প্রণয়ের_তৃষ্ণা (২০)

0
885

#প্রণয়ের_তৃষ্ণা (২০)
অলিন্দ্রিয়া রুহি
_______

পিঁক পিঁক শব্দে মুঠোফোন টা জানিয়ে দিলো কেউ বারবার ফোন দিয়ে চলেছে। ওপাশের ব্যক্তিটির নিশ্চয়ই ধৈর্য্য কম। নইলে ধরছে না দেখেও কেন বারবার ফোন দিয়ে যাচ্ছে? সারা রাত ঘুম হয়নি বলে চোখের পাতাগুলি টেনে মেলতেও রাজ্যের কষ্ট যেন। এবার টুং করে একটা শব্দ হলো। ম্যাসেজ এসেছে। বাধ্য হয়ে ঘুম উড়িয়ে জেগে উঠল অর্ক। তার কপাল কুঁচকে রয়েছে। বিরক্তি নিয়ে পাশ থেকে ফোনটা হাতে তুলে নিলো। সঙ্গে সঙ্গে আবারও টুং করে শব্দ হলো। আরেকটি ম্যাসেজ এসেছে।

প্রথম ম্যাসেজ,
শীঘ্রি কল ব্যাক করো অর্ক। তোমার থেকে এসব আশা করিনি আমরা।

দ্বিতীয় ম্যাসেজ,
ইথিশার কিছু হলে ওর পরিবার তোমাকে ছাড়বে না। এতবড় গ্যাঞ্জামে ফেলে দিয়ে গা ছাড়া ভাবে থাকছো কেমন করে?

দুটো ম্যাসেজই দিয়েছে অর্ক’র বাবা। অর্ক চক্ষুদ্বয় কপালে তুলে ফেলল। দ্রুততার সঙ্গে বাবার নাম্বারে ফোন করে বসল। একবার রিং পড়তেই কলটা রিসিভ হলো।

ওপাশ থেকে কথা ভেসে এলো প্রথমে। কোনো হাই হ্যালো নয়। সরাসরি গুরুত্বপূর্ণ কথা, গম্ভীর কণ্ঠস্বর, খুব যে রেগে আছেন তা বোঝা মুশকিল নয়।

‘তুমি কোথায়?’

অর্ক রয়েসয়ে জবাব দিলো,

‘গ্রামে।’

‘ওখানে কী করছো এখনো? আচ্ছা ইথিশাকে কী আমরা পছন্দ করেছিলাম তোমার জন্য? নাকি তুমিই পছন্দ করে আমাদের সাথে দেখা করিয়েছো? ওর ফ্যামিলি থেকে একটু সমস্যা ছিল তাও আমরা মেনে নেইনি? ক’দিন পর তোমাদের বিয়ে। আর এখন এসব কী শুনছি?’

অর্ক ভারী গলায় প্রশ্ন ছোঁড়ে,

‘কী শুনছো?’

‘সেটা ঢাকায় এসে শুনে যাও। এক্ষুনি রওনা হবে অর্ক। ইথিশা নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে এক ঘরে নিজেকে আঁটকে নিয়েছে। ওর বাবা আমাকে ফোন দিয়ে যা তা ভাষা করেছে। আমাদের নাকি পুলিশে দেবে যদি উনার মেয়ের কিছু হয়। এই বয়সে এসে তোমার মতো একজন বুদ্ধিমান ছেলের জন্য এসব শুনতে হবে আমাকে অর্ক?’

অর্ক আশ্চর্যের চূড়ান্তে গিয়ে বলল,

‘কী বললে, ওর বাবা আমাদের পুলিশে দেবে?’

‘এর চাইতেও আরও বাজে ভাষা সে করেছে আমার সঙ্গে। তোমার মা’র সঙ্গে। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না অর্ক। তোমাদের মধ্যে কী হয়েছে?’

অর্ক দমবন্ধ গলায় জবাব দিলো,

‘আমি ঢাকা আসছি। এক্ষুনি আসছি। ইথিশার সামনেই সবকিছু খোলাসা করব। সচ্ছ জল পুরোটাই ঘোলা করে দিলো ও।’

এইটুকু বলে ফোন কে’টে দিয়ে দ্রুত বিছানা ছাড়লো ও। গায়ে টি-শার্ট পরে গলায় তোয়ালে জড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল কল পাড়ের উদ্দেশ্যে।

______
আখতার সবেমাত্র টেবিলে খেতে বসেছেন। এমনিতেই তার মেজাজ অষ্টমে, তার মধ্যে খাবার পাতে খিচুড়ি দেখে রাগটা যেন আরও বেড়ে গেল। তিনি চোখ লাল করে পুতুলের দিকে তাকালেন। পুতুল খেয়াল করল, পাত্তা দিলো না। নিচু কণ্ঠ অথচ তেজপূর্ণ, বলল সে,

‘আমি নতুন আইছি। কে কী খায় হেইডা তো আর জানি না। ভাবীরে জিগাইছিলাম কী রানমু, হেয় কিছু না কইয়া চইলা গেছে। তাই আমি আমার বুদ্ধিতে যা কুলাইছে তাই রানছি। হেইডা কী আমার দোষ?’

নাসিকাপথ ভেদ করে কিছু উষ্ণ শ্বাস বের করে দিয়ে বিড়বিড়িয়ে কাকে যেন গা’লি দিলেন আখতার। তারপর চুপ করে খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন। এক চামচ খিচুড়ি মুখে নিয়ে তার সমস্ত রাগ পড়ে গেল। এই মেয়ের রান্নার হাত ফাটাফাটি। তিনি বেশ আয়েশ করেই দুই প্লেট ভরে খিচুড়ি খেলেন। ধুনিয়াপাতা দিয়ে শুটকির যে একটা ভর্তা করেছে পুতুল,সেটা সে একাই সাবাড় করে দিলেন। তারপর বেশ তৃপ্তি নিয়েই ঢেঁকুর তুললেন। পুতুল ঠোঁট টিপে হাসলো। খেতে আসার পথে শম্পা যে তাকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়েছিল সেটা দরজার আড়ালে থাকা পুতুলের চোখ এড়ায়নি। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলেও যখন শম্পার ঘরের দরজায় কান পেতে চ’ড়ের শব্দটা শুনেছে তখন যতটা ব্যথা পেয়েছিল বুকে ঠিক ততটাই শান্তি অনুভব করেছে। ধীরে ধীরে সবকিছু তার অনুকূলে চলে আসছে। পুতুল বুঝেছে, তাকে শক্ত হতে হবে। সে বয়সে ছোট বলে বুদ্ধিতেও ছোট হওয়া যাবে না। ‘নরম জিনিস টিপতে মজা’ কথাটা খারাপ দিক ইঙ্গিত করে। কিন্তু এটাই যে তীব্র সত্য! তাই নিজেকে পরিপূর্ণ ভাবে শক্ত,কঠোর,দৃঢ় রূপে গড়ে তুলতে হবে। তাহলে শম্পা অথবা আখতার- কেউ ওকে কষ্ট দিতে পারবে না। কেউ কাউকে জায়গা দেয় না। নিজের জায়গা নিজেকে করে নিতে হয়। পুতুলও নিজের জায়গায় এই ঘরে করে নিবে। পুতুল একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

টেবিলের উপর থেকে এঁটো বাসন গুলো তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় আখতার ডেকে বললেন,

‘আইজকা থেইকা তুমিই রান্নাবান্না করবা। তোমার রান্নার হাত ভালা।’

পুতুল ভ্রু নাচিয়ে বলল,

‘তাই? রান্না করমু, আবার ঘরের সব কাজও করমু, ক্যান? আমি কী চাকর লাগি আপনের?’

আখতার কপট রাগী হয়ে বললেন,

‘উল্টাপাল্টা কথা কইয়া মেজাজ নষ্ট করিস না। যেইডা কইছি হেইডা করবি।’

তার গরম মেজাজের বিন্দুমাত্র পরোয়া করল না পুতুল। গা ছাড়া ভাব দেখিয়ে বলল,

‘করব। তয় একটা শর্ত আছে। আমি খালি রান্ধুমই, বাকি কাজ যেন ভাবী করে। আমি আইছি দেইখা সব কাজ আমার উপর চাপাইয়া দেয় না যেন।’

আখতার টেবিল ছাড়তে ছাড়তে বললেন,

‘ওয় করব নাইলে ওর বাপরে দিয়া করামু। তোরে যেইডা কইছি হেইডা করিস। আমি ওরে ডাইকা কইয়া দিমুনি।’

‘আর একটা কথা।’

‘কী?’

‘আমি যে এত ভালো কইরা রানলাম, আমারে উপহার দিবেন না?’

আখতার ভ্রু কুঁচকে তাকালেন,

‘এট্টু ভালা রানছোস, এর লাইগা আবার কী উপহার দিমু তোরে?’

‘বারে! আমি তো নতুন বউ। আমার কী শখ আহ্লাদ এডি কিছুই থাকবার পারে না?’

পুতুল যেন ভীষণ মন খারাপ করেছে এমন একটা ভাব দেখালো। চোখের পাতা কয়েক বার জাপটে মুখ টাকে নিচু করে নিলো। আখতার রাগ করতে গিয়েও করতে পারলেন না। সত্যিই পুতুলের রান্না বেশ মজাদার হয়েছে। বিনিময়ে মেয়েটা কিছু চেয়েছে। এতে দোষের কী? আখতার বললেন,

‘বল, কী দিতে হইবো তোরে?’

পুতুল তাকাল, তার চোখেমুখে হাসির ঝিলিক। সে ঘাড় নেড়ে বলল,

‘সত্যি দিবেন তো?’

‘ক আগে। ছলনা করিস না।’

পুতুল ঠোঁট কামড়ে হাসি আঁটকানোর চেষ্টা করে।

‘বাপের বাড়ি যাইতে চাই। সকালে যামু বিকালে আইয়া পড়মু। এইটুক সময়। দিবেন?’

কথাটা বলেই পুতুল ভয় পেয়ে গেল। আখতার যদি না দেয়! যদি ভাবে অন্য কোনো মতলব আছে! অবশ্য বাবার বাড়ি যাওয়ার পেছনে দুটি উদ্দেশ্য আছে পুতুলের। বাপজানের মুখটা ভীষণ মনে পড়ে। এছাড়াও শাপলার সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করতে হবে অনেক কিছু। পুতুল চোখ ছলছল করে তাকিয়ে রইলো। আখতার জোরে কিছু বললেন না। শুধু আস্তে করে বললেন,

‘যাইস।’

তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ে পুতুল। সে ভেবেছিল আখতার রাজী হবেন না। কিন্তু এত সহজে আখতার রাজী হয়ে গেলেন! এর চাইতে বড় আনন্দের আর কী হতে পারে!

বাবার বাড়িতে থাকা হয়নি দুই রাত, একদিন, অথচ মনে হচ্ছে কতবছর পর ওই বাড়ি যাবে পুতুল! মাথার ভেতর অদ্ভুত সব জল্পনা কল্পনা ঘুরতে শুরু করল।

_____

এঁটো থালাবাসন গুলো সব ধোয়ার জন্য নিয়ে এলো পুতুল কল পাড়ে। সেখানে এসেই সে জমে গেল আড়ষ্টতায়। অর্ক গড়গড়া করছে মুখে। পুতুলকে দেখে মুখের পানিটুকু ছুঁড়ে ফেলল ওঁ। পুতুল নীরবে থালাবাসন গুলো এক পাশে নামিয়ে রেখে ধীর পায়ে আবার চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই অর্ক মৃদু স্বরে ডাকল,

‘শোনো।’

পুতুল দাঁড়াল, উল্টোদিক ফিরে, নির্বাক হয়ে। অর্ক বলল,

‘আমি চলে যাচ্ছি।’

‘কোথায়?’

সঙ্গে সঙ্গে অর্ক’র দিকে ফিরে তাকিয়েই প্রশ্নটা করল সে। চোখেমুখে বিষাদের ছায়া। করুণ চাহনি। অধরে অল্প একটু হাসি মাখিয়ে অর্ক বলল,

‘ঢাকায়। এক্ষুনি রওনা হবো।’

পুতুলের মনে যে সুখ প্রজাপতি গুলো উড়াউড়ি করছিল, সেগুলো সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। অর্ক চলে যাবে শুনেই নাকী অর্ক’র অনুপস্থিতি মানতে পারবে না জেনে, কে জানে! মলিন কণ্ঠে পুতুল জবাব দিলো,

‘ও।’

অর্ক একটু এগিয়ে মুখোমুখি এসে দাঁড়াতেই পুতুল তিন চার কদম পিছিয়ে দূরে সরে দাঁড়াল। জড়তার সঙ্গে মাথায় ঘোমটা তুলে নিলো। অর্ক বলল,

‘আমি আবার আসবো। না আসা পর্যন্ত চাচা যেমন চায় তেমনটাই করো। উনার মন মতো চলিও। উল্টাপাল্টা কিছু করতে যেয়ো না। পরে হিতে বিপরীত হবে। উনি লোকটা সুবিধার না।’

শরতের আকাশ এই ভালো এই খারাপ। এই দেখা যায় রোদ ঝলমলে দিনের আলো তো এই দেখা যায় কালো মেঘের ভেলা সন্ধ্যার সৃষ্টি করেছে। তারপর একসময় টুপটুপ করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। ঠিক যেন পুতুলের মনের অবস্থা। মনের ভেতর জমা মেঘগুলো চোখে এসে ভীড় জমিয়েছে। চোখ জ্বালা করছে। মাটির দিকে তাকিয়ে পুতুল বলল,

‘আমি খিচুড়ি রানছি। খাইয়া যান।’

‘দেড়ি হয়ে যাবে পুতুল। আর তিরিশ মিনিট পর নেক্সট বাস। আমাকে এখনই বের হতে হবে।’

‘আচ্ছা।’ বিষন্নতা বেড়ে চলে।

‘আমি আসবো, কথা দিচ্ছি, আবার আসবো। যদি তুমি চাও..’

অর্ক থামে, দম নেয়, পুতুল ঘোলা চোখে তাকাল। বলল,

‘কী?’

অর্ক একটুখানি হেসে বলল,

‘তোমাকে এখান থেকে মুক্ত করব।’

পুতুল জবাব না দিয়ে পুনরায় চোখ নামিয়ে নেয়। তার ভাগ্যে কী আছে সে জানে না। কিন্তু বুঝতে পারছে, এই ভদ্রলোক টা একটু একটু করে তার মনের সমস্ত স্থান দখল করে নিচ্ছে। কেন এমনটা হচ্ছে! এই মানুষটা তার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তাও কেন অবাধ্য মন একে জায়গা করে দিচ্ছে নিজ কুঠুরিতে? আরও একবার আঘাত পাওয়ার জন্য? নিজেকে নিঃস্ব করার জন্য? নাকি প্রণয়ের ক্ষ’ত নিয়ে আজীবন বাঁচবার জন্য?

পুতুল চলে যায়। কথা বাড়ায় না। অর্ক পুনরায় নিজের চোখেমুখে পানির ছিঁটে দিতে লাগল। তার মনও যে কম বিষন্ন হয়নি তা না। কলের পানিতে চোখের পানি ধুয়ে গেল। ভালোই হলো। নইলে সে পানি দেখে ভীষণ ভীষণ অবাক হতো ভদ্রলোক। ভাবতো, কোন কালে কেমন করে গন্ডগ্রামের বিবাহিত এক নারীকে সে নিজের মন দিয়ে বসেছে নিজের অজান্তেই!

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here