড়ায়, হাটা দেয় দরজার দিকে৷ থাকুক না মানুষটা একান্ত নিজের মত, দরকার কি কাছে যাওয়ার? কাছে গেলেই তো পিছুটান বাড়ে। বন্দী স্মৃতিগুলো পাখা মেলে উড়ে বেড়ায় মনের আঙ্গিনায়। হৃদয়ের দহন জাগ্রত হয় নতুন দমে। দূরে থেকে যদি এসব থেকে মুক্ত পাওয়া যায়, তাহলে দূরত্বই ভালো।
দ্যুতি সামনের দিকে দুই কদম এগুতেই পিছন থেকে অরণ্য বলে উঠে,
— কি, আজ কথা না বলেই চলে যাচ্ছিস? এখন কি আমার সাথে কথা বলার রুচিও হয় না তোর?
দ্যুতির কর্ণকুহরে কথাটা ভেসে আসতেই পা দু’টি স্থির হয়ে আসে। ক্ষণেই সে ঘুরে দাঁড়ায়, বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় অরণ্যের দিকে। অরণ্য তখনও সেই আগের ন্যায় উল্টোমুখ করে দাঁড়িয়ে ধীর গতিতে সিগারেট খাচ্ছে৷ দ্যুতি কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
— আপনি পিছনে না ঘুরে কিভাবে বুঝলেন আমি এইখানে আছি?
অরণ্য এইবার সিগারেটটা পাশে ছুঁড়ে ফেলে দ্যুতির দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। ঠোঁটের কোনে শ্লেষের হাসি ঝুলিয়ে বলে,
— যাদের স্থান অন্তঃস্থলের গহীনে তাদের উপস্থিতি না দেখেই উপলব্ধি করা যায়।
দ্যুতি বিমর্ষ দৃষ্টিতে তাকায় অরণ্যের দিকে। তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে মনের মাঝে। কন্ঠস্বর কেঁপে কেঁপে উঠছে বার বার। আজ কতটা মাস পর অরণ্যের সাথে তার মুখোমুখি। দুইজনের ব্যস্ততা এতটাই ছিল যে, দুইজনের আর সামনে পড়া হয়নি। তাই আজ এই অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎ-এ দ্যুতি মনে বিচলিত ভাবটা হানা দিচ্ছে। সংকোচিত বোধ করছে কিছুটা। মুখভঙ্গিতে তা প্রকাশ না পেলেও হাব-ভাবে সেটা কিঞ্চিৎ স্পষ্ট৷
— কথা না বলেই চলে যাচ্ছিলে যে?
দ্যুতি সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে বসে,
— আপনি এখনো সিগারেট খাওয়া ছাড়তে পারলেন না?
— যার জন্য ছাড়তাম সেই তো জীবনে নেই এখন। তাহলে ছেড়ে লাভ কি?
দ্যুতি কিছু না বলে অরণ্যের দৃষ্টির অগোচরে নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। স্মিত দৃষ্টিতে অরণ্যের দিকে তাকাতেই অরণ্য বলে উঠে,
— শুনলাম, বিদেশ গিয়ে পড়ালেখা করতে চাচ্ছিস। সত্যি নাকি?
দ্যুতি কম্পিত স্বরেই বলে উঠে,
— হ্যাঁ।
অরণ্য তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,
— পালিয়ে যেতে চাইছিস সব কিছু থেকে?
দ্যুতি এক পলক অরণ্যের দিকে তাকায়। অরণ্যের দৃষ্টিতে বিরাজ করেছে এক ঝাঁক শীতলতা। যা মুহূর্তেই পরিবেশটাকে আরও ভারী করে তুলছে। দ্যুতি ভিতরে ভিতরে নিজেকে গুছিয়ে নেয় কিছুটা। স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে,
— পালিয়ে যাব কেন? পালানোর মত কিছু কি হয়েছে? বাহিরে গিয়ে পড়ার ইচ্ছা ছিল তাই যাচ্ছি।
— মিথ্যা বলাটা ভালোই রপ্ত করেছিস দেখছি।
দ্যুতি এতে কিছুটা উৎকন্ঠা হয়ে যায়৷ স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
— মানে?
অরণ্য ঠোঁটের কোনে শ্লেষের হাসি ঝুলিয়ে বলে,
— মেডিক্যালে পড়ার স্বপ্ন এইভাবেই ছেড়ে দিলি? কেন করলি এমন? আমার জন্য হলো কি সব? নিজের অজান্তেই কি তোর সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেললাম? মেরে দিলাম তোর সব স্বপ্নগুলোকে?
শেষের কথাটা বলার সময় অরণ্যের কন্ঠস্বর বেশ করুণ শুনালো। যা যথেষ্ট দ্যুতির মনে হাহাকার সৃষ্টি করতে। দ্যুতির শরীর মৃদু পরিমাণ কাঁপছে। কন্ঠস্বর ভারী হয়ে আসছে৷ হ্যাঁ এইটা সত্য তার স্বপ্ন ছিল মেডিক্যালে পড়ার কিন্তু সেটা সে মাটিচাপা দিয়েছে পরিস্থিতির কবলে পড়ে। সে এতটাও শক্ত নয় যে, সে অরণ্যের সামনে থেকেই নিজের জীবন গুছিয়ে নিবে। যতবারই সে অরণ্যের মুখোমুখি হবে, ততবারই মনের মাঝে আঁচড়ে পড়বে হৃদয় ভাঙা ঢেউ। যা মুহূর্তেই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিবে তাকে। দ্যুতির সব ভুলে এগিয়ে যেতে হলে এই জায়গায়, স্মৃতি থেকে দূরে যাওয়া আবশ্যক। অরণ্যের থেকেও হাজার, কোটি মাইল দূরে অবস্থান করা প্রয়োজন। এতেই হয়তো তার,অরণ্যের ও নুরির জীবনে গতি আসবে। তাই তো সে দূরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হোক এতে কিছু কিছু স্বপ্নের সমাধি, ভালো তো থাকা যাবে নাকি?
দ্যুতি নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে চাপা কন্ঠে বলে,
— এতে আপনার কোন দোষ নেই ভাইয়া। খামাখা নিজেকে দোষারোপ করবেন না। আমি সব ভেবে চিন্তেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি৷ আর সত্যি বলতে আমি নিজেই এখন তীব্র ভাবে চাইছি বাহিরে গিয়ে পড়া লেখা করতে৷
অরণ্য কিছু না বলে একমনে তাকিয়ে থাকে দ্যুতির পানে। দ্যুতি তা বুঝতে পেরে স্মিত হেসে বলে,
— সকল স্বপ্ন পূরণ হওয়ার হয়না, সম্পর্কে মতই কিছু স্বপ্নও অপরিপূর্ণ থেকে যায়।
অরণ্য নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠে,
— বাবাকে দেওয়া আমার একটা ওয়াদাই আমায় ফাঁসিয়ে দিল রে। ওয়াদাটা যদি না করতে হতো, তাহলে হয়তো সত্যি আমি শেষ সুযোগটা নিতাম।
ওয়াদা সম্পর্কে দ্যুতি অবগত। সে সম্পর্ক ছিন্ন করার পরও অরণ্য চেষ্টা করেছিল শাখাওয়াত সাহেবকে সবটা বুঝাতে। কিন্তু লাভ হয়নি। উল্টো শাখাওয়াত সাহেব বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়ায় শারিরীক অবস্থা প্রচন্ড করুণ হয়ে গিয়েছিল। এমনকি এক রাতের জন্য হসপিটালেও থাকতে হয়েছিল তার। সেই সময়েই তিনি অরণ্যের কাছ থেকে ওয়াদা নিয়েছিলেন, অরণ্য যেন বিয়েটা করে। কোন রকম বাঁধা সৃষ্টি না করে। অরণ্য প্রথমে কথা দিতে না চাইলেও অজ্ঞাত শাখাওয়াত সাহেবের অসুস্থতা ও চাপাচাপিতে এক প্রকার বাধ্য হয়েই অরণ্য তার নিকট ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিল আর বিয়েটা করেছিল। কিন্তু শেষ সুযোগ হিসাবে অরণ্য কি বুঝাতে চাইছে তা দ্যুতির বোধগম্য হলো না। সে অরণ্যের দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকাতেই অরণ্য স্মিত হেসে বলে,
— তোকে নিয়ে পালিয়ে যেতাম৷ হোক সেটা তোর ইচ্ছার বিরুদ্ধেই।
কথাটা শুনে দ্যুতি মিইয়ে যায়। অস্বস্তিরা ঘিরে ধরে চারদিক থেকে। সে স্বতঃস্ফূর্ত কন্ঠে বলে উঠে,
— আপনি কেন এখনো অতীত নিয়ে পড়ে আছেন বলুন তো? অতীতটা ভুলে বর্তমানকে আগলে নিন না। কেন নুরি আপুকে এইভাবে কষ্ট দিচ্ছেন? তার দোষটা এইখানে কোথায়?
— ওর কোন দোষ নেই আমি জানি। কিন্তু আমি বাই কি করবো বল? পারি না আমি ওর সাথে সহজ হতে, পারি না মানতে ওকে নিজের অর্ধাঙ্গিনী হিসাবে। যতবারই ওকে দেখি ততবারই আমার সামনে তোর মুখ ভেসে উঠে। তোর সাথে করা অন্যায়ের কথা মনে পড়ে যায়।
— আমার সাথে আপনি কোন অন্যায় করেন নি ভাইয়া। তাই কথাটা মাথা থেকে বের করে দিন৷ যা ছিল তা সব ভাগ্যের লিখন। আমি ভাগ্য মেনে নিয়েছি, তাই নিজেকে নিজেই গুছিয়ে নিচ্ছি। আপনিও নিন। এইভাবে আর কতদিন?
— বাস্তবিক প্রয়োজনীয়তা ও শারীরিক চাহিদার কাছে যেদিন হেরে যাব, সেদিন সবটা মেনে নিব আমি। ভুলে যাব নিজের অতীতকে।
— এইভাবে জীবন চলে না ভাইয়া। আর বিয়ে কোন ছেলে-খেলা না। একজনের দায়িত্ব যেহেতু নিয়েছেন তা পূরণ করতে শিখুন। নিজ থেকে একবার সম্পর্কটা সুযোগ দিন। আগলে নেওয়ার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করুন। দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাচ্ছে৷ স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে সম্পর্কটা।
— আমাকে নিয়ে তোর এত না ভাবলেও চলবে। আমার জীবনের একটা না একটা গতি হয়েই যাবে। তুই আপাতত নিজেরটা দেখ। যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছিস তাতেই নিজের ভালোটা বুঝে নে। সেই সাথে সেখানেই এমন কাউকে খুঁজে নিস যে তোকে কোন কিছুর বিনিময়ে কষ্ট পেতে দিবে না।
দ্যুতি অসহায় দৃষ্টিতে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বলে,
— এখনও আমার দিকটা আগে ভাববেন ভাইয়া? নিজের ভালোটা আগে কবে বুঝবেন?
অরণ্য মুচকি হেসে বলে,
— তুই এত ভালো না হলেও পারতি চাঁদ।
দ্যুতি আর কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ক্ষণেই অরণ্য বলে উঠে,
— উপস সরি! তোকে হয়তো ‘চাঁদ’ বলার অধিকার আমার আর নেই। সকল অধিকারের সাথে এই অধিকারও নিশ্চয়ই উঠিয়ে ফেলেছিস।
কথাটা দ্যুতির কর্ণকুহরে ঝংকার তুলতেই দ্যুতি অভিঘানিত দৃষ্টিতে অরণ্যের দিকে তাকায়। ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে আপনাআপনি কিঞ্চিৎ দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। অরণ্যের সেই রাতে কথা মনে আছে, কিন্তু কিভাবে? সে তো সেই রাতে মাতাল ছিল তাহলে? দ্যুতি ছলছল দৃষ্টিতে তাকায় অরণ্যের দিকে। করুণ কন্ঠে বলে,
— সেই অধিকার উঠিয়ে ফেলার দুঃসাহসিকতা আমার নেই ভাইয়া। আমাকে ‘চাঁদ’ বলার একমাত্র অধিকার আপনার ছিল, আছে আর সবসময় থাকবে৷
অরণ্য শ্লেষের হাসি হেসে শূণ্য দৃষ্টিতে আকাশের পানে তাকালো। দ্যুতিও কিছু বললো না আর, নীরবে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানেই। বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই নিভৃতে কেটে যেতে অরণ্য বলে উঠে,
— বাহিরে যেহেতু যাচ্ছিস সেহেতু নিজের খেয়াল রাখিস ঠিক মত। নিজেকে সবসময় সেফ রাখিস। নিজের মত করে লাইফটাকে গুছিয়ে নিস। যে কোন পরিস্থিতিতে কখনো নিজেকে ভেঙে পড়ে যেতে দিস না। আর চিন্তা করিস না, আমিও চেষ্টা করবো নিজের অগোছালো জীবনটা গুছিয়ে নেওয়ার।
দ্যুতি কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ায়, কন্ঠস্বর বেশ কাঁপছে তার। আপাতত কথা বলার মত শক্তি তার নেই। অরণ্য এইবার স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে,
— রাত হয়েছে অনেক এখন বাসায় যা।
দ্যুতি মাথা নাড়িয়ে নিজের সিক্ত দৃষ্টি আড়াল করে চুপচাপ এসে পড়তে নিলে পিছন থেকে অরণ্য বলে উঠে,
— ভালো থাকিস চাঁদ।
দ্যুতি কোনমতে সিক্ত কন্ঠে বলে উঠে,
— আপনিও।
অতঃপর এক মূহুর্ত বিলম্ব না করে দৌড়ে চলে আসে নিচে। অবশেষে আজ চিরতরের জন্য ইতি টানা হয়ে গিয়েছে তাদের সম্পর্কের। নেই কোন আর পিছুটান। কিন্তু তাও অবাধ্য মনটা যে মানতে চায় না, ছুটে যেতে চায় একে-অপরের কাছে। এই অবাধ্য মন কখনো অন্যের বাধ্য হবে জানা নেই কারোই।
________________
বনানীর সিগন্যালের জ্যামে প্রায় ১ ঘন্টা ধরে বসে আছে দ্যুতির পরিবারের সকলেই। এতক্ষণে তাদের বিরক্তির চরম পর্যায়ে চলে যাওয়ার কথা হলেও, সে রকমটা হয়নি। শান্ত হয়েই বসে আছে সকলে, শুধু শান্ত নেই দ্যুতি। গাড়িতে এসি ছাড়া থাকলেও দ্যুতির হাত-পা ঘেমে একাকার। বাহির দিয়ে তাকে স্বাভাবিক লাগলেও ভিতরে ভিতরে বার বার দমে যাচ্ছে সে। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে মন। দ্যুতি ব্যাগ থেকে পানির বোতলটা বের করে এক ঢোকেই অর্ধেক বোতল পানি শেষ করে দিব। অতঃপর চোখ বুলালো হাত ঘড়িতে। বিকেল পাঁচটা বাজে এখন। আর ছয় ঘন্টা পরই দ্যুতির তুরস্কের ফ্লাইট। সপ্তাহ খানিক আগেই ইস্তাম্বুলের নাম করা একটা ভার্সিটিতে স্কলারশিপ পেয়েছে সে, যার দরুন আজ তাকে নিজের দেশ ফেলে চলে যেতে হচ্ছে ভিনদেশে৷ আজ এই দেশে ও বাবা-মা-ভাইয়ের সাথে তার শেষদিন তা ভাবতেই দ্যুতি বার বার মিইয়ে যাচ্ছে। মনের মধ্যে বার বার কু ডাকছে। সে জানে, এইসব অকারণেই হচ্ছে কিন্তু তাও নিজেকে শান্ত করতে ব্যর্থ হচ্ছে সে। কান্নারা সব দলা পাকিয়ে আসছে কণ্ঠনালীর মাঝে। কোনমতে নিজেকে সামলে রেখেছে সে। বার বার ভাবছে, “আপনজনদের ছাড়া কিভাবে থাকবে সে ভিনদেশে? আদৌ থাকতে পারবে তো?” সে এক নজর চোখ বুলালো রুহুল সাহেব আর শাহিদা বেগমের মুখপানে। দুইজনের মুখই শুকিয়ে প্রায় কাঠ। শাহিদা বেগম ক্ষণে ক্ষণে এইটা সেটা নিয়েছে কি-না তা জিজ্ঞাসাবাদ করলেও রুহুল সাহেব একদমই চুপ। দিহানও তেমন একটা কথা বলছে না। এমন নীরবতা দ্যুতির মোটেও ভালো লাগছে না। ভিতরকার ভয় বৃদ্ধি পাচ্ছে বেশ। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোন কথা না বলে রুহুল সাহেবের কোলে মাথা এলিয়ে দেয়। এতে রুহুল সাহেব কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেন। আদরমাখা হাতটি গলিয়ে দেন দ্যুতির মাথায়। দ্যুতির ভিতরকার অবস্থা কিছুটা আঁচ করতে কিছুটা চিন্তিত হন তিনি। অতঃপর দ্যুতিকে স্বাভাবিক করতেই তিনি সকলকে নিয়ে গল্পে মেতে উঠেন।
এয়ারপোর্টের সামনে আসতেই একেক করে নেমে পড়ে সকলে। এয়ারপোর্টের গেটের সামনে আসতেই শাহিদা বেগমের উপদেশ দেওয়া শুরু হয়ে যায়। সেই সাথে যোগ দেয় রুহুল সাহেব আর দিহানও। আজ সকলের উপদেশ শুনতে একটুও বিরক্ত আসছে না দ্যুতির বরং ভালোই লাগছে। তাই মন দিয়েই শুনছে সে সকলের উপদেশ। অতঃপর ভিতরে ঢুকার সময় হয়ে আসলে দিহান দ্যুতির দিকে লাগেজ ব্যাগ দু’টি এগিয়ে দেয়। দ্যুতি সিক্ত চোখে সকলের থেকে বিদায় নিয়ে পা বাড়ায় ভিতরের দিকে। হঠাৎ কি যেন মনে করে থমকে দাঁড়ায় সে, পিছনে ঘুরে চোখ বুলায় সকলের দিকে। কাউকে খুঁজছে সে, তীব্রভাবে চাইছে তাকে শেষবারের মত দেখতে, একটু কথা বলতে। দ্যুতি জানে মানুষটা এইখানে নেই কিন্তু তাও মন কি তা মানে? মনকে সন্তুষ্টির জন্য একবার চোখ বুলালো। অতঃপর কোথাও তার অস্তিত্ব দেখতে না পেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। শেষবারের মত সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢুকে পড়লো ভিতরে। দূর থেকে সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি সবই দেখলো কিন্তু নিজের স্থান থেকে অনড় হলো না। আড়ালেই দাঁড়িয়ে থাকলো, প্রাণভরে দেখে নিল প্রিয় মানুষটিকে শেষবারের মত। অন্তিম বিদায় জানালো দূর থেকেই। দ্যুতি অরণ্যের দৃষ্টির আড়াল হতেই অরণ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হাটা দেয় উল্টোপথে।
হয়তো এইটাই তাদের শেষ দেখা, আবার হয়তো না। কিন্তু জীবনের কোন মোড়ে এসে আবার তাদের দেখা হবে কে জানে? আদৌ কি হবে দেখা? তাদের জীবনের গতানুগতিক ধারা ঠিক কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে।
#চলবে