#প্রণয়ের_তৃষ্ণা-৬,০৭
অলিন্দ্রিয়া রুহি
০৬
_____
এবার খুব কাছে কোথাও বজ্রপাত পড়ল। বিকট আওয়াজে পুতুল শিউরে উঠে সঙ্গে সঙ্গে অপরিচিত ব্যক্তিকে ছেড়ে দূরে গিয়ে বসল। হাত-পা ভয়ে তিরতির করে কাঁপছে। গলাও কম্পমান। একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে সে প্রশ্ন ছোঁড়ে, ‘কে…কে আপনে?’
অর্ক উঠে বসেছে। তার ড্যাবড্যাবে চোখের চাউনি পুতুলের ভয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওই চোখে তাকিয়ে থাকা যায় না। কেমন ঘোর লাগে। সম্মোহনের সৃষ্টি হয়। পুতুল দ্রুততার সঙ্গে নিজের মাথা নামিয়ে নেয়। নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবে। তারপর চোখে তুলে তাকাল। ফের বলল, ‘আপনে কেডা? না কইলে যান এইহান থেইকা। নাইলে আপনে থাকেন, আমি যাই।’
কথাখানা বলেই পুতুল উঠে দাঁড়াল। জমিনে পা দিতেই তার সমস্ত শরীর টলে উঠে। মাথার উপর বড় কাঠের তক্তা। হাত বাড়িয়ে শক্ত করে চেপে ধরে তা। নিজেকে সামলে নিতে নিতে শুনলো, আগন্তুক বলছে, ‘আপনার যেতে হবে না। আমিই চলে যাচ্ছি।’
একদম স্পষ্ট গলা! কোথাও বিন্দুমাত্র সংকোচ নেই। শুদ্ধ ভাষা। কে এ? পুতুল অবাক বিস্ময় নিয়ে তাকাল।
অর্ক বলল, ‘আপনার গায়ে সম্ভবত খুব জ্বর। আপনি কাঁপছেনও। আমিই চলে যাচ্ছি। আপনি এখানে রেস্ট করুন।’
‘রেস্ট’ শব্দটার মানে ঠিক বুঝল না পুতুল। তবে এই নিয়ে তার মনে কোনো প্রশ্নও তৈরি হলো না। তার বিস্ময়তা তখনো কাটেনি। তার মন বলছে, এই ছেলে গ্রামের নয়। নিশ্চয়ই শহর থেকে এসেছে।
কখনো শহর দেখেনি পুতুল। শুধু শুনেই এসেছে লোক মুখে। সেখানে নাকী সাহেবের মতোন মানুষজন থাকে। তাদের আচার-আচরণ, ভাষা, কথা বলার ভঙ্গি- সবকিছুই অন্যরকম। সবকিছুতে ভদ্রতার ছাপ। ঠিক যেমনটা অর্ক’র ভেতরও লক্ষ্য করা যায়। সে উঠেই হুড়ুমদুড়ুম করে নিচে নেমে গেল না। বরং, ধীরেসুস্থে পাশে খুলে রাখা হাতঘড়িটা হাতে পড়ল। পড়তে পড়তে একবার পুতুলের দিকে তাকালও। তারপর দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। উনি উঠে দাঁড়াতেই বেশ খানিকটা লজ্জা পেল পুতুল। গাঢ় দৃষ্টি সরিয়ে কিছুটা মিঁইয়ে গেল লজ্জায়। লোকটা এত লম্বা হবে! ভাবেনি সে। তার ঠিক বুকের সমান হবে পুতুল। তার মাথা কাঠের তক্তার সঙ্গে লেগে যায়! শরীরের গঠনও পেটানো, সুন্দর। গ্রামে এরকম উচ্চতার লোক খুব কমই দেখেছে সে।
ভারী পুরুষালি কণ্ঠটি নাড়ালো অর্ক। বলল, ‘এটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট ছিল। নাথিং এলস। সো চিন্তার কোনো বিষয় দেখছি না। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন। কথা দিচ্ছি, আর উপরে আসবো না।’
তারপর সিড়ি বেয়ে তরতর করে নিচে নেমে গেল সে। রেখে গেল একখানা বিস্ময়ে থমথমে মুখ- যে বোঝার চেষ্টা করছে এই গণ্ডগ্রামে এত সুদর্শন ভদ্র পুরুষ এলো কোথা থেকে!
_____
ঘরের ভেতর পারুল উঁকি দিলেন। ডাকলেন, ‘ও পুতুলের বাপ, রান্না অইয়া গেছে। খাওন বাড়তাছে।’
হাসমত আলী, মনু মিয়া এবং আখতার- তিনজনে মিলে গল্প করছিলেন। পারুলের উপস্থিতিতে তাদের ধ্যান ভাঙে। পারুলের পেছন পেছন তিনজনেই ভেতর ঘরে এসে ঢুকলো। কিন্তু সেখানে পুতুলকে না দেখতে পেয়ে আখতার প্রথমে বলে উঠলেন, ‘পুতুল কই? ওরে দেখতাছি না।’
‘ওয়ে তো আপনেগো লগেই ছিল। চুলার ধারে তো আইয়ে নাই।’ জবাব দিলেন পারুল।
আখতার বললেন, ‘ওরে ডাইকা আনেন। সবাই এক লগে খাই।’
পারুল হাসমত আলীর চোখের দিকে একবার তাকালেন। মানুষ হিসেবে আখতার বড় বেহায়া কিসিমের। বাবা-মায়ের সামনেই মেয়েকে অনেক আহ্লাদ করে দেখাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসা থাকবে আড়ালে,গোপনে। সবার সামনে এত আহ্লাদ কীসের? যদিও তারা এখনো স্বামী-স্ত্রী হয়নি। তবুও সবার ভাবটা এমন, যেন বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আর বিয়ের পরই আখতারের বাড়িতে তার শ্বশুর শাশুড়ি এসেছে।
পারুল পুরো ঘরের কোথাও খুঁজেও পুতুলকে পেলেন না। তিনি আশংকিত হয়ে পড়লেন। আইতনার ঘর (বাহির ঘর) খুঁজে যখন চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবেন, ঠিক তখনই একজন বলে উঠল, ‘আপনার মেয়ে উপরে আছে। ঘুমাচ্ছে। উনার গায়ে বোধহয় অনেক জ্বর। আপনি একবার দেখে আসুন তো।’
পারুল হতভম্ব হয়ে গেলেন। এত সুন্দর করে, শুদ্ধ ভাবে কাউকে কথা বলতে এই প্রথম দেখলেন। এর আগে দেখেছেন, তবে সেটা টিভিতে, ছবির ভেতর। তিনি কথার প্রত্যুত্তরে কী জবাব দিবেন, ভেবে পান না। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিজোড়ায় প্রশ্ন ঘুরপাক খায়, কে এই ছেলে?
অর্ক হাসলো, নাই নাই হাসি। সেই হাসির কোনো শব্দ হয় না, দেখাও যায় না। শুধু যে হাসে, সে-ই উপলব্ধি করতে পারে।
‘আপনি আমার দিকে চেয়ে কী দেখছেন এমন ভাবে? বলুন তো। আমি কোনো ভূত না। আপনাদের মতোই স্বাভাবিক একজন মানুষ।’
পারুল নির্বোধের ন্যায় চেয়ে, তার মুখে ভাষা নেই। অর্কের পেট ফেটে হাসি পেলেও সে অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করল। পুনরায় ডাকলো, ‘এই যে আন্টি! শুনছেন?’
পারুল স্পষ্ট ভাবে বলতে চাইলো, ‘হুম..’, কিন্তু ঠোঁট চিঁড়ে বেরিয়ে এলো ‘উঁ..’ যেন গুঙিয়ে উঠলেন তিনি। অর্ক এবার আর নিজের হাসি থামাতে পারল না। হো হো করে একটু জোরেই হেসে উঠল। পারুল ভড়কে গেলেন। তার চোখেমুখে এতক্ষণ বিস্ময় থাকলেও এবার খানিকটা ভয় এসে যুক্ত হলো।
‘আপনি প্লিজ এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না। আমার রীতিমতো শাই ফিল হচ্ছে। আপনি যে খোঁজে এসেছেন, তা আমি বলে দিয়েছি তো। এখন এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে উপরে যান। প্লিজ!’ হাসতে হাসতেই কথাখানা ছুঁড়ে দিলো সে। পারুল মুখে কুলুপ এঁটেছেন। কোনো রাঁ নেই। যেভাবে হন্তদন্ত হয়ে এসেছিলেন,সেভাবেই ছুটে গেলেন।
যেন ভূত দেখে এসেছেন, এমন ভঙ্গিতে ভেতর ঘরে গিয়ে থামলেন। তার গোল গোল চোখ জোড়া হাসমত আলী, মনু মিয়া আর আখতারের দৃষ্টি কাড়ে। হাসমত আলী বললেন, ‘কী অইছে তোমার? ভয় পাইছো ক্যান? পুতুল কই?’
পারুল থেমে থেমে বললেন, ‘পুতুল মাচায় বলে। ঘুমায়। ওর গায়ে জ্বর।’
‘জ্বর?’ আখতার উঠে দাঁড়ালেন। যাওয়ার জন্য পা বাড়াবেন, ওমনি পারুল বললেন, ‘আপনে কই যান? ওয়ে একলা হুইয়া আছে। হেইনে আপনের কাম কী? ও কিন্তু এহনো আপনের বউ হয় নাই।’
‘বউ হয় নাই, হইবো। দুইদিন আগপিছ, তাতে কী সমস্যা?’ পরিপূর্ণ তেজ আখতারের গলায়। মনু মিয়া পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে আখতারের লুঙ্গি পেছন থেকে টান দিয়ে ধরেন। বললেন, ‘ভাই, বহো। তোমার শাশুড়ী ঠিক কথাই কইছে।’
আখতার মনু মিয়ার চোখের ভাষা বুঝে চুপচাপ বসে পড়লেন। হাসমত আলী দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলেন। পুতুলকে এর হাতে তুলে দেওয়া কতটুকু সমীচীন হবে,কে জানে!
পারুল বললেন, ‘নিয়ম নীতি ভুইলা যাইয়েন না। আমার মাইয়া এহনো আব্যায়িত (অবিবাহিত)। হের লগে এক কামড়ায় আপনার কোনো কাম নাই। আগে বিয়াডা হোক, হেরপর যত খুশি যত্ন নিয়েন। আপনেরা খাইয়া লন। পুতুল খাইবো না। ওর শরীরডা ভালা না।’
হাসমত আলী বললেন, ‘তুমি গিয়া দেইখা আইছো? জ্বর কদ্দুর? বেশি হইলে গঞ্জে যাইতে হইবো। ওষুধ আনাইতে হইবো।’
‘আমি যাই নাই। ওই পোলায় কইলো আমারে..আর ওর তো সন্ধ্যা হইতেই শরীরডা ভালা আছিলো না। তাই গিয়া আর ঘুম ভাঙাই নাই। আপনেরা খাইয়া লন। আমি গিয়া ওর লগেই শুমু।’ পারুলের জবাব।
‘কোন পোলা?’ মনু মিয়া আসল জায়গা খপ করে ধরে বসলেন। পারুল থতমত খেল। ছেলেটার ব্যাপারে বলা উচিত হয়নি। যদি এরা তিল কে তাল বানায়! ভালো কথা, ছেলেটাই বা জানলো কী করে পুতুলের জ্বর এসেছে? পারুলের মাথায় নতুন চিন্তার আবির্ভাব হলো। মনু মিয়ার প্রশ্নকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তিনি নতুন ভাবে প্রশ্ন করলেন, ‘ওই পোলাডা কেডা? বাইরের ঘরে বইয়া আছে।’
অনেকক্ষণ পর কারো কথা মনে পড়ল যেন। আখতার তড়িঘড়ি করে বলে উঠলেন, ‘ওরে ডাক দেন। ওয় আমার বন্ধুর পোলা। এইনে আইছে একটা কামে। শহরের লোক। ওরে ডাক দিয়া খাইতে আইতে কন। আহহারে! ছেড়ার কথা আমি ভুইলাই গেছিলাম!’
পারুল নিশ্চিন্ত হলেন। এতক্ষণ যাকে দেখে জ্বিনের বাদশা বলে মনে হচ্ছিল তার কাছে, সে কোনো জ্বিন নয়। তাদের মতোই মানুষ তবে সে সাধারণ নয়। শহরের লোক! পারুল পুনরায় ভয়ে ভয়ে গিয়ে অর্ককে ডেকে এলো।
_____
পূবের আকাশে সূর্য দেখা যায়নি তবে তার আলো খানিকটা এসে পৃথিবীর আঁধারকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ আগেই ফজরের আজান পড়ে গেছে। পুতুলের ঘুম ভেঙেছে ফজরেরও আগে। সে চুপ করে শুয়ে শুয়ে ভাগ্যের কথা ভাবছিল। দু’দিন আগেও যে ছিল চিন্তাহীন, সুখী একজন বালিকা, আজ তার প্রতি মুহূর্ত কাটে চিন্তায় চিন্তায়। সেই চিন্তায় সুখ বা প্রশান্তির লেশটুকুও নেই। আছে শুধু উদ্বেগ,উৎপীড়ন আর বুকের দহন!
পারুল পাশে নেই। রাতে এসে মেয়ের সঙ্গেই ঘুমিয়েছিলেন,আজানের পর উঠে নিচে নেমে গেছেন। হতে পারে রান্নাঘরের বাকী সবার সাথে হাত লাগিয়েছেন। পুতুল একা একা বেশ খানিকক্ষণ শুয়ে রইলো। মাচায় ছোট ছোট আটটা জানালা। ধীরে ধীরে অন্ধকার মাচাটা আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছে। পুতুল শোয়া থেকে উঠে বসল। তার শিয়রের পাশেই যে জানালাটা সেটা বন্ধ ছিল, পুতুল খুলে দিলো। অনেকটা আকাশ, উঠানের একপাশ, একটা সবজি বাগান, আর পুকুরপাড়- এখান থেকে দেখা যায়। পুতুল একে একে সবকিছুর উপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। তারপর তাকাল আকাশপানে, জানালায় হেলান দিয়ে উদাসীন চোখজোড়া মেলে চেয়ে রইলো নির্নিমেষ। ক’গাছি আলুথালু চুল এসে চোখেমুখে পড়ছে, উড়ছে, বড্ড ত্যক্ত করছে। পুতুলের সেদিকে সামান্যতম ভ্রুক্ষেপ নেই।
দাঁত খিলান করতে করতে এক দলা থুতু পুকুরের পানিতে ছুঁড়ে দিলো অর্ক। তার এক হাতে ছাঁইয়ের গুড়ি, অপর হাতে আম পাতা। কিছু গুড়ি গলার ভেতর চলে গেছে ফলে বারবার কাঁশি আসছে। অর্ক’র চোখমুখ জুড়ে শুধু বিরক্তি আর বিরক্তি। দীর্ঘ সাত বছর বিদেশ থেকে সে এখানে এসেছে বাবার কথায়। জমি বিক্রি করতে। তার বৃদ্ধ বাবার আদেশ, দেশে যেহেতু কেউ থাকে না,তাই ওই জমিটুকু বিক্রি করে দিতে। তারপর আবারও সে পাড়ি জমাবে বিদেশে। গ্রামের এসব কাদামাটি, খাঁ খাঁ রোদ, এখানে সেখানে হাস-মুরগীর বিষ্ঠা- কোনো কিছুই সহ্য হচ্ছে না তার। তবুও দাঁতে দাঁত কামড়ে থাকতে হচ্ছে। জমি মাপা হয়েছে। খরিদদারের খোঁজ চলছে।
ঠিক এমন সময়ে পেছন থেকে কারো আকুতিভরা গলা ভেসে এলো। অনেকদিন পর প্রিয় মানুষটিকে দেখলে মানুষ যেভাবে উচ্ছ্বাস নিয়ে ডাকে, ঠিক সেরকম ভাবে-
অর্ক পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল, ইথিশা। অর্ক’র বিস্ময়ের সীমা রইলো না।
‘তুমি?এখানে?’ ইথিশাকে একেবারেই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে অর্ক’র কাছে।
ইথিশা দৌড়ে এসে অর্ক’র বুকে মাথা রাখল। অর্ক’র মনে হলো, অনেকদিন পর তার তপ্ত মরুভূমিতে প্রশান্তির বারিপাত ঝরে পড়ল।
‘আমি ভাবতেই পারছি না তুমি এসেছো! আমাকে।সারপ্রাইজ করলে?’
‘ইয়েস মাই লাভ! আই সারপ্রাইজড ইউ। ডিড নট ইউ লাইক ইট?’
‘আই লাভ ইট সুইটহার্ট।’
ইথিশার কপালে একটা উষ্ণ চুমু আঁকে অর্ক। তারপর একটু সরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘পাপা মম জানে?’
ইথিশা ঠোঁট ভেঙে বলে, ‘শুধু জানেই না বরং তারাই আমাকে বলল, তোমাকে সঙ্গ দিতে। তাই চলে এলাম।দেড়ি না করে।’
অর্ক মেকী অভিমান নিয়ে বলল, ‘আমার সঙ্গে এলেই পারতে। শুধু শুধু এই ক’দিন আমাকে বোর হতে হতো না।’
ইথিশা মিষ্টি করে হাসল, ‘ইচ্ছে করে আসিনি। আসলে এই সুন্দর সারপ্রাইজটা দেওয়া যেতো না।’
‘তা ঠিক..’ হাসে অর্কও, ‘তুমি দাঁড়াও, আমি মুখটা চট করে ধুয়ে ফেলি।’
‘ওকে।’ হাত দিয়ে থাম্বস আপ চিহ্ন দেখায় সে। অর্ক প্রত্যুত্তরে হাসি ছুঁড়ে দিলো। পুকুর ঘাটে নেমে কুলকুচি করে নিলো। উঠে আসার সময় তার চোখ পড়ে দো-তলায়, জানালায় কেউ বসে আছে, রাতের ঐ মেয়েটা! ওর উদাসীন চোখজোড়া অর্ক’কে থমকে দিলো। অর্ক’র হুট করে খুব ইচ্ছে করে, মেয়েটাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে, ‘আপনাকে এত আপসেট দেখাচ্ছে কেন? আপনার কী মন খারাপ?’
(চলবে)
#প্রণয়ের_তৃষ্ণা (৭)
অলিন্দ্রিয়া রুহি
_____
‘ওমন করে কী দেখছো তুমি?’ অর্কের চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে ইথিশাও চাইলো এবং সঙ্গে সঙ্গে অবাক হয়ে গেল। পুতুলের মতো ধবধবে সুন্দর একটি মেয়ে হেলান দিয়ে বসে রয়েছে। নড়াচড়া নেই, শুধু তার চুল গুলো উড়ছে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো এক মূর্তি মানবী।
ইথিশা চোখ নামিয়ে অর্ক’র দিকে তাকাল। অর্ক তখনো চেয়ে। ইথিশার মন বাড়িতে অভিমান জমে। সে গাঢ় অভিমানে ডুব দিয়ে বলে উঠে, ‘বাহ! সুন্দর দেখলে হুশ থাকে না, না?’
অর্ক সম্বিৎ ফিরে পেল। থতমত খেয়ে গেল। সেই সঙ্গে মৃদু স্বরে আর্তনাদও করে উঠে।
‘ছিঃ! ও কত ছোট আমার। দেখেছো?’
‘তাতে কী? দেখতে তো সুন্দর।’
ততক্ষণে ইথিশার কোমরে দু’হাত চলে গেছে। রাগী ভঙ্গিতে সে বলল, ‘ও-ই কী সেই কারণ, যার জন্য তুমি ব্যাক করছো না এখনো।’
‘ইথি! স্টপ ইট প্লিজ। তুমিও ভালো করে জানো আমি কী জন্যে এখানে এসেছি। লিসেন টু মী…মেয়েটা এসেছিই গতকাল রাতে। তখন থেকেই দেখছি ভীষণ মন খারাপ নিয়ে আছে। আমি ভেবে পাই না, এতটুকু পাখির মতো একটা মেয়ে। ওর তো উড়ার কথা। মন খারাপ করে খাঁচায় আঁটকে থাকার কথা নয়।’
কথা শেষ করে অর্ক ফের তাকাল। মেয়েটা নেই। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল? অর্ক’র সঙ্গে সঙ্গে ইথিশাও তাকাল। অপরাধী ভঙ্গিতে বলল, ‘সরি অর্ক। আমি খুব খারাপ। তোমাকে শুধু আবোলতাবোল বলে ফেলি।’
‘উঁ..’ অর্ক আনমনে, কিছু একটা ভাবছে খুব। ধীরে ধীরে ঘাট থেকে উঠে এলো। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে লম্বা হাতল বানানো। সেখানে গামছা ঝুলছে। গামছাটা নিয়ে নিজের আদল খানা মুছতে মুছতে পুনরায় চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে উঠল, ‘আমার খুব কিউরিওসিটি হচ্ছে ইথি।’
‘কী নিয়ে?’ ইথিশার প্রশ্ন।
‘মেয়েটাকে নিয়ে। ওর নাম কী জানো?’
‘কী?’
‘সম্ভবত পুতুল।’
‘পুতুল? বাহ! পুতুলের মতো দেখতে মেয়েটার নামও পুতুল। দারুণ না?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু পুতুলের মতো মেয়েটার সবসময় হাসিখুশি থাকার কথা। সেখানে আমি শুধু মন ম’রাই দেখছি। কী কারণে কেউ এত উদাসীন হতে পারে, তাও এইটুকু বয়সে, আমার মাথায় খেলছে না।’
অর্ক’র চোখেমুখে কেমন একটা উদ্বেগের দীপ্তি। ইথিশা বলল, ‘আমি যাবো? কথা বলে দেখবো?’
‘তুমি?’ অর্ক দুই সেকেন্ড ভাবল, বলল, ‘ওকে। দেখতে পারো। তোমার কাছে খুলে বললেও বলতে পারে। আই এম ড্যাম শিউর, সামথিং ইজ রং ইথি..সামথিং ইজ ভেরি রং!’
ইথিশা কাছে এগিয়ে আসে। অর্ক’র কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘ডোন্ট ওরি, কিছুই রং হবে না। আমি কথা বলছি..’
_____
দপদপ করে কেউ সিড়ি ভেঙে উপরে উঠে আসছে। পুতুলের ধ্যান ভেঙে যায় সেই শব্দের জোরে। মনে কামড় মারে, আখতার নয় তো? ভাবনাটি মাথায় চেপে বসতেই পুতুল ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে আঁচল খানা মাথায় তুলে নিজেকে ঢাকার চেষ্টা করতে করতে দেখল, আখতার নয়, পারুল এসেছেন। পুতুলের বুক চিঁড়ে অজান্তেই স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে।
‘ও মা, উঠছো তুমি?’ পারুল প্রশ্ন করলেন।
জবাবে পুতুল ছোট্ট করে বলে, ‘হুম।’
‘আইয়ো,নিচে আইয়ো। খাওন দেওয়া হইছে। রাইতেও কিছু খাও নাই। তোমার বাপজান তোমার লিগা বইয়া আছে।’
‘আম্মা, বাড়ি যাবা না?’ পারুলের কথার প্রত্যুত্তরে খুব ধীর স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় সে। তারপর করুণ চোখ করে তাকাল। যেন তার চোখের দৃষ্টি বলে দেয়, এখানে বিয়ে করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। কিন্তু হায়! পারুল একজন ভালো স্ত্রী হলেও ভালো মা হয়ে উঠতে পারেননি৷ তিনি তার সন্তানের চোখের ভাষা, মনের হাহাকার, আহাজারি- কোনোটিই শুনতে বা বুঝতে পারলেন না।
তিনি বললেন, ‘যামু তো। খাইয়াই যামু। আইজকা তোমার গায়ে হলুদ। বাড়িত যাইয়া সব ব্যবস্থা করতে হইবো।’
পুতুল নিশ্চুপ হয়ে গেল। পারুল শুধালেন, ‘কীরে, আয়। খাবি না?’
পুতুল ভারাক্রান্ত মনে জবাব দেয়, ‘মুখে তিতা লাগে। খাওয়ার ইচ্ছা নাই। তোমরা খাইয়া নাও। আমারে জোর কইরো না মা।’
পারুল বকতে গিয়েও বকলেন না। কয়েক সেকেন্ড নির্নিমেষ মেয়ের দিকে চেয়ে থেকে চলে গেলেন। আজ বাদে কাল মেয়ে তার চলে যাবে শ্বশুর বাড়ি। পারুলের মতো এরকম হাজারও বাবা-মা আছেন, যারা সন্তানের ভালো করতে গিয়ে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা করে ফেলেন। পুতুলকে অন্ধকার কূপের দিকে একটু একটু করে ঠেলে দিচ্ছেন তারা-ই। অথচ ভাবখানা এমন, তাদের চেয়ে পূন্যের কাজ বোধহয় গোটা তল্লাটে আর কেউ করেনি!
এতক্ষণ জমিয়ে রাখা অশ্রু কণারা এবার আর কোনো বারণ শুনতে চাইলো না। চোখের কোল ঘেঁষে তারা গড়িয়ে পড়ল এক এক করে। গাল, চিবুক, ঠোঁট ছুঁলো। তাদের বাঁধা দিলো না পুতুল। জীবনের হাসিখুশি মুহূর্ত গুলো সত্যিকার অর্থেই এবার ফুরিয়ে যেতে চলেছে। মানসিক ভাবেই নয়, শারীরিক ভাবেও আখতারের কাছে নির্যাতিত হবে সে। জানে পুতুল। মন জানান দেয় সবকিছু। তবুও উপায় নেই কোনো। বাবা-মাকে সমাজের কটুক্তি থেকে মুক্ত করতে নিজেকে বিলীন করে দিবে সে চিরতরে….
_____
আখতার মুখ কালো করে বললেন, ‘পুতুল আইয়ে নাই?’
পারুল গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দেন, ‘না।’
‘ক্যান? ও খাইবো না ক্যান? রাইতেও খায় নাই। আমি গিয়া…’
মনু মিয়া বাঁধা দিলেন, ‘বহো মিয়া। ছেড়ি মাইনষের লজ্জা শরম বইলা একখান জিনিস আছে তো নাকী। আইজ বাদে কাইল হের বিয়া। আর হেয় এহন আইয়া তোমার লগে রঙ্গ কইরা খানা খাইবো?’
আখতার লজ্জা পেলেন। চুপচাপ বসে পড়লেন। পারুল বললেন, ‘হলুদ কী আমরা গিয়া বাটমু, নাকী আপনেরা পাডাইবেন?’
‘আপনেগো বাটতে হইবো না। আমার গায়ে ছোঁয়ানো হলুদই পুতুলের গায়ে লাগবো। আমি এইহান থেইকা পাডাইয়া দিমুনি। ও মনু ভাই, তুমি গিয়া দিয়া আইতে পারবা না?’
‘পারুম না ক্যান, অবশ্যই পারুম।’
‘সন্ধ্যের মধ্যে মধ্যে হলুদ টা শেষ করতে পারলে ভালা হয়। আকাশের যা অবস্থা। আবার কহন ঝড় উডে, কে জানে!’ বললেন পারুল।
আখতার, মনু মিয়া, দু’জনেই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন। হাসমত আলী বললেন, ‘তাইলে আমরা অহনই বাড়িত যাই। বেবাক কাম বাকী পইড়া রইছে। বিয়ালের (বিকাল) মধ্যে হলুদ পাডাই দিয়েন। কাইল যোহরের পর ময়-মুরুব্বী নিয়া আপনেরা সবাই হাজির থাইকেন।’
‘আপনেরা খানা পিনার চিন্তা করবেন না। ওই বাড়িত গিয়া বউ তুইলা নিয়া আহুম খালি। খানা যা খাওয়ার এই বাড়িত হইবো। বুঝছেন?’
হাসমত আলী নিশ্চুপে মাথা নাড়ালেন। তিনি বুঝেছেন।
ফেলে রাখা চাদরটা পুনরায় গায়ে-মাথায় ভালো মতো পেঁচিয়ে পুতুল নিচে নামলো। পারুল ডেকেছেন। তাদের এখন যেতে হবে। নিচে নামতেই সে দেখতে পেল, আখতার, মনু মিয়া, এবং গতকাল রাতের সেই সুপুরুষ, তার পাশে একজন অপরিচিত সুন্দরী রমণী দাঁড়িয়ে আছে। পুতুল কারো দিকে তাকাল না। শুধু একবার, হ্যাঁ একবার খুব আলগোছে, যেন কেউ দেখতে না পায়, এমন ভঙ্গিতে অর্ক’র দিকে তাকাল। খুব গাঢ় চোখে তাকে একবার দেখে নিলো। হতে পারে এই দেখা-ই শেষ দেখা।
অর্ক ইথিশার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলছিল। পুতুল চোখ নামিয়ে নিলো। এরকম একজন সুপুরুষ যদি তার ভাগ্যে জুটতো! হায়! এ যে দিবা স্বপ্ন বৈ আর কিছুই নয়।
মুখের ভেতর তেঁতো স্বাদটা সারা শরীরে কেমন জানি ছড়িয়ে পড়ল। গা টা গুলিয়ে উঠে ওর। পাশে দাঁড়ানো পারুল কে চাপা স্বরে বলল, ‘তাড়াতাড়ি চলো।’
অতঃপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে বাড়ির পথে যাত্রা শুরু করল। যেতে যেতে শুনলো, গতকাল রাত থেকে আজ সকাল পর্যন্ত আখতার কতটা পাগলপারা হয়ে ছিল তার জন্যে। বারবার তাকে দেখতে চেয়েছে, উপরে উঠতে চেয়েছে, সবার বারণে থেমেছে। পারুল ইনিয়েবিনিয়ে বারবার বোঝালেন, আখতারের মতো স্বামী পেয়ে পুতুলের জীবন ধন্য বনে গিয়েছে। এখনই বউকে চোখে হারায়। বিয়ের পর কতটা সোহাগে রাখবে, ভাবা যায়!
বড় বিরক্ত লাগছিল সেসব শুনতে পুতুলের। কিন্তু মুখ ফুঁটে কিছু বলাও দায়। বাবা-মায়ের মুখের উপর কখনো জবাব দেয়নি এর আগে। এবার যখন নিজেকে বলি দিয়ে দিচ্ছেন উনারা, তখনও পুতুলের কিছু বলার নেই। দিক…দিয়ে যদি শান্তি পায় পাক! তাতে দোষের কী?
_____
ইথিশা অস্থির ভঙ্গিতে রুমময় পায়চারি করছে। অর্ক চুপচাপ বিছানায় বসে নিজের মোবাইল ঘাটতে ব্যস্ত তখন। ইথিশার অধৈর্য্য ভঙ্গি দেখে সে মৃদু হাসল। সেই হাসি ইথিশার অস্থিরতা আরও বাড়িয়ে তুললো যেন। সে গটগট হেটে অর্ক’র সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কোমরে দু’হাত গুঁজে রগচটা কণ্ঠে বলল, ‘আমাকে চিন্তায় ফেলে দিয়ে নিজে হাসছেন?’
অর্ক ঠাট্টার ভঙ্গিতে বলে, ‘মস্তো বড় অপরাধ করে ফেলেছি ম্যাম?’
অর্ক’র দুষ্টুমিতে ইথিশা মজা পাচ্ছে। কিন্তু তখনো সে মিথ্যে রাগকে মুখাবয়বে টেনে ধরে রাখলো। গলার স্বর গম্ভীর করে বলল, ‘হুম। অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছেন। নিজের চিন্তা আমার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে চিন্তাহীন জীবন কাটাচ্ছেন।’
‘তাহলে আমার মতো আপনিও চিন্তাটাকে ঝেড়ে ফেলুন ম্যাম। সে তো চলেই গেছে। আর চিন্তা করে লাভ কী?’
ইথিশা হতাশ ভঙ্গিতে অর্ক’র পাশে বসে বলল, ‘হুম, তা জানি। কিন্তু তাও কোথাও একটা গোলমাল লাগছে আমার কাছে। যাওয়ার সময়ও মেয়েটার মুখে এক রতি হাসি ছিল না। যেন মানুষ নয় কোনো মূর্তি মানবী। যে যেভাবে চালনা করছে সেভাবেই চলছে। কোনো আবেগ নেই, অনুভূতি নেই। ওর চেহারাটা দেখেছিলে? পুরোপুরি আবেগ শূন্য! আবেগ-অনুভূতি ছাড়া মানুষ হয় কেমন করে?’
একদমে এতগুলো কথা বলায় ইথিশার ভীষণ পানির তেষ্টা পেল। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। অর্ক অল্প একটু হাসে। বলল, ‘আমার ঘাট হয়েছে তোমাকে এসব বলা। শুধু শুধু তুমি চিন্তাকে অতিরিক্ত চিন্তা বানিয়ে ফেলছো। গ্রামের মেয়ে। ওদের স্বভাব অপরিচিত লোকদের আড়ালে থাকা। হতে পারে নতুন জায়গায় এসে ভালো লাগেনি, তাই ওরকম করছে। হতে পারে না?’
‘পারে, তাই বলে এতোটাও?’ ইথিশার প্রশ্নে অর্ক নিজেই উত্তর খুঁজে কূল কিনারা পায় না। বলা বাহুল্য, সে নিজেও এই নিয়ে অনেক ভেবেছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। তাই অন্যের চিন্তা বাদ দিয়ে নিজের কাজের প্রতি মনোযোগ দিয়েছে। এখানে আর কয়দিনই বা থাকা হবে? তারপর সে আবার পাড়ি জমাবে দেশ ছেড়ে। পাশে থাকবে এই সুন্দরী রমণী তার স্ত্রী হিসেবে। একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ তাদের অপেক্ষায়। তাই অন্য কোনো কিছুতে ফোকাস না করাই বেটার। পুতুলের বাবা-মা আছে। তার কিছু হলে তার বাবা-মা-ই দেখবে। বাহিরের লোক হয়ে অর্ককে ওসবে জড়ানোটা একদমই উচিত হবে না।
কিন্তু ইথিশা বারবার পুতুলের ব্যাপারটা তুলছে। ওকে কিছু না বললেই ভালো হতো। এখন নিজেও নিজের মাথা খাবে আর অর্ক’র মাথাটাও চাবাবে। অর্ক ভাবলো, এই চিন্তা থেকে ইথিশাকে দূর করতে হলে ওকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসতে হবে।
অর্ক বলল, ‘তোমার প্রশ্ন উত্তর খেলা শেষ হলে একটা কাজ করবে?’
ইথিশা তাকাল, ‘কী কাজ?’
‘সুন্দর করে সাজবে।’ অর্ক’র আদুরে গলা।
ইথিশা এক নিমিষেই লজ্জা পেয়ে গেল, ‘কেন?’
‘তোমাকে নিয়ে আমাদের জমিটা ঘুরতে যাবো। তুমি তো এখনো দেখোনি।’
‘সত্যি বলছো?’ ইথিশা খুশি হয়ে উঠল।
অর্ক মাথা উপর-নিচ দুলিয়ে জবাব দিলো, ‘ইয়েস ম্যাম, সত্যি। এখন যান, দ্রুত তৈরি হয়ে আসুন। আমি আখতার চাচাকে জানিয়ে আসি।’
‘আচ্ছা।’
ইথিশা নিজের বরাদ্দকৃত ঘরের দিকে তীরের বেগে ছুটলো। তার বাচ্চামো দেখে হেসে উঠে অর্ক। বয়সটা বাড়লেও মনটা ছেলেবেলাতেই রয়ে গেছে।
_____
হলুদ বাছাইয়ের পর্ব চলছে। বস্তা থেকে বের করে ভালো হলুদ গুলো কুলায় সাজানো হচ্ছে। একটু পর এগুলো বাটনার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হবে।
বাছাই পর্ব পরিচালনা করছেন শম্পা। সম্পর্কে তিনি আখতারের বড় ভাইয়ের বউ হন। তার বড় ভাই দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাহিরে রয়েছেন। শম্পা এবং তার মেয়ে আঁখি আখতারদের সঙ্গেই থাকে।
আখতারকে উঠোনে নামতে দেখে শম্পা কুলা রেখে এগিয়ে আসেন। রসিকতা নিয়ে বলেন, ‘বাইরে বাইর হইছো ক্যান দেওর? যেই রোদ! কালা হইয়া যাবা তো। যাও যাও,ভিত্রে যাও। তোমার ধলা বউ তোমারে পরে পছন্দ না-ও করবার পারে।’
আখতার হাসলেন। পেছনে কয়েকজন মহিলা গালগল্প করছে,হাতে হাতে কাজ ও করছে। তাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করে তিনি বেশ চাপা স্বরে শম্পাকে ফিসফিস করে বললেন, ‘পছন্দ না করলে না করব। ব্যাক আপ দিতে তুমি আছো না?’
শম্পার গা শিরশির করে উঠে। তিনি আখতারকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিয়ে হো হো করে হাসলেন। পুনরায় রসিকতা করে বললেন, ‘হইছে। তহন নয়া বউ পাইয়া পুরাতনের কথা মনেই হইবো না। হুদাই ঢপ দিও না আমারে।’
আখতার ঠেস দিয়ে বলে উঠেন, ‘এহহহহ! এক্কেরে বেশি জানো, না? ক্যান? আমারে না পাইলে কার কাছে যাইবা? নতুন কাউরে পাইছো বুঝি?’
‘ওই কথা কইয়ো না। আমার তোমার মতো এত ভীমরতি নাই। দুইদিন পরে পরে নয়া লাগে না।’
‘মুখ ছুটাইয়ো না। ছুটলে অনেক কথা বাইর হইবো। বড় ভাই দেশে আহনের সময় হইয়া আইছে কিন্তু।’
শম্পা চুপ করে ভোঁতা মুখে ভেংচি কাটেন।
আখতার বললেন, ‘পুতুল তোমার ছোট অনেক। তাই বইলা ওরে যাতবা (যন্ত্রণা করা) না বেশি। তোমার যেমন অধিকার আছে,ওর-ও অধিকার আছে। দুইজন মিলামিশা চইলো।’
শম্পা অবাক হওয়ার ভান ধরে বলেন, ‘বাব্বা!বউ হইতে না হইতেই দরদ উথলায়ে উঠতেছি দেহি!’
‘বউ? কার বউ? পুতুল কার বউ?’ পেছন থেকে ঠিক তক্ষুনি অর্ক’র গলা ভেসে আসে। সে এর আগের কোনো কথা না শুনলেও আসতে আসতেই শেষ কথাটি শুনতে পেল শম্পার। সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা বিস্ময় ঘিরে ধরল তাকে। প্রশ্নটি না করে আর পারল না।
আখতার ঘুরে তাকালেন। শম্পা জবাব দিলেন, ‘ওমা! এই ছেড়ায় দেহি জানেই না কিছু। আইজকা তোমার চাচার গায়ে হলুদ, কাইলকা বিয়া। ওই যে ফর্সা কইরা ছেড়িডা আইছিলো না, ও তোমগো নতুন চাচী। কী? চাচী পছন্দ হইছে তো?’
অর্ক’র কান জোড়া রীতিমতো ভো ভো করে উঠে। শম্পার বাকী কথাগুলো ঠিক ভাবে কর্ণকুহরে না পৌঁছুলেও একটি কথা বারংবার ঘুরপাক খেতে লাগল, ‘পুতুল আখতার চাচার হবু বউ!’
(চলবে)