প্রণয়ের_তৃষ্ণা (১৯)

0
779

#প্রণয়ের_তৃষ্ণা (১৯)
অলিন্দ্রিয়া রুহি
________
‘ও চাচী, তোমরা যাইবা কবে?’

অধৈর্য্য কণ্ঠে বলে উঠে শাপলা। ভোর বেলায় উঠে নামাজ পরে বাসন মেজে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করেই এসে পড়েছে সে পুতুলদের বাড়িতে। উঠানেই পারুলের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তিনি এক ঝাপি ভেজা পাতা শুকানোর জন্য উঠানে মেলে দিচ্ছিলেন। শাপলা এসেই কথাখানা ছুঁড়ে দিয়ে কোমরে হাত গোঁজ করে দাঁড়াল। সেই সে গতকাল পুতুলের বিয়ে হয়ে গেল,এরপর আর কেউ ওই বাড়ি গেল না। ওই বাড়ি যাওয়ার নামগন্ধও নেই। অথচ শাপলার চিন্তায় সারারাত ঘুম হয়নি। মেয়েটার উপর দিয়ে কী যাচ্ছে কে জানে।

পারুল গম্ভীর স্বরে উত্তর করলেন,

‘জানি না। তোর চাচারে জিগা।’

পুনরায় নিজের কাজে মনোযোগ দিলেন। শাপলা হতভম্ব হয়ে বলল,

‘মানে কী? তোমরা কেউ কী যাইবা না? মাইয়াডারে পর কইরা দিলা?’

পারুল কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,

‘আমগো মাইয়া আর সব দরদ বুঝি তোর?’

‘হ আমারই তো। আমার সই লাগে না? হেই ছোট্ট বেলার সই। তোমগো তো কাইলকাই যাওন উচিত আছিল। কাইল গেলা না, আইজকাও যাইবা না? এইডা কেমন কথা চাচী?’

রীতিমতো কণ্ঠ উঁচু করে বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে কথাগুলো বলে থামলো ও। পারুল হতবাক হলেন। সেই সঙ্গে পুরোনো রাগটাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। তিনি গমগমে সুরে বললেন,

‘জামাইয়ের বাড়ি যাইতে হইলে হাতে টাকাপয়সা নিয়া যাইতে হয়। বিয়াডা কেমনে হইলো! একটা টাকা খরচা করতে দেয় নাই জামাই। এহন হের বাড়িত যামু, তাও ভিখারির মতোন? তোর শখ জাগলে তুই দই মিষ্টি কিনা নিয়া যা। আমগো যহন টাকা হইবো তহন যামু। এহন যা এইহান থেইকা। ঘ্যানঘ্যান করবি না খবরদার।’

ধমক খেয়ে শাপলার তেজ কমলো। একটা মেদুর রঙের মেঘ তার মন আকাশকে ঢেকে নিলো পুরোদমে। টাকার কাছে সবাই পরাজিত! তিতা হলেও সত্য। কথাটা একদিন পুতুল বলেছিল, আজ শাপলা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। সামান্য ক’টা টাকার জন্য মেয়েটাকে কেউ চোখের দেখাটুকু দেখতে যাচ্ছে না!

শাপলা নিজের বাড়িতে ফিরতে ফিরতে ভাবলো, একবার নিজেই চলে যাবে নাকী? ও গেলে তো আর মিষ্টি-দই কিচ্ছু নিতে হবে না। বান্ধবী বান্ধবীর বাড়ি যেতেই পারে, দেখা করতেই পারে, আর ও তো ছোট মানুষ। আখতার চাচা নিশ্চয়ই বুঝবে! ইশ! চাচা কীসের! এখন তো দুলাভাই হয়ে গেছে। ওই বুড়ো খাটাশ টাকে দুলাভাই বলতে হবে ভাবতেই শাপলার হাসি পেয়ে গেল। পুতুলটার ভাগ্যে শেষমেশ এই লেখা ছিল!

_____
আর দুই ঘর পেরোলো অর্ক’র ঘর। পুতুল এতদূর এসে থমকে দাঁড়াল। অর্ক নিশ্চয়ই ঘুমাচ্ছে। তার উপর শম্পাও জেগে। দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। পুতুল বুঝতে পারছে, শম্পা তাকে ঠিক পছন্দ করছে না। কেন করছে না সেটা এতক্ষণ না জানলেও গতকালের পর থেকে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। পুতুলের অবাক লাগে। এতই যখন আখতারের প্রতি মায়া-মহব্বত তখন বিয়ে করে নিক না। কে মানা করেছে? পুতুলকে কেন আনলো শুধু শুধু! এদের কাছে দরিদ্র মেয়েদের জীবন জীবন না! আশ্চর্য ব্যাপার স্যাপার। পুতুল মৃদু শ্বাস ফেলে। সে শ্বাসে হতাশা মাখানো। তারপর উলটো পথে পুনরায় এগিয়ে চলে। অর্ক উঠুক, পরে তার থেকে বিস্তারিত জানা যাবে। তবে আঁখির সাথে যদি শাহীনেরই সম্পর্ক থেকে থাকে তাহলে পুতুল কী করবে? শাপলাকে সব জানিয়ে দিবে, এর বাইরে তো কিছু করতে পারবে না। কিন্তু শাপলার চোখে যে ভালোবাসা সে দেখেছে শাহীনের জন্য, শাপলা কী আদৌও বিশ্বাস করবে পুতুলের কথা?
পুতুল নিজেই নিজের মনে চলা প্রশ্নের উত্তর করে, ‘ক্যান করব না? আমি ওর সই। আর শাহীন ভাই তো…’ তারপর থমকে যায়। দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভরে উঠে মনখানা। সামনে যে কী অপেক্ষা করছে, কে জানে!

শম্পা জেগেছিলেন তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। উঠলেন যখন তখন ঘড়ির কাটায় ন’টা বাজে। এতবেলা পর্যন্ত এর আগে কখনো ঘুমাননি তিনি। সারারাত আখতারের সঙ্গে সময় কাটানোর পর ফজরের সময় বিছানা ছাড়তেন। উচ্ছ্বাস নিয়ে সকালের নাশতা বানাতেন। আখতারকে নিজ হাতে খেতে দিতেন। প্রথম প্রথম সংসার জীবনে প্রবেশ করলে মেয়েদের যেরকম আনন্দ উদ্দীপনা লেগে থাকে, তার ক্ষেত্রেও ঠিক একইরকম আনন্দ উল্লাস কাজ করতো। এই প্রথম আখতারের জন্য নাশতা বানাননি তিনি। রাগ করে পুতুলের উপর সব চাপিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এখন দুশ্চিন্তা হচ্ছে। খাবার টেবিলে ঠিকঠাক খাবারটা না পেলে আখতারের মেজাজ গরম হয়ে যায়। সেই ঝালটাও সে শম্পার উপরেই তোলেন। এখন হয়তো তুলবেন না। নতুন বউ এসেছে! তবুও চিন্তিত মুখে তিনি ঘর থেকে বেরোলেন। পুতুল কদ্দুর কী জোগাড় করেছে, দেখা যাক।

চাল ডাল আর সবজি মিশিয়ে পাতলা একটা খিচুরি রেঁধেছে পুতুল। খিচুরির সুন্দর ঘ্রাণে রসুইঘর মঁ মঁ করছে। শম্পা আসতে আসতেই সেটা টের পেলেন। রান্নাঘরের দরজায় মাথা ঢুকাতে ঢুকাতে বললেন,

‘খিচুরি রানছো ক্যা? আখতার সক্কাল বেলা রুটি খায় তো।’

পুতুল মরিচ ভর্তা পাটায় পিষছিল। সে না তাকিয়েই জবাব দিলো,

‘আপনে আমারে কইছেন? আমি নিজের আন্দাজে যা পারছি করছি। কে খাইলো কে না খাইলো তা দেখার দরকার নাই।’

শম্পা চোখ বড় বড় করে বললেন,

‘যত সময় যাইতেছে ততই তোমার জবান ফুঁটতাছে। স্বামীর প্রতি বিন্দুমাত্র সোহাগ নাই দেখি।’

পুতুল তাকাল। ক্রুর হাসি ঠোঁটে, হাসিটা দীর্ঘ করে বলল,

‘স্বামীর তো অন্য ভা-তারের ভালোবাসা আছে। আমার সোহাগ হের না পাইলেও চলবো।’

শম্পা কেঁপে উঠলেন। হতচকিত ভঙ্গিতে তাকালেন। পুতুল কথাটার দ্বারা কী বুঝালো? তবে কী ও সব কিছু জেনে ফেলেছে? জানার তো প্রশ্নই আসে না! শম্পা আমতা আমতা করলেন,

‘ব্যবহার ঠিক কইরা করো। তোমার জামাইর বাইরে ভা-তার আছে না লা-ঙ আছে, হেইডা আমি জাইনা কী করুম? যখন পাতের খিচুরি তোমার মুখের মধ্যে ছুইড়া মা’রবো তহন এইসব চ্যাটাং চ্যাটাং কথা কই যায়, দেহুমনি।’

পুতুল ঘাবড়ায় না। পূর্বের ন্যায় টিপ্পনী কে’টে বলে,

‘আমার গায়ে খিচুরির দাগই লাগুক। আপনের গায়ে তো হের সোহাগের দাগ লাগছে, তাইলেই হইলো।’

শম্পা এবার পুরোপুরি হতভম্ব বনে গেলেন। ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলেন,

‘তুমি কী বলতে চাইতাছো? খোলাসা কইরা বলো?’

পুতুল নিজের অবস্থান পরিবর্তন করতে করতে হেসে উঠে জবাবে বলল,

‘কিছু না। ফাইজলামি করলাম। এত ভয় পাইয়া গেলেন ক্যান?’

ওর হাসি শম্পার গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। মেয়েটা বড্ড বেশি বেড়েছে। একে কীভাবে সোজা পথে আনতে হবে তা খুব ভালো করেই জানা আছে। আজ উঠুক আখতার, তারপর দেখে নেবে। শম্পা জবাবহীন রান্নাঘর থেকে গটগট করে বেরিয়ে পড়ল। তার পরাজিত মুখ দেখে হাসিতে ফেটে পড়ে পুতুল। এই বাড়িতে আসার পর এই প্রথম তার মন খুলে হাসতে ইচ্ছে করছে।

_____
রান্না শেষ করে পুতুল রসুইঘরেই বসে রয়। আখতার এখনই উঠবেন। খেয়ে দেয়ে তারপর বেরিয়ে যাবেন। সে না যাওয়া পর্যন্ত পুতুল আর ও ঘর মুখী হচ্ছে না। শম্পার ঘরের সামনে দিয়েই রসুইঘরের দিকে যেতে হয়। তিনি দরজা খুলে বিছানায় মুখ গোমড়া করে বসে রইলেন। আখতার উঠে এখান দিয়েই যাবে।

প্রায় কুড়ি মিনিট পর আখতারের হাঁক-ডাক শোনা গেল। উঠেছেন, তারপর আওয়াজ করে মুখে গড়গড়া করলেন। দাঁত মাজলেন। এরপর কুলকুচি করে গায়ের পোশাক পাল্টে রসুইঘরের দিকে এগোলেন। শম্পার ঘর পার করতে নেওয়ার সময় ভেতর থেকে একটা হাত তাকে প্রায় টেনে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে নিলো। আখতার চকিতে রাগ নিয়ে তাকালেন। শম্পা দ্রুত দরজা আঁটকে দিলেন। তার দিকে ঘুরে তাকাতে না তাকাতেই আখতার কষিয়ে এক চড় মেরে বসলেন। শম্পা থ বনে গেল।

‘খা*** মা** তোর কইলজা বাইড়া গেছে? দিনে দুপুরে এমনে টান মা’রলি ক্যান? কেউ দেইখা নিলে..’

‘কী হইতো? সম্মান যাইতো? আর রাইতের পর রাইত যহন আমার লগে কাটাও তহন তোমার সম্মান কই থাকে?’

‘আবার তর্ক করোস! তোর মুখ..’

শম্পার দুই গাল চিপা দিয়ে ধরেন আখতার। সাপের মতো ফোঁসফোঁস করে বললেন,

‘তোর মুখ ভাইঙ্গা দেওয়া উচিত। আজকের পর থেইকা আমার আশেপাশেও যেন তোরে না দেহি। নাইলে ভাইয়ের কাছে সবকিছু কইয়া দিতে আমার এক সেকেন্ড সময়ও লাগবো না।’

শম্পা ঝামটা দিয়ে আখতারকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিলেন। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,

‘আমার সংসার ভাঙলে তোমার সংসার ও আস্তা থাকবো না।’

আখতার ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন,

‘ভয় দেহাও আমারে? কী মনে করোস? পুতুলের মতো একটা ছেড়ি আমারে ছাইড়া গেলে আমার পরান পুড়বো? হুন, আমি হইলাম গিয়া বেডা মানুষ। আমি একটা না, দশটা সংসার ভাঙতে পারি। এই সমাজ আমারে কিচ্ছু কইবো না। কিন্তু তোরা হইলি বান্দীর জাত। তোগো এক সংসার ভাঙলে আরেক সংসার জোগাইতে জীবন পার হইয়া যাইবো। কথাডা মাথায় রাখিস।’

আখতার বেরিয়ে গেলেন। ঠোঁট টিপে গুমোট কান্নায় ভেঙে পড়লেন শম্পা। তিনি চেয়েছিলেন পুতুলের নামটা আরেকটু বিষিয়ে দিতে আখতারের কানে। কিন্তু সেটা তো হলোই না বরং আখতারের সঙ্গে তার সম্পর্ক টা খারাপ দিকে মোড় ঘুরলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here