#প্রণয়ের_ঢেউ
#Part_06
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
গ্রীষ্মকালের এক রৌদ্রজ্বল দুপুরে ঘর্মাক্ত শরীর নিয়েই ঘন্টাখানিক ধরে কম্পিউটার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দ্যুতি। উদ্দেশ্য কলেজের জন্য এপ্লাই করা। কিন্তু সার্ভারে ডিস্টার্ব দেওয়ায় এখন পর্যন্ত সে এপ্লাই করতে পারেনি। পিছনেই একদল ছেলে-মেয়ে ঝাঁক দিয়ে আছে। সকল জায়গায় একই সমস্যা হওয়ায় কেউ এখন আর নড়ছে না। অলস ভঙ্গিতে একই স্থানে দাঁড়িয়ে আছে। দ্যুতি একবার নিজের কলেজ লিস্ট চেক করে নিলো। একটুর জন্য তার গোল্ডেন মিস হলেও নাম্বার ভালোই এসেছে। যার দরুন ঢাকার টপ ও পছন্দনীয় কলেজগুলোতে এপ্লাই করার সুযোগ পেয়েছে সে। এখন ভাগ্যক্রমে একটা ভালো কলেজে চান্স পেলেই হয়। হঠাৎ সার্ভার কাজ করছে শুনে সকল ছাত্র-ছাত্রী হামলে পড়লো সামনের দিকে। এতে দ্যুতি পড়ে হেলো ভীড়ের মাঝে আর চ্যাপ্টা হয়ে যেতে থাকলো সকলের ঠ্যালা-ঠ্যালিতে। হঠাৎ একজোড়া শক্তপক্ত হাত ওকে আগলে নেয় আর ভীড় থেকে বের করে নিয়ে আসে। দ্যুতি মাথা তুলে অরণ্যকে দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। অরণ্য দ্যুতিকে একটা নিরিবিলি জায়গায় নিয়ে এসে দাঁড় করায়। অতঃপর গমগমে গলায় বলে,
— ভীড়ের মাঝে কি স্যান্ডউইচ হতে গিয়েছিলি তুই বেদ্দব? স্যান্ডউইচ হওয়ার এত শখ তা আমাকে বললেই হতো। এত কষ্ট করে এইখানে আসলি কেন?
দ্যুতি নিচু স্বরে বলে,
— আমি তো সামনেই ছিলাম। কিন্তু সকলের ধাক্কাধাক্কিতে মাঝে চলে আসি।
— এই কমন সেন্স নেই তোর? নিজের ভালো বুঝিস না কিছু? ঘটনাক্রমে বিষয়টা কত বিশ্রী হতো বুঝতে পারছিস?
দ্যুতি কথার অর্থ বুঝতে পেরে নতজানু হয়ে বলে,
— প্রথমে বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা।
— তা বুঝবি কেন? মাথায় তো গোবর ভরা তোর।একটু পর এপ্লাই করলে কি তোকে আর তোর এপ্লিকেশন সরকার লাথি মেরে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিত যে এতটা ডেস্পারেট হয়ে উঠেছিস? শান্ত থাকা যায় না?
— সরি!
— তোর সরি তুই রাখ। সরি দিয়ে কি আমি আচার বানিয়ে বেঁচবো নাকি? ষ্টুপিড!
দ্যুতি এইবার কিছু না বলে চুপ করে থাকে। অরণ্য তা দেখে ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে। তখনই আবার খবর আসে সার্ভার আবার ডাউন হয়ে গিয়েছে। কাজ করছে না। কথা শুনে দ্যুতি এইবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হতাশ দৃষ্টিতে তাকায় অরণ্যের দিকে। অরণ্য কিছু না বলে একটা টুল এনে দ্যুতির সামনে রেখে বলে,
— চুপচাপ এইখানে বস। এই সার্ভার ঠিক হতে সময় আছে। আমার পিসি নষ্ট নাহলে বাসায় বসেই এপ্লাই করতে পারতি। এত কষ্ট করতে হতো না।
দ্যুতি মিনমিনে স্বরে বলে,
— ভাইয়ারও এখনই ল্যাপটপ নিয়ে আউট অফ টাউন যেতে হলো। আমার কাজের বেলায় যত যায় ঝামেলা।
বেশ কিছুক্ষণ এইভাবেই অতিবাহিত হওয়ার পর অরণ্য বলে উঠলো,
— সকালে থেকে তো খাস নি কিছু তাই না?
দ্যুতি থমথমে গলায় বলে,
— না মানে, খিদে ছিল না তখন।
— তোর খিদে থাকে কখন শুনি? খেতে বললেই তো বলস খিদে নেই। আচ্ছা, তোকে না খেয়ে খেয়ে কনজুরিং মুভির ভুতনী হওয়ার আইডিয়া কে দিয়েছে বলতো?
দ্যুতি কিছু না বলতে কটমট দৃষ্টিতে তাকায়। অরণ্য সে দৃষ্টি তোয়াক্কা না করে বলে,
— দেখছি এইখানে কি পাওয়া যায়। তোকে আবার কিছু না খাওয়ালে দেখা গেলো রাতে আমার রুমে এসে সত্যি ভুতনী হয়ে আমায় বারবিকিউ করেই খেয়ে ফেলছিস।
দ্যুতি বিরবির করে বলে,
— আমি পারলে আপনাকে এখনই কাঁচা খেয়ে ফেলি।
হঠাৎ অরণ্য ঝুঁকে গিয়ে বলে,
— পারলে খেয়ে দেখা না। মানা করেছ কে?
কথাটা শুনে দ্যুতি পিলে চমকে উঠলো। অরণ্য দ্যুতির মুখভঙ্গি দেখে হালকা হাসে, নিজের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দ্যুতির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
— আমি আসা পর্যন্ত গেম খেল তুই। তোর পছন্দের গেম নামানো আছে ফোনে। আর শুন, আমি না আসা পর্যন্ত এইখান থেকে এক চুলও নড়বি না। মনে থাকো যেন।
দ্যুতি মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানিয়ে মোবাইলটা নিয়ে নেয়। অতঃপর অরণ্য যেতেই গেম খেলতে শুরু করে। কিন্তু চারপাশে সোরগোল হওয়ায় গেমে মনোযোগ টিকিয়ে রাখতে না পেরে গেম থেকে বেরিয়ে আসে। কি করবে, কি করবে ভাবতেই অরণ্যের গ্যালারিতে চলে যায় সে। গ্যালারিতে ঢুকে একেক ফোল্ডারে গিয়ে সব ছবি দেখতে থাকে৷ অতঃপর একটা ফোল্ডারে ‘প্রিয়তম চাঁদ’ নামটা লিখা দেখে দ্যুতির ভ্রু কুঁচকে আসে। সে সেই ফোল্ডারে ক্লিক করতেই দ্যুতি তার হাজার হাজার ছবি সেখানে দেখতে পায়। এমনকি ওর ছোট কালেরও বেশ ছবি দেখতে পায়। দ্যুতি নীরবে সেসব ছবি দেখতে থাকে। বেশির ভাগই ক্যান্ডিট। দ্যুতি সব ছবি দেখে আনমনেই হেসে উঠে। মনের মধ্যে বয়ে যায় ভালো লাগার ঢেউ। অনুভূতিগুলো যেন প্রগাঢ়তা পায় পলকেই। এতদিনের দ্বিধাও ঘুচে গেল নিমিষেই। সেই সাথে, দ্যুতির প্রণয়ের যাত্রাও হলো এইখান থেকেই।
____________________
ঝড় হচ্ছে তুমুল বেগে। বাতাসের শা শা শব্দের সাথে মেঘের তীক্ষ্ণ ডাক মিশে ভয়ংকর সুর তুলছে। ঝড়ের দাপট এতই যে সামনেই অবস্থিত একটি পার্কের দুটি গাছ ইতিমধ্যে লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। প্রকৃতির এই বিপর্যয় সকলের চোখে পড়লেও, মানুষের ভিতরে হওয়া বিপর্যয় আদৌ চোখে পড়ে কি? না, পড়ে না। যার জন্যে মানুষের দুঃখ, কষ্ট কোনটাই আঁচ করা যায় না। আর না এর গভীরতা মাপা যায়। শুধু দেওয়া যায় মুখরোচক কিছু সান্ত্বনা।
হসপিটালের কেবিনে বসে আছে দিহান আর অরণ্য। ঔষধ পত্র নিয়ে কথা বলছে দুইজনে। তারই থেকে কিছু দূর রুহুল সাহেব কথা বলছেন ডাক্তারের সাথে। সামনে থাকা বেডের উপর চোখ বুঝে শুয়ে আছেন শাখাওয়াত সাহেব। দুইদিন আগে রাতে খাবারের সময় শাখাওয়াত সাহেবের মেজর স্টোক করেন। অরণ্য তখন তার সামনে ছিল বিধায় সে দ্রুত তাকে হসপিটালে নিয়ে আসে আর ভর্তি করায়। তৎক্ষনাৎ হসপিটালে আনায় সেই যাত্রায় তিনি বেঁচে যান। সারারাত অবজারভেশনে রাখার পর পরের দিন সকালে তার জ্ঞান ফিরে। কিন্তু এর কিছুই দ্যুতিরা জানতো না। শাখাওয়াত সাহেবের জ্ঞান ফিরার পরই অরণ্য দ্যুতির বাসায় খবর পাঠায়। সকলে এতে অরণ্যের প্রতি রুষ্ট হলেও কিছু বলে না। দ্রুত চলে আসে হসপিটালে। সেখানে এসে জানা যায় শাখাওয়াত সাহেব আপাতত সুস্থ আছেন কিন্তু তার নতুন করে শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দিয়েছে বলে তাকে আরও একদিন হসপিটালেই থাকতে হবে। সেটা শুনে যেন সবাই স্বস্তি পায়। সেই রাতে দিহান থাকতে চাইলেও অরণ্য না করে দেয় এবং সম্পূর্ণ দৌড়াদৌড়ি একাই করে। অতঃপর আজ ডিসচার্জ দিবে বলে অরণ্যের নিষেধ করা সত্ত্বেও দিহান আর রুহুল সাহেব চলে আসেন শাখাওয়াত সাহেবকে নিতে।
ঝড়ের জন্য তাদের বাসায় আসতে প্রায় রাত হয়ে যায়। শাখাওয়াত সাহেবকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে দিহান আর রুহুল সাহেব বাসায় চলে আসেন আর দ্যুতি খাবার নিয়ে চলে যায় অরণ্যের বাসায়। অতঃপর অরণ্য ফ্রেশ হয়ে শাখাওয়াত সাহেবকে খায়িয়ে দিতে শুরু করে। দ্যুতি কি করবে বুঝতে না পেরে চুপটি মেরে ঘরের এককোনায় দাঁড়িয়ে থাকে। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অরণ্যের দিকে। ভেজা চুলগুলো অবিন্যস্ত হয়ে পড়ে আছে কপালে। দুই রাত নির্ঘুম কাটানোর ফলে চোখ দুটো রক্তিম লাল আকার ধারণ করেছে,নিচে পড়েছে কালি৷ ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া না করায় চেহেরা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে। মুখ-চোখ শক্ত হলেও তার ভিতরে যে এক আলাদা ঝড়ই বয়ে যাচ্ছে তা দ্যুতি ভালো মতই বুঝতে পারছে। তাই তো, তার কষ্ট হচ্ছে। অরণ্যকে যতবারই এলোমেলো অবস্থায় দেখছে ততবারই বুকের বা পাশটা চিন চিন করে ব্যথা করে উঠছে।
অরণ্য তার বাবাকে নিজের চাইতেও যে বেশি ভালোবাসে তার দ্যুতির অজানা নয়। অরণ্যের জীবনে দুইজন মানুষের স্থান সবার উপরে। আর তারা হচ্ছে শাখাওয়াত সাহেব ও শাহিদা বেগম। এই দুইজনের সামান্য অসুস্থতা যেমন অরণ্যের কাম্য নয়, তেমনেই তাদের জন্য সে নিজের জান দিতেও প্রস্তুত। আর সেই বাবার এমন অসুস্থতা অরণ্য কিভাবে সহ্য করছে আল্লাহই জানে। আসলেই মানুষটাকে দ্যুতির ভাবনার চাইতেও শক্ত।
অরণ্য শাখাওয়াত সাহেবকে খাবার শেষে একবারে ঔষধ খায়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। শাখাওয়াত সাহেব বেড়িয়ে আসতেই দ্যুতিও তার পিছু পিছু বেড়িয়ে আসে। অরণ্যকে খাবার না খেয়ে নিচের রুমে চলে যেতে নিলে দ্যুতি পিছন থেকে জিজ্ঞেস করে উঠে,
— আপনি খাবেন না ভাইয়া?
অরণ্য ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে বলে,
— ইচ্ছে নেই। আর তুই এখনো এই বাসায় কি করছিস? যা বাসায় যা?
কথাটা বলেই অরণ্য চলে যায় নিজের রুমে। তা দেখে দ্যুতি বেশ কিছুক্ষণ চুপটি মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। অতঃপর রান্নাঘরে গিয়ে অরণ্যের জন্য একটা প্লেটে খাবার বেরে নিয়ে চলে যায় অরণ্যের রুমে। অরণ্যকে এক হাত মাথায় দিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে থাকতে দেখে নিভৃতেই ওর পাশে গিয়ে বসে। রুমে কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে অরণ্য হাত সরিয়ে সামনে তাকায়। দ্যুতিকে খাবারের সাথে দেখতে পেয়ে বিরক্তি নিয়ে বলে,
— বললাম তো খিদে নেই। একবার কথা বললে বুঝিস না? খাবার নিয়ে যা তো৷
— দু’দিন ধরে কিছু খাননি আপনি। এমন করলে শরীর খারাপ করবে ভাইয়া৷ একটু খান!
অরণ্য এইবার তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
— বলেছি না, খাব না। কানে যায় না কথা?
দ্যুতি কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিচু স্বরে বলে উঠে,
— আমি খায়িয়ে দেই?
কথাটা বলে আর এক মিনিটও বিলম্ব না করে দ্যুতি ভাত মেখে অরণ্যের মুখের সামনে এগিয়ে দেয়। অরণ্য প্রথমে দ্যুতির এহেন কান্ডে হকচকিয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে ক্ষীণ হাসে। কোন প্রকার দ্বিরুক্তি না করে নীরবে খাবারটুকু খেয়ে নেয়। দ্যুতিও আর কিছু না বলে অরণ্যকে খায়িয়ে দিতে থাকে। খাওয়ার মাঝেই অরণ্য জিজ্ঞেস করে,
— তোর ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা কবে থেকে?
— এইতো সপ্তাহ খানিক বাদেই।
— আমি যেগুলো মার্ক করে দিয়েছিলাম সেগুলো ভালো মত পড়ে নিস। আপাতত কয়েকদিন হয়তো আমি পড়াতে পারবো না তোকে।
দ্যুতি অকপট রাগ দেখিয়ে বলে,
— আমার পড়া নিয়ে এত চিন্তা করতে হবে না আপনাকে। আঙ্কেলের চিন্তা করুন আর দেখাশোনা করুন।
— বড় হয়ে যাচ্ছিস দেখছি। আমাকে উপদেশ দিচ্ছি। বাহ!
দ্যুতি অরণ্যের কথা তোয়াক্কা না করে জিজ্ঞেস করে,
— অফিস থেকে ছুটে নিয়েছেন কতদিনের?
অরণ্য কোন রকম ভণিতা না করে বলে,
— সাতদিনের!
— কয়েকদিন আগে না জয়েন দিলেন, এতদিনের ছুটি মঞ্জুর করছে?
— মেডিক্যাল লিভ নিয়েছি বলেই দিয়েছে।
দ্যুতি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে অজ্ঞাত খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অতঃপর খাওয়া শেষে উঠে দ্যুতি উঠে পড়ে। প্লেট আর তরকারির বাটি সব রান্নাঘরে পরিষ্কার করে রেখে দেয়৷ অতঃপর যাওয়ার আগে একবার অরণ্যের ঘরে উঁকি দেয়। অরণ্য লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে দেখে নীরবেই গেট লক করে চলে যায়।
#চলবে