#প্রণয়ের_তৃষ্ণা (৮)
অলিন্দ্রিয়া রুহি
_____
উত্তরের চালাঘরের টিন উড়ে গেছে। ঘরের সাথে লাগোয়া চাল কুমড়া আর লাউয়ের চাই করেছিল। সেটাও ভেঙে পড়ে রয়েছে। রান্নাঘরের পাশে যে পাঁচ ফিটের মতো জায়গা ঘিরে পারুল সবজি বাগান করেছিলেন, সেখানেও কয়েকটা গাছ গোড়া থেকে উল্টে আছে। মাঝখান বরাবর ভেঙে পড়েছে।
হাসমত আলী কোমরে গামছা বেঁধে নেমে পড়লেন সেসব ঠিকঠাক করতে। তাকে সঙ্গ দিলো প্রিন্স। আর পারুল লাগলেন দুপুরের রান্নার আয়োজনে। পুতুল চুপ করে নিজের ঘরে গিয়ে ঢোকে। কতক্ষণ শুয়ে থাকে। তারপর উঠে এসে ঘরের দাওয়ায় বসে রয়। নির্নিমেষ চেয়ে থাকে আব্বাজানের দিকে। এমন সময় শাপলার উদয় হলো। আজ সঙ্গে কেউ নেই। কালু, রতন, গোলাপী- শাপলা একাই এসেছে। দূর থেকেই সে দেখেছে পুতুল দাওয়ার উপর বসে আছে। তাই সে সরাসরি দাওয়ার সামনে চলে আসে। এমন ভাবে আসে, পুতুল তাকে দেখতে পেয়ে খানিকটা চমকে উঠল। তার অধরে দীর্ঘক্ষণ পর একটুখানি হাসির ঝলক ফুঁটে উঠল।
উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল, ‘তুই?’
কণ্ঠে উচ্ছ্বাস থাকলেও চেহারা মলিন। সজীবতা নেই। কেমন যেন ফ্যাকাশে, আর অনেকটা শুকনোও লাগছে। পুতুল একটু সরে শাপলাকে বসার জায়গা করে দেয়। শাপলা বসতে বসতে বলল, ‘তোরা ঝড়ের মধ্যে ঘরেই আছিলি? আমরা চেয়ারম্যান বাড়িত গেছিলাম। তোগো দেহি নাই।’
পুতুল ধীরগতিতে তার মাথাটা এদিক ওদিক অল্প একটু নাড়িয়ে বলল, ‘না, বাড়িত আছিলাম না।’
‘তাইলে কই গেছিলি?’ শাপলার প্রশ্নে পুতুল প্রথম কয়েক সেকেন্ড থম ধরে থাকল। একটা ভারী দীর্ঘশ্বাস মনের গভীর থেকে ছলকে বেরিয়ে আসে। সে বলল, ‘আখতার চা…’ ঠোঁট ভেঙে ‘চাচা’ শব্দটি বেরিয়ে যেতে নিলে নিজের ঠোঁটের লাগাম টানে সে। ঢোক চেপে অনাকাঙ্ক্ষিত শব্দটিকে গিলে ফেলে। আর বলতে হয় না। এতটুকু থেকেই শাপলা বুঝে ফেলল পুতুলের না বলা বাকী কথাগুলো। সে খানিকটা বিস্ময় এবং খানিকটা বিমর্ষ চিত্তে উদ্বেলিত হয়ে বলে উঠল, ‘আবার ওই বাড়ি? হায়রে! তোর ভাগ্য খালি ওইদিকে টানতাছে কেন তোরে?’
পুতুল হাসে, ‘যার লগে বিয়া হইবো, আজীবন থাকা লাগবো, হেয় তো আমারে টানবোই, টানবো না?’ ঠোঁটে লেগে থাকা হাসির মাঝে লুকিয়ে আছে একদল তাচ্ছিল্য, বিদ্রুপতা।
শাপলার দুঃখ হয়। কেমন যেন সবকিছু উল্টেপাল্টে গেছে। দু’জনেই এরপর খানিকটা সময় চুপ করে রইলো। এইতো, দু’দিন আগেও দু’জনে ঘন্টার পর ঘন্টা বিরামহীন ভাবে কথা বলে গেছে। কোনো আরক্তি নেই, কোনো থামাথামি নেই। তাদের কথার গতিতে মানুষ ডাকতো, ‘বাচাল’ বলে। আজ সেই তারা পাশাপাশি অথচ চুপ। যেন ঠোঁট না নড়লেও মনের খবর মনে মনে আদানপ্রদান হয়ে যাচ্ছে। যেন চোখ এক না হলেও চোখের ভাষা নিঃশ্বাসে ঢুকে অন্তরে গিয়ে মিশছে।
অতঃপর নীরবতা ভেঙে শাপলা ব্যথিত কণ্ঠে বলে, ‘তোর আব্বারে কস নাই? কইলে নিশ্চয়ই মানতো পুতুল।’
পুতুল তাকাল, জলে ভরা নয়ন খানি, শাপলার বুকের ভারটা এবার দ্বিগুণ হয়।
‘আমার বিয়ার শাড়ি পাডাই দিছে। আইজকা গায়ে হলুদ। সবাই কত খুশি, দেখোস না? আমি সবার খুশি কেমনে মাটি কইরা দিই?’
‘তাই বইলা নিজের খুশি মাটি কইরা দিবি? তুই কী মহান? দিল বড়?’ শাপলা চেঁচিয়ে উঠে। অনেকটা রাগ লাগছে বান্ধবীর এই উদারতার উপর, ‘তুই যদি না-ই কইতে পারোস, তাইলে আমি যাই, আমি কই।’
শাপলা পা এগোয়। পেছন থেকে তার শাড়ি খপ করে মুঠোয় নেয় পুতুল। করুণ কণ্ঠে বলে, ‘তোরে আমার কসম, যাবি না। কাউরে কিচ্ছু ক’বি না। এই নে ব।’
শাপলা মানতে নারাজ, বসবে না। পুতুলের সঙ্গে কথাও বলবে না। পুতুল মৃদু হেসে শাপলাকে টেনে নিজের পাশে বসালো। শাপলার মুখাবয়ব নিজের হাতের আঁজলায় তুলে নিয়ে বলল, ‘রাগ কইরা থাকবি? কথা ক’বি না? আইজ বাদে কাইল আমি যামু গা। চাইলেও আর যহন তহন পাবি না আমারে। আইজকা মন ভইরা কথা কইয়া ল শাপলা। আর যদি দেখা না হয় আমগো!’
শাপলা ডুকরে উঠল। ঝাপিয়ে পড়ল পুতুলের গায়ের উপর। দু’হাতে শক্ত করে বাহুডোরের বন্ধনে আবদ্ধ করে নিলো তাকে। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে ভেজা কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তুই এত ভালা ক্যান হইলি পুতুল? খালি মাইনষের কথা ভাবোস। নিজের কথাডা একবারও ভাবোস না। তুই এত ভালা ক্যান? এত ভালা ভালা না রে। তুই বুঝোস না?’
‘বুঝতে চাই না। আমার আব্বা আম্মা ভাই-বোন সবাই ভালো থাকুক।’ ধরে আসে পুতুলের গলাও, ‘তুই এমনে কানতাছোস ক্যান? আমি কী মইরা যাইতাছি? এই ছেড়ি..’ নিজেকে সামলে শাপলাকে বুকের উপর থেকে উঠায় সে। শাপলার চোখজোড়া নিজ হাতে মুছে দিতে দিতে বলল, ‘বা রে! তোর চোখ দুইডা অনেক সুন্দর তো! শাহীন ভাইয়ের লগে দেহা করবার সময় এট্টু কাজল লাগাইয়া যাবি। দেখবি, হের ভালোবাসা বাইড়া গেছে।’
ক্রন্দনে আচ্ছাদিত শাপলার গাল দুটো হালকা লাল হয়ে উঠে লজ্জায়। সে শাপলার বাহুতে আলতো ধাক্কা দিয়ে উচ্চারণ করে, ‘যাহ!’
‘কালকে তুই কাজল লাগাইয়া আইবি। এইটা আমার হুকুম।’
শাপলার চেহারা থেকে মেঘগুলো কেটে গিয়ে রোদ ঝলমলে বিকেল এলো যেন। সে হাসিতে ভেঙে পড়ে। পুনরায় পুতুলের বাহুতে আলতো স্পর্শ করে জবাবে বলল, ‘ধুর! পাগলামি করিস না তো।’
পুতুল নাছোরবান্দা, ‘আমি পাগলামি করতেছি না। তুই আমার কথা শুনোস না দেইখা মেজাজটা গরম হয়। একটা আবদার করছি বান্ধবীর কাছে, এই একটা মাত্র আবদার রাখবি না?’
শাপলা হাসি থামাল, তবে চোখেমুখে উজ্জ্বল দীপ্তি বহমান। কিছুক্ষণ ভেবে ধীর স্বরে বলল, ‘আচ্ছা,পড়ুম।’
‘সত্যি?’ পুতুল উচ্ছ্বসিত হলো এবার।
শাপলা উপরনিচ মাথা দুলিয়ে বলল, ‘হুম। কিন্তু আমি একা পড়ুম না। তোরও পড়া লাগবে।’
‘আমি? আমি তো পড়মুই। কাইল আমার বিয়া। আর আমি সাজুম না? আমারে সবাই মিলা সাজাইয়া গোছাইয়া বিদায় করব দেহিস।’ পুতুল খিলখিল করে হাসে। হাসতে গিয়ে মনে চাপানো ভারী নিঃশ্বাসটা একটু ধাক্কা দিয়ে উঠে। চোখ জ্বালা করে। সে দ্রুত অন্যদিকে তাকিয়ে মন ঘুরায়।
‘কাইল সক্কাল সক্কাল তোরা সবাই চইলা আসিস। আমারে যোহরের পর লইয়া যাইবো।’
শাপলা চুপটি করে রইলো। মুখে কথা নেই। আনমনে নিচু হয়ে পায়ের নখ খুঁটছে। পারুল উঠোন দিয়ে পেছন থেকে সামনের দিকে এলেন। তাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে, তিনি ভীষণ ব্যস্ত। হাসমত আলী কে কিছু একটা বললেন, তারপর যাওয়ার সময় দুই বান্ধবীকে চোখে পড়ায় একটুখানি সময় দাঁড়ালেন। হাঁক ছেড়ে ডাকলেন, ‘ও শাপলা, এদিক আয় দেহি।’
‘কী চাচী?’ শাপলা এক দৌড়ে পারুলের সামনে এসে উপস্থিত হয়।
‘তোর মায়েরে ডাইক্কা আন। দরকার আছে। আর হুন, আইজকা তুই পুতুলের লগে থাকবি। কেমন? তুই ওর সব চাইতে কাছের সই (বান্ধবী)। তোর সইয়ের কাইল বিয়া। আইজ ওর লগে কাউরে না কাউরে থাকা লাগবো। আমি তো কামের লিগা পারুম না, তুই থাহিস?’
এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি! শাপলা ভীষণ ভীষণ খুশি হয়ে উঠল। বিয়েটা যখন হচ্ছেই, পুতুল যখন নিজেকে মনস্থির করে নিয়েছে, তখন নিজের মন খারাপ করে লাভ কী? তার চাইতে বরং পুতুলকে যেভাবে খুশি রাখা যায় এই মুহূর্ত টা সেটা করা উচিত।
শাপলা বলল, ‘আমি এক্ষনি মায়েরে ডাইকা আনতাছি। আপনে কইয়া দিয়েন।’
‘আইচ্ছা।’
পারুল গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন। শাপলা পুতুলকে পারুলের বলা কথাখানি বলে নিজেও ছুটলো বাড়ির পথে….
_____
‘চাচা, আপনি কী করছেন এসব? ওই মেয়েটা আপনার কত ছোট! আপনার যদি সঠিক বয়সে বাচ্চা হতো, তবে সেই বাচ্চাটা ওই মেয়েটার সমান হতো। এইটুকু একটা মেয়েকে আপনি বিয়ে করতে চাইছেন? গ্রামে কী মেয়ের অভাব পড়েছে চাচা?’
একদমে কথাগুলো বলে থামে অর্ক। তার মাথা ভীষণ গরম হয়ে উঠেছে যবে মাত্র শুনেছে পুতুল নাকী তার চাচী হতে যাচ্ছে! শম্পা দুই ভ্রু কুঁচকে ফেললেও আখতার উত্তেজিত হলেন না। তিনি কেমন যেন, অতিরিক্ত ঠান্ডা গলাতেই প্রত্যুত্তর করলেন, ‘তুমি মেহমান। তোমার আব্বা আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বাড়ির দিকে তোমার না নজর দিলেই চলে। তুমি তোমার কাম করতে আইছো, কইরা যাও গা। হুদাই ক্যাচাল কইরো না অর্ক।’
‘না চাচা, আমি অন্যায় একদমই সহ্য করতে পারি না। আমার আপনার উপর রাগ হচ্ছে। যদি পুলিশ জানতে পারে আপনাকে টেনেহিঁচড়ে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে যাবে। সব জেনেও আপনি…’
‘কে? কেডায় আমার কোমরে দড়ি বানবো? নিয়া আহো দেহি..কার এতবড় কলিজা?’ অর্ককে মাঝপথে থামিয়ে দিলেন আখতার, কথাটি বলতে গিয়ে তার ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি ফুঁটে উঠল।
হতাশ হলো অর্ক। গ্রাম্য রাজনীতি সম্পর্কে তার সেরকম কোনো জ্ঞান না থাকলেও আখতারের এই একটি কথায় বুঝে গিয়েছে, পুলিশদেরও ভালো ভাবেই হাত করে রেখেছে এই লোক। তবে অর্ক’র বুঝে আসে না। সামান্য দোকান চালিয়ে আয় যার, তার এত ক্ষমতা কীসের জোরে আসে!
অর্ক হার মানলো না। পুনরায় আখতারকে বোঝানোর উদ্দেশ্যে খানিকটা নরম হয়েই বলল, ‘চাচা, আপনাকে বিয়ে করতে আমি মানা করছি না। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন। এইটুকু মেয়ের জীবন টা নষ্ট করে দিয়েন না প্লিজ। ওর এখন পড়াশোনার বয়স। খেলে বেড়ানোর বয়স। সেখানে আপনি…’
এবার নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করা বেশ মুশকিল হয়ে যায় আখতারের কাছে। তিনি এক হাত তুলে অর্ককে থামার আদেশ দিয়ে গলায় কাঠিন্য যোগ করে বললেন, ‘শোনো বাবা, ওইসব পড়াশোনা তোমগো শহরেই মানায়। আমগো গেরামে মাইয়া মাইনষের পড়াশোনা দিয়া কাম কী? হেরা বড় হইবো, বিয়া হইবো, ছাও ফুঁটাইবো, মইরা যাইবো- শেষ কাহিনি। আর ওই ছেড়ির জীবন আমি নষ্ট করতাছি না বরং বাঁচাইতাছি। ওর বাপে ঠিক মতো তিনবেলা খাওনের জোগাড় করতে পারে না। দামড়ি হইয়া গেছে তাও কেউ বিয়া করে না। দুইদিন বাদে যখন আর সহ্য করতে না পাইরা গলায় দড়ি দিয়া ম’রবো, তহন কী হইবো? তার চাইয়া আমার ঘরে আমার বউ হইয়া থাকলে কোনো সমস্যা আছে? আমি তো কোনো সমস্যাই দেহি না।’
‘কিন্তু চাচা..’
‘তুমি এইসবে জড়াইয়ো না বাবা। তোমার ভালোর লইগা কই, জড়াইয়ো না। যেমনে মেহমানের মতো আইছো, হেমনে মেহমানের মতো চইলা যাও কাম সাইড়া। আর যদি ভালো না-ই লাগে তবে এক্ষুনি যাও গা। দরজা খোলা আছে।’
এ কথার পর আর কোনো কথা থাকে না। অর্ক চুপ করে গেল। অপমানটা গায়ে হজম করার চেষ্টা করল। এই গ্রামে তার চেনা পরিচিত কেউ নেই। শুধুমাত্র বাবার আদেশেই এখানে এসেছিল। এবং এই জমিটা বিক্রি করাও খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শোনা গেছে, একদল চক্রান্তকারীরা জমিটাকে দখলের আশায় ওঁৎ পেতে আছে। তাই যতদ্রুত সম্ভব অন্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে ওরা বাপ-বেটা নিশ্চিন্ত হতে চায়।
কথা বাড়ালো না অর্ক। উত্তপ্ত নিঃশ্বাস গুলো বাতাসে মিলিয়ে দিয়ে ঘরের ভিতর চলে গেল। তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের ক্রুর হাসিটাকে আরেকটু বড় করলেন আখতার। পেছনে দাঁড়ানো শম্পাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘আমার লগে আইছিল কাইজ্জা করবার! আমারে জ্ঞান দিবার চায়! হায়রে… আমার ছাও, আমারেই কয় মেউ!’
শম্পা হাসলেন। অর্ককে উদ্দেশ্য করে একটা মুখ ভেংচিও কাটলেন। আখতারকে বললেন, ‘তাত্তাড়ি এডিরে খেদাইয়া দেও দেওর। ভালোর জন্যি কই।’
‘খেদামু খেদামু, বিয়াডা হইয়া যাক। তারপর কমু জমি বেঁচতে না পারলে দ্রুত বিদায় হও। মাগনা মাগনা আর কয়দিন?’
‘আপনের বন্ধু আবার..’
‘আরে না! ওর লগে সম্পর্ক থাকলে থাকবো না থাকলে নাই। আমি কাউকে পরোয়া কইরা চলি না। জানো না হেইডা?’
শম্পা ভ্রু নাচিয়ে বললেন, ‘জানি জানি, হেইডা জানি।’
_____
মনু মিয়ার জায়গায় শম্পা আর আঁখি এলো। গায়ে হলুদের হলুদ নিয়ে। পুতুলকে থান কাপড়ের কটকটে রঙের হলুদ শাড়ি পরিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে চৌকির উপর। তার পাশে রয়েছে শাপলা, গোলাপী, কালু আরও জনা কয়েক মুরুব্বী। শম্পা পারুলের মাধ্যমে সবাইকে চলে যেতে বলে ঘর খালি করালেন। তারপর নিজে গিয়ে বসলেন একলা পুতুলের পাশে। বাটি থেকে একটুখানি হলুদ নিয়ে পুতুলের গালে ডলে দিলেন। পুতুল নিসাড়,বোবার মতো বসে রইলো। তার চেহারায় কোনো অনুভূতি নেই।
শম্পা এক নজর পুতুলকে দেখে ঠেস দিয়ে বলে উঠলেন, ‘গায়ের রঙ ভালোই তো পাইছো। এই গায়ের রঙ দিয়াই আমার দেওররে কাবু করছো,না?’
পুতুল এবার অবাক হলো। মিনমিনিয়ে প্রশ্ন করল, ‘মানে?’
শম্পা মুখ ভেংচি কাটেন, ‘কিছু না। হুনো, ওই বাড়ির বড় বউ আমি। তুমি হইলা ছোট বউ। ছোট ছোট’র মতোই থাকবা। কোনো ব্যাপারে আগ বাড়াইয়া নাক গলাইতে না দেহি যেন, বুঝছো?’
পুতুল ঘাড় কাত করে। যার অর্থ ‘হ্যাঁ’ তবে সে মনে মনে বলল, ‘ওই বাড়ির কোনো কিছুতেই আমার যায় আসে না। আমারে বন্দী কইরা নিতেছে, আমি বান্দীর মতো থাকুম। এর চাইয়া বেশি কিছু আশাও করি না।’
শম্পা বললেন, ‘তুমি এমনিতে লক্ষী আছো। যা কয় তাই বলে হুনো। আমিও অহন থেইকা যা কমু তাই শুনবা, পালন করবা। তোমার শ্বশুর নাই, শাশুড়ী নাই।মুরুব্বির মধ্যে আমিই আছি।’
পুতুল পুনরায় ঘাড় নাড়ালো। মুখে কিছু বলল না। শম্পা আঁড়চোখে একবার তাকাল। এতোটা চুপচাপ ওর কাছে রহস্য ময় লাগছে। মনে হচ্ছে এই মেয়ে বিয়ের পর ধানিলঙ্কা হয়ে উঠবে। তবে ও-ও কম যায় না। তেলেবেগুনে কীভাবে ভাজতে হয় একজনকে তা খুব ভালো করেই জানা আছে তার।
হলুদে আমন্ত্রিত সবাইকে একটুখানি ফিরনি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হলো। আশেপাশের অনেকে এলো। হলুদ মাখালো, গান-বাজনা করল, কেউ কেউ দুষ্টু টিপ্পনী কাটলো। তারপর ফিরনি খেয়ে বাড়ির পথ ধরল। সবাই চলে গেলে রয়ে গেল শাপলা এবং তার মা।
আজ এক ঘরে শাপলা আর পুতুলকে ঘুমোতে দেওয়া হলো। আরেক ঘরে শাপলার মা আর পারুল। প্রিন্স এবং হাসমত আলী বাহিরে পাটি বিছিয়ে শুয়ে পড়লেন। হাসিবের খবর নেই। বোনের বিয়েতেও সে এলো না। সেই যে ঘর ছেড়েছে, এখন পর্যন্ত তার কোনো খোঁজখবর নেই। বড়টার মতো সেও নিশ্চয়ই বাপ-মাকে ফেলে চলে গেছে নিজের ঠিকানা করতে!
রাত গভীর। আকাশের চাঁদ ডুবে গেলেও খানিকটা আলোকিত প্রকৃতি। বাহিরে টিমটিমে একটা হলদে আলো জ্বলছে। এতক্ষণ ঝিঝি পোকাদের ডাকে কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড় থাকলেও এখন সব চুপ। ক্ষণে ক্ষণে ব্যাঙের ডাক ভেসে আসে। একসময় সেটাও বন্ধ হয়ে গেল। নিশুতি রাতের প্রহর গুলো সেকেন্ডে সেকেন্ডে বাড়ে আর পুরো প্রকৃতি যেন ঘুমিয়ে পড়ে পাল্লা দিয়ে। শুধু ঘুম নেই আজ পুতুলের চোখে। শাপলার চোখে অবশ্য রাজ্যের ঘুম উদয় হয়েছে। কিন্তু সে না ঘুমিয়ে টান টান করে চোখ মেলে আছে।
‘তুই ঘুমাবি না?’ শাপলা প্রশ্ন ছোঁড়ে।
পুতুল বলল, ‘তুই ঘুমা। আমার ঘুম আসতেছে না।’
‘তোরে আগেই কইছিলাম মন না চাইলে চাচারে কইতে। তুই কিছু কস নাই,আমারেও কইতে দেস নাই। এহন হলুদ হইয়া গেছে। এমন সময় যদি বিয়া ভাঙে, কী কেলেঙ্কারি টা হইবো, ভাব একবার।’
পুতুল ভ্রু কুঁচকে তাকাল, ‘আমি কী একবারও কইছি বিয়া ভাঙার কথা?’
‘যদি না চাস তাইলে মন খারাপ কইরা আছোস কেন? একটু হাসি নাই ঠোঁটে।’
পুতুল কথা ঘুরানোর চেষ্টা করে, ‘আমি ওই জন্যে মন খারাপ কইরা নাই। বাপ-মায়রে ফালাইয়া চিরদিনের লইগা চইলা যামু। এইটা ভাইবাই…’
মাঝদিয়ে শাপলা বলে উঠল, ‘হইছে, আমারে বুঝ দিতে আহিস না তো।’
পুতুল চুপ করে যায়। শাপলা পুনরায় কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই তাদের ঘরের জানালায় পরপর দুইবার টোকা পড়ল। পুতুল, শাপলা দু’জনেই কেঁপে উঠে।
পুতুল চিৎকার করে বলতে নিবে, ‘কে?’
তার আগেই জানালার ওপাশ থেকে ভেসে আসে শাহিনের গলা, ‘শাপলা? আছো?’
শাপলা আর পুতুল একে অপরের দিকে তাকাল। দু’জনেই তড়িঘড়ি করে বিছানা ছাড়ে। দরজার কাছে দাঁড়ায় পুতুল, শাপলা গিয়ে দ্রুত হাতে জানালা খুলে দেয়। চোখ কপালে তুলে বলল, ‘তুমি এত রাইতে আইছো কেন? কী হইছে? আর কেমনে খবর পাইলা আমি আইজকা এইনে?’
শাহিন বলল, ‘কেমনে খোঁজ পাইছি, এডি ছাড়ো। একখান খবর দিতে আইলাম। জানো কী হইছে?’
‘কী হইছে?’
‘রুজিনা চাচী..হেরে কেডায় জানি খু’ন করছে। হের লাশ পাওন গেছে আইলের মাঝখানে। রুজিনা চাচীর ভাইরা কইতাছে,এইডা বলে আখতার চাচার কাম। কাইলকে সমাবেশ বইবো এডি নিয়া। আল্লাহই জানে,কী অয়!’
শাপলা-ই না, প্রতিটি কথা শুনে কেঁপে উঠল পুতুলও। তার চোখের পাতায় ভেসে উঠল রুজিনা চাচীর মুখ খানা। সবসময় পুতুলকে দেখলে কী সুন্দর হাত নেড়ে ডাকতেন, এটা ওটা খেতে দিয়ে গল্পে মাততেন। তারপর যাওয়ার সময় সদকার মুরগীটা, ছোট মাছগুলো, অথবা বাগানের একটা লাউ, কখনো বা কবুতরের দুইটা বাচ্চা কোঁচে ভরে দিয়ে দিতেন পারুলের জন্য।
(চলবে)