প্রণয়ের_ঢেউ #Part_05

0
781

#প্রণয়ের_ঢেউ
#Part_05
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat

আজ রুহি বেগমের মৃত্যুবার্ষিকী। মানে অরণ্যের মায়ের। প্রতিবছর এইদিনটায় শাখাওয়াত সাহেব তার প্রিয়তম স্ত্রীর নামে মিলাদ পড়ান ও এতিমখানায় খাবার দেন। আর সেই খাবারটা শাহিদা বেগম নিজ হাতেই রান্না করে দেন। রুহুল সাহেব আর দিহানও মিলাদ পড়াতে এবং খাবার বিতরণ করতে অরণ্য ও শাখাওয়াত সাহেবের সাহায্য করেন। যার দরুন দিনটা দুই পরিবারেরই ব্যস্ততায় কাটে।
দ্যুতি গোসল করে বের হতেই শাহিদা বেগমের ডাক পড়লো। দ্যুতি চুলগুলো মুছে এগিয়ে গেলো রান্নাঘরের দিকে। রান্নাঘরের সামনে আসতেই দেখলো শাহিদা বেগম খাবারের প্যাকেটগুলো গুণছেন। প্যাকেটগুলো গোণা শেষে তিনি বলে উঠলেন,

— অরণ্যকে গিয়ে একটু বল খাবার হয়ে গিয়েছে।

দ্যুতি মাথা নেড়ে সাই জানিয়ে চলে যায় উপরে। ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখতে পেলো দিহান আর অরণ্য মিলে ড্রয়িংরুমটা গুছাচ্ছে। হয়তো একটু পর হুজুররা এসে পড়বে বলে। দ্যুতি সোজা অরণ্যের কাছে গিয়ে বলে,

— ভাইয়া খাবার হয়ে গিয়েছে৷

অরণ্য একপলক দ্যুতির দিকে তাকিয়ে বলে,

— আচ্ছা।

কথাটা বলেই অরণ্য পুনরায় কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর দ্যুতিও কোন কাজ না পেয়ে নিচে চলে আসে। মিনিট দশেকের মাঝেই রুহুল সাহেব হুজুর নিয়ে হাজির হলেন। মিলাদ ও খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই দিহান,অরণ্য, রুহুল সাহেব ও শাখাওয়াত সাহেব বেড়িয়ে যান এতিমখানার উদ্দেশ্য। সকলে বেড়িয়ে যেতে দ্যুতি চুপচাপ গিয়ে বসলো শাহিদা বেগমের পাশে। শাহিদা বেগম অরণ্য আর দিহানের ছোট বেলার ছবি দেখছেন। দ্যুতিও তাই কোন কথা না বলে নীরবে সেগুলো দেখতে থাকলো।

মায়ের মুখ থেকে সে শুনেছে, অরণ্য আর দিহান ছোটবেলা থেকেই বন্ধু৷ একই বিল্ডিংয়ে তাদের ফ্ল্যাট ছিল বিধায় দুইজনের পাশাপাশি দুই পরিবারের মাঝেও খুব দ্রুতই সখ্যতা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। রুহি বেগমের সাথে শাহিদা বেগমেরও হয়ে গিয়েছিলেন একে অপরের সখী। দিন যত যায়, তাদের মধ্যকার সম্পর্ক বেশ ভালো হয়ে উঠে, সেই সাথে দিহান আর অরণ্যও। বছর খানিকপর শাহিদা বেগমের পেটে যখন দ্যুতি আসে তখন রুহি বেগমের কঠোর অসুখ হয় আর সেই যাত্রায় তিনি ইন্তেকাল করেন। অরণ্য তখন মাকে হারিয়ে একদম নিঃস্ব। ছোট মনে এত বড় আঘাত সইতে না পেরে অরণ্য মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করে। শাখাওয়াত সাহেব বেশ হিমশিম খাচ্ছিলেন অরণ্যকে সামলাতে। সেই সময় শাহিদা বেগমই অরণ্যকে আগলে নেন। দিহানের পাশাপাশি অরণ্যের দায়িত্বও নিয়ে নেন। তাই দিনের বেশির ভাগ সময় অরণ্য শাহিদা বেগমের কাছেই থাকতো। শাহিদা বেগমের ভালোবাসা,আর দিহানের সঙ্গ পেয়ে অরণ্য ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে। অতঃপর দ্যুতি হওয়ার পর অরণ্যের সকল মনোযোগ চলে গিয়েছিল সেদিকেই। সারাক্ষণ দ্যুতির পাশে বসেই খেলা করতো সে। দিহান দ্যুতির সাথে খেলতে চাইলে খেলতে দিত না সে। ঝগড়া করতো। অনেক কষ্টে তখন তিনি দিহান আর অরণ্যকে সামলাতেন। শাহিদা বেগম কখনো অরণ্যকে পর ভাবেন নি। সর্বদাই, দিহান আর দ্যুতির পাশাপাশি অরণ্যকেও নিজের সন্তানের মতই ভেবেছেন। স্নেহ করেছেন। দ্যুতি ও দিহানের জন্য বিশেষ কিছু রান্না করলে অরণ্যকে না দিয়ে কখনোই সেটা দ্যুতি আর দিহানকে দিতেন না। কোথাও ঘুরতে গেলেও তিনি অরণ্যকে সাথে নিয়েই যেতেন। যে কোন জায়গায় গেলে অরণ্যকে নিজের সন্তান বলেই পরিচয় দিতেন। এখনোও পর্যন্ত শাহিদা বেগম বলে বেড়ান, তার তিন সন্তান। অরণ্য,দিহান ও দ্যুতি।

কথাটা ভেবেই দ্যুতি দীর্ঘশ্বাস নেয়। হঠাৎ একটা ছবির দিকে তার নজর আটকে যায়। ছবিতে অরণ্য দ্যুতিকে কোলে নিয়ে বসে আছে আর তা পাশেই একটা প্লে-বোর্ডে ‘হ্যাপি বার্থডে চাঁদ’ লিখা। সম্ভবত এইটা দ্যুতির প্রথম বার্থডের ছবি। ছবিটা দেখে দ্যুতির শাহিদার বেগমের বলা আরেকটা কথা মনে পড়ে গেলো।

যখন দ্যুতি হয়েছিল তখন অরণ্য নাকি ওর দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। বার বার ঘুরে ঘুরে তাকে দেখছিল। অবশেষে সে জিজ্ঞেস করে বসেছিল,

–” আন্টি এই বাবুটার নাম কি? আমি একে কি বলে ডাকবো? ”

শাহিদা বেগম তখন কোন উত্তর দিতে পারেন নি। কেন না তখনও যে দ্যুতির নাম ঠিক করেননি তারা। তাই শাহিদা বেগম বলেছিল,

— তার তো এখনো নাম রাখা হয়নি। তুমিই বরং একটা নাম রেখে দাও।

অরণ্য তখন ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিল,

— তাহলে আমি ওকে চাঁদ বলে ডাকি? দেখো, চাঁদ আর ওর গায়ের রঙ একদম সেম সেম।

শাহিদা বেগম তখন মুচকি হেসে সম্মতি জানিয়েছিলেন। অরণ্য দ্যুতির নাম ‘চাঁদ’ রাখলেও অন্য কারোর সেই নামে দ্যুতিকে ডাকার অধিকার ছিল না। অধিকার ছিল না বলতে অরণ্যই অন্য কাউকে দ্যুতিকে এই নামে ডাকতে দেয়নি ৷ এমনকি দিহানকেও না। ওর মতে, ও যেহেতু দ্যুতিকে ‘চাঁদ’ নামটা দিয়েছে সেহেতু সেই ওই নামে ডাকবে তাকে। আর কেউ না।

কথাটা ভেবেই দ্যুতি আনমনে হেসে উঠলো। মানুষটা পাগলাটে হলেও খানিকটা অন্যরকম।

___________________

পরিষ্কার আকাশে খিলে উঠেছে পূর্ণ চাঁদ। তারই আলো গলিয়ে পড়ছে ধরণীর বুকে। হিম শীতল বাতাসগুলো উত্তাপ দেহের ছোঁয়া পেয়ে বসাচ্ছে কামড়। কিন্তু তাতে যেনো অরণ্যের মাঝে কোন ভাবান্তর নেই। সে তো নির্বাক ভঙ্গিতে একেক পর এক সিগারেট জ্বালিয়েই যাচ্ছে আর আনমনে কি যেন ভাবছে। নিজের ভাবনায় এতই বিভোর ছিল সে যে বুঝতেই পারলো সে ব্যতীতও ছাদে দ্বিতীয় কারো অস্তিত্ব আছে। হঠাৎ তার হাত থেকে কেউ সিগারেট টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলতেই অরণ্য হকচকিয়ে যায়। সচেতন দৃষ্টিতে তাকায় পাশে থাকা মানুষটির দিকে। চাঁদের আবছা আলোয় দ্যুতি মুখশ্রী অরণ্যের নিকট স্পষ্ট হতেই সে কিছুটা স্বস্তিবোধ করে। দ্যুতি ক্ষণেই বাজ কন্ঠে বলে উঠে,

— আপনি আবার সিগারেট খাচ্ছেন? আপনাকে না আমি, না করেছি এইসব খেতে।

অরণ্য ছাদের রেলিং এর উপর হাত রেখে নিজের সম্পূর্ণ ভড় ছেড়ে দিয়ে নির্বোধ কন্ঠে বলে,

— তুই মানা করলেই আমার শুনতে হবে? আমার বড় তুই, গার্ডিয়ান আমার? পা ছুঁয়ে সালাম করবো? দে সামনে পা সালাম করি। দে!

দ্যুতি ফুঁসে উঠে বলে,

— সবসময় বাজে কথা। ভালো মত কথা বলা যায় না? কথা এত প্যাঁচান কেন বলুন তো?

— আমার কথা আমি প্যাঁচাবোই। হলে পাঁচমিশালি আচার করবো। তারপর পুরো মহল্লায় বিলবো। তাতে তোর সমস্যা কই এত?

দ্যুতি হতাশাজনক নিঃশ্বাস নিয়ে বলে,

— কিছু না।

অরণ্য ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

— কিছু না হলে এইখানে এসেছিস কেন? ফিফটিন ডিগ্রি সেলসিয়াসে ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল হতে?

দ্যুতি নির্লিপ্ত কন্ঠে বলে,

— আমাদের বাসায় যেতে বলেছেন মা। একসাথে নাকি আজ খাবেন।

— আন্টিকে গিয়ে বল আরেকটু পর আসছি আমি।

দ্যুতি কিছুক্ষণ চুপ থেকে জিজ্ঞেস করে,

— মন খারাপ আপনার? আন্টিকে মনে পড়ছে?

অরণ্য নিষ্পলক দৃষ্টিতে দ্যুতির দিকে তাকায় বুঝার চেষ্টা করে, তার ছোট চাঁদটা কি আচমকাই বড় হয়ে গিয়েছে নাকি? নাকি সে অরণ্যের ভিতরটা বুঝতে শুরু করেছে? অরণ্যের মন যে আসলেই খারাপ করছে তার মায়ের জন্য। কিন্তু সেটা তো সে কোনভাবে প্রকাশ করেনি। তাহলে? অরণ্য বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে স্বাভাবিক কন্ঠেই বলে,

— বয়লার মুরগির মত পকপক না করে এইখানে থেকে যা তো। আসছি আমি একটু পরে।

________________

কাল থেকে এসএসসি পরীক্ষা শুরু। দ্যুতি বার বার সবকিছু রিভিশন দিলেও নার্ভাসনেসের জন্য সব গুলিয়ে ফেলছে। চাপা উত্তেজনা ঘিরে ধরেছে তাকে বেশ। দ্যুতির এমন অবস্থা দেখে অরণ্য ওকে বার বার রিল্যাক্স হতে বলছে আর সকল নিয়ম-কানুন শান্তি মাথায় বুঝিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু দ্যুতি যেন সেই কথা গায়ে মাখছে না। অতঃপর না পেরে অরণ্য ধমকে উঠে। অরণ্যের ধমক খেয়েই দ্যুতি শান্ত হয়ে যায়। অরণ্য এইবার গমগমে গলায় বলে,

— সামন্য পরীক্ষা দিতে যাচ্ছিস, যুদ্ধে শহীদ হতে না। ষ্টুপিড!

দ্যুতি কাঁচুমাচু হয়ে বলে,

— তাও ভয় লাগে তো ভাইয়া।

— সেই আন্ডাকাল থেকে পরীক্ষা দিয়ে আসছিস আর এখন বুইড়া বয়সে এসে বলছিস ভয় করে? ফাজলামো করিস,বেদ্দব? এতদিন যেভাবে পরীক্ষা দিয়েছিস এইটাও সেরকমই। তাহলে এত ভয়ের কি আছে?

— যদি কোন ভুল করি। পড়া তো সব মনে হচ্ছে এখনই ভুলে গিয়েছি। পরীক্ষায় কি লিখবো? পরীক্ষা যদি বাজে হয়? সব কমন যদি না পড়ে লিখবো কি?

— এমন এক ভাব করছিস যেন, পুরো ইউনিভার্সে তুই একাই কাল পরীক্ষা দিবি আর বাকি সব তো আঙ্গুল চুষবে। পরীক্ষা খারাপ হলে তোর একার না সবার যাবে। তোর জন্য দিপু মনি স্পেশাল কোন প্রশ্ন তৈরি করবে না। চুপচাপ যে প্রশ্নগুলো দাগিয়ে দিয়েছি সেগুলো ভালো মত রিভাইস কর।

দ্যুতি কিছু না বলে শুধু মাথায় নাড়ায়। অতঃপর মিনিট পাঁচেকের পর অরণ্য বলে উঠে,

— তোর হাত দে তো।

দ্যুতি এইবার ভ্রু কুঁচকে তাকায়। কৌতূহলী কন্ঠে জিজ্ঞেস কিরে,

— কেন?

— দিতে বলেছি দিবি। নাকি আমাকে তোর হাত দিলে সেটা খুঁয়ে যাবে?

দ্যুতি আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ অরণ্যের দিকে হাত এগিয়ে দেয়। অরণ্য এইবার নিজের পকেট থেকে একটা ঘড়ি বের করে। সেটা দ্যুতির হাতে পড়িয়ে দিতে দিতে বলে,

— কাল পরীক্ষা দেওয়ার সময় যদি একটুও নার্ভাস হয়েছিস বা ভুল করেছিস তাহলে তোকে আমি সেখানে গিয়েই থাপ্পড়ে সোজা করে আসবো। মাইন্ড ইট!

ঘড়িটা পড়িয়ে দিয়েই অরণ্য উঠে দাঁড়ায় এবং আর কোন দ্বিরুক্তি না করে সোজা চলে যায়৷ দ্যুতি সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতঃপর আনমনে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে দেয়।

______________________

চৈত্রের মধ্যভাগ। হিম শীতল বাতাসগুলো এখন পরিনত হয়েছে তপ্ত বাতাসে। গরম পড়ে গিয়েছে সেই সাথে দ্যুতির এসএসসি পরীক্ষাও পাঁচদিন আগেই শেষ হয়েছে। পরীক্ষা সবভ
গুলোই মোটামুটি ভালোই হয়েছে। তাই আপাতত দ্যুতির কোন দুশ্চিন্তা নেই। পরীক্ষা শেষ বলে সে এখন নিজের মন-মর্জি মত চলছে। সারাদিন খাওয়া-দাওয়া,ঘুম, টিভি ও মোবাইলে গেমস খেলেই দিন যাচ্ছে তার।

বিকেলে বিছানায় হেলান দিয়ে দ্যুতি মনোযোগ দিয়ে গেমস খেলছে। এমন সময় ডাক পড়ে অরণ্যের।

— চাঁদ! এই চাঁদ, এইদিকে আসতো।

দ্যুতি প্রথমে গেম ছেড়ে উঠতে না চাইলেও অরণ্যের ডাকাডাকিতে তাকে উঠতেই হলো। দ্যুতি একরাশ বিরক্তি নিয়ে দাঁড়ায় অরণ্যের সামনে। তেতো কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

— কি হয়েছে? এইভাবে ডাকছো কেন?

অরণ্য সোফায় মাথা হেলিয়ে দিয়ে ক্লান্ত কন্ঠে বললো,

— এক কাপ কফি করে দে তো।

— কফির জন্য খালি আমাকেই পান? মাকে বললেই তো হয়। প্রতিবার আমাকেই কেন আপনার জন্য কফি করতে বলেন?

অরণ্য মাথা তুলে দ্যুতির দিকে তাকিয়ে বলে,

— তোকে কফি বানাতে বলি কি তোর দাম বেড়ে গেছে নাকি? কুইন এলিজাবেথ হয়ে গিয়েছিস?

দ্যুতি কিছু না বলে চুপ করে থাকে। লোকটির সাথে কথা বাড়ানো মানেই তর্কে যাওয়া। অরণ্য পুনরায় সোফায় মাথা এলিয়ে দিয়ে দ্যুতির দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

— তুই ভালো করেই জানিস আমি তোর হাতের কফি বাদে অন্য কারো হাতের বা জায়গার কফি খাই না। সব জেনেও এত ভণিতা করছিস কেন? যা কফি করে নিয়ে আয়, মাথা ধরেছে।

দ্যুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

— হুম দিচ্ছি।

কথাটা বলেই দ্যুতি চলে যায় রান্নাঘরের দিকে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here