#প্রণয়ের_তৃষ্ণা (১৭)
অলিন্দ্রিয়া রুহি
_____
ফোঁপাতে ফোঁপাতে গলা শুকিয়ে আসে পুতুলের। চোখজোড়া ফুলে ঢোল হয়ে গেছে। এত কান্না! তবুও চোখের পানি শুকোয় না। নিভু নিভু চোখজোড়া জোর করে টেনে খুলে রেখেছে সে। উঠে গিয়ে দেখল জগে পানি নেই। ঠোঁট চিঁড়ে বিরক্তিকর একটি শব্দ বেরিয়ে এলো। বড় শাড়িটা আবার এলোমেলো হয়ে গেছে। সেটাকে কোনোরকমে গুছিয়ে নিয়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে পুতুল। ধিমি পায়ে এগিয়ে গেল রসুইঘরের দিকে। বাড়িতে বড় বড় তিনটে মাটির কলসি আছে। তার ভেতর সবসময় পানি ভরে রাখে শম্পা। সেখান থেকেই জগে পানি ভরে খায় সকলে। রসুইঘরের যাওয়ার পথটায় শম্পার ঘর পড়ে। সেই ঘর ক্রস করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় পুতুল। একটা চাপা গোঙানির স্বর ভেসে আসছে। পুতুলের হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠে অজানা আশংকায়। সে কান পেতে রইলো দরজায়। ভেতর থেকে খুবই চাপা স্বরের দু-চারটে কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।
প্রথমেই শোনা গেল শম্পার গলা, সে বলছে,
‘আমারে উপোস রাখিয়ে কী লাভ পাও বলো তো? প্রতিদিন এভাবে একটু সোহাগ করলে কী খুব ক্ষতি হয় আখতার?’
আখতার জবাবে বললেন,
‘সপ্তাহের চাইর পাঁচটা দিন তো তোমার লগেই কাটাইতাম আগে। এহন তো নয়া বউ আইছে। তারেও তো সোহাগ করতে হয়। নাইলে কইবো আমার মেশিনে সমস্যা। হা হা হা।’
‘তাই বলে আমারে ভুইলা যাবা? সারাদিনে এক নজর তাকাও-ও তো না।’
‘আমি মনে হয় সারাদিন ঘরের মধ্যে ডুব মাইরা থাকি! এহন অতো কথাবার্তা কইয়ো না তো। এক কামের মধ্যে আরেক জিনিস ঢুকাইয়া দিও না। চুপ মা’রো।’
এরপর সবকিছু নিস্তব্ধতায় ডুবে গেল। তবে পূর্বের চাপা শীৎকারের আওয়াজ এবার আরেকটু বেড়ে গেল। মুখে হাত দিয়ে বিস্ফোরিত নয়নে চেয়ে রইলো পুতুল, অন্ধকারের মাঝে। সে আখতারকে ভালোবাসে না, আখতারের প্রতি তার কোনো টান ও নেই, আখতার জলে ভেসে যাক, তাতেও তার কিচ্ছু যায় আসে না। কিন্তু তারপরও নিজের স্বামীর এহেন কু-কীর্তিতে কোনো স্ত্রীই নিজেকে ধরে রাখতে পারে না, পারবে না। পুতুলও পারল না। শম্পার ঘরের দরজার সামনেই হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল। মুখে হাত চাপা দিয়ে কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। তার প্রাণ পাখি চিৎকার করে বাপজানকে ডাকছে। এ কার কাছে তার বাপজান তাকে বিক্রি করে দিলো! আখতার বয়স্ক হোক, দেখতে অসুন্দর হোক, বদমেজাজি হোক, তবুও পুতুল তাকে ধীরে ধীরে মানতে চেষ্টা করছিল। কিন্তু নতুন স্ত্রী রেখে যে আরেকজনের সাথে ফুর্তি করে বেড়ায়, আগেও করেছে, ভবিষ্যতেও করবে, এরকম একটি চরিত্রহীন লোকের সঙ্গে কেমন করে সারাটা জীবন কাটাবে পুতুল?
মৃ’ত্যু কী এতোই সোজা? সহজ? চাইলেই পাওয়া যায়?
মৃ’ত্যু সবার জন্য অভিশাপ নয় বরং আশীর্বাদ হয়েও নিজের আগমন ঘটায়। মৃ’ত্যুর থেকে কেউ কেউ পালাতে চাইলেও অনেকেই ওঁর জন্য প্রস্তুতি সমেত অপেক্ষায় থাকে। কেউ কেউ মৃ’ত্যুগ্রহণ করবার চাইতে আজীবন এই নরক সমান পৃথিবীতে বাঁচবার আশা পোষণ করলেও অনেকেই পৃথিবীর আলোর চাইতে কবরের অন্ধকার কে বেশি ভালোবাসে। সেই তাদের অপেক্ষার মুহূর্ত গুলোই হয় অধিকতর লম্বা, দীর্ঘ! প্রতিবেলায় বেলায় মনে হবে, ইশ! এক্ষুনি যদি ম’রে যেতে পারতাম! কিন্তু হায়…দিনশেষে রাত ঢলে পড়লেও তাদের শ্বাস ঢলে পড়ে না। অতৃপ্তি নিয়ে শুরু করতে হয় আরেকটি ভোর, আরেকটি নতুন দিনের সূচনা…
কেউ মৃ’ত্যু চায় না, কেউ মৃ’ত্যু পায় না।
পুতুলও জানে এই কারাগার থেকে তাকে মুক্তি দিতে পারা একমাত্র মৃ’ত্যু ও এত দ্রুত তাকে মুক্ত করতে আসবে না। বছরের পর বছর এই যন্ত্রণা বুকে চেপে বয়ে বেড়াতে হবে। এখনো অষ্টাদশীতে পদার্পণ না করা পুতুল কী পারবে এত দুঃখ কষ্ট বয়ে বেড়াতে? নিজেকে শক্ত করতে?
______
একটা হাত এসে পড়ল পুতুলের ঘাড়ের উপর। পুতুল চকিতে পেছন ঘুরে তাকাল। অর্ক নির্লিপ্ত চোখে চেয়ে রয়েছে। পুতুল দ্রুততার সঙ্গে নিজেকে সংযত করে উঠে দাঁড়ায়। লম্বা করে মাথায় আঁচল টানে। চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ওর একটা হাত টেনে ধরে অর্ক। পুতুল এতোটাই চমকে গেল যে খানিকটা কেঁপে ছিটকে উঠল ও। অর্ক হাত ছেড়ে দিলো। ফিসফিস করে বলল,
‘এখান থেকে চলো। কথা আছে।’
পুতুল দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে তাকাল। অর্ক’র স্পষ্ট চোখের চাউনিতে কী যেন ছিল! সে সম্মোহনের মতো অর্ক’র পিছু পিছু চলতে শুরু করল। মাচায় উঠার সিড়িটার সামনে এসে অর্ক থামলো। সেই সঙ্গে থামলো পুতুলও। তার চোখে হাজারও প্রশ্ন। অর্ক একবার সিড়ির দিকে তাকিয়ে তারপর পুতুলের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। বলল,
‘সিড়িতে উঠো। উপরে উঁকি দাও। ওখানে কে আছে,দেখো তো।’
‘ক..কে?’
ভয়ার্ত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় পুতুল।
জবাবে অর্ক বলে,
‘সেটা দেখার জন্যেই তো তোমাকে বললাম উপরে যাও। দেখো।’
অর্ক গলার স্বর যতটা সম্ভব নিচু করে কথা বলছে দেখে পুতুলের কৌতুহল বেড়েই চললো। একটু আগের ঘটনার তীব্রতা এখন অনেকাংশে কমে গিয়েছে। সে অর্ক’র কথামতো চারটে সিড়ি বেয়ে শুধু মাথাটা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করল মাচায় কে রয়েছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে কাউকেই ঠাহর করতে পারল না। কয়েক সেকেন্ড বৃথা দেখার চেষ্টা করে পুতুল নিচে নেমে এলো। তার চোখে প্রশ্ন আর ভয় মিলেমিশে একাকার। অর্ক একটা মৃদু শ্বাস ফেলে পুতুলের হাত ধরে টেনে নিয়ে চললো পুতুলের ঘরের ভেতরে।
দরজাটা ভেতর থেকে আঁটকে দিলে পুতুল বিস্মিত হলো। তবে ওর ভয় লাগছে না। অর্ককে যতটুকু চিনেছে তাতে একজন ভদ্রলোকই মনে হয়েছে। পুতুল জানে অর্ক এমন কিছুই করবে না যা পুতুলকে অসম্মানিত করবে।
রাতের প্রহর গুলো গাঢ় হচ্ছে যত ততই ভোরের আলো এগিয়ে আসছে পুরো পৃথিবীকে আলোকিত করে তুলতে। ঠিক সেভাবেই অর্ক আজ এসেছে পুতুলকেও সমস্ত অন্ধকার থেকে টেনে আলোর পথ দেখানোর জন্য।
অর্ক বলতে শুরু করল,
‘আমি যখন প্রথম এই বাড়িতে আসি তখন থেকেই আবিষ্কার করেছি আখতার চাচার সঙ্গে উনার ভাবীর একটা খারাপ সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু সেটা আমি নিজের চোখে দেখিনি। উনাদের আচার আচরণে ধারণা করেছিলাম জাস্ট। এরপর আরও আবিষ্কার করি এই বাড়িটাকে বাহির থেকে যতটা সহজ সরল লাগে ভেতর থেকে ততটাই কূটনৈতিক চালে ভরা। এই বাড়ির প্রতিটি দেয়াল কোনো না কোনো অনৈতিক কাজের সাক্ষী। এমনকি আঁখি, ও-ও নিজেকে মন্দের পর্দায় জড়িয়ে নিয়েছে। মাচার উপর আঁখি রয়েছে। তাও একটি পুরুষের সঙ্গে। সেই পুরুষটিকে আমি চিনি না। তোমাদের গ্রামেরই কেউ হবে। তাই তোমাকে দেখতে বলেছিলাম, যদি চিনতে পারো। কিন্তু অন্ধকারে তো তার মুখটাই তুমি দেখলে না। আমি বাথরুমে যাওয়ার জন্য যখন বেরিয়েছিলাম, তখনই শম্পা চাচীর ঘরে আখতার চাচাকে আবিষ্কার করে ফেলি। আমার মাথায় আসে চাচী এখানে হলে আঁখি কোথায়? ও কী ওর মায়ের এই দিকটা জানে না? আঁখিকে খুঁজতে গিয়ে দেখলাম, পেছনের দরজা দিয়ে একটা ছেলে এই বাড়িতে ঢুকেছে আর তাকে নিয়ে মাচার দিকে যাচ্ছে আঁখি। আমি বুঝে যাই মা যে পথে গিয়েছে মেয়েও সেই একই পথে গিয়েছে। শুধু তাই নয় পুতুল, আখতার চাচা এই একটা অনৈতিক কাজেই নয়, আরও অনেক অনৈতিক কাজের সাথে জড়িত। সেটাও আমি জানতে পেরেছি পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে। তিনি নাকী তাকেও টাকা খাইয়ে নিজের হাতের মুঠোয় করে রেখেছেন। এই গ্রামের প্রায় সবাই-ই তাকে মান্য করে। মান্য করতে বাধ্য। নইলে যে মাথা টা সঙ্গে থাকবে না।’
চুপ করে মনোযোগ দিয়ে অর্ক’র সব কথা শুনছিল পুতুল। এ পর্যায়ে এসে নিজের কৌতুহল আর দমাতে না পেরে সে বলে উঠল,
‘উ..উনি মানুষ খু…খু’ন করেন?’
‘মা’রতে দ্বিধাবোধ ও করেন না পুতুল।’
পুতুল বজ্রাহত হলো। গোটা আকাশটা ওর মাথায় ভেঙে পড়ল। বুকের ভেতর একধরনের ভোঁতা,সূক্ষ্ম,চাপা ব্যথা অনুভব করল। বিয়ের একদিনও গড়ায়নি, তাতেই এত এত খারাপ খবরের সাক্ষী হলো তাও স্বামী নামক মানুষটির ব্যাপারে! কী এমন ক্ষতি হতো যদি এসব বিয়ের আগেই জানতে পারতো? তাহলে হয়তো ওর সিদ্ধান্ত অন্যকিছু হতো।
পুতুলকে ভেঙে পড়তে দেখে অর্ক এগিয়ে গেল। কেন যেন আজ খুব সাহস বেড়ে গেছে ওঁর। বারবার পুতুলকে স্পর্শ করছে বিনা অনুমতিতে। আর পুতুল, সেও বা কেন সেই স্পর্শ মেনে নিচ্ছে! আখতার স্পর্শ করবে- এমনটা ভাবলেও যে পুতুলের গা গুলিয়ে উঠে অর্ক’র স্পর্শে সে কেন নিরাপত্তা খুঁজে পায়? কী চলছে এই দু’জনের মনে? এমন কোনো কিছু যা তারা জানে কিন্তু স্বীকার করতে চাইছে না? ভাগ্য বা পরিস্থিতি কোন মোড়ে নিয়ে দাঁড় করাবে পুতুল কে? সেখানে অর্ক থাকবে তো তাকে পুনরায় সাহস জোগানোর জন্য?
পুতুল বিছানার উপর স্তব্ধ ভঙ্গিতে বসে রয়েছে। তার মুখে ভাষা নেই। চোখের পলকটাও পড়ছে না। সবকিছু কেমন অদ্ভুত লাগছে। নিজের হাত-পা নিজের কাছেই অসাড় মনে হচ্ছে। ক্লান্তি…দেহ মন জুড়ে শুধুই ক্লান্তি…
অর্ক এগিয়ে গিয়ে পুতুলের কাঁধের উপর নিজের একটা হাত রাখে। পুতুল চাইলো, কোনো কিছু বলল না। অর্ক হাতের দ্বারা বল প্রয়োগ করে আরেকটু শক্ত ভাবে পুতুলের কাঁধ চেপে ধরতেই দু’চোখ বেয়ে ঢল নামে জলের। হু হু করে কেঁদে উঠে উদ্ভ্রান্তের ন্যায়। দু’হাতে মুখ ঢেকে নিজেকে লজ্জার হাত থেকে বাঁচাতে চায়। অর্ক’র মনের ভেতর একধরনের সুপ্ত ব্যথার বীজ বুণলো। পথ হারিয়ে বিপথগামী পাখি যখন ভাঙা ডানা নিয়ে উড়তে না পারার কষ্টে হাউমাউ করে কেঁদে বুক ভাসায়, পুতুলও ঠিক সেভাবেই কাঁদছে। কান্নার কোনো শেষ সীমানা নেই। কান্না একবার পেয়ে বসলে ক্ষণে ক্ষণে চোখ ভেঙে জল ঝড়িয়ে ছাড়ে।
‘শান্ত হও! প্লিজ পুতুল কাম ডাউন। এভাবে ভেঙে পড়ো না। জানি সবকিছু শোনার পর তোমার মানসিক অবস্থাটা কেমন হতে পারে। কিন্তু পুতুল তুমি নিজেও তোমার এই পরিণতির জন্য দোষী।’
পুতুলের ঝট করেই কান্না কমে এলো। সে অর্ক’র দিকে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো,
‘আ..আমি? আমি দোষী? ক্যান? আমি কী করছি? আমি ক্যান দোষী হইলাম আপনের চোখে?’
‘কারণ তুমি চাইলেই এই বিয়েটা না করতে পারতে। বলো পারতে না? নাকী আমি ভেবে নেবো, তোমার বাবা মা জোর করে তোমাকে বিয়েটা দিয়েছেন। তারা নিশ্চয়ই এতোটা জালিম নন?’
পুতুল চুপসে যাওয়া গলায় বলল,
‘হেরা জালিম না। আমি না করলে বাপজান আমারে এইহানে দিতো না। কিন্তু..’
পুতুল তাকাল, গলায় তেজ এনে বলল,
‘আপনেরা বড়লোক। গরীবগো পলিটিক্স আপনেরা বুঝবেন না। এই যে আমি আইজকা স্বামীর ঘরে আইছি, আমার আব্বার ঘরে এহন একজন মাইনষের চাউল কম লাগবো। তরকারি কম লাগবো। আমার পিন্দনের কাপড়ের জোগান দেওন লাগবো না। একটা মানুষ আব্বার ঘাড় থেইকা নাইমা যাওয়া মানেই অনেক কিছু। এডি কী আর আপনেরা বুজবেন? পেট আছে দেইখাই এত কষ্ট। এই পেটটা না থাকলে আমি কী আর এইনে বিয়া বইতাম? আমারে মাইরা ফালাইলেও বইতাম না। আব্বার কষ্টডা কমাইতে চাইছি। হেই লইগা আমি…’
পুতুল পুনরায় কেঁদে উঠে। কয়েক বছর আগে অর্ক যখন প্রথম বিদেশ গেল পড়াশোনার খাতিরে, দারিদ্রতার উপর একটা থিসিস করতে হয়েছিল ওদের। কিন্তু সেই দেশে দরিদ্র লোক বলতে মাসে তিরিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকা আয়ের মানুষ গুলোকে বুঝানো হতো। তারা ভালো খেতো, ভালো পড়তো, কিন্তু বাড়ি নেই, গাড়ি নেই, এই দুঃখে নিজেদের গরীব বা মধ্যবিত্ত বলে পরিচয় দিতো। তাদের উপর থিসিস করতে গিয়ে দরিদ্র বলতে তাদেরকেই চিনেছিল অর্ক। ভেবেছিল এটাই আসলে দারিদ্রতা। আজ এতবছর পর এসে ও দারিদ্র্যতার এক অন্য সংজ্ঞা সম্পর্কে জানতে পারল। ওঁ বুঝে উঠতে পারল না ঠিক কোন উপায়ে পুতুলের জীবনের সবকিছু আবারও সুন্দর করে দেওয়া যেতে পারে!
______
ভোরের আজান পড়তে খুব বেশি দেড়ি নেই। দু একটা পাখির কিচিরমিচিরের শব্দ শোনা যাচ্ছে বাইরে থেকে। আলো ফুঁটি ফুঁটি করছে। অর্ক এখনো পুতুলের ঘরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে অবশেষে পুতুলকে একটু শান্ত করতে পেরেছে ও। সারা রাত জেগে থেকেছে তার উপর কান্নাকাটি করেছে। মনের দিক থেকে একবারেই ভেঙে পড়েছে রুগ্ন মেয়েটা। ফলাফল চোখ ভেঙে ঘুম নেমেছে। নিজের অজান্তেই বিছানায় এলোমেলো ভাবে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। অর্ক পুতুলকে টেনে ঠিকঠাক করে পাতলা কাঁথাটাও গায়ে টেনে দিয়েছে। এবার ওকে যেতে হবে। যেকোনো মুহূর্তে আখতার এই ঘরে চলে আসতে পারে। এছাড়াও অন্য কেউ যদি দেখে ওকে এ ঘর থেকে বেরোতে তবে ভীষণ বড় গ্যাঞ্জাম সৃষ্টি হবে। অর্ক চলে যাওয়ার সময় আরেকবার ঘুরে দাঁড়াল।
পুতুল ঘুমোচ্ছে। তার দু’চোখে ভারী পর্দা নামানো। সেই সাথে বুকের উঠানামা জানান দেয়, তার ঘুম গভীর পর্যায়ে পৌঁছেছে। পুতুল তার কেউ হয় না। চিরপরিচিত কেউও না। গ্রামে একটা কাজে এসে হুট করে পরিচিত হওয়া একটা মেয়ে, যার বয়সটা এখনো কৈশোর ছাড়েনি। অথচ পাহাড়সম কষ্ট আর ক্লেশে জর্জরিত জীবনটা দিনকে দিন নরক হতে চলেছে। অর্ক’র মতো ন্যায়বান একজন পুরুষের পক্ষে এ অন্যায় মেনে নেওয়া ভীষণ কষ্টের! অর্ক মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, যেভাবেই হোক, যে কোনো উপায়েই হোক না কেন, পুতুলকে সে এখান থেকে মুক্ত করে ওর পরিবারের হাতে তুলে দিয়ে তবেই যাবে। এতে যদি আখতারের মুখোমুখি হতে হয় তবে হবে। তাও ও এই ছোট মেয়েটার উপর হওয়া জুলুম গুলোকে খুব বেশিদিন মাথাচাড়া হয়ে বাঁচতে দেবে না।
অর্ক বেরিয়ে গেল। যাওয়ার সময় দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে গেল। নিজেরও যথেষ্ট ক্লান্ত লাগছে। এবার একটু ঘুম প্রয়োজন। অর্ক যে বারান্দা দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো সেই একই বারান্দা দিয়ে আখতার টলতে টলতে নিজের ঘরে এলো। পুতুলকে গাঢ় ঘুমে তলিয়ে থাকতে দেখে তার কপালে বেশ কয়েকটি ভাঁজ পড়ে। পুতুলকে জাগানোর উদ্দেশ্যে তার কাছে গেলে গলার কাছটায় নিজের চোখের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। ফর্সা গলাটা যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে আরেকটু কাছে আসার। আরেকটু স্পর্শ করার জন্য! আখতার ঘুমন্ত পুতুলকেই শক্ত হাতে চেপে ধরে। গভীর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে। ঘটনা কী বুঝে উঠার আগেই ঠোঁট চিঁড়ে চিৎকারের আওয়াজ বেরিয়ে এলো। আখতার পুতুলের গলায় কা’মড় বসিয়ে দিয়েছেন।
(চলবে)