#প্রণয়ের_তৃষ্ণা-১৩,১৪
অলিন্দ্রিয়া রুহি
১৩
______
উত্তর দিক থেকে কতগুলো কালো মেঘ এসে আখতার বাড়ির আকাশ ঘন আঁধারে ঢেকে দিয়েছে। ইথিশাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। অর্ক বার কয়েক ইথিশার ঘরের ভেতর গিয়ে ঘুরে আসলো। ওই সময়ে খানিকটা কঠিন করে কথা বলা হয়ে গিয়েছে। এর জন্য এখন অনুতপ্ত বোধ হচ্ছে ওর। মেয়েটাকে একটিবার ‘সরি’ বলা প্রয়োজন।
অর্ক হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির পেছন দিকে পুকুর ঘাটে এসে দাঁড়াল। কোমরে হাত রেখে এদিক ওদিক কয়েক বার তাকিয়ে জোরে ডাক দিয়ে উঠল,
‘ইথিশা! ইথিশা..!’
কাছে একটি মা মুরগী ছিল। অর্ক’র ডাক শুনে সে কককক কককক করতে করতে বাচ্চা গুলো কে নিয়ে আড়াল হয়ে গেল। অর্ক ভ্রু কুঁচকে ওদিকে তাকিয়ে রইলো। ইথিশা গেল কই!
পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। নিশ্চয়ই ইথিশা এদিকেই আসছে। শব্দটা হচ্ছে মড়মড় টাইপ। যেন কেউ শুকনো পাতা ভেঙে ছুটে আসছে ক্ষিপ্র গতিতে। কে? ইথিশা-ই?
অর্ক আওয়াজ অনুসরণ করল। খেয়াল করল, পায়ের আওয়াজটা ঘুরে গেছে অন্যদিকে। অর্ক’র দিকে না এসে পুকুর পাড় পার হয়ে ওই পাশে যাচ্ছে। অর্ক পিছু নিলো। কে যাচ্ছে, তা দেখা না গেলেও আন্দাজে কানে আসা শব্দ গুলো অনুসরণ করেই এগোতে লাগল সে। এক মিনিটের ব্যবধানে পদধ্বনির অধিকারিণী ব্যক্তিটিকে চোখে পড়ল।
আঁখি! শম্পার মেয়ে। যেন সে অর্ক কে এখানে আশা করেনি। কেমন চমকে ভীরু চোখে তাকাল। উশখুশ ও করল সামান্য। পরক্ষণেই পা বাড়ালো ছুটে পালানোর জন্য। তার আগেই তার এক হাত টেনে চেপে ধরে অর্ক। গলায় কাঠিন্য যোগ করে কোঁচকানো কপাল নিয়ে বলে,
‘এখানে কী করছিলে?’
‘কি…কিছু না।’
আঁখির গলা কাঁপছে। সেটা স্পষ্ট বুঝতে পেরে অর্ক টের পেল, কিছু একটা গড়মিল রয়েছে। হঠাৎ পেছন থেকে একটি পায়ের আওয়াজ শোনা গেল। যে ছুটে পালিয়ে গেছে। আঁখির হাত ছেড়ে বিদ্যুৎ গতিতে পেছন ঘুরে কাউকে না দেখতে পেয়ে অনেকটাই চমকে গেল অর্ক। কী হচ্ছে এসব!
সে আঁখির দিকে পুনরায় দৃষ্টি স্থাপন করে। পূর্বের চেয়েও কঠিন সে চাহনি। আঁখি জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে।
‘কে ছিল? তোমার সঙ্গে কে ছিল?’
‘কেউ না।’
‘মিথ্যে বলো না। স্পষ্ট শুনলাম, কেউ দৌড়ে পালালো।’
‘মুরগীর শব্দ। আপনে মনে করছেন মানুষ। আমি যাই।’
শশব্যস্ত হয়ে উঠল আঁখি। যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে পুনরায় তার হাত চেপে ধরে তাকে থামায় অর্ক।
‘আমাকে এতোটা বোকা মনে করো না। হাঁটুর বয়সী মেয়ে.. প্রেম করো?’
আঁখি এমন ভাবে চমকে উঠল যে তার শরীরও খানিকটা ছিঁটকে পেছন দিকে সরে গেল। এইবার অর্ক হেসে ফেলল। আঁখিকে ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল। বলল,
‘লুকোতে হবে না। বুঝে গেছি। ভয় নেই, কাউকে বলব না। কিন্তু একটা উপদেশ, এভাবে বাড়িতে ডেকে এনে দেখা করো না। তোমারই ক্ষতি। তোমার চাচা যে ডেঞ্জারাস মানুষ!’
‘আপনেরে ধন্যবাদ।’
বলেই পড়িমরি করে ছুটে পালালো আঁখি। অর্ককে আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না। তার ছুটে যাওয়া দেখে অর্ক এক গাল হাসলেও কেন যেন একটা খুঁচ খুঁচানি অনুভব করল বুকের ভেতর। কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে কোথাও একটা কিছু ঠিক নেই। কিছু একটা হতে চলেছে। কিন্তু কী? আপাতদৃষ্টিতে তো সবকিছুই ঠিকঠাক আছে। তবুও কেন এত অশান্তি অনুভূত হচ্ছে মনের গহীনে?
______
ঘামে জবজবে হয়ে উঠেছে পুতুল। একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে তার উপর থেকে সরে যায় আখতার। পরনের লুঙ্গিটা ঠিক করতে করতে পুতুলের দিকে তাকান। পুতুল যন্ত্রের মতোন শুয়ে রয়েছে। কোনো হুশ নেই। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে সিলিং এর উপর। চোখের পাতাও পড়ছে না। দেখে মনে হচ্ছে,তার দেহে প্রাণ নেই।
আখতার বিরক্তবোধ করলেন। ঠোঁট বাঁকা করে বললেন,
‘ভাবছিলাম তুই মাইয়াডা ভালা। কিন্তু এত নাটক যে জানোস…’
আখতারের কথার মধ্যিখানেই আজ প্রথমবারের মতো পুতুল জবাব দিয়ে বসল,
‘আগে জানলে বিয়া করতেন না?’
প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে সে উঠে বসল। বুকের উপর আঁচল নেই, ব্লাউজের বোতাম খোলা। ছায়া হাঁটুর উপরে উঠে আছে। এলোমেলো বিধ্বস্ত অবস্থা। শরীর বলে দেয়, এতটুকু শান্তি জেই জ্বলন ছাড়া। তবুও তার কণ্ঠধ্বনি অদ্ভুত শান্ত! শীতল!
আখতার পিটপিট করে তাকালেন। পুতুলের কথা বলার ধরনে সামান্য পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন। এ যেন চুপচাপ সবকিছু মেনে নেওয়া সেই পুতুল নয়, কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে একেবারেই ভিন্ন কেউ হয়ে উঠেছে।
আখতার বিছানার উপর বসলেন। এতক্ষণ পুতুলের উলঙ্গ দশা তার কাছে উপভোগীয় মনে হলেও এখন কেন যেন ভাল লাগছে না। তাই তিনি আদেশের সুরে বললেন,
‘লইড়া চইড়া ব। কাপড় ঠিক কর।’
প্রতিউত্তরে হাই তুলে পুতুল। দু’হাত উঁচু করে আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে ব্লাউজের বোতাম খোলা জায়গাটা আরেকটু ফাঁক হয়ে যায়। আখতার খেঁকিয়ে উঠলেন এইবার।
‘এই ন*টি মা**, কী কইছি তোরে? কাপড় ঠিক করোস না ক্যান?’
পুতুল ভ্রু কুঁচকে তাকাল। নিজের উন্মুক্ত বুকের দিকে এক নজর চেয়ে আখতারের সঙ্গে দৃষ্টি মেলালো। বিচলিত কণ্ঠে বলল,
‘কেন? আপনের পছন্দ হয় নাই? এতক্ষণ তো চটকাইলেন মজা কইরা। এহন কী হইছে? এমন করতাছেন কেন?’
ভীষণ, ভীষণ অবাক হলেন আখতার এবার। সেই সঙ্গে সামান্য হতবুদ্ধি ও হলেন। পুতুলের থেকে এইধরনের উত্তর জীবনেও আশা করেননি তিনি। শুধু তাই নয়, পুতুলের বসার ভঙ্গি, বাচনভঙ্গি, কথা বলার স্টাইল- সবকিছুই পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ করে এমন হলো কী ভাবে!
আখতার দাঁতে দাঁত পিষে ক্রোধ আঁটকে বললেন,
‘আমার লগে সিনেমা করোস মা**? বিয়ার পরথম দিন দেইখা ছাইড়া দিলাম। নাইলে..’
‘নাইলে কী? মারতেন? মারেন। দেহ দিয়া দিছি, এহন জীবন দিয়া দিমু। ডর কীয়ের?’
পুনরায় আখতারের কথার মাঝখানে নিজের কথাখানা ছুঁড়ে দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে পুতুল। আখতারের থমথমে মুখখানা দেখার শখ তার নেই। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বারকয়েক বিড়বিড় করে কিছু একটা বললেও সেটা আখতারের কর্ণকুহরে পৌঁছে না।
মেজাজ খারাপ বাড়তে বাড়তে এখন আকাশের চূড়ায় প্রায়। ইচ্ছে হচ্ছে একটা আ’ছা’ড় দিয়ে হাড্ডি-গুড্ডি সব গুড়ো গুড়ো করে দিতে। অনেক কষ্টে নিজের রাগ সংবরণ করেন আখতার। হুট করে কিছু একটা মনে পড়ে যাওয়ায় তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটে ওঠে। তিনি ভর দিয়ে পুতুলের গায়ের উপর শুয়ে পড়েন। পুতুল চমকে উঠলেও বুঝতে দেয় না। বুকের কাপড় সরিয়ে আখতারকে আরেকবার আহ্বান করেন,
‘কী? আরও লাগবো?’
পুতুলের সে প্রশ্নের ধারেকাছেও গেলেন না আখতার। উন্মুক্ত বুকখানি হাতাতে হাতাতে বলতে লাগলেন,
‘রুজিনারে কেডায় মারছে জানোস? তোর ভাই, মেজো ভাই, হাসিব। এডা হাসিবের কাম। রুজিনার উপরে ওর নজর আছিলো, আমি আগে হইতেই জানতাম। আমার লইগা কিছু করা পারে নাই এতদিন। যেই রুজিনারে তালাক দিয়া দিছি, ওমনি উইঠা পইড়া লাগছে ওরে খাওয়ার লইগা। যহন রুজিনায় বাঁধা দিছে, তহন উঠাইয়া নিয়া আইসা ওরে খাইছে। এক কথায় রেপ করছে। তারপর মাইরাও দিছে। আর ওর লগে কেডায় আছিলো জানোস? শাহিন…যারে লইয়া তোর বান্ধবী স্বপ্ন বুনতাছে। হেই ছেড়া। এমনে ফ্যালফ্যাল কইরা চাইয়া আছোস ক্যান? বিশ্বাস হয় না আমার কথা? তুই যে আমারে বিয়া করবার চাস না, আমারে পছন্দ করোস না, হেই কথা আমারে বা তোর বাপ-মারে একবারও কইছোস? তাও আমি জানছি। কেমনে জানছি, বুঝ এইবার..’
এক নিঃশ্বাসে কিছু তিতকুটে শক্ত কথা পুতুলের কর্ণকুহরে ঢুকিয়ে দিলেন আখতার। বরফের মতো জমে যাওয়া পুতুলের হাবভাব বড় উপভোগ করলেন তিনি। ভাবনায় হারিয়ে যেতে দেখে পুতুলের বুকের মধ্যে একটা চিমটি কাটতেই পুতুলের ঠোঁট চিঁড়ে ‘ইশ’ শব্দটি বেরিয়ে আসে। সে দ্রুত উঠে বসে আঁচল ঠিকঠাক করতে লাগল। আখতার ও উঠে বসলেন ঠোঁটে জয়ের হাসি নিয়ে। তাকে খেলা দেখিয়ে হতভম্ব করে দিতে চেয়েছিল যে পুতুল, সেই পুতুল কেই হতভম্ব করে দিয়েছেন তিনি। তার ঠোঁটে তাই জয়ের হাসি।
আখতার উঠে দাঁড়ালেন। গায়ে শার্ট পরতে পরতে বললেন,
‘আমার কথামতো চলবি, তোর ভাই ভালো থাকবো। একটু ছ্যাড়াব্যাড়া করবি, সোজা জেলে যাইবো। কথাডা মনে থাহে যেন..’
আখতার চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ব্যথাতুর কণ্ঠে পুতুল আবদার করে উঠে,
‘হাসিব ভাইয়ে কই? আমার লগে একবার দেহা করাইবেন?’
আখতার থামেন, পুতুলের দিকে চেয়ে অল্প বিস্তর হাসেন। ভেজা বিড়াল হয়ে গেছে এখন!
‘না, দেহা যাইবো না। এত দেহনের কী আছে? তোর ভাই ভালা আছে,ভালাই থাকবো। কাপড় ঠিকঠাক কইরা বাইর হ। আইজকা কোনো কাম তোরে দিয়া করামু না ভাবছিলাম। কিন্তু আমার লগে যেই নাটকটি করলি এই লইগা আইজকা থেইকাই তোরে সংসারের দায়িত্ব বুইজ্জা নিতে হইবো। এইডা তোর শাস্তি।’
কথাগুলো ছুঁড়ে দিয়েই আখতার যাওয়ার জন্য এক কদম বাড়িয়ে পুনরায় পেছন ঘুরে হঠাৎ মনে পড়ে গেল এমন ভঙ্গিতে বললেন,
‘আর হুন, মাথার কাপড় যেন না পড়ে কামের সময়। ঘরে পরপুরুষ আছে, এইডা মাথায় রাইখা কাম করবি। আর ওই অর্ক নামের পোলাডার থেইকা দূরে থাকবি। কিছু জিগাইলেও কবি না। বুঝছোস?’
হ্যাঁ বা না কোনোটাই জবাব দিলো না পুতুল। নির্জীব পুতুলের মতো এক এক করে আখতারের আদেশ গুলো মাথায় ঢুকিয়ে নীরবে নিজেকে ঠিক করতে লেগে গেল। ব্যাগ থেকে নতুন শাড়ি বের করতে করতে ভাবলো, আখতার যা যা বলেছেন, তা যদি সব সত্যিই হয়, তাহলে শাপলাকে যে করেই হোক মানা করতে হবে। ওর জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেছে দারিদ্রের বেড়াজালে আঁটকে। শাপলার জীবনটাও না ধ্বংস হয়ে যায়!
হাতের কাপড় ব্যাগের উপর রেখেই মাথায় ঘোমটা তুলে পুতুল ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ল। উদ্দেশ্য আখতারের কাছে যাওয়া। তাকে হাতেপায়ে ধরে বলবে, তার বন্ধুবান্ধব আর বাবা-মাকে একবেলা অন্তত দাওয়াত করে এনে খাওয়ানোর জন্য। আর সেই ফাঁকে শাপলার কানে কথাখানা তুলে দেবে সে।
(চলবে)
#প্রণয়ের_তৃষ্ণা (১৪)
অলিন্দ্রিয়া রুহি
_______
পুতুলের আর যাওয়া হলো না। তাকে মাঝপথেই থামতে হলো। হুট করেই মাথায় নতুন চিন্তারা ভর করল। আখতারকে বললে সে নিশ্চয়ই বুঝে যাবে কেন তার বাবা মা আর বন্ধুদের দাওয়াত করে খাওয়াতে চাচ্ছে পুতুল। সে কক্ষনো দাওয়াত তো করবেই না বরং এ বাড়িতে তারা যেন কেউ আসতে না পারে,বিশেষত শাপলা, সে ব্যাপারেও সদা সাবধান থাকবে। সঙ্গে সঙ্গে বুক চিঁড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো পুতুলের। মন মরা হয়ে পেছন দিক ঘুরলো। পুনরায় ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে কী বাড়ায়নি, ওমনি একজনের কণ্ঠস্বর তাকে পুরোপুরি থতমত করে দিয়ে থমকে দাঁড় করালো।
‘শুনছেন?’
পুতুল বিদ্যুৎ বেগে পেছন ঘুরে অর্ক’র চিন্তা মিশ্রিত মুখখানা এক নজর দেখে ঝট করে নিজেকে অন্য দিকে এমন ভাবে ঘুরিয়ে নিলো যে ওর পিঠ ছাড়া আর কিছুই অর্ক’র চোখে পড়ল না। এমনকি মাথায় টানা ঘোমটাটাও আরেকটু টেনে লম্বা করে সামনে ফেলে দিলো। ওর চেহারা কোনোভাবেই দেখানো যাবে না। আর এখান থেকে অতিদ্রুত কেটে পড়তে হবে। আখতার অথবা বাড়ির অন্য কেউ দেখলে নিশ্চয়ই ভালো চোখে নেবে না বিষয়টি।
‘কী হলো? জবাব কই?’
দুই কদম এগিয়ে আসতে আসতে অধৈর্য্য কণ্ঠে প্রশ্ন করে অর্ক। তার এগিয়ে আসা পুতুল অনুভব করতে পেরে নিজে সামনে এগিয়ে গেল। আকুতিভরা কণ্ঠে চাপা স্বরে বলতে লাগল,
‘আমাকে যাইতে দেন। কেউ দেখলে..’
বাকিটুকু বলতে হলো না। অর্ক বুঝে নিলো। আশ্বস্ত স্বরে বলল,
‘ভয় নেই। চাচাকে বাহিরের দিকে যেতে দেখলাম। আপাতত এদিকটায় আসবে না হয়তো।’
‘তাও..’
পুতুলের ভয় কমছে না বরং সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। ওর কণ্ঠের অস্বাভাবিক কাঁপা-কাঁপি অর্ক আন্দাজ করতে পেরে পরাজয় বরণ করে নিলো।
‘ওকে ফাইন! আমি চলে যাচ্ছি।’
কী বলতে এসেছিল? জানার জন্য অবাধ্য মনটা ভীষণ আকুলিবিকুলি লাগিয়ে দিলো। পুতুল পেছন ঘুরে দেখল, অর্ক নেই, চলে গেছে! কী বলতে এসেছিল? না বলেই চলে গেল? নাকি পুতুল তাড়িয়ে দিলো? অপমানিত বোধ করলেন নাকি? একগাদা হাবিজাবি প্রশ্ন এসে মনের দুয়ারে কড়া নাড়তেই ঢোক চেপে সেগুলোকে পেটে চালান করে দিয়ে বুক ফুঁড়ে একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে দিয়ে ঘরের উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করল ও। ভাগ্যিস কেউ দেখেনি!
পুতুল বিড়বিড় করে, ‘আল্লাহ! বাঁচাইছো।’
______
আখতার বাড়ি দুটো রান্নাঘর। একটা টিন ঘেরা বড় রান্নাঘর, যেখানে একত্রে চারটি মাটির চুলো। আরেকটি পেছন দিকের এক চিলতে উঠোনে। দুটি চুলো মাত্র। গরমের দিন বাহিরের চুলোতেই রান্নাবান্না হয়। বৃষ্টি এলে বাহিরের চুলো ভিজে যায়। তখন টিন ঘেড়া রান্নাঘরে রান্না করা হয়। আজ বড় রান্নাঘরে রান্না চাপিয়েছে শম্পা। উঠোনের চুলো ভেঙে পড়েছে একপাশ থেকে। এমনিতেই গত দু’দিনের ঝড় বৃষ্টিতে মাটি বেশ নরম হয়ে গিয়েছিল, কেউ একজন এসে পা মাড়িয়ে অর্ধেকের মতোন ভেঙে দিয়ে গেছে। কে করেছে শম্পা দেখেনি। দেখলে তার আর রক্ষে ছিল না।
এখন রান্না-ই করবে নাকি ওই চুলো লেপে শুকোতে দেবে? আঁখিটাও নেই! আর নতুন বউ তো স্বামীর সোহাগে একেবারে সিক্ত হয়ে উঠছে। তাকে আর আজকে এদিকে ডাকা যাবে না! আখতারের আদেশ! মান্য না করলে কপালে খারাপি আছে।
শম্পা মৃদু শ্বাস ফেলে। সে এ বাড়ি বউ হয়ে এসেছিল কত বছর আগে,তা ঠিকঠাক হিসেব করে উঠতে পারে না। তখন শ্বশুর শাশুড়ী দু’জনেই বেঁচে ছিল। একটি মাত্র ননদ, সেও ছিল। বিয়ের দিন কয়েক পরেই শ্বশুর পাড়ি জমালেন ওপারে। শ্বশুরের শোকে শোকে শাশুড়ী ও চলে গেলেন মাস ছয়েকের ব্যবধানে। তারপর থেকেই একা হাতে এই সংসারটাকে সামলে গেছেন একা শম্পাই। তার স্বামী প্রথম থেকেই প্রবাসী। স্বামীর টাকায় ছোট বাড়ি বড় হয়ে উঠেছে। বাউণ্ডুলে দেবর একের পর এক দোকানের মালিক হয়ে এখন গ্রামের মাতবর বনে গেছে। এমনকি পুরো বাড়ির দখলদারি ও নিয়ে নিয়েছে। অথচ এসবের পেছনে অধিকাংশ টাকা গিয়েছে আখতারের বড় ভাইয়ের। সে মানুষ হিসেবে ভীষণ বোকা এবং সহজ-সরল বলেই আজ বছরের পর বছর ভাইয়ের কথায়-ই নিজের সংসার ফেলে বাহিরে পড়ে রয়েছে। অপরদিকে আখতার? একলা ভাবীর সম্মান লুটে নিতে দ্বিতীয় বার ভাবেনি। প্রথমবার নিজের ইচ্ছা না থাকলেও আস্তেধীরে শম্পাও জোয়ারে গা ভাসিয়েছে। আবেগের বশবর্তী হয়ে এমন এমন কাজ করেছে যা সে কল্পনা ও করেনি কোনোদিন। এমনকি আখতারকে গোপনে বিয়েও করতে চেয়েছিল। এতোটাই দেওয়ানা হয়ে গিয়েছিল সে আখতারের জন্য। কিন্তু আখতার, ধরি মাছ না ছুঁই পানি ধরনের লোক। সে শুধু ফ্রি-তেই মজা লুটে গেছে। মাঝে মাঝে তো শম্পার এও সন্দেহ হয়, আঁখি কার সন্তান? ওর স্বামীরই তো? নাকী….
শম্পার মাথা ঘুরে উঠে। যখনই সে এসব ভাবে তখনই অনুতাপে মনটা কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। কিন্তু এরপর আবার সব ভুলে জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেয়। এভাবে আর কতদিন চলবে ওঁর জানা নেই। ঘন ঘন কয়েকটা শ্বাস ছাড়তেই কিছুটা স্বাভাবিক হয় ওঁ। সম্মুখে তাকিয়ে দেখে জড়সড় পায়ে এসে দাঁড়িয়েছে পুতুল। গায়ে হালকা মিষ্টি রঙের একটা সুতি শাড়ি। খানিকটা এলোমেলো হয়ে আছে। এতবড় শাড়ি পরার অভ্যাস হয়তো এই মেয়ের নেই।
শম্পা একবার ভাবলো, সে নিজে থেকে ওকে শিখিয়ে দিবে কীভাবে বড় শাড়ি গুছিয়ে পরতে হয়। পরমুহূর্তেই সিদ্ধান্ত বদলালো। যেমন ইচ্ছা তেমন শাড়ি পরুক, ওঁর তাতে দরকার কী?
‘কী করুম?’
খানিকটা জড়ানো কণ্ঠেই কথাখানা ছুঁড়ে দিয়ে পূর্বের চেয়েও বেশি জড়সড় হয়ে পড়ল সে। শম্পা থোঁতামুখ বলল,
‘আইছো ক্যা? তোমার জামাই দেখলে আবার আমারে বকবো। যাও, ঘরে যাও।’
‘উনিই কইছেন আইজ থেইকা কাম করতে।’
‘ক্যান? নিশ্চয়ই হের মন মেজাজ খারাপ করছো, না?’
শম্পা সরু চোখে তাকালেন। পুতুল অসহায় মুখে ‘হ্যাঁ’ বলল। শম্পা টিপ্পনী কেটে বললেন,
‘বুঝবার পারছি। হুনো তোমার জামাই হইলো মাত্র একদিন আর আমার…’
বাকী কথা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে উঠলেন শম্পা। ড্যাবড্যাব করে ওঁর দিকে চেয়ে রয়েছে পুতুল। পুরো কথা শুনবার আশায়। তাই দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টাতে শম্পা বললেন,
‘এমনে চাইয়া থাইকো না। লেপতে পারো?’
ঘাড়টা যথাসম্ভব নিচু রেখে বিনয়ের সঙ্গে জবাব দিলো ও,
‘পারি।’
‘বাহিরের চুলা দুইডা ভালামতো লেইপা দেও। লেপা শেষে চাইরপাশে খুঁটি গাইড়া দিবা। নাইলে কেডায় কোনহান দিয়া পাড়াইয়া যাইবো। এইডা তো ঘর না,হোডেল। মাইনষে আহে আর যায়।’
‘ক্যান? পেছন দিকে হেগো কাম কী? আপনে মানা করতে পারেন না?’
ফট করে মুখ দিয়ে কথাগুলো বেরিয়ে যেতেই নিজেকে সংযত করে নিলো পুতুল। এগুলো বলার কোনো দরকার ছিল না। তবুও কেন বলল, কে জানে!
শম্পা ভ্রু কুঁচকে বললেন,
‘এইডা তোমার জামাইরে যাইয়া কইয়ো। মুখে খালি পর্দাবেশের কথা কয়। কিন্তু কামের বেলায় নাই। যে মন চায় হেয় আয়,যায়। আইছো না? আস্তেধীরে সবই দেখবার পারবা। এহন কথা না বাড়াইয়া কামে যাও। ম্যালা রান্ধা পইড়া রইছে।’
শম্পা ব্যস্ত ভঙ্গিতে কাজে লেগে পড়লেন। কাজে লেগে পড়ল পুতুলও। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক ফেটে। সে চেয়েছিল শুধু আখতারের সঙ্গেই নয়, এই বাড়ির প্রত্যেকের সঙ্গেই যতটা সম্ভব কাঠিন্য বজায় রেখে চলবে। কিন্তু পরমুহূর্তে ভেবে দেখল, এতে লাভ কার? তার তো কোনো লাভ নেই! বরং দিনকে দিন ঝামেলা বেড়েই চলবে। এমনকি তার পারিবারিক শিক্ষা নিয়েও কথা উঠতে পারে। সে চায় না তার কোনো কর্মকান্ডের কারণে তার বাপজানের মুখ কালো হোক। এই কারণে যেখানে সে নিজের জীবনটাই বিসর্জন করে দিলো সেখানে অযথা ঝামেলা করে লাভ আছে? লাভ নেই। তাই সবকিছুর সুতো উপরওয়ালার হাতে ছেড়ে দিয়ে পুতুল নিজের ভাগ্যকে মেনে নিতে চেষ্টা করছে।
একটা ছোট বালতি ভরা পানি। আরেক বালতিতে খানিকটা মাটি এনে রাখা হয়েছে। অল্প একটু মাটি পানিতে মিশিয়ে ধীরে ধীরে লেপতে গিয়ে বারবার ঘোমটার কারণে সমস্যা সৃষ্টি হতে লাগল। ঘোমটা হয় পড়ে যাচ্ছে,নয়তো জড়িয়ে যাচ্ছে। পুতুল বিরক্ত মুখ করে উঠে দাঁড়াল। আশেপাশে চেয়ে দেখল, কেউ নেই। পুরো ফাঁকা। লেপতে দশ মিনিটের মতো লাগতে পারে। এর বেশি নয়। এই দশ মিনিট ঘোমটা খুলে দ্রুত হাতে কাজ সেড়ে এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে।
পুতুল আলগোছে ঘোমটা সরিয়ে দিলো। কাঁদা হাতে আঁচল ঘুরিয়ে কোমরে টাইট করে প্যাঁচ দিয়ে পুনরায় কাজে মন দিলো।
ইথিশাকে খুঁজতে খুঁজতে পুনরায় বাড়ির পেছনে রান্নাঘরের দিকে আরও একবার আগমন ঘটে অর্ক’র। তার কপালে একের পর এক ভাঁজ লেপ্টে রয়েছে। গত কয়েক মিনিট যাবত পাগলের মতো মেয়েটাকে সারা বাড়ি খুঁজে চলেছে। তার ফোনেও ফোন দিয়েছে। অথচ ফোন ইথিশার ঘরেই পড়ে রয়েছে। মেয়েটা হাওয়া!
বড় রান্নাঘরে উঁকি মেরে দেখল শম্পা ছাড়া কেউ নেই। শম্পা অর্ককে খেয়াল করল না। ওঁকে আর ঘাটালো না অর্ক। চুপচাপ বেরিয়ে এলো। কল পাড়ে যাওয়ার সময় ওর পা জোড়া অজান্তেই থমকে গেল মনোমুগ্ধকর এক দৃশ্য দেখে। হাতে-পায়ে, কপালে-গালে কাঁদার ছড়াছড়ি। খোঁপা খুলে পিঠময় ছড়িয়ে পড়েছে। চোখেমুখে বিরক্তি, কপাল কুঁচকে আছে। মুখ দিয়ে অদ্ভুত রকমের বিড়বিড় করছে আর ডলে ডলে মাটি লেপে দিচ্ছে। যেন ওর সমস্ত রাগ ঝাড়ছে ওই নির্জীব বস্তুর উপর। অর্ক’র চট করে হাসি পেয়ে গেল। এতদিন পর তার মনে হলো, এ শুধু পাখিই না, ডানা ঝাপটে দূর আকাশে উড়ে চলা পাখি। যে কোনো ঝড় ঝাপটাকে ভয় করে না। নিজের মতো উড়ে চলতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। অর্ক নির্নিমেষ চেয়ে রইলো পুতুলের দিকে, এক অন্যরকম মুগ্ধ করা বিস্ময় নিয়ে।
মাচার ছোট জানালা থেকে কেউ একজন সবটা চুপচাপ দেখতে লাগল। তার চোখ ভেঙে জল এলো সঙ্গে সঙ্গে। অস্ফুটে গুঙিয়েও উঠল। তার ভালোবাসা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে!
(চলবে)