#প্রণয়ের_ঢেউ
#Part_08
#Writer_Asfiya_Islam_Jannat
— তুই কি আমার আঁধার রাতের ব্যক্তিগত চাঁদ হবি? একান্ত আমার?
কথাটা শোনা মাত্র দ্যুতির সর্বাঙ্গ জুড়ে শীতল শিহরণ বয়ে যায়৷ নয়ন দু’টির মাঝে ফুটে উঠে অপার বিস্ময়। হৃদস্পন্দনটি চলতে শুরু করে তার সর্বোচ্চ গতিতে, চারদিকে প্রতিধ্বনি হচ্ছে সেই ধ্বনি। অরণ্যও বোধহয় সেই আওয়াজ শুনতে পারছে.. ধুকধুক..ধুকধুক। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসে দ্যুতির, বার কয়েক পলক ফেলের রুমের স্নিগ্ধ নরম আলোয় অরণ্যের দিকে ভালো মত তাকায়। অরণ্যের চেহেরায় তখন স্পষ্ট উত্তর পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ভেসে বেড়াচ্ছে। দ্যুতি দ্রুত নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। আদৌ তার বিশ্বাস হচ্ছে না তার ভালোবাসার মানুষটি নিজ থেকে তার কাছে ধরা দিয়েছে। তার যে সব সুন্দর স্বপ্ন বলেই মনে হচ্ছে। দ্যুতির জবাব না পেয়ে অরণ্য বলে উঠে,
— কি উত্তর দিবি না চাঁদ? আমার কিন্তু উত্তর পাওনা রে। তুই যে আমার শর্তের বেড়াজালে আটকা ভুলে গিয়েছিস?
অরণ্যের কথায় দ্যুতির সেই বৃষ্টির দিনের কথাটি মনে পড়ে যায়। সেই সাথে শর্তটিও। দ্যুতি এইবার দীর্ঘশ্বাস নেয়। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় অরণ্যের দিকে। অরণ্য দ্যুতির দৃষ্টির মাঝে নিজের দৃষ্টি স্থাপন করে মৃদুস্বরে বলে,
— বল না, হবি কি আমার ব্যক্তিগত চাঁদ?
দ্যুতি মনে মনে সাহস জুগিয়ে নিয়ে কম্পিত কন্ঠে বলে উঠে,
— হ্যাঁ হবো।
ক্ষণেই অরণ্যের ঠোঁটের কোনে ফুটে উঠে সরু হাসির রেখা। অরণ্য কিছু না বলে দ্যুতিকে নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরে। মিশিয়ে নেয় একদম নিজের সাথে। অরণ্যের এহেন কান্ডে দ্যুতি কিংকর্তব্যবিমুঢ়। বোধশক্তি সব লোপ পায় তার। অতঃপর ঘটনাক্রমে বুঝে উঠতেই লজ্জায় মিইয়ে যায় সে। লজ্জানত হাসি হেসে রক্তিম হয়ে আসা মুখটি লুকায় অরণ্যের বুকের মাঝে। ক্ষণিকের মাঝেই অরণ্য সরে আসে৷ নিজের ট্রাউজারের পকেট থেকে ছোট একটা আংটি বের করে। নীরবেই দ্যুতির বাম হাতটি টেনে তার অনামিকা আঙ্গুলে আংটি-টা পড়িয়ে দিতে দিতে বললো,
— এখন থেকে তুই অরণ্যের আমানত বুঝলি, যা কখনো খেয়ানত হবে না। তুই শুধু অরণ্যের চাঁদ।
কথাটা বলে অরণ্য দূরে সরে দাঁড়ালো। অরণ্য সরে যেতেই দ্যুতির দৃষ্টি আটকে গেলো আংটিটার দিকে। সাদা ও নীল পাথরে মিশ্রিত লাভ সেপ আংটিটা যে দ্যুতির ঠিক কতটা পছন্দ হয়েছে তা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে। এইটা কি আদৌ প্রকাশ করা সম্ভব? দ্যুতি যখন ঘোর লাগা চোখে নিজের অনামিকা আঙ্গুলটির দিকে তাকিয়ে ছিল তখন অরণ্য তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠে,
— এইভাবে ঘুরে ঘুরে তাকিয়ে কি দেখছিস? আগে কখনো আংটি দেখিস নি? আমার বউয়ের আংটির দিকে নজর দিলে একবারে খুন করে দিব বলে দিলাম। এখনই চোখ সরা।
শেষের কথাটা শাসিয়ে বলে অরণ্য। এতে দ্যুতি ভ্রু কুঁচকে আসে। সে স্বগতোক্তি কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠে,
— তাহলে আপনার বউকেই পড়াতেন আমাকে পড়ালেন কেন?
অরণ্য শান্ত কন্ঠে বলে,
— বউ তো হতে অনেক দেরি তাই আগে ভাগে তাকে পার্মানেন্টলি আমার জন্য বুকড করে রাখলাম যাতে অন্য কেউ কোন সুযোগ না পায়। সিম্পল!
কথাটা শুনে দ্যুতি আনমনে ভাবে, এই লোক ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না। কার প্রণয়ের ডোরে যে সে বাঁধা পড়লো কে জানে।
দ্যুতি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আড়চোখে তাকায় অরণ্যের দিকে। অরণ্য তা দেখে রসিকতার সুরে বলে,
— কি আমাকে এইভাবে দেখছিস কেন? আজ বেশি সুন্দর লাগছে নাকি আমায়? দেখে প্রেম প্রেম পাচ্ছে বুঝি? পেলে সামনে আয় চুমু খাই।
অরণ্যের এমন লাগামহীন কথা শুনে দ্যুতি দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে নাক ছিটকে বলে,
— ছিঃ নির্লজ্জ লোকটা। দূরে থাকুন আপনি কাছে আসবেন না।
অরণ্য এক গাল হেসে বলে,
— কি সব প্রণয় ফুড়ুৎ? এই তোর প্রণয়?
দ্যুতি আড়চোখে একবার অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বলে,
— সময় হোক জানতে পারবেন আমার প্রণয় কেমন। আপাতত রাত হচ্ছে বাসায় যেতে হবে আমায়।
অরণ্য দু’হাত বুকে গুঁজে শীতল কন্ঠে বলে,
— বড় গেছিস দেখছি। রাগ-অভিমান করাও শিখে গিয়েছিস।
— বড় তো সেই কবেই হয়েছি, শুধু আপনার চোখে ছোট ছিলাম বলে বুঝতে পারেননি।
অরণ্য বাঁকা হেসে বলে,
— তাই নাকি! আচ্ছা, সামনে আয় তো দেখি কত বড় হয়েছিস।
দ্যুতি উৎকন্ঠা স্বরে বলে উঠে,
— কে বলেছে আমি বড়? আমি তো এখনো কিউট ইনোসেন্ট মাসুম ছোট বাচ্চা।
অরণ্য দ্যুতির কথার প্রত্যুত্তর না করে নিভৃতে হাসে। অতঃপর রেপিং এ মোড়ানো বক্সগুলো দ্যুতির হাতে দিয়ে বলে,
— সোজা এইখান থেকে গিয়ে চুপটি করে ঘুমিয়ে পড়বি। আর হ্যাঁ! তোর হাত থেকে যেন আংটি না নামে। যদি কোনদিন নামে তাহলে তোকে সেদিনই জ্যান্ত পুঁতে দিব আমি৷ মাইন্ড ইট!
_________________
মানুষ নিয়মানুবর্তিতা বিষয়টা হেলায় নিলেও সময় কিন্তু নেয় না। একই চক্রের মাঝে শতবার ঘুরেও তার ক্লান্তি হয়না। আর তার এই ক্লান্তিহীন যাত্রাতেই পেরিয়ে যায় দিন,মাস,বছর। পেরিয়ে যাওয়া দিনগুলোই হয়ে উঠে অতীত, আর অতীতের মাঝেই বেঁচে থেকে যায় শত শত স্মৃতি। যেমন এখন দ্যুতির স্মৃতিগুলো বন্দী হয়ে আছে অতীতের পাতায়। এখনো ভাবলে মনে হয় এইতো গত-পরশুই তো দ্যুতির ১৮ম জন্মদিন ছিল। সেইদিন রাতেই সে তার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান উপহারটি পেয়েছিল। বিশেষ এক রাতে অবগত হয়ে ছিল সুন্দর অনুভূতি সাথে। পেয়েছিল কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে সেই সাথে পেয়েছিল তার প্রণয়ের ঢেউ একটি নির্দিষ্ট তীর। অনুভূতিগুলোর মাঝে পরিবর্তন না আসলেও সময়ের মাঝে এসেছে৷ সেই রাতটির পরে কেটে গিয়েছে কয়েকটি মাস। এরই মাঝে দ্যুতির উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর্ব চুকে গিয়েছে৷ পরীক্ষাগুলো ভালোই গিয়েছে বিধায় দ্যুতি নিশ্চিন্তে আছে। দুই-একদিনের মাঝেই এডমিশনের জন্য কোচিং-এ ভর্তি হবে বলে ঠিক করেছে। আপাতত ক্ষণিকের বিরতিতে আছে সে।
গোধুলির লগ্ন পেরুতেই হানা দিল আঁধারের দল। রাস্তায় রাস্তায় কৃত্রিম আলো জ্বলতেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো সমস্ত নগরী। দ্যুতি একহাতে কফি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার শেষ সীমানায়। চোখ দু’টি বার বার নজর বোলাচ্ছে মূল সড়কের দিকে। নয়ন দু’টি আজ বড্ড তৃষ্ণাতুর হয়ে আছে আপন মানুষটির দেখা পাওয়ার জন্য। খানিকটা সময় পেরুতেই দেখা মিললো কাঙ্ক্ষিত মানুষটি। স্বস্তি মিললো যেন তখনই। ক্ষণেই চোখ আটকালো তার অরণ্যের মাঝে। ঘর্মাক্ত শরীরে লেপ্টে আছে সাদা চেকের শার্টটি, ইন করা শার্টটির একপাশ বের হয়ে আছে, চুলগুলো বেশ এলোমেলো। অরণ্য গলার টাই আলগা করতে করতে চার তলার বারান্দায় চোখ বোলাতেই দেখতে পেলো তার প্রেয়সীকে। হয়তো তারই প্রতিক্ষা করছিল এতটা সময় জুড়ে। এক গাল হেসে ঢুকে পড়ে গেটের ভিতরে৷
________________
গ্রাম্য অঞ্চলের সকালটাই যেন ভিন্ন। শহরের জীবন থেকে একদম আলাদা। শহরের বাতাস থেকে শুরু করে সবই অবিশুদ্ধ হলেও গ্রামে কিন্তু সবটাই শুদ্ধ। এইখানে কোন প্রকার ভেজাল নেই বলেই হয়তো দ্যুতির গ্রাম বেশ প্রিয়। পরশুই দ্যুতি তার দাদা বাড়ি এসেছে। সাথে শাহিদা বেগম আর রুহুল সাহেন না আসলেও দিহান আর অরণ্যও এসেছে। হঠাৎ গ্রামে আসার মোক্ষম কারণ হলো, দ্যুতির দাদী রেখা বেগম বেশ কয়েকদিন ধরে বড় ছেলের ঘরের নাতি-নাতনিদের দেখবেন বলে ইচ্ছা প্রকাশ করছিলেন। কিন্তু দ্যুতির পরীক্ষা আর দিহানের কাজের চাপের জন্য আসা সম্ভব হচ্ছিল না। এখন সময় ও সুযোগ আছে বলে, শাহিদা বেগমও তা হাতছাড়া করলেন না। রুহুল সাহেব কাজের সুবাদে শহরের বাইরে গিয়েছেন তাই শাহিদা বেগম বাসা ফাঁকা রেখে গ্রামে আসতে রাজী হননি। তাই তিনি দিহানকেই বলেন দ্যুতিকে নিয়ে তাদের গ্রামে বাড়ি ঘুরে আসতে। দিহান একা আসতে চাইছিল না বলে অরণ্যকে সাথে করে নিয়ে আসে। এর আগেও অরণ্য বেশ কয়েকবার দ্যুতির গ্রামের বাড়িতে এসেছে বলে দ্বিধা করেনি। অবশ্য দ্যুতির ছোট চাচার পরিবারের সকলের কম বেশি অরণ্যকে ভালো মত চিনে তাই কেউ অন্য চোখে বিষয়টা দেখেনি। স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছেন।
রৌদ্রজ্বল দুপুরে রোদের প্রখরতা বাড়তেই দ্যুতি চিন্তা বেড়ে গেলো, ঘরে থাকতে না পেরে এগিয়ে গেলো নদীর পাড়ে। নদীর মাঝ বরাবর দেখা যাচ্ছে একটি নৌকা, তার মধ্যে চড়েই অরণ্য আর কিছু বাচ্চাকাচ্চারা মিলে মাছ ধরছে। দিহান নদীর পাড়ে বসেই ফোনে কথা বলছে আর ক্ষণে ক্ষণে চোখ বুলাচ্ছে নৌকার দিকে। দ্যুতি নদীর পাড়ে এসে অরণ্যের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চললো এখনো লোকটা পানির মাঝেই আছে। তার উপর নাকি একটু আগে মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে পড়েছে। এই ভেজা শরীরে থাকলে নির্ঘাত জ্বর বাজাবে। কিন্তু তাকে কথাটা বুঝাবে কে? এই পর্যন্ত দ্যুতি তিনবার খবর পাঠিয়েছে বাড়ি ফেরার জন্য। কিন্তু কে শুনে কার কথা? অজ্ঞাত দ্যুতিকেই আসতে হলো এইখানে।
অরণ্যের দিক থেকে চোখ সরিয়ে এগিয়ে সে দিহানের দিকে। দিহান তখন ফোনে কথা বলতে মশগুল। দ্যুতি দিহানের পিছনে গিয়ে বলে,
— ভাইয়া শুনো!
হঠাৎ দ্যুতির আওয়াজ পেয়ে দিহান ভড়কে যায়। ক্ষণেই ঘাড় ঘুরিয়ে দ্যুতিকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ‘পরে কথা বলবো’ বলে ফোনটা রেখে দিয়ে বিরক্তিকর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
— এইখানে কি করিস তুই?
— তোমাদের দেখতে এলাম। মাছ ধরা হয়নি?
— হলে তো দেখতেই পেতি।
দ্যুতি এইবার অসহায় মুখ করে জিজ্ঞেস করে,
— আর কতক্ষন?
দিহান তার হাত ঘড়িতে একবার চোখ বুলিয়ে বলে,
— ঠিক জানি না। অরণ্যকে তো চিনিসই, ওর মন মত মাছ না পাওয়া পর্যন্ত ও পানি থেকে উঠবে না। দুনিয়া উল্টিয়ে গেলেও না।
— ঠান্ডা লাগলে বুঝবে নে ঠ্যালা।
— ওরটা ওই বুঝবে নে। তুই এখন যা তো, এই ভরদুপুরে তুই ঘাটে এসেছিস তা দাদী জানলে তোকে আস্ত রাখবে না। যা বাড়িতে, যা!
দ্যুতি এইবার অসহায় চাহনিতে তাকায় দিহানের দিকে। সে কিভাবে বুঝাবে তার মনের দুশ্চিন্তা। অরণ্য এতক্ষণ পানিতে থাকলে যে নির্ঘাত শরীর খারাপ করবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু এখন কিছু জোড় গলায়ও বলতে পারছে না সে। কি এক জ্বালা।
_____________________
অরণ্য মাছ ধরে বাড়িতে ফেরত আসলো ঠিক সন্ধ্যা হওয়ার আগ মূহুর্তে। বেশ বড় এক রুই ও কাতলা মাছ ধরে এনেছে বলে কি এলাহি কান্ডই না বাড়িতে। আশেপাশের মানুষও এসে ভীড় জমিয়েছে সেই মাছ দেখার জন্য। সোরগোলে পরিপূর্ণ পরিবেশ৷ এইদিকে সকলে যখন মাছ নিয়ে ব্যস্ত তখন দ্যুতি গ্যাসের চুলোয় গরম পানি দিতে ব্যস্ত। কেন না, সে দেখেছে ইতিমধ্যে অরণ্যের হাঁচি দেওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। ঠান্ডা পানিতে গোসল গলা বসে যাবে তাই সে দ্রুত গরম পানি চড়িয়েছে চুলোয়৷ অতঃপর অরণ্য গোসল করার আগেই দ্যুতির চাচীকে দিয়ে গরমপানিটা গোসলখানায় পৌঁছেও দিয়েছে।
কিন্তু তাও শেষ রক্ষা হলো না। সেই রাতেই অরণ্যের শরীর কাঁপিয়ে জ্বর উঠলো। উত্তাপে পুরো যাচ্ছিল পুরো শরীর। রাতের খাওয়ার আগ পর্যন্ত দ্যুতির চাচী আর চাচাতো বোন মিলে সব করে। অতঃপর রাতে অরণ্যকে ঔষধ খায়িয়ে দিয়ে তারা নিজ নিজ রুমে চলে যায়। সকলে নিজ নিজ রুমেই যেতে দ্যুতি এক বাটিতে জলপট্টি নিয়ে হাজির হয় অরণ্যের রুমে। অরণ্য তখন ঘুমে আর দিহান অরণ্যের পাশে বসেই তার জ্বর দেখছিল। দ্যুতিকে দেখে জিজ্ঞেস করে,
— তুই এত রাতে এইখানে কি করিস?
দ্যুতি কোনমতে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট দু’টি ভিজিয়ে বলে,
— ভাইয়ার তো জ্বর কমছে না তাই ভাবলাম জলপট্টি দিয়ে দেই।
— আচ্ছা তাইলে বস পাশে।
— জ্বর এখন কত ভাইয়া?
— এখনো ১০২°।
কথাটা শুনে দ্যুতির চোখে-মুখের চিন্তার ভাঁজটা যেন প্রগাঢ় হলো। মনের মাঝে দুশ্চিন্তারা বাসা বাঁধলো একে একে। হঠাৎ দিহানের ফোন আসায় সে দ্যুতিকে দেখতে বলে বাহিরে চলে গেলো। দ্যুতি কোন প্রকার শব্দ না করে চুপচাপ অরণ্যের মাথায় জলপট্টি দিতে শুরু করলো। অরণ্যের গায়ে মোটা কম্বল ও কাঁথা থাকা সত্ত্বেও সে থরথর করে কাঁপছিল। অরণ্যের কাঁপুনি দেখে দ্যুতি ভালো মত কম্বলটা জড়িয়ে দেয়। অরণ্যের এমন অবস্থা দ্যুতির হৃদয়টা যেন দহনে ছাড়খাড় হচ্ছিল। অজানা কষ্টে দগ্ধ হচ্ছিল মন। অনিচ্ছায় বার বার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিল। দ্যুতি কোনমতে নিজেকে সামলে অরণ্যের মাথায় জলপট্টি দেওয়ায় মনোযোগ দেয়। মিনিট পাঁচেক অতিক্রম হতেই অরণ্য চোখ খুলে তাকায়৷ চারদিকে চোখ বুলিয়ে মাথার পাশে দ্যুতিকে দেখে ভ্রু কুঁচকে আসে তার। স্বগতোক্তি কন্ঠে বলে উঠে,
— এইখানে কি করছিস তুই?
কথাটা শুনে দ্যুতি অকপট রাগ দেখিয়ে বলে,
— দেখেন না কি করছি? নাকি জ্বরের ঘোরে তাও বুঝছেন না? বার বার বলেছিলাম আপনাকে ভেজা কাপড়ে এতক্ষণ পানির মাঝে না থাকতে, জ্বর আসবে। কিন্তু কে শুনে কার কথা? এখন কার কথা ঠিক হলো দেখুন? নিজের শরীরের কথা একটুও ভাবেন না৷ আগেও কি করতেন? জব থেকে ফিরেই ফ্রেশ না হয়ে সোজা আমাকে পড়াতে চলে আসতেন। সারাদিন গাঁধার মত খাটনি করে ক্লান্তি শরীর নিয়ে পড়াতেন। আমি না করলেও শুনতেন না। শরীর আপনার দূর্বল হবে না তো কি আমার হবে? যত্ন তো নেন না একটুও। কবে নিজের যত্ন নিবেন বলেন তো?
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে দ্যুতি ক্ষান্ত হয়। দ্যুতির কথা শুনে অরণ্য মুচকি হাসে। মৃদুস্বরে বলে,
— বাব্বাহ! আমার প্রতি দেখছি কারো অনেক চিন্তা। আমার চিন্তা করতে করতে তো দেখছি তার মুখ শুকিয়ে একদম কদু হয়ে গিয়েছে।
— জ্বরেও আপনার ফাজলামো যায় না, তাই না?
অরণ্য কিছু না বলে স্মিত হাসে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে তার। বার বার ধরে আসছে গলা। দ্যুতিও কথা না বাড়িয়ে সযত্নে অরণ্যের মাথায় জলপট্টি দিতে থাকে। বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হতেই অরণ্য জ্বরের ঘোরে বলে উঠে,
— জানিস চাঁদ, তোর থেকে না আজ পুরাই বউ বউ ফিলিং আসছে৷ মনে হচ্ছে আসলেই তুই আমার বউ।
দ্যুতি হালকা হেসে বলে,
— আমি তো আপনারই।
— হু জানি কিন্তু চাঁদ, তুই সত্যি সত্যি আমার বউ কবে হবি? আমার না তোকে বউয়ের সাজে দেখার অনেক ইচ্ছে৷
দ্যুতি অরণ্যের এমন কথা শুনে শীতল কন্ঠে বলে,
— যেদিন আপনি বলবেন বউ সাজতে আমি সেদিনই সাজবো।
অরণ্য কিছু না বলে চুপ থাকে৷ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দ্যুতির দিকে। দৃষ্টি তার ঘোর লাগানো। দ্যুতি সেই চাহনি উপেক্ষা করে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। জ্বর কিছুটা কমে আসতেই হঠাৎ অরণ্য বলে উঠে,
— তুই রুমে যা চাঁদ। তোর এইখানে থাকা এখন সেফ না।
অরণ্যের শেষ কথাটি শুনে দ্যুতি ভ্রু কুঁচকে আসে। প্রশ্নবোধক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
— সেফ না মানে?
অরণ্য অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে,
— সেটা তুই বুঝবি না। তুই এইখান থেকে যা তো।
দ্যুতি ‘কিন্তু কেন?’ কথাটা বলার আগেই দিহান চলে আসে যার জন্য কথাটা হজম করে নেয় সে। চুপটি মেরে বসে থাকে পাশে। জ্বর কিছুটা কমে এসেছে দেখে দিহান দ্যুতিকে চলে যেতে হবে। দ্যুতি আরও কিছুক্ষণ থাকতে চাইলেও দিহানের কথার উপর কথা বললো না। একপলক অরণ্যকে দেখে বেড়িয়ে এলো সে।
_________________
গ্রাম থেকে আজ ঢাকায় ফিরে যাচ্ছে দ্যুতিরা। ঢাকায় ফিরার কথা আরও ৪ দিন আগে হলেও অরণ্যের জ্বরের জন্য তা সম্ভব হয়নি। টানা তিন জ্বরে ভুগে অবশেষে কালকে গিয়ে সুস্থ হয়েছে সে। তাই আর দেরি না করে আজই রওনা হয়েছে ঢাকার উদ্দেশ্যে। ঢাকায় আসতে আসতে তাদের প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়। অতঃপর ঢাকার জ্যাম ঠেলে বাসায় পৌঁছাতে আরও ঘন্টাখানিক লেগে যায় তাদের। বাসার সামনে আসতেই দিহান আগেই বাসার ভিতর চলে যায়৷ ওর নাকি আগে যাওয়া প্রয়োজন। এখন কেন প্রয়োজন তার বুঝতে পেরে অরণ্য আর দ্যুতি হেসে উঠে৷ অতঃপর অরণ্য তাদের সকলের ব্যাগগুলো নিয়ে দ্যুতির ফ্ল্যাটেই চলে আসে। দ্যুতি আর অরণ্য বাসায় ঢুকতেই দেখতে পেলো ড্রয়িংরুমেই রুহুল সাহেব, শাহিদা বেগম ও শাখাওয়াত সাহেব একত্রে বসে কোন এক বিষয় নিয়ে শলাপরামর্শ করছেন। সাথে অরণ্যের ফুপি রিনা বেগমও আছেন। অরণ্য তার ফুপিকে দেখে একটু চমকালো। কেন না, তার ফুপু বিশেষ কারণ ছাড়া সচারাচর এইখানে আসে। তাহলে আজ কি এইখানে বিশেষ কোন আলোচনা হচ্ছে? তাই সবাই একত্রে বৈঠকে বসেছে?
দ্যুতি আর অরণ্যকে দেখে সকলে আলাপ-আলোচনা ছেড়ে তাদের দিকে হাসি মুখে তাকায়। দ্যুতি সকলকে সালাম দিতেই তারা ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করে৷ দ্যুতি হাসি মুখে সকলকে উত্তর দিয়ে শাহিদা বেগমকে জিজ্ঞেস করে,
— মা আজ তোমরা সবাই একসাথে যে? কারণ কি? আর কি নিয়ে কথা বলছিলে তোমরা?
শাহিদা বেগম হেসে বলেন,
— বিশেষ কারণ আছেই বলেই সকলে একত্রিত হয়েছে।
দ্যুতি বরাবরই এইসবে আগ্রহ বেশি তাই সে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
— কি কারণ মা? বলো না?
শাহিদা বেগম হালকা হেসে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বলেন,
— অরণ্যের বিয়ে নিয়ে৷ সামনেই তো ওর বিয়ে তাই সেটা নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল।
#চলবে