প্রণয়ের_ঢেউ (২য় খন্ড) #Part_06,07

0
831

#প্রণয়ের_ঢেউ (২য় খন্ড)
#Part_06,07
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
Part_06

বিমানে উঠে নিজের সিটে অবস্থান করতেই দ্যুতির বুকটা ধক করে ওঠে। অজানা এক ভয়ে হ্রাস হয়ে যেতে থাকে তার দৃঢ় মনোবল। বিচলিত হয়ে উঠে মন। তার ইচ্ছে করছে, এখনোই ফ্লাইট থেকে নেমে পড়ে দৌড়ে চলে যেতে মায়ের নিকট, তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলতে,

— চল মা, বাসায় চল। আমি যাব না কোথাও। আমার পক্ষে সম্ভব না তোমাদের ছাড়া থাকা।

কিন্তু আদৌ কি তা এখন সম্ভব? দ্যুতি কিছুক্ষণ হাঁসফাঁস করে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললো। নিজেকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনে গা এলিয়ে দিলো নিজের সিটে। নয়ন দু’টির কপাট বন্ধ করে বসে থাকলো সেভাবেই। নিভৃতেই শক্ত করে নিল নিজের মনোবল। অতঃপর বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই থেকে চোখের কপাট খুলে তাকালো চারদিকে। এখনো বোর্ডিং পাস করছে কিছু মানুষ, যার জন্য কোলাহলটা কিঞ্চিৎ পরিমাণ বেশি। অবশ্য, ফ্লাইট একবার টেক অফ করলে সবটাই নীরব হয়ে যাবে তা দ্যুতি জানে। দ্যুতি এইবার জানালার বাহিরে তাকালো। শেষবারের মত প্রাণভরে দেখে নিল তার জন্মভূমিকে। ক্ষণিকের মাঝেই নিজ দেশের ও স্বজনের মায়া পেরিয়ে যাচ্ছে সে ভিনদেশে। শেষবারের মত মনে করে নেয় অরণ্যের হাস্যজ্জ্বল চেহেরা, তার সাথে কাটানো সকল স্মৃতি, তার ভালোবাসা। কেন না, এরপর যে আর এইসবের জায়গায় থাকবে না দ্যুতির জীবনে। সবটাই নিবিষ্টভাবে বন্দী হয়ে যাবে অন্তঃস্থলের গহীনে। সব ভুলে নতুন উদ্যমে বাঁচার নতুন পন্থা অবলম্বন করবে সে। হঠাৎ তার মনে প্রশ্ন জাগে, আদৌ কি সে সেখানে থাকতে পারবে? নিজেকে সেখানের সাথে মানিয়ে নিয়ে চলতে পারবে কি? ভুলতে কি পারবে তার অতীতকে? নতুন ভোরের রৌদ্রছায়ায় সাজাতে সক্ষম হবে কি এক রঙ্গিন জীবন?

ক্ষণেই স্পিকারের তীক্ষ্ণ ধ্বনি কর্ণকুহরে এসে ঠেকতেই দ্যুতি আপন ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে। সচকিত দৃষ্টিতে তাকায় সামনে। কিছুক্ষণেই মাঝেই ফ্লাইট টেক অফ করবে বলে ইশারায় সকলকে সিটবেল বাঁধার বিনীত অনুরোধ করছে এক তরুণী৷ মুখে ঝুলছে অমায়িক এক হাসি। দ্যুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিটবেলটি বেঁধে নেয়৷ সিক্ত হয়ে আসা নয়ন দু’টির কপাট বন্ধ করে গা এলিয়ে দেয় নিজের সিটে। অতঃপর মিনিট দশকের মাঝেই উড়াল দেয় বিমানটি৷ চোখের পলকেই ঘন তুলারাশির বুক চিরে ভাসমান হয় তারা স্বচ্ছ আকাশের বিস্তীর্ণ বুকে।

__________________

দীর্ঘ আট ঘন্টা সফর করার পর দ্যুতি এসে পৌঁছায় ইস্তাম্বুলে। বিমান থেকে নেমে ইস্তাম্বুলের মাটিতে পা রাখতেই দ্যুতির শরীরের অজানা এক শিহরণ বয়ে যায়। বিশুদ্ধ বাতাসে আভাস পেতেই দ্যুতি লম্বা এক নিঃশ্বাস নিল। অতঃপর হাটা দিল এয়ারপোর্টের দিকে৷ বিশালাকৃতি এয়ারপোর্টের একেক প্রান্তে একেক কাউন্টার হওয়ায় ক্ষণেই হাঁপিয়ে উঠলো দ্যুতি। কোনমতে নিজের লাগেজব্যাগ গুলো সংগ্রহ করে, খোঁজ করতে থাকলো মানি এক্সচেঞ্জ কাউন্টারের। আপাতত মানি এক্সচেঞ্জ না করলে সে এই ভিনদেশে পুরাই কাঙ্গাল।

সকল ফর্মালিটির শেষে দ্যুতি এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসে। চোখ বুলাতে থাকে চারপাশে। ইস্তাম্বুলে দ্যুতির শাহিদা বেগমের দূরসম্পর্কের মামাতো বোন শারমিন বেগমের বাসায় উঠার কথা। শাহিদা বেগম আর শারমিন বেগমের সখ্যতা বেশ গভীর হওয়ায়, প্রায়শই কথা হয় তাদের। সেই সুবাদে দ্যুতি ও দিহানও তাদের কিছুটা চিনে৷ শাহিদা বেগম যখন জানালেন দ্যুতি ইস্তাম্বুলে যাচ্ছে পড়ালেখা করার জন্য তখন শারমিন বেগম নিজ থেকেই প্রস্তাব দিলেন দ্যুতি যাতে তাদের ওইখানেই উঠে আর তাদের সেই থেকেই নিজের পড়াশোনা শেষ করে। প্রথমে শাহিদা বেগম রাজি না হলেও, শারমিন বেগনের জোড়াজুড়ি ও ভিনদেশে দ্যুতির নিরাপত্তার কথা ভেবে তিনি রাজি হয়ে যান। দ্যুতি সবটা শুনে নাকচ করলেও মায়ের পিড়াপীড়িতে রাজি হতে বাধ্য হয়। কিন্তু মনে মনে ঠিক করে রাখে যে, সে কিছুটা সময় সেখানে থাকবে পরবর্তীতে সে হোস্টেলে উঠে যাবে। কেন না সে জানে, সময়ের চক্র ঘূর্ণন হওয়ার পর মূহুর্তেই বাহিরের মানুষ বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

এয়ারপোর্টে তাকে নিতে শারমিন বেগমের বড় ছেলের আসার কথা। কিন্তু সে আদৌ এসেছে কি-না দ্যুতির জানা নেই। উপরন্তু, দ্যুতি তাকে ভালো মত চিনেও না, নাম পর্যন্ত ভালো মত নেই তার। এখন তাকে চিনবেই বা কিভাবে তা নিয়ে দ্বিধায় পড়লো সে। শারমিন বেগমের সাথে তার কথা স্বল্প হারে হয়েছে, যত বারই কথা হয়েছে ততবারই সে হালচাল জিজ্ঞেস করে ফোন মাকে দিয়ে দিত। যার দরুন তার যে একটা ছেলেও আছে তা দ্যুতি এয়ারপোর্টে আসা অব্দি জানতোই না।

দ্যুতি হতাশাজনক নিঃশ্বাস ছেড়ে এদিক সেদিক তাকায়। চারদিকে এখনো অন্ধকার ছেয়ে আছে নিবিড় ভাবে। ভোর হতে কিঞ্চিৎ সময় বাকি৷ যার দরুন জায়গায়টা কেমন নির্জনতা ও নিস্তব্ধতার মাঝে ডুবে আছে। দ্যুতির কিছুটা ভয় হলেও সে তা মুখে প্রকাশ হতে দিল না। বরং সামনের দিকে কিছুটা এগিয়ে গেল। হঠাৎ কেউ পিছন থেকে বলে উঠে,

— এক্সকিউজ মি মিস! আর ইউ আফরা ইবনাত?

ক্ষণেই দ্যুতি পিছনে ঘুরে তাকায়। ছিপছাপ গড়নের একটি ছেলেকে দেখে দ্যুতির ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে। পড়নে কুঁচকে থাকা একটি আকাশী রঙের টি-শার্ট ও ধূসর রঙের ট্রাউজার। ছেলেটি অবস্থা দেখে মনে হচ্ছ সে সোজা ঘুম থেকে উঠে এইখানে এসে পড়েছে। দ্যুতি সন্দিহান কন্ঠে বলে,

— ইয়েস বাট হু আর ইউ?

ছেলেটি হেয়ালি কন্ঠে বলে,

— আ’ম নিদ্রান, নিদ্রান আহমিদ।

দ্যুতির কপালের ভাঁজ সুক্ষ্ম হয়ে আসে। সে মনে করার চেষ্টা করে সে আদৌ নিদ্রান নামের কাউকে চিনে কি-না। অতঃপর মনে পড়তেই সে ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

— আপনাকে কি শারমিন আন্টি পাঠিয়েছেন?

নিদ্রান নিজের মাথার পিছে বা হাতটি গলিয়ে দিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে উঠে,

— এনি ডাউট?

নিদ্রানের এমন খামখেয়ালি ব্যবহারে দ্যুতির মেজাজটা একটু খারাপই হলো কিন্তু কিছু বললো না৷ কোন মতে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

— জ্বী না।

নিদ্রান এক নজর দ্যুতির দিকে তাকিয়ে নিজের হাত ঘড়ির দিকে নজর বুলালো। অতঃপর কোন প্রকার দ্বিরুক্তি না করে হাতের ডান দিকে হাটা দেয়। তা দেখে দ্যুতি উচ্চ স্বরে বলে উঠে,

— আরেহ কোথায় যাচ্ছেন?

নিদ্রান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়৷ কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে পুনরায় স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে উঠে,

— অ্যামাজনের জঙ্গলে যাচ্ছি, যাবা?

নিদ্রানের এহেন কথায় দ্যুতি হতবিহ্বল চোখে তাকায় তার দিকে। নিদ্রান এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,

— ড্যাম! পার্কিং এরিয়াতে যাচ্ছিলাম গাড়ি আনতে। বাসায় যাব তো নাকি সকাল এইখানেই পার করব?

দ্যুতি কিছু না বলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিদ্রানের দিকে তাকায়। নিদ্রান সেই দৃষ্টি তোয়াক্কা না করে সোজা হাটা দিয়ে চলে পার্কিং এরিয়াতে। তা দেখে দ্যুতি বিরবির করে বলে উঠে,

— অসভ্য একটা। সদ্য পরিচিত মানুষের সাথে কেউ এত রুক্ষ ব্যবহার করে?

হঠাৎ আজানের মধুর ধ্বনিতে পরিবেশ মুখরিত হতেই দ্যুতি আকাশের পানে তাকায়। রাতের শুভ্র তারারা এখনো ঝিকিমিকি আলোয় শোভা পাচ্ছে, তুলরাশি মেঘগুলো ছুটা-ছুটি করছে এদিক সেদিক। হিম শীতল বাতাসে ভাসছে মোহনীয় এক সুবাস। দ্যুতির চোখ বন্ধ করে গভীর নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। হঠাৎ তার মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠে অরণ্যে চেহেরা, হিম রাতে কাটানো কিছু স্মৃতি। ক্ষণেই দ্যুতি চোখ খুলে ফেলে, নয়ন দু’টি সিক্তপ্রায়। দ্যুতি শ্লেষের হাসি হেসে আনমনে বলে উঠে,

— এইখানে এসেও কি আমার নিস্তার নেই?

কোন প্রাণীর করুণ ডাক শুনতে পেয়ে দ্যুতি ঝাপসা চোখে রাস্তার দিকে তাকাতেই ছোট একটি বিড়াল দেখতে পায়৷ বিড়ালটি হয়তো পায়ে আঘাত পেয়েছে তাই আর্তনাদ করছে৷ দ্যুতি বা হাত দিয়ে নিজের চোখে ভেজা অংশটুকু মুছে লাগেজটা রেখে এগিয়ে যায় বিড়ালটির দিকে। হাটু মুড়ে বিড়ালটির গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। রাস্তার এই অংশে থাকলে নির্ঘাত বিড়ালটি আরও বেশি আঘাত পাবে বলে দ্যুতি ঠিক করলো বিড়ালটিকে এক কিনারে রেখে আসবে। দ্যুতি আস্তে করে বিড়ালটিকে কোলে তুলে নিল অতঃপর যেই না উঠে দাঁড়াতে যাবে তখনই একটি গাড়ি ওর সামনে চলে আসে। দ্যুতি ভয়ে একটু পিছিয়ে যেতেই মাটিতে পড়ে যায়, হাত থেকে ছুটে যায় বিড়ালটি। মাটির সাথে কপালের একাংশ ঘর্ষণ খেতেই চোখ নিভে আসে দ্যুতির, ঝিমঝিম করে উঠে মাথাটা। ক্ষণেই কেউ দ্যুতির সামনে এসে তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠে,

— এই যে মিস! তুমি ঠিক আছো?

ব্যক্তির কন্ঠ দ্যুতির কর্ণগোচর হতেই পিটপিটিয়ে তাকায় সে। ক্ষণেই নিদ্রানের মুখশ্রী স্পষ্ট হয়ে আসতে দ্যুতি অস্ফুটস্বরে বলে,

— হু।

নিদ্রান স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে দ্যুতির বাহু ধরে ওকে উঠে বসায়৷ দ্যুতি একহাত দিয়ে নিদ্রানের হাত শক্ত করে ধরে আর অন্য হাতটি মাথায় চেপে উঠে বসে। নিদ্রান দ্যুতির কপালের দিকে তাকালে দেখতে পায়, কপালের একপাশ বিশ্রী ভাবে ছিলে গিয়েছে। নিদ্রান দ্যুতিকে বসিয়ে সোজা চলে যায় গাড়ির কাছে। ভিতর থেকে ফাস্টএইড বক্স আর এক বোতল পানি নিয়ে ফিরে আসে দ্যুতির নিকট। দ্যুতির সামনে হাটু মুড়ে বসে কপালে আঘাত পাওয়া অংশটুকু হেক্সিসল আর তুলোর সাহায্যে পরিষ্কার করে দেয়। অতঃপর সেখানে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দ্যুতির দিকে পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়ে ভরাট কন্ঠে বলে,

— আর ইউ ম্যাড অর হোয়াট? রাস্তার মাঝে করছিলেটা কি তুমি? ঠিক সময় ব্রেক না করলে তো আজ খবর ছিল আমার।

দ্যুতির মাথা এইভাবেই ঘুরাচ্ছিল তার উপর নিদ্রানের এমন কথায় সে কিছুটা রেগে যায়। তাই তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠে,

— হওয়া উচিৎ ও। চোখ নেই আপনার, দেখে গাড়ি চালাতে পারেন না? যতসব!

কথাটা বলেই পানির বোতলটা নিয়ে পানি খায়। মাথা ভার ভার লাগছে তার। হঠাৎ নিদ্রান স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে,

— তুমি তো দেখছি আসতে না আসতেই আমাকে জেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার ফন্দি আঁটছো। ভারী সাংঘাতিক মেয়ে তো তুমি?

নিদ্রানের এহেন কথায় দ্যুতির হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। বিস্ময়ে আপনা-আপনি ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। হঠাৎ নিদ্রানের ফোন বেজে উঠতেই সে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে ফোনটা বের করে। মোবাইলের ক্রিনে ‘মাম’ শব্দটি ভেসে উঠতেই নিদ্রান কলটা রিসিভ করে বলে,

— হ্যাঁ, পেয়েছি ওকে। আমার সাথেই আছে, আসছি বাসায় আমরা।

কথাটা বলার পরমুহূর্তেই কলটা কেটে দিয়ে নিদ্রান দ্যুতির দিকে তাকিয়ে বলে,

— বাকি দেখা আমাকে বাসায় গিয়ে দেখো এখন চল৷

ক্ষণেই নিদ্রান দ্যুতির বাহু ধরে দাঁড় করিয়ে গাড়িতে নিয়ে বসায়। অতঃপর লাগেজ আর ব্যাগগুলো গাড়ির পিছনে রেখে ড্রাইভিং সিটে এসে বসে৷ এক নজর দ্যুতির দিকে তাকিয়ে বলে,

— সিটবেলও কি এখন আমাকে পড়িয়ে দিতে হবে?

দ্যুতি একপলক নিদ্রানের দিকে তাকিয়ে সিটবেলটা বেঁধে নেয়। নিদ্রান তা দেখে গাড়ি স্টার্ট করতেই দ্যুতি বিরবির করে বলে উঠে,

— অসভ্য!

#চলবে

#প্রণয়ের_ঢেউ (২য় খন্ড)
#Part_07
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

সোনালি রোদ্দুরের ছটা ইস্তাম্বুলের বুকে পরশ বুলাতেই প্রাণবন্ত হয়ে উঠে শহরটি৷ মেঘে মেঘে খেলা করছে মিষ্ট পাখির দল। দ্যুতি গাড়ির কাঁচটা আরেকটু নামিয়ে দিতেই এক ঝাঁক বাতাস এসে বারি খায় দ্যুতির চোখে মুখে। ক্ষণেই দ্যুতি চোখের কপাট বন্ধ করে সিটে গা এলিয়ে দেয়, অনুভব করতে থাকে হিম বাতাসের শীতলতা। নিদ্রান একপলক দ্যুতির দিকে তাকিয়ে স্লো ভলিউমে টার্কিশ একটা গান ছাড়ে। গানের টুংটাং শব্দ দ্যুতির কর্ণধারে এসে প্রতিধ্বনিত হতেই শব্দটা সোজা মস্তিষ্কে গিয়ে টনক নাড়ে, শুরু হয় অসহ্যনীয় ব্যথাও হচ্ছে। হয়তো তখন কপালে আঘাত পাওয়ার ফলে এমনটা হচ্ছে। ব্যথাটা যখন তিক্ত হয়ে আসে তখন দ্যুতি চোখ খুলে নিদ্রানের দিকে তাকায়। স্বগোতক্তি কন্ঠে বলে,

— গানটা অফ করবেন, প্লিজ? ভাল্লাগছে না আমার।

নিদ্রান গাড়ির চালানোর দিকেই মনোযোগ দিয়ে বলে,

— তোমার ভালো লাগা আর না লাগা দিয়ে আমি করবো?

— গাড়িতে তো আপনি ছাড়া আরেকজনও আছে, তার সুবিধা-অসুবিধা দেখবেন না?

নিদ্রান হেয়ালি কন্ঠে বলে উঠে,

— আমি সব আগে আমার দিকটাই প্রাধান্য দিতে পছন্দ করি। তাই, অন্যের সুবিধা-অসুবিধা দেখা আমার কাম্য নয়।

দ্যুতি তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠে,

— আপনি কি জানেন, আপনি চরম অসভ্য?

— হলেও তোমার কি?

দ্যুতি বিরক্ততে চোখ খিঁচে বন্ধ করে, বিরবির করে বলে উঠে,

— উফফ অসহ্য!

মিনিট দুই-একের মাঝে গানের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতে দ্যুতি চোখ খুলে একপলক নিদ্রানের দিকে তাকায়। অতঃপর কোন প্রকার দ্বিরুক্তি না করে পুনরায় চোখ বন্ধ করে জানালার দিকে মাথা হেলিয়ে দেয়।

কিছু সময়ের ব্যবধানেই গাড়ি একটি এপার্টমেন্টের সামনে এসে দাঁড়ায়। দ্যুতি চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে নিদ্রানের দিকে তাকায়। নিদ্রান নিজের সিটবেল খুলে বলে,

— নামো!

দ্যুতি দ্বিরুক্তি না করে সিটবেল খুলে গাড়ি থেকে নেমে পরে। দ্যুতির হ্যান্ডব্যাগের একটা চেইন খোলা থাকায় সে যখন সেটা টান দিতে যায় তখন ব্যাগের ভিতরকার জিনিসগুলো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। নিদ্রান তা দেখে বিরক্তি নিয়ে বলে,

— গুড ফোর নাথিং!

দ্যুতি নিদ্রানের কথা তোয়াক্কা না করে হাটু মুড়ে বসে দ্রুত নিজের জিনিসপত্র উঠিয়ে নেয়৷ সবকিছু গুছিয়ে উঠে দাঁড়াতেই নিদ্রান দ্যুতির লাগেজগুলো নিয়ে ভিতরে দিকে হাটা দেয়। তা দেখে দ্যুতিও নিঃশব্দে এগিয়ে যায় ভিতরের দিকে।

________________

নিদ্রান কলিংবেলটা বাজাতেই শারমিন বেগম এসে দরজা খুলে দেন। দরজার বাহিরে দ্যুতিকে দেখার পর তিনি চওড়া হাসি হেসে দ্যুতিকে জড়িয়ে ধরে বলেন,

— অবশেষে আসলে।

হঠাৎ এইভাবে জড়িয়ে ধরায় দ্যুতি কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলো কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করলো না। বরং মিষ্টি হেসে জবাব দিল,

— জ্বী!

শারমিন বেগম দ্যুতিকে ছেড়ে দিয়ে আরও কিছু বলতে যাবেন তার আগেই নিদ্রান গমগমে গলায় বলে উঠে,

— আরেহ, এইসব জড়াজড়ি ভিতরে গিয়ে করো না। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এইসব আদিখ্যেতা করা কি খুব জরুরি?

শারমিন বেগম নিদ্রানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,

— নিদ্র! এইসব কি রকম কথা?

নিদ্রান বিরক্তিকর কন্ঠে বলে,

— সেটা তোমার জানা কথা। এখন সরো তো আমি রুমে যাব, কাউরো সাথে কথা বলার মুড নাই এখন আমার।

শারমিন বেগম বিরক্তি নিয়ে সরে দাঁড়াতেই নিদ্রান ভিতরে ঢুকে পড়ে। লাগেজগুলো এক সাইডে রেখে গটগট করে চলে যায় নিজের রুমে। শারমিন বেগম সেদিকে তোয়াক্কা না করে দ্যুতিকে ভিতরে আসতে বললেন। দ্যুতি কিঞ্চিৎ হেসে ভিতরে ঢুকে। শারমিন বেগম দরজা লাগিয়ে দ্যুতির সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলেন,

— ক্লান্ত লাগছে নিশ্চয়ই? আসো তোমায় রুম দেখিয়ে দিচ্ছি,ফ্রেশ হয়ে নাও আগে। পরে কথা বলবো নে।

দ্যুতি সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে মাথা নাড়ায়।

________________

ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসার পরমুহূর্তে শারমিন বেগম নাস্তা খেতে ডাক দেন। দ্যুতি চুল মুছে বারান্দায় তোয়ালেটা মেলে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। হলওয়ের সরু রাস্তা দিয়ে হাটার সময় একটা দরজার উপর “ডু নট ডিস্টার্ব” বোর্ড দেখে একটু থমকালো সে। ভ্রু কুটি কুঞ্চিত করে তাকায় লিখাটির দিকে। হঠাৎ দরজা খুলে রুম থেকে নিদ্রান বেরিয়ে আসতেই দ্যুতি ভড়কে গিয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। ক্ষণেই দেয়াল বাঁধা রুপক দাঁড়াতে দ্যুতি মাথার পিছিনে কিঞ্চিৎ আঘাত পায়। আঘাতের তাড়নায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুখ দিয়ে চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। নিদ্রান তা দেখে বলে,

— তোমার কি হুটহাট আঘাত পাওয়ার মুদ্রা দোষ আছে?

প্রশ্নটা শুনে দ্যুতি কিছুটা বিভ্রান্ত হলো। প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে,

— জ্বী?

নিদ্রান নিজের ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে খাম-খেয়ালি সুরে বলে,

— নাথিং।

কথাটা বলেই নিদ্রান নির্বিকার ভঙ্গিতে ডায়নিং রুমে চলে গেল। দ্যুতি এইবার নিজের মাথায় হাত গলিয়ে বিরবির করে বলে উঠে,

— আজ আমার সাথে হচ্ছেটা কি এইসব?

ক্ষণেই শারমিন বেগম দ্যুতিকে আবার ডেকে উঠতেই দ্যুতি এগিয়ে যায় সেদিকে। ডায়নিং-এ এসে দেখে শারমিন বেগম টেবিলে খাবার সাজিয়ে বসে আছেন। তারই পাশে নিদ্রান ইতি মধ্যে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। দ্যুতি নিদ্রানকে সম্পূর্ণ অনাগ্রহ করে শারমিন বেগমের মুখোমুখি বসেন। অতঃপর বিনয়ী সুরে জিজ্ঞেস করে,

— আঙ্কেল কোথায় আন্টি? তিনি নাস্তা করবেন না?

— তোমার আঙ্কেল আর নাদিরা এখনো ঘুমাচ্ছে। পরে উঠে নাস্তা করে নিবে নে তারা। এত সকালে আবার এই বাসায় কেউ নাস্তা করে না।

দ্যুতি কথাটা শুনে একটু থমকালো। বড় দেয়াল ঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে দেখলো কয়টা বাজে। ছয়টা বেজে ত্রিশ মিনিট। এত সকালে নাস্তা না করাটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। সে এসেছে বলেই হয়তো শারমিন বেগম এত সকালে উঠে নাস্তা বানিয়েছেন। দ্যুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে,

— নাদিরা কে?

— আমার ছোট মেয়ে। তোমার বয়সী প্রায়।

— অহ আচ্ছা।

শারমিন বেগম আর কথা না বাড়িয়ে দ্যুতির প্লেটে খাবার উঠিয়ে দেন আর এক কাপ চা ওর দিকে এগিয়ে দেন। দ্যুতিও দ্বিরুক্তি না করে খেতে শুরু করে। হঠাৎ শারমিন বেগম দ্যুতির কপালের দিকে তাকিয়ে বলেন,

— তুমি কপালে আঘাত পেলে কিভাবে?

তখন দ্যুতি হিজাব পড়ে ছিল বলে শারমিন বেগম চোটটা সনাক্তকরণ করতে পারেন নি। কিন্তু এখন হিজাব ও বেন্ডেজটা খুলে রাখার ফলে আঘাতটা স্পষ্ট কপালে ফুটে উঠেছে। দ্যুতি সচকিত দৃষ্টিতে শারমিন বেগমের দিকে তাকায়, অস্ফুটস্বরে বলে,

— তেমন কিছু না। আসার সময় রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলাম আরকি।

— ইশশ! কি বাজেভাবে ছুঁলে গিয়েছে। দাঁড়াও আমি মেডিসিন এনে দিচ্ছি।

দ্যুতি সাথে সাথে বলে উঠে,

— এখন লাগবে না আন্টি। আমি ঠিক আছি।

শারমিন বেগম কথাটাতে সন্তুষ্ট হতে না পেরে নিদ্রানের দিকে তাকিয়ে বলেন,

— এই তোকে না বলেছিলাম ওকে সাবধানে আনতে? তুই থাকতে ও ব্যথা পেল কিভাবে?

নিদ্রান এতক্ষণ নিজের মধ্যেই মগ্ন ছিল। কোন দিকে না তাকিয়ে চুপচাপ নিজের নাস্তা খাচ্ছিল। হঠাৎ শারমিনের কথা তার কর্ণগোচর হতেই সে চোখ তুলে তাকায়৷ নির্লিপ্ত সুরে বলে,

— সে যদি নিজেই কেয়ারলেস হয় তাহলে এতে আমার কি করার আছে,আজিব? আমি তো আর তার বডিগার্ড না যে তাকে পড়তে,বসতে বাঁচাবো। ইট ইজ নট মাই ডিউটি।

— ও আমাদের মেহমান, তাই ওর দ্বায়িত্ব এখন আমাদেরই।

নিদ্রান বিরক্তি নিয়ে বলে,

— তো দায়িত্ব পালন করেছি না? নিজের স্বাদের ঘুম ছেড়ে গিয়েছিলাম না তাকে আনতে?

শারমিন বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

— অহ আচ্ছা, আজ তোর ঘুম পুরো হয়নি বলে এমন রুক্ষ আচরণ করছিস। তাই তো? যা এখনই গিয়ে ঘুমা। নিজের স্বাদের ঘুম, ঘুমিয়ে পূরণ কর।

— তা তো করবোই। আর হ্যাঁ দুপুর হওয়ার আগে আমায় ডাকবা।

— আচ্ছা, খেয়ে তারপর ঘুমাতে যা।

নিদ্রান হালকা হেসে বলে,

— কিউট মম আমার।

শারমিন কিছু না বলে নীরবে হাসে। দ্যুতি এতক্ষণ নীরব দৃষ্টিতে দেখছিল সব। তাদের খুনসুটি দেখে দ্যুতির বাসায় ফোন করার কথা মনে পড়ে গেল। তাই তাদের কথোপকথন শেষ হতেই দ্যুতি বলে উঠে,

— আন্টি আমার বাসায় ফোন করার দরকার ছিল। আপনার ফোন যদি দিতেন, আমার তো সিম নেই।

শারমিন বেগম দ্যুতির দিকে তাকিয়ে বলেন,

— হ্যাঁ, তুমি খেয়ে নাও তারপর আমার ফোন দিয়ে কথা বলে নিও। আর সিমসহ বাকি টুকটাক যা লাগে, বিকেলে নিদ্র-এর সাথে গিয়ে তুলে নিও।

দ্যুতি একপলক নিদ্রানের দিকে তাকিয়ে শারমিন বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,

— আচ্ছা।

________________

বিকেল হওয়ার পরমুহূর্তেই দ্যুতি নিদ্রানের সাথে বেরিয়ে পড়ে গ্রেন্ড বাজারের উদ্দেশ্য, প্রয়োজনীয় ও টুকটাকি জিনিস কিনতে। নিদ্রানের বাসা থেকে গ্রেন্ড বাজার কাছে বলে হাটাই ধরলো তারা। নিদ্রান আগে আগে হাটছে আর দ্যুতি তার পিছে পিছে। দ্যুতি দ্রুত হাঁটতে পারছে না বলে নিদ্রানকে আস্তে হাটতে বলে কিন্তু নিদ্রান তার কথা কানে তুলে নি। নিজের মতই হেঁটে চলেছে। বিকেলের সময় হওয়া রাস্তা-ধারে ভিড়টা একটু বেশি। যার দরুন দ্যুতি ভিড় এগিয়ে যেতে না পেরে বেশ খানিকটা পিছে পড়ে যায়। কিছু সময়ের ব্যবধানেই ভীড়ের মাঝে নিদ্রান তারর দৃষ্টির অগোচর হয়ে যায়। দ্যুতি ক্ষণেই ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেলেও নিদ্রানকে আর দেখতে পায় না৷ হারিয়ে ফেলে তাকে। দ্যুতি এইবার বিচলিত হয়ে উঠে, উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে খুঁজতে শুরু করে নিদ্রানকে। অতঃপর তাকে না পেয়ে হতাশ হয়ে রাস্তার একপাশে এসে দাঁড়ায়। অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় চারপাশে। দ্যুতি এইভাবেই এইখানে নতুন, তেমন কিছুটা একটা চিনে না, ঠিকমত জায়গার নামও জানে না। উপরন্তু, নিদ্রানের বাসার এড্রেসও তার খেয়াল নেই যে জনে জনে জিজ্ঞেস করে বাসায় ফিরে চলে যাবে। তার এখন নিদ্রানের উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। একটা মানুষ কতটা দায়িত্ব ও জ্ঞানহীন হলে কেউ এই রকম আচরণ করে তা জানা নেই দ্যুতির। তার সাথে নিদ্রানের সমস্যা বা শত্রুতা কি তাই দ্যুতি ধরতে পারছে না। তার কোন পাকা ধানে সে মই দিয়েছে, আল্লাহ জানে। দ্যুতি এইবার বিরবির করে বলে উঠে,

— যত-যায় ঝামেলায় আমাকে আজকেই পড়তো হলো। যতসব! বুঝি না, আমার জন্য আজকের দিনই কুফা নাকি মানুষটাই কুফা।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here