#প্রণয়ের_ঢেউ ২য়_খন্ডের,সূচনা_পর্ব
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
নিজের হবু বরকে অন্যের সাথে বিয়ে হতে দেখার মতো পরিস্থিতিতে কখনো পড়তে হবে ভাবতে পারে নি দ্যুতি। নিজের ভালোবাসাকে তুলে দেওয়া এতোটা কষ্টের সেটা আগে বুঝতে পারলে দ্যুতি কখনো এই দুঃসাহসিক কাজ কখনোই করতো না। আজ যেখানে অরণ্যের পাশে তার নাম থাকার কথা আজ সেখানে অন্যের নাম। তাও কিনা সেটা দ্যুতি নিজেই বসিয়েছে। দ্যুতি আরেকবার বিয়ের কার্ডে লিখা বর ও কনের নামের দিকে চোখ বুলালো। আলতো হাতে অরণ্যের নামটি ছুঁয়ে দিতে গিয়েও পাশে নুরি নামটা দেখে থেমে যায়। ঝাপসা নয়নে ভারি পল্লব ফেলতেই টুপ করে চিবুক বেয়ে কার্ডের উপর গড়িয়ে পড়লো কয়েকটি অশ্রুকণা। হৃদয়ের অন্তঃস্থলে চাপিয়ে রাখা কষ্টগুলো বেরিয়ে এলো। দহনে শেষ হতে থাকলো মন ও হৃদয় দুইটি। দ্যুতি চোখ দুটি বন্ধ করে বিরবির করে উঠল,
— হবু বর তো আপনি আমার ছিলেন অরণ্য ভাইয়া। আজ আপনার বউ হওয়ার কথা তো আমার ছিল। আপনার সাথে সংসার বাঁধার কথা ছিল। তাহলে এমনটা কেন হলো না? ভাগ্য কেন এত নির্দয় হলো আমাদের সাথে?
হঠাৎ দ্যুতির খেয়াল একটু আগে সে অরণ্যকে নিজের হবু বর বলেছে। হবু বর কথাটা আওড়াতেই দ্যুতি মূর্ছা যায়। আনমনে বলে উঠল,
— আদৌ কি সে আমার হবু বর ছিল? না, সে ছিল না। বর তাকে আমি মেনেছিলাম ঠিকই কিন্তু তা দৃষ্টির আড়ালে। মনে মনে। যা ছিল ভিত্তিহীন। তাই তাকে হবু বর বলার অধিকার আমার নেই। তিনি নুরি আপুর হবু বর, আমার না।
নিজের সাথে নিজেই কতক্ষণ যুদ্ধ করলো দ্যুতি। নিজের মনকে মানাতে চাইলো, মনের অন্তরালে বোনা ছোট ছোট স্বপ্নগুলো কখনো কখনো পূর্ণতা পায় না। অপূর্ণতায় পরিতৃপ্ত হওয়ার জন্যই ওই স্বপ্নগুলোর সৃষ্টির। অরণ্যের কাছ থেকে দূরে সরে আসার সিদ্ধান্ত তার ছিল। একান্ত তার। সেই সিদ্ধান্তেই তাকে অটল থাকতে হবে। আবেগে ভেসে গেলে হবে না, তাকে শক্ত থাকতে হবে। দ্যুতি যখন নিজেকে এইসব বুঝ দিচ্ছে তখনই ডাক পড়লো শাহিদা বেগমের। তিনি চেঁচিয়ে বলছেন,
— দ্যুতি কই তুই? একটু গিয়ে দেখতো দিহান কোথায়? হাদাটা কখন কাঁচা হলুদ আনতে পাঠিয়েছিলাম এখনও খোঁজ নেই। যা তো। এই দ্যুতি!
দ্যুতি কোনমতে কণ্ঠনালী স্বাভাবিক রেখে উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে বলে,
— যাচ্ছি মা।
অতঃপর অরণ্যের বিয়ের কার্ডটা বালিশের নিচে লুকিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। মুখে চোখে ভালো মত পানি বেরিয়ে যায় রুম থেকে। বাসায় কোথায় দিহানকে দেখতে না পেয়ে দ্যুতি চলে যায় ছাদে৷ ছাদে এসেই দ্যুতির বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে৷ দহনে রিক্ততা বৃদ্ধি পায় তখনই। সে সিক্ত দৃষ্টিতে তাকায় চারদিকে। রাতে অরণ্যের হলুদের অনুষ্ঠান বলে ছাদটা এখন সাজানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে স্টেজ বানানো শেষ। এখন শুধু তা ফুল দিয়ে সাজানো বাকি। স্টেজ থেকে চার-পাঁচ হাত দূরেই স্পিকারের বড় বড় বক্স পরে আছে। চেয়ার গুলো অবিন্যস্ত আকারে পরে আছে এদিক সেদিক। তারই বিপরীত পাশে ডেকোরেশনের লোকেরা মিলে মরিচ বাতিগুলো ঝুলাচ্ছে। ছোট বাচ্চারা এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছে। উচ্ছাসে পরিপূর্ণ যেন পরিবেশ। ক্ষণেই দ্যুতির বুক চিরে বেরিয়ে দীর্ঘশ্বাস। যে ছাদের আনাচে-কানাচেতে রটেছিল এক মধুর প্রেমকাহিনী, সেই আনাচে-কানাচেতে আজ ভেসে বেড়াবে বিচ্ছেদের আত্মগ্লানি। এইটাকেই হয়তো বলে ভাগ্যের লিখন।
বিষাক্ত হয়ে আসা অনুভূতিগুলো ছন্নছাড়া হওয়ার পূর্বেই দ্যুতি নিজের অশ্রুসিক্ত নয়ন মুছে এগিয়ে যায় ভিতরে। ছাদের একপাশে দিহানকে ফোনে কথা বলতে দেখে এগিয়ে যায় সেদিকে। দ্যুতিকে পাশে এসে দাঁড়াতে দেখে দিহান একপলক তার দিকে তাকায়। দ্যুতিকে একটু অপেক্ষা করতে বলে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফোন আলাপে। অতঃপর কথা শেষ হতেই সে দ্যুতির দিকে তাকিয়ে তার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলে,
— এইখানে এসেছিস কেন? কোন দরকার?
দ্যুতি মাথা ঝাকিয়ে স্মিত হেসে বলে,
— মা নাকি তোকে কাঁচা হলুদ আনতে বলেছিল। এনেছিস?
দিহান নিজের কপালে চাপড় মেরে তিক্ত কন্ঠে বলে,
— এত কাজের মধ্যে এইসব মনে থাকে? এমনেই সবাই মিলে কামলা খাটাচ্ছে আমায়। কিভাবে যে এখনো সুস্থ আছি তা শুধু আমি জানি।
দ্যুতি পুনরায় স্মিত হেসে বলে,
— তোর এক মাত্র বন্ধুর বিয়ে, কামলা না খাটলে কি হয়? এখন দ্রুত যা, কাঁচা হলুদ নিয়ে আয় নাহলে মায়ের ঘ্যানঘ্যানানি শুরু হয়ে যাবে।
— তোর বলতে হবে না, যাচ্ছি আমি। যত জ্বালা আমারই। ড্যাম!
কথা বলে দিহান দ্যুতির পাশ কাটিয়ে চলে যায়। কিছু দূর যেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে দ্যুতির দিকে তাকিয়ে বলে,
— এই তুই ওইখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস? নিচে চল। নাহলে মাকে বলে তোর আচ্ছা খবর করাবো।
দ্যুতির বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
— আরেহ ভাই! আসছি।
_____________
গোধুলি পেরিয়ে ধরণীর বুকে আঁধার নেমে আসতেই জ্বলে উঠেছে বিল্ডিংয়ের গায়ে লাগানো মরিচ বাতিগুলো। সোরগোলের মাঝে মেতে উঠেছে পরিবেশ। মাগরিব আযানের পর পরই মৃদুস্বরে বাজতে শুরু করেছে গান-বাজনা। বেশি না হলে সামান্য কিছু মেহমানের আনাগোনা শুরু হয়ে গিয়েছে। কাছের আত্মীয় ব্যতীত আর কাউকেই ডাকা হয়নি। অবশ্য এক মাত্র ছেলের বিয়ে হিসাবে শাখাওয়াত সাহেবের ইচ্ছা ছিল আরও কিছু মানুষকে ডাকার, জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে সকল অনুষ্ঠান করার। কিন্তু অরণ্যর জন্য পারেন নি। অরণ্য প্রথমে কোন প্রকার অনুষ্ঠানই করতে চায়নি, অজ্ঞাত শাখাওয়াত সাহেবের মন রক্ষার্থে রাজি হয়েছিল। কিন্তু তাও শর্ত জুড়ে দিয়েছিল সে যাতে বেশি মানুষ দাওয়াত না করেন, সব যাতে হয় সাদামাটা। নাহলে ফল খারাপ হবে। তিনিও তখন বিনাবাক্যে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। ছেলে যে বিয়েতে রাজি হয়েছে এইটাই ঢের, অনুষ্ঠান নাই বা তার মন মত হোক।
অনুষ্ঠান শুরু হতেই সকলে বরের খোঁজ শুরু করে দিল। কিন্তু তার তো খোঁজই নেই। শাহিদা বেগমের কানে খবরটা পৌঁছাতেই তিনি চিন্তিত হয়ে উঠেন। অরণ্যের মা নেই বলে তাকেই সব দিক সামাল দিতে হচ্ছে। এতে অবশ্য তার কোন আপত্তি নেই৷ ছোট থেকে তো তিনিই অরণ্যকে ভালোবেসে লালন-পালন করেছেন। দিহানের পাশাপাশি অরণ্যকেও নিজের আপন সন্তান হিসাবেই মেনে এসেছেন। তাই তো, অরণ্যের বাবা শাখাওয়াত সাহেব অরণ্যের বিয়ের সকল দায়িত্ব শাহিদা বেগমের হাতে নিশ্চিন্তে তুলে দিয়েছেন। কিন্তু এখন সেই দায়িত্ব বোধহয় তিনি ঠিকমতো পালন করতে পারছেন না। হিমশিম খাচ্ছেন। এইটা নিয়েই তার চিন্তার শেষ নেই, তার উপর অরণ্যের এমন খাপছাড়া ভাব। সব মিলিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছেন তিনি। তিনি ডালার কাজটা অসম্পূর্ণ রেখেই ডাক দিলেন দ্যুতিকে। দ্যুতি তখন সবেমাত্র গায়ে ওড়নাটা জড়িয়েছিল৷ মায়ের ডাক পড়তেই সে চলে যায় মায়ের কাছে। দ্যুতিকে সাদামাটা বেশে দেখে শাহিদা বেগম অকপট রাগ দেখিয়ে বলেন,
— এখনও রেডি হোস নি কেন? হলুদ শেষে কি রেডি হবি? কি করছিলি এতক্ষণ?
দ্যুতি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
— ভাল্লাগছিল না মা। তাই শুয়ে ছিলাম।
— তোর ভাল্লাগে কোন দিন শুনি? যা এখনই গিয়ে সাজবি। তারপর গিয়ে দেখবি অরণ্যকে এখনো স্টেজে নেওয়া হয়নি কেন। সবাই খোঁজ করছে তো৷ আমি যেতাম কিন্তু এখন কাজ ছেড়ে যেতে পারছি না।
দ্যুতি কিছু না বলে রুমে চলে গেল।
______________
অরণ্যের রুমের সামনে তার কিছু কাজিন আর বন্ধুরা দাঁড়িয়ে আছে। দিহানও সেখানেই আছে। সকল মিলেই তাকে তাড়া দিচ্ছে তৈরি হওয়ার জন্য। কিন্তু অরণ্যের মাঝে কোন হেলদোলই নেই। সে বিছানার উপর নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে পা ঝুলাচ্ছে। মুখভঙ্গিতে তার বিরক্তির রেখা স্পষ্ট। অতঃপর তার সহ্যের সীমা অতিক্রম হতেই সে সকলের উপর গর্জে উঠে। তার গর্জনে সকলে কেঁপে উঠে, দিহানের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে একেক করে সকলে কেটে পড়ে। অরণ্য যত যাই করুক না কেন দিহানকে সে কিছু বলবে না তা সকলেরই জানা। আফটার অল দিহান তার কলিজার বন্ধু বলে কথা৷ ছোট থেকে একই সাথে বেড়ে উঠেছে তারা, তাই সকলেই আশাবাদী দিহান বুঝালে ঠিক অরণ্য রেডি হয়ে উপরে চলে আসবে।
দিহান এইটা সেটা বলে তাকে রেডি হতে বলছে কিন্তু অরণ্য তা বার বার অনাগ্রহ করছে। সবটাই দ্যুতির দরজার পাশ থেকে দেখছে আর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলছে। অতঃপর মনের ভিতর সাহস জুগিয়ে সে চলে যায় ভিতরে। দিহানের দিকে তাকিয়ে বলে,
— ভাইয়া তোকে বাবা খুঁজছে। তুই একটু নিচে যা তো।
দিহান উঠতে উঠতে বলে,
— তুই একটু অরণ্যকে রেডি হতে বলতো, আমার কথা তো এই হারামি শুনছেই না। তোর যদি শুনে। আমি ততক্ষণে নিচ থেকে আসছি।
কথাটা বলেই দিহান চলে গেল। দ্যুতি এইবার অরণ্যের পড়ার টেবিলের উপর থেকে অরণ্যের পাঞ্জাবীটা নিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে স্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
— রেডি হচ্ছেন না কেন? সকলে তো অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। জলদি রেডি হয়ে নিন তো।
অরণ্য নিষ্পলক দৃষ্টিতে দ্যুতির মুখপানে তাকিয়ে থাকে। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
— মন ও শরীর কোনটাই তো টানছে নারে চাঁদ৷
দ্যুতি এইবার অরণ্যের চোখের দিকে তাকাতেই দুইজনের দৃষ্টি এক সুতোয় এসে মিলিত হয়। দ্যুতি দ্রুত নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে কম্পিত কন্ঠে বলে,
— কেন এমন করছেন? ভালোয় ভালোয় সব মিটিয়ে নিন না৷
— ভালো আছেটা কি যে ভালোয় ভালোয় সব মিটিয়ে নিব?
দ্যুতি কিছু না বলে চুপটি মেরে থাকে। কি বলবে সে এই কথার পৃষ্ঠে? কিছু কি বলার আছে? হঠাৎ অরণ্য দ্যুতির হাতটা চেপে ধরে ওর সামনে এনে দাঁড় করায়৷ অতঃপর নিস্তেজ কন্ঠে বলে,
— ভালো আছিস চাঁদ?
কথাটা শোনামাত্র দ্যুতির বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠে। গলা ধরে আসতে চায় তখনই। দূর্বল হয়ে আসে মন। অন্তস্থলের গহীন থেকে কেউ চিৎকার করে বলে উঠতে চাইছে, “না আপনি ভালো নেই৷ একদম ভালো নেই। আপনাকে ছাড়া আপনার চাঁদ কিভাবে ভালো থাকতে পারে বলুন?” কিন্তু দ্যুতি সেই কন্ঠ চাপা দিয়ে মুখে মিথ্যে হাসি টেনে বলে,
— হ্যাঁ, আমি খুব ভালো আছি৷ দেখছো না আজ তোমার হলুদ বলে কত সুন্দর করে আমি সেজেছি৷ কত খুশি আমি।
— কিন্তু তোকে ছাড়া যে এই অরণ্য ভালো নেই রে চাঁদ। একটুও নেই।
দ্যুতি কোনমতে নিজে সামলে বলে,
— আমি তোমার কাছে তোমার বন্ধুর বোন ব্যতীত কিছু নই। তাই খামাখা পিছুটান বারিও না। জলদি রেডি হয়ে উপরে চলে আসো। আমি যাচ্ছি এখন।
কথাটা বলেই দ্যুতির অরণ্যের কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায়৷ রুম ত্যাগ করার পূর্বেই অরণ্যের দৃষ্টির অগোচরে দ্যুতির চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে এক ফোঁটা নোনাজল। দ্যুতি বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট দুয়েক পরই শাখাওয়াত সাহেব রুমে ভিতরে আসেন। অরণ্যের সামনে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বলেন,
— বাবা, রেডি হচ্ছো না কেন? সবাই অপেক্ষা করছে তো। কিছু কি হয়েছে?
অরণ্য পাঞ্জাবী হাতে নিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,
— যা হওয়ার তা আগেই হয়ে গিয়েছে। নতুন করে হওয়ার মত কিছুই নেই। চিন্তা নেই, আমি রেডি হয়ে নিচ্ছি। তুমি যাও।
শাখাওয়াত সাহেব অরণ্যের কথার মানে বুঝতে পেরে অরণ্যের একটি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে বলেন,
— আমি দায়বদ্ধ না থাকলে কখনোই তোমায় এই বিয়ে করার জন্য বাধ্য করতাম না, বাবা। বুঝার চেষ্টা কর।
অরণ্য নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে,
— তোমার দায়বদ্ধতা আমার নিঃস্ব করে দিল বাবা।
কথাটা বলেই সে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। শাখাওয়াত সাহেব সেদিকে তাকিয়েই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।
_______________
অরণ্য সকলের মাঝে আসতেই হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যায়। গান বাজনার মাঝেই একেক করে সকলে অরণ্যকে হলুদ ছুঁয়ে দেয়। অবশেষে দ্যুতি যখন হলুদ ছুঁয়ে দিতে যায় তখন তার হাত কেঁপে কেঁপে উঠে। বুকটা বার বার দুমড়ে মুচড়ে যেতে শুরু করে। কষ্টরা হানা দেয় পলকেই। সিক্ত হয়ে আসা চোখে তাকায় অরণ্যের পানে। নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে আজ সে নিজের হাতে অন্যের নামের হলুদ ছুঁয়ে দিচ্ছে৷ নিজেই একটু একটু ঠেলে দিচ্ছে অন্যের তীরে। নিজের ভালোবাসাকে বিলীন করছে অন্যের নামে। এর চেয়ে বেশি বেদনাদায়ক অনুভূতি পৃথিবীতে আর দুটো আছে কি-না দ্যুতির জানা নেই। যতই সে নিজেকে শক্ত করুক না কেন, দিন শেষে অরণ্যের সামনে এসে সে দূর্বল হয়ে পড়ে। যেমনটা এখন পড়ছে। দ্যুতি কোনরকম অরণ্যকে হলুদ ছুঁয়ে দূরে সরে আসে। অরণ্যের আশেপাশে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না। একদমই না।
হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে ঘন্টাখানিক আগেই। অনুষ্ঠান শেষেই অরণ্যের কাজিন আর বন্ধুরা মিলে ওকে চেপে ধরে। জোর করেই বসিয়ে রাখে তাদের মাঝে। অরণ্য প্রথমে চলে যেতে চাইলেও সকলের চাপাচাপিতে আর তা পারলো না। অজ্ঞাত চুপটি মেরে বসে থাকতে হইলো। সকলেই এইখানে উপস্থিত বলে দ্যুতিকেও এইখানেই বসতে হলো। আড্ডা একসময় জমজমাট হতেই সকলে আবদার করলো অরণ্যকে গান গাওয়ার জন্য। অরণ্য বার বার মানা করা সত্ত্বেও কেউ মানলো না। শতবার বলেই গেল। অবশেষে দ্যুতি অরণ্যকে গান গাইতে বললে অরণ্য রাজি হয়ে যায়। হয়তো দ্যুতিকে নিজের শেষ গানটা শোনানোর সুযোগটা হাত ছাড়া করতে চাইলো না। দিহান অরণ্যের রুম থেকে গিটারটা আনতেই অরণ্য সুর তুললো তাতে। টুংটাং শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে গাইতে থাকলো,
“আমার কল্পনা জুড়ে
যে গল্পেরা ছিলো
আড়ালে সব লুকোনো
সেই গল্পেরা সব
রঙিন হল পলকে
তোমাকে হঠাৎ পেয়ে যেন
প্রেম তুমি আসবে এভাবে
আবার হারিয়ে যাবে ভাবিনি
আজও আছে সেই পথ শুধু নেই তুমি
বলো কোথায় আছো অভিমানী?”
পুরো গানটা অরণ্য দ্যুতির দিকে তাকিয়েই গাইলো। নিষ্পলক ভাবেই। অরণ্য এমন ভাবেই গানটি গাইলো যে, তার ভিতরকার অবস্থা সম্পূর্ণরূপে ধরা দিল দ্যুতির নিকট। অরণ্যের গাওয়া প্রত্যেকটি লাইনে যে তার কষ্টগুলো লুকায়িত ছিল তা দ্যুতি জানে। হঠাৎই দ্যুতির হৃদয় আর্তনাদ করে উঠে। গলা জড়িয়ে আসে ক্ষণেই৷ সিক্ত হয়ে আসা চোখজোড়া লুকাতে দ্যুতি গান শেষ হওয়ার পর মূহুর্তে উঠে দাঁড়ায়। চলে যায় নিচে, নিজের ঘরে। কোনমতে দরজা ভিজিয়ে বিছানার কাছে চলে যায়। বালিশে নিজের মুখ গুঁজে বিসর্জন দিতে থাকে নিজের কষ্টগুলো অশ্রুরুপে। ভাগ্য আজ তাদের দুইজনকে এমন এক জায়গায় দাঁড় করিয়েছে যেখানে না পারছে কেউ আগাতে, না পারছে পিছাতে। অতীতের পিছুটানে আবদ্ধ দুটি হৃদয় শুধু পুড়ছে উত্তপ্ত দহনে। ভালোবাসায় এতটা কষ্ট তা জানলে দ্যুতি হয়তো কখনোই ভালোবাসার মত দুঃসাহসিকতা দেখাত না। কখনো না!
_________________
নিস্তব্ধতায় পরিপূর্ণ পরিবেশ। ঘড়ির কাটা জানান দিচ্ছে মধ্যরাত পেরিয়ে যাচ্ছে। এখনই সময় নিশাচর প্রাণীগুলোর আঁধারে মিইয়ে যাওয়ার। জানালার পাতলা পর্দা ভেদ করে শীতল হাওয়া এসে দ্যুতির গায়ে পরশ বুলাতেই দ্যুতি ঘুমের মাঝে কেঁপে উঠে। কান্না করতে করতেই দ্যুতি কখন ঘুমিয়ে পড়িয়েছিল তা তার জানা নেই৷ ভিতরকার শীতল অনুভূতি নাড়া দিয়ে উঠতেই দ্যুতির ঘুম আলগা হয়ে আসে। আসতে করে গায়ের ওড়নাটা গায়ে আরেকটু টেনে নেওয়ার চেষ্টা করতেই হঠাৎ অতি শীতল কিছু তার পা জড়িয়ে ধরে। ধীরে ধীরে সেই বাঁধন শক্ত হতেই ভড়কে উঠে দ্যুতি। এত রাতে তার রুমে কে এসেছে তা ভাবতেই ঘুম ছুটে যায় তখনই। সে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে সামনে দিকে তাকায়। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসায় কোন কথাই বের হচ্ছে না গলা থেকে। তাই সে আবছা অন্ধকারে বুঝার চেষ্টা করে আসলে তার পায়ের কাছে কে। অতঃপর সে যাকে দেখলো তাতে যেন তার দুনিয়া মূহুর্তেই দুমড়েমুচড়ে বিষিয়ে গেল। বিষিয়ে গেল সে নিজেও।
#চলবে
একটা বিষয় প্রথমেই ক্লিয়ার করে দেই, এই উপন্যাসটা বুঝার জন্য ১ম খন্ডটা পড়া যে আবশ্যক তা কিন্তু নয়। তাই ১ম খন্ড না পড়লেও সমস্যা নেই। ২য় খন্ড পড়েই আপনি সম্পূর্ণ কাহিনী বুঝতে পারবেন।