প্রণয়ের_তৃষ্ণা-১১,১২

0
506

#প্রণয়ের_তৃষ্ণা-১১,১২
অলিন্দ্রিয়া রুহি
১১
_____
বুকের ভেতর কেউ যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। ফুসফুস, হৃদপিণ্ড, কিডনি- মনে হচ্ছে সব পুড়ছে, সব। পুড়ে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। পুতুল কোনোভাবেই নিজের কান্না থামাতে পারছে না। তবে কান্নার শব্দ হচ্ছে না। শুধু ক্ষণে ক্ষণে তার সর্বাঙ্গ কেঁপে কেঁপে উঠছে।

আখতারের দুই ভ্রু কুঁচকে আছে। কপালে ঈষৎ ভাঁজ। তিনি আঁড়চোখে পুতুলকে একবার দেখে নিলেন। তার হাতের মুঠোয় পুতুলের হাত। তিনি ইচ্ছে করে একটু চাপ প্রয়োগ করলেন। পুতুল হুশ ফিরে পেল। আলতো ভাবে নিজের হাত আখতারের হাতের মুঠো থেকে সরানোর জন্য চেষ্টা করতে লাগল। তার সারা শরীর রি রি করছে। আখতারের স্পর্শ কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। পুতুলের নড়াচড়া টের পেয়ে আখতার দাঁত বের করে হাসলেন। পুতুলের হাত পূর্বের তুলনায় আরও শক্ত করে ধরলেন। বলতে লাগলেন, ‘লাভ নাই। এই যে একবার ধরছি, আর ছাড়মু না।’

পুতুল নিস্তেজ হয়ে পড়ল। হাত ছাড়ানোর চেষ্টা বাদ দিয়ে আখতারের অপোজিট দিকে মুখ ঘুরিয়ে চুপ করে রইলো। মনে মনে নিজেকে বোঝালো, এখন তো মাত্র হাত ধরেছে। রাতের আঁধারে সারা শরীর ছোঁবে। আর সেটাকে মেনে নিতেই হবে ওকে। ও নিজের ইচ্ছায় নিজেকে বলিদান করে দিয়েছে। তাই এরপর যা যা হবে তার সবকিছুই ওকে মেনে নিতে হবে। দাঁতে দাঁত কামড় দিয়ে পড়ে থাকতে হবে। যতদিন শ্বাস আছে ঠিক ততদিনই….

বাড়ির সামনে এসে রিকশা থামল। টাকা বের করার জন্য পুতুলের হাত ছেড়ে দিতেই পুতুল তড়িঘড়ি করে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়াল এক পাশে। আখতার চোখ গরম করে তাকালেও পুতুল দেখল না। চুপচাপ রিকশা ওয়ালাকে টাকা দিয়ে পুতুলের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন উনি। রাগে গজগজ করতে করতে বললেন, ‘এহন আর তোমার বাপের আদরের মাইয়া নাই তুমি। এই বাড়ির বউ হইছো। বউ বউয়ের মতো থাইকো। উল্টাপাল্টা কাম যেন না দেহি। আর আইজকা থেইকা বনে-বাদাড়ে ঘুরাঘুরি ও বন্ধ তোমার। কথা কী কানে গ্যাছে?’

পুতুলের চোখ পুনরায় অশ্রুসজল হয়। নির্বাক ঠোঁটে ঘাড় কাত করে ‘হ্যাঁ’ সূচক জবাব দেয় সে। আখতার হাসলেন, বউকে প্রথম দিনই টাইট দেওয়া গেছে। বউ মানুষ কে রাখতেই হয় টাইটের উপর। এরা ভালোবাসা বোঝে না। বেশি ভালো ব্যবহার করলে মাথার উপর উঠে প্রস্রাব করে দেয়। তাই প্রথম থেকেই এদের পায়ের জুতোর মতো করে রাখতে হবে। তাহলেই সংসার সুখের হবে- যদিও এটা আখতারের নিজস্ব চিন্তাভাবনা।

বাড়ির মূল ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আখতার চমকে গেলেন। দু’জন পুলিশ এসে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পাশে অর্ক ও আছে। আসার পথে মনু মিয়া এবং বাকী মুরুব্বিরা সবাই যার যার গন্তব্যের দিকে চলে গিয়েছেন। তারা থাকলে মনে আরও খানিকটা জোর পাওয়া যেত। না জানি কীসব প্রশ্ন করবে ওঁরা! আখতার শুনেছেন, পুলিশরা হাজারটা প্রশ্ন করে। প্রশ্নের চোটে সবাইকে কনফিউজড করে দেয়। একটু উল্টাপাল্টা বললেই শেষ। আখতার ফাঁকা ঢোক চেপে নিজের মনে সাহস জোগালেন। তিনি এতবড় মাতবর গ্রামের অথচ সামান্য পুলিশ দেখে ভয় পাচ্ছেন ভেতরে ভেতরে! এ যেন সত্যিই হাস্যকর ঘটনা।

ঘোমটা থাকার কারণে মাটি ছাড়া আর কিছুই পুতুলের চোখে পড়ছে না। তাই পুলিশের উপস্থিতি অথবা অর্ক, কাউকেই দেখার সৌভাগ্য হলো না তার। কিছুদূর গিয়ে আখতার থামলেন বিধায় পুতুলও থেমে দাঁড়াল। আখতার গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘তুমি ভিত্রে যাও।’

পুতুল জবাব না দিয়ে চুপচাপ ঘরের ভিতরে চলে গেল। অর্ক বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলো। বিয়েটা হওয়ার কথা ছিল দুপুরে, এখনো দুপুর হতে কিছু সময় বাকী। অথচ উনি একা একাই গিয়ে বিয়ে করে নিয়ে এলেন তাও এত হন্তদন্ত ভাবে! একটা বিষাদ মাখানো মেঘ অর্ক’র মনের ভেতর ধীরে ধীরে গুমোট ছায়া ছড়াতে লাগল। পুতুলের মতোন একটুখানি একটা মেয়েকে পিশাচের হাত থেকে বাঁচাতে পারল না ও!

‘আরে ওসি সাহেব? হঠাৎ আমার বাড়িত আপনের পদচারণ পড়ল যে?’ আখতার হেসে হেসে কথাখানা বললেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা। কিন্তু তার কথায় বিন্দুমাত্র চেহারার অভিব্যক্তি পরিবর্তন হয় না ওসি মকবুল রহমানের। তিনি ভ্রু কুঁচকে ঘরের ভেতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, ‘মেয়েটা কে?’

আখতার জবাব দেওয়ার আগেই অর্ক বলে উঠল, ‘চাচার নতুন বউ।’
আখতার চোখ রাঙিয়ে তাকালেন অর্ক’র দিকে। অর্ক তার ধার ধারলো না। ওসি সাহেব ভ্রু উঁচিয়ে তাকালেন, ‘আমি কিছু বুঝলাম না আখতার ভাই। আপনার প্রথম স্ত্রী খু’ন হয়েছে আর আপনি আজকে আরেকটি বিয়ে করে নিয়ে এসেছেন? মেয়েটাকে দেখেও তো বেশ ছোট লাগল। ওর চেহারাটা দেখা যাবে?’

পুতুলের মাথায় লম্বা ঘোমটা থাকার কারণে তার চেহারা দেখতে পায়নি ওসি সাহেব। যদি দেখতো, এক্ষুনি আইনি পদক্ষেপ নিতো এত ছোট মেয়েকে বিয়ে করার কারণে! আইন অনুযায়ী পুতুলের এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। আখতার খুব ভালো করে জানে এটা। এর আগে যে ওসি ছিলেন, তিনি আখতারের থেকে অনেক টাকা খেয়েছেন। বিনিময়ে আখতারকে সবসময় সাপোর্ট দিয়ে গেছেন। হুট করে তার বদলি হয়ে এই নতুন ওসি এসেছে আজ নিয়ে সাতদিন মাত্র। এরই ভেতর লোকমুখে শোনা গেছে,উনি মানুষ হিসেবে ভীষণ ন্যায়নীতিবাণ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময় রুখে দাঁড়ান। এমনকি ঘুষ খান না। তবে আখতার মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এরপরও একবার চেষ্টা করে দেখবেন উপঢৌকন পাঠানোর। একেও যদি হাত করা যায় একবার! তাহলে আর কথা-ই নেই।

পুতুলকে দেখানো যাবে না কোনো ভাবেই। তাই আখতার গলায় একটু কাঠিন্য যোগ করে বললেন, ‘না, না, ওরে দেহা যাইবো না। পর্দার একটা ব্যাপার আছে তো। পর পুরুষের সামনে যাওন যাইবো না।’

অর্ক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আখতার কথা থামিয়ে ওকে বললেন, ‘তুমি এইনে? আইজকে না তোমগো যাওয়ার কথা? সকালে কইলা…’

‘যতদিন আপনার প্রথম স্ত্রী’র হ’ত্যা কান্ডের কোনো সুরাহা না হচ্ছে ততদিন এই বাড়ির এবং এই গ্রামের কোনো সদস্যই গ্রাম ছাড়তে পারবে না। যে এরপরও ছাড়বে তাকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হবে।’

বললেন ওসি সাহেব। এর মানে অর্কদের চলে যাওয়া আরও কয়দিন পেছালো! আখতার বিরক্তি নিয়ে নিঃশ্বাস ফেললেন।

‘যাও, তুমি ভিত্রে যাও। ওসি সাহেবের লগে আমার কথা আছে।’

আগ বাড়িয়ে অর্ক যেন আর কিছু না বলতে পারে তাই কায়দা করে অর্ককে চলে যেতে বললেন তিনি। অর্ক বুঝল, আর কিছু বলল না। একবার ওসি সাহেবের দিকে তাকিয়ে চলে গেল ঘরের ভেতরে।

আখতার ওসি সাহেবকে নিয়ে বৈঠকখানায় বসলেন। তার কিছু গোপন কথা আছে ওসির সঙ্গে।

_____

শম্পা মুখ ঝামটা মেরে বললেন, ‘আল্লাহই জানে কী দিয়া জাদু করছে আমার দেওররে। বউরে আনানোর লিগা একটু ধৈর্য্য হইলো না। সক্কাল সক্কাল কাউরে কিছু না জানাইয়া নিয়া আইলো। এইডা একটা কাম করল?’

ইথিশা বালিশের খোলশ খুলতে খুলতে মৃদু হেসে জবাব দিলো, ‘উনি হয়তো মেয়েটাকে সত্যিই খুব ভালোবাসে।’ হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল ইথিশা। কথার মাঝে সামান্য বিরতি শেষে বলল, ‘ভালোবাসার মানুষকে কে না কাছে পেতে চায়?’

শম্পা পূর্বের ন্যায়ই গোমড়া মুখে বললেন, ‘ভালোবাসা না কচু। তুমি এইনের মেহমান। তুমি আর কী জানবা ঘরের কতা?’

‘তবুও, আমার মন বলে, উনি মেয়েটা কে অনেক ভালোবাসেন। তাই তো ভয়ে ছিলেন, যদি বিয়েটা কোনো কারণে পিছিয়ে যায়। তার ভেতর উনার প্রথম স্ত্রী’র বিষয়টা…’

‘হ, এইডা একটা সত্য কতা কইছো। রুজিনারে কেডায় মারলো এমনে কইরা? আমার মাথায় ঘোরে না।’ শম্পাকেও বেশ অন্যমনস্ক দেখালো।

‘উনি হয়তো এই চিন্তা করেই দ্রুত বিয়ের কাজটা সেড়ে ফেলেছেন। উনার যেভাবে সুবিধা হয়, সেটাই করেছেন। আর এতে যদি উনি খুশি থাকেন তাহলে আপনি আমি কথা বলার কে বলেন? তার চেয়ে চলুন, দ্রুত ঘরটা গুছিয়ে দেই।’

‘বিয়াডা তাড়াতাড়ি সাড়ছে, বাসরডাও তাড়াতাড়িই সাড়বো,কী?’ টিপ্পনী কাটেন শম্পা। ইথিশা খিল খিল করে হেসে উঠে। ওরা দু’জনেই ব্যস্ত হাতে আখতারের ঘরটা সাজাতে শুরু করে।

_____

পুতুলকে আপাতত ইথিশার ঘরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এই ঘরটায় এর আগেও এসেছে পুতুল। তখন এখানে কেউ থাকত না। শুধু মেহমানরা এলে ঘুমাতো। তবে প্রায় বিকেলে রুজিনা যখন ডেকে নিতো পুতুলকে, তখন ওরা এই ঘরে বসেই বিভিন্ন গল্পে মত্ত হয়ে যেতো। পুরোনো স্মৃতি গুলো চোখের পাতায় কেমন স্পষ্ট ভাবে ভেসে উঠল। পুতুলের খাঁ খাঁ মন আরও সিক্ত হয়ে উঠে। সে উঠে গিয়ে আলনাটায় হাত বোলাতে লাগে। মনে পড়ে যায় এক বিকেলের ঘটনা,

লুডু খেলছিল রুজিনা আর পুতুল ঘরে বসে। সেদিনটা ছিল বসন্তের আটাশ তারিখ। আবহাওয়া সুন্দর, ওদের মনটাও ফুরফুরে। দু’জনে একটু পর পর হেসে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছিল একজনের উপর আরেকজন। কোন ফাঁকে যেন একটি কাচা গুটি পাঁকা গুটির ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছিল পুতুল। পরবর্তীতে রুজিনা টের পেয়ে গেলে তেড়ে এসে পুতুলকে ধরতে নিলে পুতুল উঠেই দৌড় লাগাল। রুজিনাও কম যায় না। সেও উঠে আসে পুতুলকে ধরার জন্য। ঠিক তখনই দৌড়াতে গিয়ে গায়ের সঙ্গে জোরে ধাক্কা লেগে আলনা টা কাত হয়ে বিছানার উপর পড়ে যায়। আচানক ঘটনায় হতবিহ্বল দুই জোড়া চোখ মুহূর্তেই হো হো শব্দে হেসে উঠে বাড়ি মাতালো।

ভাবতে গিয়ে চোখের কোণা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লেও ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুঁটে উঠে পুতুলের। সে বিড়বিড় করে স্বগতোক্তি করে, ‘কী কপাল দেহো! তোমার ঘরে তোমার সতীন হইয়া আইলাম, তাও এমন দিনে যেদিন তুমি নাই।’
মুহূর্তেই ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গিয়ে চোখজোড়া ভরে উঠল জলে। আলনার উপর শক্ত ভাবে হাত রেখে পুতুল ব্যথিত মনে বলল, ‘কেডায় মারলো তোমারে? ক্যান এমনে কইরা চইলা গেলা? তুমি তো মানুষটা অনেক ভালা আছিলা। তাও তোমার কপালে এমন ঘটনা ক্যান ঘটলো? ভাবতেই পারি না, তোমারে আর দেহুম না! কোনোদিন না!’

‘কাঁদছেন?’

পুতুল চমকে উঠল। এমন ভাবে কেঁপে উঠল আর একটু হলেই আলনায় কপাল লেগে মোটামুটি আকারের একটা ব্যথা পেতো সে। তড়িঘড়ি করে পেছন ঘুরে তাকিয়ে দেখল অর্ক দাঁড়িয়ে। পুতুলের মাথায় ঘোমটা ছিল না। সে দ্রুত ঘোমটা তুলে দিলো। মুখ সরিয়ে অপর পাশে তাকাল। মাথা নিচু করে কাঁপন নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

অর্ক দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। এক নজর বাইরে তাকিয়ে সে ভেতরে ঢুকে পড়ল। আশ্বাসের সুরে বলল, ‘আমাকে দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি আসলে ইথিশার কাছে এসেছিলাম। ওকে বলতে যে আমরা আজ যাচ্ছি না।’

‘আপনেরা কী আইজকা চইলা যাইতেন নাকি?’ মুখ ফসকে দ্বিতীয় বারের মতো কিছু একটা জানতে চাইলো পুতুল অনাকাঙ্ক্ষিত এই মানুষটার কাছে। প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েই কেমন সিঁটিয়ে গেল ও। মনে মনে লজ্জা পেল। কী দরকার ছিল প্রশ্ন করার?

অর্ক বলল, ‘হুম। আজ চলে যেতে চাইছিলাম। ওসি সাহেব আঁটকে দিলেন। খু’নের তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত…’

‘কেডায় মারছে? জানা গেছে?’ পুনরায় ভীষণ উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চাইলো ও। অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষ টা কেমন কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠছে!

অর্ক দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়, ‘না, কিচ্ছু জানা যায়নি।’

‘ও।’ ছোট্ট করে বলে পুতুল, তারপর মুখ সরিয়ে অন্যদিকে চেয়ে রইলো। যেন আর কিচ্ছু বলার নেই মানুষ টাকে। কিন্তু এই মানুষ টার যে অনেক কিছু বলার আছে পুতুল কে! অনেক কিছু!

‘একটা কথা বলব?’ অর্ক সম্মতি চায়। পুতুল হ্যাঁ না কিছুই বলে না, কিন্তু তার মৌনতা যেন ‘হ্যাঁ’ বলে দেয়।

‘আপনি কাঁদবেন না। আমার ক্ষমতা থাকলে এই বিয়েটা আঁটকে দিতাম বিশ্বাস করুন। জোর যার, মুল্লুক তার। আর এই গ্রামে আমার কোনো জোর নেই। তাই…’

অর্ক একটু থামে। পুতুল ভাবলেশহীন। চুপচাপ শুনছে।

‘যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। আপনার জন্য আগামীতে কী আছে জানি না। তবে আফসোস থেকে যাবে, চেয়েও আপনার জন্য কিছু করতে পারলাম না।’

একটা কী ধন্যবাদ দেওয়া উচিত?
পুতুলকে নিয়ে কেউ তো এভাবে ভাবেনি! এতোটা ভাবেনি! তার যে আপন বাবা-মা, তার রক্ত, কই, তারাও তো ভাবেনি! আর কোথাকার কোন শহুরে শিক্ষিত লোক, তার মতো পুচকে একটা মেয়ের জন্য কতকিছু ভেবেছে তাও! একটা ধন্যবাদ অন্তত দেওয়াই যায়।

মনে মনে ভাবল পুতুল। মুখ তুলে ‘ধন্যবাদ’ দেওয়ার মুহূর্তেই ঘরের ভেতর প্রবেশ করে ইথিশা। পুতুল দ্রুত চোখ নামিয়ে নিলো। অর্কও খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। অথচ এখানে এত অস্বস্তির কিছু নেই। চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলে মানুষের যেরকম অনুভূতি হয়, ঠিক একইরকম অনুভূতি অর্ক-পুতুলের মাঝে বিরাজমান। অথচ ওরা তো চোর না। কিছু চুরিও করতে আসেনি। তবুও! কী অদ্ভুত!

(চলবে)

#প্রণয়ের_তৃষ্ণা (১২)
অলিন্দ্রিয়া রুহি

_____
অস্বস্তি নাকি অন্যকিছুর ভয়- জানা নেই পুতুলের। একটু না,অনেকখানি চমকে উঠল সে ইথিশার আগমনে। চমকালো অর্কও। যদিও বাহির থেকে সে স্থির, নিশ্চল। যেন ইথিশা এখনই আসতো আর তারই অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে ও।

‘তুমি এখানে?’

অবশেষে মুখ খুললো ইথিশা। তার চোখের দৃষ্টি সরু। একবার পুতুলের দিকে চেয়ে পুনরায় অর্ক’র উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।

অর্ক জানে না কাকে সে আশ্বস্ত করল, নিজেকে নাকি ইথিশাকে! তবে বলল,

‘আমি ভেবেছি তুমি ঘরে আছো। তোমার কাছেই এসেছিলাম। এসে দেখি উনি..’

‘উনি টা আবার কী? চাচী বলো।’

প্রত্যুত্তর ইথিশার। কথাটা বলামাত্র তার ঠোঁট সামান্য বাঁকা হলো, যেন বিদ্রুপ করেছে। পুতুলের সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে। অজানা খারাপ লাগায় মন ছেঁয়ে যায়। অর্ক’র চাচী- এমনটা যেন শুনতেই চায়নি ও। মানতে চায়নি মনও! তবুও কেন যে শুনতে হলো। বিষাদের ঢল এবার গাঢ় হয় বেশ। তবুও চুপচাপ রয়। কাউকে কিচ্ছুটি বলার নেই। ভাগ্য তরী যেখানে নিয়ে যাবে যাক…সে তৈরি হয়েই এসেছে।

‘এইটুকু মেয়েকে চাচী বলে ডাকতে পারব না প্লিজ! আর আখতার চাচা আমার কোনো আপন চাচাও নয়।’

হঠাৎই মোড় বদলে গেল। তীব্র স্বরে প্রতিবাদ করে উঠল অর্ক। তার জোরালো চোখের দৃষ্টিতে চোখ রেখে ফের কিছু বলার সাহস করে না ইথিশা। মানুষ টা এমনিতে শান্ত, রাগলে বাপের যম!

পুতুল তাকাল, ঘোমটার ভেতরই চোখ, তবুও একবার সামনের দিকে চেয়ে মাথাটা নামিয়ে নিলো। কোনো অনুভূতি হচ্ছে না, না ভালো লাগা, না খারাপ লাগা। নিজেকে এতোটা পাথর যে কবে, কীভাবে করে তুললো!

‘যাইহোক, তোমাকে একটা কথা বলতে এলাম।’

বলল অর্ক। ওর কথার পিঠে ইথিশা আঁড়চোখে পুতুলের দিকে তাকিয়ে ভোঁতা মুখ করে বলল,

‘চলো, বাইরে চলো।’

ওই চোখের ভাষায় কী ছিল তা স্পষ্ট পড়তে পারল অর্ক। পেছন ঘুরে অন্যদিকে ফিরে দাঁড়ানো পুতুলকে একবার দেখে নিয়ে বলল,

‘এমন কিছু না যা উনার সামনে বলা যাবে না। বলতে এসেছিলাম এটাই যে আমরা যাচ্ছি না। আর কিছুদিন এখানে থাকতে হবে।’

‘মানে? কেন?’

ইথিশার প্রশ্ন উপেক্ষা করেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। ইথিশা পেছন ঘুরে তাকাল। পুতুলের দিকে। তার চোখেমুখে অন্যরকম দ্যুতি। এতক্ষণ এখান থেকে চলে যেতে হবে শুনে খানিক মন খারাপ হওয়া মেয়েটা হঠাৎ করেই এখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। অথচ এর পেছনে কোনো জোরালো কারণ নেই। অর্ক এসেছে, পুতুলও এ ঘরেই ছিল, পুতুলকে চাচী সম্বোধনে বারণ করেছে ও- ব্যস এতটুকুতেই অনেক কিছু ভাববারও কোনো কারণ নেই ওর। তবুও কেন যেন মনের ভেতর একটা খচখচ কামড়ানি অনুভব করল ইথিশা। কয়েক পলক পুতুলের দিকে তাকিয়ে থেকে সে ও ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

এতক্ষণে একটু নির্ভার হলো পুতুল। এতক্ষণ পরিবেশটা দম বন্ধ করে দিচ্ছিলো। মনে হচ্ছিল গলার কাছে শ্বাস এসে আঁটকে গিয়েছে। রুদ্ধশ্বাস টা নাসিকাপথ ভেদ করে বেরিয়ে গেলে সে বিছানার উপর বসে পড়ল। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। নিজের জীবন নিজের হাতেই শেষ করে দিলো!

_____

আখতার দুইবার কাশলেন। গলা কেশে পরিষ্কার করলেন। ওসি সাহেব ভীষণ বিরক্ত নিয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার দুই ভ্রু, কপাল কুঁচকে আছে। আখতারের ভণিতা দেখে তিনি অধৈর্য্য কণ্ঠে বলে উঠলেন,

‘ঝেড়ে কাশুন তো। যা বলার সাফ সাফ বলেন।’

আখতার এবার কাশাকাশি থামিয়ে দাঁত বের করে হাসলেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা টাকার বান্ডিল বের করলেন অল্প একটু। সেটা স্পষ্ট দেখলেন ওসি সাহেব। তার চোখেমুখে বিরক্তি সরে গিয়ে কপট রাগ ফুঁটে উঠল। তিনি খেঁকিয়ে বললেন,

‘আপনি আমাকে ঘুষ দিতে চাচ্ছেন?’

সঙ্গে সঙ্গে পকেটের ভেতর টাকার বান্ডিল টা ঢুকিয়ে দাঁত দিয়ে জিভ কাটলেন আখতার। এদিক ওদিক জোরে জোরে মাথা নাড়িয়ে বলতে লাগলেন,

‘ছিঃছিঃ ঘুষ কন ক্যান? আমি তো আপনেরে সামান্য উপহার দিতে চাইতাছি।’

‘আপনার উপহারের আমার কোনো প্রয়োজন নেই। শর্ষের ভেতরই ভূত দেখছি। আপনার প্রথম স্ত্রী’র খু’ন টা তাহলে আপনিই করেছেন?’

‘এমা! না, না! আপনি আমার কথাটা মন দিয়া আগে হোনেন..’

আখতার এবার একটুখানি চেপে ওসি সাহেবের কাছাকাছি বসলেন। চাপা স্বরে বললেন,

‘আমি খু’ন করি নাই এডা যেমন সত্য, চাইলে খু’ন করাইতে পারি এডাও তেমন সত্য। রুজিনার লগে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক আছিলো। একটু হইলেও ওর লিগা আমার দয়ামায়া আছিলো মনে। আর আমি তো ওরে তালাক দিয়াই দিছি। তাইলে ক্যান ওরে খু’ন করবার যামু? যার লগে আমার সমস্ত সম্পর্ক শ্যাষ তারে মাইরা আমার লাভটা কী কন?’

ওসি সাহেবের চোখমুখ কঠিন। তিনি শক্ত চোয়ালে বললেন,

‘তাহলে আমাকে ঘুষ দিতে চাচ্ছিলেন কেন? কোন কারণে?’

‘ওহোরে! আবার ঘুষ ঘুষ করতাছেন আপনে! আমি তো কইছিই এডা একটা সামান্য উপহার। আমাগো এলাকায় আইছেন, এতবড় পুলিশ আপনে, একটা উপহার কী দেওন যায় না?’

ওসি সাহেব প্রত্যুত্তর করার পূর্বেই আখতার পকেট থেকে টাকার বান্ডিল টা বের করে আনলেন। যেন কেউ না দেখে তাই দ্রুত ওসি সাহেবের বুক পকেটের ভেতর বান্ডিল টা ঢুকিয়ে দিতে দিতে বললেন,

‘এইডা রাখেন। এই গেরামে নতুন আইছেন। সবকিছু আস্তে আস্তে বুঝবেন। তহন দেখবেন আপনের বন্ধু কম, শত্রু বেশি। তবে আমারে বন্ধুই ভাবতে পারেন। আপনার বিপদে আমি, আমার বিপদে আপনি..’

‘আপনি কিন্তু..’

‘আমি কিন্তু কিছুই না। রুজিনার বিষয়টা ধামাচাপা দিয়া দেন। এইডা নিয়া বেশি ক্যাচাল কইরেন না।’

‘আপনি কী বলতে চাইছেন!’

ওসি সাহেব ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন।

‘আহহা! এত উত্তেজিত হইলে তো চলে না সাহেব। আপনের ভালার লিগা কইতাছি। কেডায় মা’রছে হেইডা আমিই আমার লোক দিয়া বাইর করতাছি।”

‘আপনি কী পুলিশ?’

‘না পুলিশ না। আমি হইলাম এই গেরামের মাতবর। বিশ্বাস না হইলে গেরামে জিগাইতে পারেন যান।’

এবার আখতারও উঠে দাঁড়ায়। ওসি সাহেবের উত্তেজিত ভাবভঙ্গি উনার ভালো লাগছে না। উনার সামনে এর আগে কেউ এতোটা উত্তেজিত ভাবে রাগ দেখিয়ে কথা বলেনি। এই নলা-ই প্রথম। হয়তো এ জানেই না আখতার চাইলে কী কী করতে পারেন! তাকে সামান্য দোকান ব্যবসায়ী দেখে অনেকেই প্রথমবারে বুঝতে পারেন না, এর আড়ালে উনার আর কী কী ক্ষমতা রয়েছে।

‘বেশি চেইতেন না। থাকছেন তো ঢাকায়। তাই খুব আইনের ক্ষমতা দেখাইতেছেন। এইডা হইলো গেরাম। এইনে কারো গলাডা কাইড্ডা ক্ষেতের ভিত্রে মাটি দিয়া দিলে কারো ক্ষমতা নাই খুইজ্জা বাইর করনের। কথাডা যত তাড়াতাড়ি বুজবেন, ওত ভালো।’

এরপর আর কথা চলে না। আখতার আকারে ইঙ্গিতে কী বুঝিয়েছেন তা বেশ ভালো করেই বুঝতে পারলেন ওসি সাহেব। তিনি প্রত্যুত্তরে কিছুই বললেন না। পকেটের টাকাটা নিয়ে চুপচাপ বৈঠকখানা ছাড়লেন। তার গমন পথের দিকে চেয়ে আখতার মৃদু হাসেন। পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী পুতুলের কথা। পুতুল তাকে বুড়ো বলে অপমান করেছে, তার চাই কচি ছেলে! মনে পড়ে যায় শাহিনের বলা প্রতিটি কথা। রন্ধ্রে রন্ধ্রে রাগ ছুটে গিয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠে ওঁর। ফোঁস করে একটি উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ছেড়ে তিনি এগোলেন ঘরের ভেতরে…

_____

পুতুলকে আখতারের ঘরে এনে বসানো হয়েছে। কোনো ফুল দিয়ে বিছানা সাজানো হয়নি। শুধুমাত্র বিছানার কভার,বালিশের কভার বদলে ঘরটা পরিপাটি ভাবে গোছানো হয়েছে। পুতুলের চোখের পানি থামছেই না। এখন দুপুর। একটু একটু করে বেলা অন্ধকারের দিকে গড়াচ্ছে। সেই সঙ্গে পুতুলের জীবনেও ঘোর অন্ধকার নেমে আসছে। রাত হলেই আখতারের শয্যা সঙ্গী হতে হবে নিশ্চয়ই। আবেগের বশে পরিবারের কথা ভেবে নেওয়া সিদ্ধান্ত গলায় বিঁধে যাওয়া কাঁটার মতো লাগছে এখন। না উগড়াতে পারছে আর না পারছে গিলে ফেলতে। প্রতিটা মুহূর্ত ভয়ে ভয়ে কাটছে ওর।

ঘরের ভেতর কারো পদধ্বনি শুনতে পেয়ে বুকের ভেতর কামড়ে থাকা ভয়টা এবার গলায় উঠে এলো। পানির পিপাসা পেয়ে বসল। নিশ্চয়ই আখতার এসেছেন! কী করবেন? ছোঁবেন?

নাহ, পুতুলকে খানিকটা স্বস্তি দিলো শম্পা। তিনি কাঠখোট্টা গলায় বলে উঠলেন,

‘এমনে ঘোমটা দিয়া আর কতক্ষণ বইয়া থাকবা? ঘরের বউ অইছো, কাম কাইজ করা লাগবে না? জলদি পাল্টাইয়া বাইরে আহো। দুপুরের রান্ধন বাকী। তোমার স্বামী যে বেলার খাওন বেলায় খায়, এট্টু দেড়ি হইলে বাপ-মা তুইলা গাল দেয়, হেই কথা জানা আছে তো?’

পুতুল হা হুঁ কিচ্ছু বলতে পারল না। সে জানে আখতার বদমেজাজি পুরুষ। তবে কতটুকু তা সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। কিন্তু সে যে স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে পারে, এ বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিত পুতুল। এর আগে প্রায়শই রুজিনাকে মা’র খেতে দেখেছে ও। কখনো তো রুজিনার কপাল, গলায়, গালে লাল-নীল ছোপ ছোপ দাগও দেখতে পেতো। রুজিনাকে জিজ্ঞেস করলে সে মলিন ঠোঁটে বলতো,

‘এডি কিছু না। তোর চাচায় আমারে আদর করে। এডি সোহাগের দাগ..’

কিন্তু ছোট্ট পুতুলের বুঝতে বাকী রইতো না কতটা আদর সোহাগ করলে এরকম দাগ পড়ে শরীরের উপর। আচ্ছা, এখন থেকে তাকেও সেই একই জিনিস গুলোর মুখোমুখি হতে হবে। শুধু রাতের শয্যা সঙ্গিনীই না, দিনের বেলায় ঘরের বান্দী হয়ে থাকা লাগবে। একটু ভুল করলে মা’র খেতে হবে। কথাগুলো ভাবতেই পুতুলের শরীর শিউরে উঠে। ইশ! বিয়ের আগে কেন এতকিছু ভাবেনি সে! কেন নিজেকে এভাবে শাস্তি দিচ্ছে আজ! নিজের কারণে নিজের পায়ে এভাবে কুড়াল মারলো ও!

‘কী হইলো? এমনে সংয়ের মতো বইয়া আছো ক্যান?নাকি এহনই জামাইর লগে হুইতে হইবো? ছিঃ ছিঃ ছিঃ লাজলজ্জা সব উইঠ্যা গেল দুনিয়া থেইকা..’

পুনরায় শম্পার বিদ্রুপ মাখানো কাঠখোট্টা কণ্ঠস্বর শোনা গেল। পুতুল বিছানা ছাড়তে নিচ্ছিলো, এমন সময়ে আখতারের কণ্ঠস্বর শুনে সে ওখানেই জমে গেল। হাত-পা সব যেন অবশ হয়ে গেল সেকেন্ডের ব্যবধানে।

আখতার শম্পার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। বজ্রকণ্ঠে বললেন,

‘নতুন বউরে এহনই কামের আদেশ করো ভাবী?’

শম্পা চমকে পেছন ফিরে তাকালেন। আখতারের রাগ রাগ মুখ দেখে তিনি অল্প একটু হাসার চেষ্টা করলেন। ফিচেল গলায় বললেন,

‘আমি তো মশকরা করতাছিলাম ভাই।’

‘এমন মশকরা আমার পছন্দ না। আইজকা মাত্র এই ঘরে প্রবেশ করছে ও। কাইল হইতে সংসার বুইজা লইবো। এহন যাও, রান্ধাবাড়ার কাম সাড়ো গা। পেটে ভুখ লাগছে কিন্তু।’

‘আইচ্ছা।’

‘মনেও ভুখ লাগছে। হেইডা এট্টু মিটাইয়া লই। কেউ আইলে কইবা আমি ব্যস্ত আছি। বুজছো?’

বলেই আখতার এক চোখ টিপে দেন। শম্পা ভোঁতা মুখ করে বেরিয়ে যান। আখতার দরজা আঁটকে দিলেন খট করে শব্দ হয়। সেই শব্দে পুতুলের সারা শরীর এমন ভাবে কেঁপে উঠে যেন এই মাত্র দুইশো ভোল্টেজের কারেন্ট তাকে ছুঁয়ে গেছে। সে কী করবে দিশেহারা হয়ে পড়ে। আখতারের স্পর্শ সে পেতে চায় না। একদমই না….

‘আ…আমি যাই। ভাবী একলা একলা…’

অনেক কষ্টে গলা থেকে এইটুকু কথা টেনেটুনে আখতারের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতেই ওর কোমর খপ করে চেপে ধরে নিজের বুকের কাছে নিয়ে আসেন উনি। পুতুলের দুই চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল টপাটপ করে। সে মোচড় দিয়ে উঠল ছোটার জন্য। ভেজা কণ্ঠে বলল,

‘দিন দুপুরে..মাইনষে কী কইবো?’

‘বাহানা দিস না মা**। আমি বুইড়া বইলা আমারে মনে ধরে না,না? কারে মনে ধরে? জোয়ান ছেড়া গো? অর্ক’র মতো পোলাগো? ওগো দেখলে রস উঠে, রস?’

বিশ্রি রকমের গালিগালাজ আখতারের মুখ দিয়ে বেরোতে লাগল। এই কয়দিনের আখতার আর এখনের আখতারের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ যেন। বিয়েটা হওয়া মাত্রই পুতুলের সমস্ত মর্যাদা, সম্মান তার কাছে ধূলোবালির মতো হয়ে গেল। পুতুলের কান শিরশির করে উঠে। এত খারাপ ভাষা কেউ তাকে বলেনি এর আগে।

‘আল্লাহর দোহাই লাগে আপনে চুপ করেন। আমারে ছাইড়া দেন। আমার ভালা লাগতেছে না।’

কেঁদে উঠে গুঙিয়ে। আখতার পুতুলের কোমরে খুব জোরে একটা চিমটি মারলেন। তারপর ধাক্কা দিয়ে পুতুলকে বিছানার উপর ফেললে মাথা থেকে ঘোমটা সরে গেল ওর। হিংস্র বাঘের মতো পুতুলের পেটের উপর উঠে বসেন উনি। আখতারের ভারী শরীর পিষ্ট করে পুতুলের শরীরকে। যতটা না শারীরিক কষ্ট তার চাইতেও কষ্ট বেশি মনের। বুকের উপর থেকে থাবা দেওয়ার ভঙ্গিমায় শাড়ির আঁচল সরিয়ে উন্মুক্ত করে দেয় ওকে। পুতুলের চোখ ফেঁটে বেরোনো উত্তপ্ত গরম পানি গুলো আখতারের মন ছোঁয় না। বরং এক ধরনের পৈশাচিক আনন্দ দিলো যেন।

রাগে হিসহিস করে তিনি বললেন,

‘নাটক করিস না। বুড়া বইলা অবহেলা করিস না। একবার চুপ কইরা দেখ। শান্তি দিমু জুয়ান গো মতোই।’

কী বাজে কথা! কী কথা বলার ভঙ্গিমা! ঘেন্নায় গলার কাছটায় এক দলা থুতু জমলো। এইটুকু আখতারের মুখের উপর ছুঁড়ে দিতে পারলে ভীষণ খুশি হতো পুতুল, ভীষণ…

ঘরের বাহিরে পর্যন্ত চাপা কান্নার সুর ছড়িয়ে পড়ে। বিছানার উপর ধস্তাধস্তির শব্দও শোনা যায় দরজায় কান পাতলে। গোলাঘরের দিকে যাওয়ার সময় সবটা শুনে শম্পার মন খারাপ হলো। আজ কতদিন হয়, পুতুলের চক্করে পড়ে আখতার তার ঘরে আসা ভুলে গেছে! রাতের আঁধারে এরকম সুখ শীৎকার তার ঘরের দেয়াল গুলোকে ভারী করে তুলতো। অথচ সবটা এসে দখলে নিয়ে নিয়েছে ওই মেয়ে…পুতুল! ওর আগুন রূপ আবারও শম্পাকে যৌবন পিপাসায় ফেলে দিয়েছে। শম্পা মুখ ভেংচি কেটে দ্রুত জায়গা ছাড়ে। আখতার বেরিয়ে আসুক, একটা বোঝাপড়া করবেই করবে। পুতুলকে দিয়ে নিজের জ্বালাপোড়া মিটাক, তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু তাই বলে শম্পাকেও ভুলে যাবে? এ চলবে না!

একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে নিজেকে নরপিশাচের হাতে সমর্পণ করে পুতুল। ফুলের ন্যায় শুভ্র দেহে একের পর এক আঘাতের চিহ্ন পড়ে। পুতুল যন্ত্রের ন্যায় মাথার উপর তাকিয়ে রয়। কান্না করতে করতে চোখমুখ ফুলে গেছে। তবুও কান্নারা থামছে না। দুই চোখের কোল ঘেঁষে এখনো পানি গড়াচ্ছে। তার দুই ঠোঁট বেঁকে একটি শব্দ ছিঁটকে বেরিয়ে এলো, ‘আব্বাজান!’

(চলবে)
★পুতুল কিশোরী। নিজের ভালোমন্দ বোঝার বয়স হলেও সেই ভালোমন্দ সিদ্ধান্ত গুলো নেওয়ার যে শক্তি বা সাহসের প্রয়োজন তা এখনো ওর হয়নি। তাই এই গল্পে বারবার পুতুলের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত উঠে আসবে। সে নায়িকা তাই তাকে সঠিকই হতে হবে, তার ভুল থাকা যাবে না, এমন টা কেউ ভেবে থাকলে সে আগামীতে অনেক হতাশ হবেন। কিন্তু যারা ধৈর্য্য সহকারে পুরো গল্পটা পড়বে, তারা শেষমেশ একটা তৃপ্তি নিয়ে উঠে যাবে, কথা দিচ্ছি। গল্পের এখনো অনেকটা বাকী। প্রতিটি পর্বে টুইস্ট থাকবে,মোড় ঘুরে যাবে। দয়া করে ধৈর্য্য ধরুন, আমাকে আমার মতো করে লিখতে দিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here