#প্রণয়ের_তৃষ্ণা-০৯,১০
অলিন্দ্রিয়া রুহি
০৯
_____
তবে কী হবে না বিয়েটা? ভেঙে যাবে?
অস্ফুটে মুখ দিয়ে গোঙানির ন্যায় কিছু একটা বেরোলো পুতুলের মুখ দিয়ে। শাপলা পেছন ঘুরে তাকাল। শাহিনও উঁকি দিয়ে দেখে পুতুল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে। দেখে জিভ কামড় দেয় সে। পুতুল যে পিছনে দাঁড়িয়ে আছে তা লক্ষ্য করেনি। তাই জন্য হড়বড় করে সব বলে দিয়েছে। নিশ্চয়ই মেয়েটার মন ভেঙে যাবে এবার!
শাহিন ফিসফিস করে বলল, ‘এইরে! ভুল করে ফেললাম দেহি। ও যে খাড়াইয়া আছে, তুমি আমারে আগে ক’বা না?’
শাপলা আশ্বস্ত গলায় জবাব দেয়, ‘আরে চিন্তা নিও না। ও এমনিতেও চায় না এইহানে বিয়াডা হোক। এই কথা হুইনা ওর চাইয়া বেশি খুশি কেউ হয় নাই।’
‘মানে? ওর ইচ্ছা নাই? তাও ওরে বিয়া দিতাছে?’
‘হ। চাচা-চাচীর মুখের দিকে তাকাইয়া ও রাজী হইছে বিয়া করতে। এমনিতে ওর মন মানে না। ওইরকম বুইড়া একটা বেডারে বিয়া করতে কারই বা ভাল লাগবো, কও? তোমার মতোন ছেড়া হইলে ঠিক আছিল।’
শাপলার কথা শুনে আনমনে ঠোঁট কামড় দিয়ে কিছু একটা ভাবে শাহিন। তারপর বিদায় জানিয়ে চলে গেল। ও চলে যেতেই জানালা টা ভিড়িয়ে পুতুলের সামনে এসে দাঁড়ায় শাপলা। পুতুলের কাঁধের উপর হাত রেখে ডেকে উঠে উদ্বিগ্ন গলায়, ‘এই পুতুল, তুই এমন করতাছোস ক্যান?’
‘কেমন করতাছি?’ নিশ্চল ঠান্ডা গলা।
শাপলা ভড়কে গিয়ে বলল, ‘এই যে পাত্থরের মতোন খাড়াইয়া আছোস। তুই কী শোক পাইছোস কথাটা শুইনা?’
পুতুল ফিচেল হাসে, নিচু গলায় বলে, ‘শোক পাওনের কী আছে?’
বলতে বলতে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল। শাপলাও পুতুলের পাশে গিয়ে বসে। বলল, ‘তোর মনে চলতাছে টা কী? বল তো..’
‘কিছু না। ঘুমা। জ্বালাইস না।’ বলেই অন্য পাশ ফিরে শোয় সে। তাকে টেনে নিজের দিকে ঘোরালো শাপলা। বলল,
‘আমারে ভুজুংভাজুং বুঝাইস না। সত্যি কইরা বল,কী চলতাছে তোর মনে?’
পুতুল বিরক্তি ধরা গলায় উত্তর করে, ‘কিছুই না। হেয় তো আর খু’ন করে নাই। তাইলে বিয়াডা হইবো না কেন? বিয়া হইবো, অবশ্যই হইবো।’
শাপলা চকিতে বলল, ‘তুই এত নিশ্চিত যে হেয় খু’ন করে নাই?’
‘হুম, করে নাই। হেয় আমারে পাওনের জন্য পাগল। এই বিয়া বন্ধ হইবো এমন কোনো কাম হেয় করব না।’ পুতুলের মেজাজ অসম্ভব ঠান্ডা। সেই সঙ্গে হুট করে আখতারের সাপোর্ট নিয়ে কথা বলার জন্য মেজাজটা কেমন গরম হয়ে উঠল শাপলার।
সে কপট রাগ নিয়ে বলল, ‘তুইও তো হঠাৎ কইরা ওই বুইড়া বেডারে বিয়া করনের লিগা পাগল হইয়া উঠলি..’
পুতুল চোখ পাঁকিয়ে তাকাল, ‘বুইড়া বেডা কী? তোর দুলাভাই লাগে। সম্মান দিয়া কথা ক।’
‘আমার বা*** দুলাভাই!! তোরে এহন সহ্য হইতেছে না। যা সর..’
পুতুলের থেকে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে বিছানার অন্য পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল শাপলা এবং কয়েক মিনিটের ভেতর ঘুমিয়েও পড়ল সে। তাকে ইচ্ছে করে উলোটপালোট কথা বলে রাগিয়েছে পুতুল। নইলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে কান ঝালাপালা করে ফেলতো মেয়েটা!
পুতুলের চোখে যেটুকু ঘুম আসার সম্ভাবনা ছিল, তাও এক লহমায় উবে গেল হাওয়াই মিঠাইয়ের মতোন। বাকী রাতটুকু একেবারেই চিন্তায় চিন্তায় কাটিয়ে দিলো। মাঝখানে রুজিনার কথা ভেবে একটুখানি চোখের পানিও ফেলল সে। কী এমন অপরাধে রুজিনার জীবন টা এভাবে শেষ হয়ে গেল! তার আর আখতারের তো তালাক হয়েই গেছিলো! তারপর কী এমন ঘটলো?
কোন রহস্যজাল আস্তে আস্তে তাকে লেপ্টে নিচ্ছে নিজের ভিতরে? আখতার এবং তার জীবন নিয়ে অনেক অনেক কৌতুহল হঠাৎ করেই চেপে বসে পুতুলের মাথায়। বিয়েটা হোক বা না হোক, এতসব কৌতুহলের শেষ অবশ্যই করতে হবে তাকে…..
_____
রুজিনার লাশ পাওয়া গেছে আইলের মাঝখানে। মাথা এক পাশে, পা অপরপাশে। গলার মধ্যখানে কা’টা। ধারণা করা হচ্ছে, মাটি কোপানোর জন্য যে ছু’রি ব্যবহার করা হয়, তা দিয়েই তাকে হ’ত্যা করা হয়েছে। ক্ষেত জুড়ে মানুষের উপচে পড়া ভীড়। পুলিশ এসেছে গেছে। লাশ সরায়নি, চারিদিকে মার্কিং করেছে। আশেপাশে হ’ত্যার আরও প্রমাণ, আলামত, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। কয়েকজন কে জিজ্ঞাসাবাদ ও করল।
বড় সড়কের উপর দাঁড়িয়ে দূরে হওয়া পুলিশের নানান কার্যক্রম গুলো অবলোকন করেন আখতার। তার এক পাশে মনু মিয়া দাঁড়িয়ে, অন্য পাশে আজাদ। আজাদ আখতারের বাম হাত বলা যায়। আখতারের সমস্ত কার্যক্রম সম্পর্কে সে সবসময়ই অবগত থাকে।
আজাদের বয়স ছাব্বিশ। পুরো দেহে অদম্য উচ্ছাস,রক্ত যেন টগবগ করছে। চোখের দৃষ্টি ক্ষু’রধার ধারালো হায়নার মতো। ওই চোখে তাকিয়ে বেশিক্ষণ টিকতে পারে না কেউই।
আজাদ ফিসফিস করে আখতারকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনে তো এই কাম করেন নাই। তাইলে কেডা করছে?’
আখতার ঠোঁট ভাঙলেন। তিনি মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক ‘চ’ কারান্ত শব্দ উচ্চারণ করেন। বললেন, ‘আমিও বুঝতাছি না। আইজকে এত সুন্দর একটা দিন আমার লইগা, আর আইজকেই..’
‘সবাই আপনেরে সন্দেহ করতেছে। আইজকা দুপুরে সালিশ বসাইছে। শুনছেন হেই কথা?’
‘সবই শুনছি। হোক, সালিশে কী কওন লাগবে, তা আমিও জানি। তুমি শুধু এইডা খোঁজ লাগাও, এই কামডা কেডা করছে।’
‘আচ্ছা।’ বলে আজাদ কে’টে পড়ল। মনু মিয়া আর আখতার চুপচাপ ক্ষেতের দৃশ্য গুলো দেখতে লাগলেন। মনু মিয়া ঠোঁট দিয়ে ‘চুক চুক’ জাতীয় একধরনের শব্দ সৃষ্টি করেন। হতাশ গলায় বললেন, ‘এই কয়দিন আগেই সুস্থ মানুষ টা গেল, আর দেহো..’
‘আহ!’ কথার মাঝখানেই হাত উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে দেন আখতার, তারপর বড় বিরক্তি ধরা গলায় বলেন, ‘তুমি চুপ করো। এত দরদ লাগতাছে কেন? কার লগে ফষ্টিনষ্টি করতে যাইয়া এই আকাম ঘটাইছে কে জানে! ও তো আছিল এক নাম্বারের বজ্জাত। বাঁইচা থাকতেও আমারে জ্বালাইছে। এহন মইরাই আমারে জ্বালায় ফালাইয়া গেল। আইজকা যদি ওর কারণে এই বিয়াডা না অয়…’
আখতার ফোঁস ফোঁস করে কয়েকটি নিঃশ্বাস ফেললেন।
‘না অইলে আপনের বউয়ের সুবিদাই হয় চাচা..’
শাহিনের গলা। সে কখন যে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ওদের তা দু’জনের একজন ও টের পায়নি। হুট করে তার কথা বলা শুনে দু’জনেই চমকে উঠল। মনু মিয়া ভীত চোখে তাকালেও আখতারের চোখেমুখে বিস্ময়ের ছটা।
তিনি তড়িঘড়ি করে প্রশ্ন করলেন, ‘কেন?’
শাহিন দাঁত বের করে হাসে। হাত দিয়ে শার্টের পকেট টা নিচু করে দেখালো। এর অর্থ কথা শুনতে হলে কথা কিনে নিতে হবে। আখতার বড় অতিষ্ঠ চোখ করে তাকালেন। মনু মিয়া কে ইশারা করলে নিজের পকেট থেকে বিশ টাকার একটা নোট বের করে শাহিনের খালি পকেটে গুঁজে দিলেন।
শাহিন বলল, ‘হেয় আপনেরে পছন্দ করে না। আপনে বুইডা মানুষ। আপনেরে বিয়া করনের হের ইচ্ছা নাই। হের বাপ-মায়ের লিগা রাজী হইছে। আপনের জায়গায় কোনো ছেড়া হইলে হেয় মানতো। আমি হুনলাম শাপলার থেইকা। শাপলা হের প্রিয় সই। ওয় তো আর মিথ্যা কইবো না।’
‘তুমি যাইয়া এইডির ব্যাপারে কিছু কও নাই তো?’
মনু মিয়া সরু চোখ করে তাকালেন, প্রশ্ন করলেন। শাহিন ঢোক চেপে এদিক ওদিক মাথা নাড়ায়, ‘না, না, আমি কিছু কই নাই। আমি কথা কিনছি, বেঁচি নাই।’
আখতার নাক ফুলিয়ে দাপটের সঙ্গে বললেন, ‘আমি বুইড়া মানুষ? আমারে বিয়া করন যায় না? হের কচি লাগবো? লাগাইতাছি।’
তারপর মনু মিয়ার দিকে তাকালেন, আদেশের সুরে বললেন, ‘চলো আমার লগে।’
শাহিন কে পেছনে ফেলে উনারা দু’জন থপথপ করে সামনে এগিয়ে গেলেন। আখতারের উদ্দেশ্য, দুপুরের সালিশের আগেই পুতুলকে বিয়ে করে ফেলবেন। পুতুলের স্বস্তি কে তিনি দুঃস্বপ্নে পরিণত করবেন। আখতারের ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি ফুঁটে উঠেছে।
(চলবে)
#প্রণয়ের_তৃষ্ণা (১০)
অলিন্দ্রিয়া রুহি
_____
অর্ক লম্বা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। এপাশটায় এখন কেউ নেই। চড়া রোদ উঠেছে। প্রচন্ড গরমের দাবদাহ। দু’দিন আগেই যে এতবড় ঝড় হয়ে সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল, তা বোঝার উপায় নেই। কপাল ঘেমে জবজব। এক হাত দিয়ে ললাটখানা মুছে নিয়ে একটা বিরক্তির স্বর অর্ক’র মুখ ছিঁটকে বেরিয়ে এলো। ইথিশা পায়ে পায়ে এসে অর্ক’র পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। মুখটা ভার করে বলল, ‘গুছিয়েছি।’
অর্ক আঁড়চোখে তাকাল। অস্পষ্ট স্বরে জবাব দিলো, ‘উঁ..’ তারপর আরেকটি টান দিয়ে খানিকটা নিকোটিনের ধোঁয়া ছেড়ে দেয় বায়ুতে। ওরা আজ চলে যাচ্ছে। ইথিশা চেয়েছিল আখতারের বিয়েটার পর যেতে, ধীরেসুস্থে, কিন্তু অর্ক এখানে আর থাকতে পারছে না। একটা অনৈতিক কাজ ঘটতে চলেছে অথচ সে কিছুই করতে পারছে না,এরচেয়ে দুঃখের তার জন্য কিছু হয় না। তাই বিয়েটা হওয়ার আগেই সে চলে যেতে চাচ্ছে। সেই জন্য সকাল সকাল উঠেই নিজের ব্যাগ গুছিয়ে ইথিশার ব্যাগও গোছাতে বলেছে। ইথিশা শোনামাত্রই মুখ করুণ করে রেখেছে।
তবে অর্ক জানে না, ইথিশার এই মন খারাপের পেছনে শুধু হঠাৎ চলে যাওয়াই নয়, আরও একটি বিষয় দায়ী। গতকাল রাতে যখন হলুদের অনুষ্ঠান শেষ করে সবাই ঘুমুতে চলে যায়, তখন আখতার আর মনু মিয়া সারা রাত ধরে বাড়ির বাইরে মদ্যপান করে। বাড়িতে শুধু শম্পা এবং আঁখি ছিল। ওরা ওদের ঘরে ঘুম। অর্ক আর ইথিশাকে আলাদা ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই সীমালঙ্ঘন করে অর্ক’র সাথে ইন্টিমেট হওয়ার ইচ্ছাতেই তার ঘরের কড়া নেড়েছিল ইথিশা। তখন রাত দুইটার ঘরে ঘড়ির কাটা। অর্ক ঘুম জড়ানো চোখে ইথিশাকে দেখতে পেয়ে ভীষণ হতবাক হয়েছিল।
অর্ক’র থেকে কোনোপ্রকার জবাব না পেয়েও ইথিশা ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে। বিছানায় শুয়ে হাত ইশারায় অর্ককে নিজের পাশে ডাকলে অর্ক’র ঘোর ভাঙে। তার হতভম্ব চেহারাটা মুহূর্তেই কঠিন রূপ ধারণ করল। ইথিশার উপর প্রচন্ড রিয়েক্ট করে বসে অজান্তেই। ইথিশা হতবুদ্ধি হয়ে যায়। একজন প্রেমিকা তার প্রেমিকের কাছে এমন আবদার করতেই পারে- এটা ইথিশার চোখে স্বাভাবিক! উপরন্তু ওদের সম্পর্ক অনেক দিনের। অর্ক সবসময় বিদেশ থাকায় তাকে তেমন ভাবে কাছে পাওয়া হয়নি। এই এখন কাছে পেয়েছে, তাও একবার একই বাড়িতে আছে- সুযোগ পেয়ে একটু কাছে আসতে চাওয়া খুব কী দোষের কিছু? অর্ক এমন করতে পারল?
এই নিয়ে সামান্য বাকবিতন্ডা হলে তা রাতের আঁধারেই চাপা পড়ে যায়। ইথিশা একরাশ অপমান আর লজ্জা নিয়ে কাঁদোকাঁদো মুখ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেও রেখে যায় রাগে ক্ষুব্ধ হওয়া থমথমে একখানা মুখ। ইথিশা জানে, অর্ক আর যাইহোক, নিজের প্রমিস সবসময় রক্ষা করে। তার পরও কেন! কেন তাকে বাধ্য করতে চেয়েছিল ইথিশা?
হুট করেই রোদের প্রখরতা কমে গিয়ে উত্তর দিক থেকে একটা বড় কালো মেঘের ভেলা এসে আকাশটাকে ঘিরে নিতে শুরু করল। ইথিশা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে তার টেনে ধরে অর্ক। ইথিশা তাকাল, অনুভূতিহীন বোবা দৃষ্টি। অর্ক আরেকটু টেনে তাকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো।
ফিচেল গলায় বলল, ‘খুব রাগ?’
ইথিশা নির্বাক, জবাবহীন।
‘মহারাণীর এত রাগ আমার উপর?’ অর্ক’র আদুরে গলা। তবুও যেন ইথিশার মন গললো না। গতকাল রাতে যা হয়েছে তা শুধু সামান্য নয় বরং তার ব্যক্তিত্ব কে আঘাত করেছে। নিজের আত্মসম্মানে লেগেছে। যেচে পড়ে গিয়ে নিজেকে কী একদমই সস্তা প্রমাণ করে দিয়েছে ইথিশা?
অর্ক’র বুক থেকে মোচড়ামুচড়ি করে মাথাটা সরিয়ে নিলো ইথিশা। অর্ক অবাক নয়ন মেলে চায়। বলল, ‘তুমি সত্যিই এত রাগ করছো?’
এবারেও ইথিশার ঠোঁটে জবাব নেই। যেন সে পণ করেছে, অর্ক’র কোনো কথারই উত্তর সে দেবে না।
অর্ক মৃদু ভাবে একটি নিঃশ্বাস ফেলে। বলে, ‘ইথি, ইউ নো, আমার মা আমাকে নিয়ে অনেক সেন্সেটিভ। আমি যখন বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রথম তাদেরকে বলি, আমার মা শুধু একটা কারণেই আমাকে বাঁধা দিয়েছিল। উনার ধারণা ছিল, বিদেশে গিয়ে ওদের কালচারের সঙ্গে আমি মিশে যাবো! ওরা যেরকম যখন তখন মেয়ে ইউজ করে, এসব ফিজিক্যাল রিলেশন কে কিছুই মনে করে না, আমিও নিশ্চয়ই সেরকম হয়ে যাবো। আমার মায়ের মন্তব্য, ফিজিক্যাল রিলেশন শুধু তার সঙ্গেই হওয়া উচিত, যে সত্যিকার অর্থেই আমার জন্য এই পৃথিবীতে এসেছে। এই সম্পর্ক টা এত সুন্দর, সেটাকে কেন যাকে তাকে বিকিয়ে দিয়ে অসুন্দর করবো আমি? আমি তাই কথা দিয়েছিলাম আমার মা’কে, যেদিন বিয়ে করব, সেদিনই…’
‘করবে? এইতো?’ অর্ককে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠে ইথিশা, ‘আচ্ছা, এর মানে কী দাঁড়াল? আমি তোমার জন্য না? তোমার জন্য…’
ইথিশার দিকে এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রেখে অর্ক গাঢ় স্বরে বলল, ‘স্টপ! তুমি যদি আমার না-ই হতে তবে বাবা-মার সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিতাম না ইথি। ভুলে যেয়ো না,তোমার ফ্যামিলির সঙ্গেও আমি নিজে কথা বলেছি! সবটা ঠিকঠাক করেছি। আমাদের এনগেজমেন্ট হয়ে গেছে। ক’দিন বাদেই আমাদের বিয়ে।’
‘আর এখনো আমি তোমার কাছে আসতে চাইলে তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দাও! কজ এখনো তোমার সন্দেহ, আমি তোমার না। তাই তো?’
‘না! আমি তো বলছি না তুমি আমার না। আমি শুধু চাইছি, এই সুন্দর সম্পর্ক টা সেই সুন্দর রাত থেকেই শুরু করতে। বাসর রাত- ইউ নো দ্যাট রাইট? এটা প্রতিটি মানুষের জীবনের অনেক অনেক অনেএএএক সুন্দর একটি রাত!’
ইথিশা গোমড়া মুখ করে অর্ক’র থেকে সরে দাঁড়াল। অন্যদিকে ফিরে বলল, ‘ওকে। তাহলে সেই রাতেরই অপেক্ষা করো। এর আগে আমার সাথে কথাও বলতে হবে না তোমার। সব সেই রাত থেকেই শুরু হবে। ওকে?’
গটগট করে হেঁটে ইথিশা চলে গেল। অর্ক হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে রইলো। এত সুন্দর ভাবে বোঝানোর পরও কেন ইথিশা চলে গেল! কেন বুঝতে চাইলো না একটিবারও অর্ক’র পয়েন্ট গুলো?নিজের প্রতি সেল্ফ রেস্পেক্ট থাকা ভালো, তাই বলে এতোটা যে অন্যকেও ছোট করে ফেলবে? অন্যের ফিলিংস গুলো, পয়েন্ট অফ ভিউ গুলো দেখবে না?
রাগ হলো অর্ক’রও। এবার ঢাকায় ফিরেই বিদেশ যাওয়ার আগে ইথিশার সঙ্গে বিয়েটা কমপ্লিট করার কথাও ভাবলো একবার। তারপর পকেট থেকে আরেকটা সিগারেট বের করে জ্বালিয়ে নিলো।
_____
রাতের এঁটো থালাবাসন গুলো আজ শাপলা মাজছে। পারুল আর শাপলার মা ব্যস্ত উনুন ঘরে। হাসমত আলী কোথায় যেন বেরিয়েছেন। পুতুলের কোনো কাজ নেই। বলা বাহুল্য তাকে কোনো কাজ করতে দেওয়া হচ্ছে না। তার বিয়ে হয়ে যাবে-তাই আপাতত তাকে একদম পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বলেছেন পারুল।
পুতুল ভেবে ভেবে হাসে। নিজেকে কেমন বলির পাঠা মনে হচ্ছে! বলির পাঠাকে বলি দেওয়ার আগে খাইয়ে যতন করে রাখা হয় যেভাবে, সেও যেন ঠিক তেমন! তাকে এখন যত্ন করা হচ্ছে। একটু পরে বলি দেওয়া হবে! দুপুর হতে আর কতক্ষণ বাকী?
পুতুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে। খুব বেশি দেড়ি নেই। আর কিছু সময় এই বাড়ি, এই বাড়ির লোক গুলো তার আপন হয়ে রইবে। আর তারপর? তারপর সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে। সব সম্পর্ক ফিঁকে হয়ে যাবে। নতুন সম্পর্ক গড়ে উঠবে। কী আজব এক নিয়ম! কী আজব এক মায়াজালের ভেতর ফেঁসে গেছে এই গোঁটা সিস্টেম! মেয়েরা! আহারে….
মাথার ভেতর ঘাম হয়েছে। চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে নিতে লাগল পুতুল। এমন সময়ে শাপলা হন্তদন্ত পায়ে ঘরের ভেতর ঢুকলো। তার চোখমুখ দেখলে মনে হবে, এই এক্ষুনি কোনো ডাকাত তার সামনে পড়েছে।
পুতুল গোল চোখে জিজ্ঞেস করল, ‘কী? কী হইছে?’
শাপলা এগিয়ে আসে। পুতুলের একদম মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াল। ওর গলা ভার হয়ে আসে। পুতুলের দুই হাত খানি নিজের হাতের মুঠোয় শক্ত করে চেপে নিলো। রাশভারী কণ্ঠে বলল, ‘আইয়া পড়ছে। সক্কাল সক্কালই তোরে নিয়া যাইবো।’
বিস্তারিত বলতে হলো না, অথচ পুতুল সব বুঝে গেল। প্রাণে যেটুকু বাতাস ছিল, সবটুকু মুহূর্তেই উবে গেল। মনে হলো, এক্ষুনি এখানে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে সে। কিন্তু না, সেরকম কিছুই হলো না। বরং নিজেকে কেমন পাথরের মতো লাগতে লাগল। যেন একটা যন্ত্র, যে যা করাচ্ছে,সে তাই করছে। নিজের বলতে কিচ্ছু নেই। কিচ্ছুটি নেই!
‘ও! আচ্ছা।’ যন্ত্রের মতো করেই জবাব দিয়ে উঠল সে। পুনরায় নিজের চুল আঁচড়ানোতে মনোযোগ দিলো। শাপলা কিছু একটা বলতে নেওয়ার পূর্বেই ঘরে ঢুকলেন শাপলার মা, পারুল। তারাও একই সংবাদ নিয়ে এসেছেন। তাদের কাছ থেকেই পুতুল শুনতে পেল, আখতার আর মনু মিয়া, আরও তিন জন মুরুব্বি নিয়ে, কাজীসহ এসেছেন। তারা এক্ষুনি বিয়ের কার্যক্রম শেষ করবেন। দুপুরের পর যে সালিশ বসবে, এরপর ঘটনা আরও কোন দিক থেকে কোন দিকে মোড় নেয় বলা যায় না। তিনি অনেক অপেক্ষা করেছেন। পুতুলকে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার জন্য আর এক মুহূর্ত ও অপেক্ষা করতে পারবেন না।
শাপলার মা ঠেস দিয়ে বলে উঠল, ‘এই ছেড়ি, কী জাদু করছোস লো এই বুইড়া বেডারে? তোরে ছাড়া কিছুই দেহি বুজে না! সুখে থাকবি, ভালাই সুখে থাকবি। এইরম একটা ভালা বেডা পাইলে আমগো শাপলাডারেও দিয়া দিমু।’
শাপলা ভ্রু কুঁচকে তাকাল মায়ের দিকে। ওর ফেস রিয়েকশন দেখে এমন পরিস্থিতির মাঝেও পুতুল হেসে ফেলে। শাপলা অবাক হয়ে গেল। পুতুলটা পাগল হয়ে গেছে নাকী শোকে?
নাহ, পাগল হয়নি। পাগল হলে কেউ এত ঠান্ডা ধীরস্থির ভাবে কবুল বলতে পারে না! আখতারের দেওয়া বিয়ের শাড়ি পরিয়ে পুতুলকে কনে রূপে নিজের ঘরের ভেতর বসিয়ে রাখা হয়। ততক্ষণে আশেপাশের অনেকের কাছে এই খবর পৌঁছে গেছে। সবাই ছুটে এসেছে বিয়ে দেখতে। কিছুক্ষণ পর কাজী আসেন। হাসমত আলী আসেন, মনু মিয়া ও আসলেন। কাজী দোয়া-কালাম পড়লেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন এই বিয়েতে কন্যার মত আছে কীনা? পুতুল নীরবে মাথাটা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালো। এরপর যখন তাকে বলা হলো, বলুন, ‘আলহামদুলিল্লাহ আমি কবুল করিলাম’ তখন মনে হলো, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্ত বাক্য পড়তে বলা হয়েছে পুতুলকে। তার শ্বাসনালী কেমন যেন শুকিয়ে খাঁ খাঁ করতে লাগল। বুকের ভেতর একশো মণের একটা পাথর চেপে, ঘোমটার তল দিয়েই বাবার পা জোড়া দেখতে দেখতে, খুব গোপনে, যেন নিজের কান না শোনে, পুতুল বলে উঠে, ‘আলহামদুলিল্লাহ আমি কবুল করিলাম।’
আখতার হৈচৈ লাগিয়ে দিয়েছেন। বৃষ্টি শুরু হবে যেকোনো মুহুর্তে। আকাশে গুমোট কালো মেঘ। তারচাইতেও ভারী মেঘের আবরণে ডুবে পুতুল বের হলো নিজের ঘর থেকে। সেই ঘর, যেখানে তার জন্ম হয়েছিল! পারুল হাউমাউ করে কাঁদছেন। আজ তার নাড়ীতে টান পড়েছে। পুতুলের একটু একটু পদক্ষেপ তার নাড়ী যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিচ্ছে। হাসমত আলী কে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তিনি কোথায় চলে গেলেন হুট করে কে জানে!
আখতার অধৈর্য্য কণ্ঠে বললেন, ‘কই? মেঘ আইয়া পড়লো তো!’
পুতুল ঘরের দাওয়া ডিঙিয়ে উঠোনে নেমে এসেছে ততক্ষণে। ভেবেছিল ওর বাপজান বাইরে দাঁড়িয়ে। কিন্তু সেখানেও কাউকে দেখতে না পেয়ে পুতুলের গলার কাছে যে মেঘগুলো জমা হয়েছিল, তা যেন আর জমা থাকতে পারল না। ভারী বর্ষণ আকারে চোখ ভেঙে নেমে এলো। আর্তনাদের স্বরে পুতুল বলে উঠে, ‘আমার বাপজান কই? আমার বাপরে ডাইকা আনেন। আমি যামু না নাইলে। আমার আব্বারে ডাক দেন কেউ।’
রতন আর কালু হন্তদন্ত হয়ে ছুটলো। তারা দেখেছে, হাসমত আলী পেছনে পুকুর পাড়ে নিথরের মতো বসে রয়েছেন মাথা গোঁজ করে। আহা দারিদ্র্যতা! তুমি যে কতবার অভিশাপ এরকম হাজারও হাসমত আলীর ঘরে! তা কী জানো তুমি?
‘চাচা, ও চাচা, পুতুল আপনেরে ডাকতাছে। আপনেরে না দেখলে ওয় যাইবো না। আপনে জলদি আহেন।’
রতন বলল। হাসমত আলী ভেঙে পড়লেন আরও। আদরের কন্যাকে বিদায় দেওয়ার মতো ক্ষমতা মহান আল্লাহ পাক তাকে দেননি। তবুও কেন মেয়ের মুখোমুখি হতে বলছেন! লুঙ্গিতে নিজের চোখজোড়া মুছে তিনি এগোলেন উঠোনের দিকে।
ঘোমটা সরে গেছে। পুতুলের মুখ দেখে শাপলা হু হু করে কেঁদে ফেলে। প্রিয় বান্ধবীর এত করুণ মুখ? দূর থেকে আব্বাকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে দেখে পুতুল দিগবিদিক ভুলে দৌড় লাগায়। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া হাসমত আলী নিজেকে শক্ত করে নিলেন। তার মেয়ে তার কোলে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য আসছে।
দু’হাতে যতটুকু শক্তি ধরে, তাই দিয়ে বাপজানকে নিজের শরীরের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো পুতুল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।
‘আব্বা আমারেও পর কইরা দিলেন। কে দেখবো আপনাগো রে? কেউ তো রইলো না আব্বা…কেউ তো রইলো না।’
হাসমত আলী মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। তার চোখ কাঁপছে, পানি পড়তে চাইছে কিন্তু নিজেকে খুব কষ্ট করে শক্ত রাখেন তিনি। পুতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন, ‘আমারে আল্লাহই দেখবো আম্মা। তুমি কষ্ট নিও না। আর কে কইছে তোমারে পর কইরা দিছি? তোমারে আরেকটা পরিবার বানাইয়া দিলাম আম্মা। আমি যদি না-ও থাকি, তাও তোমার কোনো চিন্তা নাই। তোমার আরেক পরিবার তোমারে দেইখা রাখবো।’
‘না আব্বা, এই কথা কইয়েন না আল্লাহর দোহাই লাগে। আমার সব হায়াতও আল্লাহ আপনারে দিক। আমার আব্বা আমার আগে কহনো যাইবার পারে না। আমি সহ্য করা পারুম না। আব্বা, ও আব্বা, কথা দেন, আমারে দেখবার যাইবেন। আগেও যেমন আমার উপর আপনের অধিকার আছিল, এহনো হেই অধিকার থাকবো। হেই অধিকারে কাউরে হাত দিতে দিবেন না আব্বা। কথা দেন আব্বা, কথা দেন।’
আখতার চেঁচালেন এইবার। তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। আকাশ গুড় গুড় করে ডাকছে।
হাসমত আলী মেয়ের কপালে চুমু এঁকে দিলেন। বললেন, ‘কথা দিলাম আম্মা। তুমি যাও। মেঘ আইয়া পড়তাছে। তোমার স্বামী খাড়াইয়া আছে।’
‘নিজের যত্ন নিয়েন আব্বা। ঠিক মতো খাইয়েন। আমার লিগা কাইন্দেন না। মনে করবেন আমি সবসময় আছি আপনার পাশে। আগে যেমন ছিলাম…’
পুতুল কাঁদছে। তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পেছন পেছন তার বাবা-মা-ভাই আসছে। একসময় পুতুলকে রিকশায় উঠানো হলো। তার পাশে আখতার বসেছেন। এক হাত দিয়ে পুতুলের একটা হাত খুব শক্ত করে ধরে রেখেছেন। পুতুল পেছন ফিরে চাইলো। তার বাবা-মা ওই দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের আসার সীমানাটুকু শেষ। আর আসতে পারবেন না! বিয়ে হয়ে গেলে বাবা-মায়ের সঙ্গে মেয়েদের মাঝে একটা দেয়াল উঠে যায় অজান্তেই। পুতুল যেন সেই দেয়াল সচক্ষে দেখতে পারছে। তার কানে বাজছে অনেক আগে শোনা একটি গান, একদিন বাজারে বাজছিল, সেদিনও সে তার বাপজানের হাত ধরে নূপুর কিনতে গিয়েছিল।
গানটি হলো,
আদর সোহাগ দিয়ে যদি করলে আমায় বড়,
কেন তবে এমন করে কন্যাকে পর করো?
এই যদি গো নিয়ম নীতি,
এই সমাজের বিধান,
হাসি মুখে করো বাবা
কন্যা সম্প্রদান।
তবে কেন কান্না চোখে,এ কোন অনুভূতি?
বাবা খেয়াল রেখো তুমি তোমার প্রতি।
বাবা খেয়াল রেখো তুমি তোমার প্রতি…..
(চলবে)