প্রনয়ের ছন্দ,সূচনা_পর্ব
আনজুম তানিশা
মাথায় বেয়ে গল গল করে রক্ত পড়ছে। মাথা থেকে হাত নামিয়ে একবার হাতের দিকে তো অন্যবার সামনে উপস্থিত মানুষ নামের পাষান অমানুষদের পানে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলাম। মানুষকে সাহায্য করতে এসে বিপদে পড়ে যাবো ব্যাপার টা কমন হলেও আমার জন্য এক নতুন অভিগ্যতা।
পেছন থেকে কেউ একজন ঘাড় বরাবর আবারো বারি মারতেই দাড়ানো থেকে পিচঢালা রাস্তায় হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। চোখ মুখে সবকিছু অন্ধকার লাগছে। আজ হয়ত
জীবনের শেষ দিন। জানি না এরা কে বা কারা। এটাও জানি না কেন মারা হলো আমায়। তবে আন্দাজ করতে পারছি আমার স্বপ্ন ই আজ আমার এই অবস্থার জন্য দায়ী । আর কিছু ভাবতে পারলাম না। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগলাম। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে।
মনে মনে কালিমা পরতে লাগলাম। একজন মুসলিমের জন্য এর চেয়ে সৌভাগ্য আর কিছু নেই।
রাত গভীর!
বৃষ্টি শেষে প্রেম প্রেম পরিবেশে নিরব হাইওয়েতে ড্রাইভ করছে এক সুদর্শন পুরুষ।
সৌডিয়ামের আলোয় রাস্তার কিনারায় রক্তাক্ত কোনো নারীকে পড়ে থাকতে দেখে টনক নড়লো আফ্রামের। অনেক টা দ্বিধা দ্বন্দ নিয়ে বৃষ্টি ভেজা পিচঢালা রাস্তায় নামলো আফ্রাম। মেয়েটির কাছে এসেছে তাকে উল্টাতেই দেখতে পেলো এক রক্তাক্ত এলোকেশী মোহিনীকে।
কিছুনা ভেবে হাতের পার্লস চেক করে মেয়েটিকে কোলে নিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে নিজেও গাড়িতে উঠল। গাড়ি ঘুরিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলো আফ্রাম।
আফ্রাম জানে না কে এই এলোকেশী মোহিনী। কেন তার এই করুন অবস্থা। আফ্রামেের মনে হলো এই এলোকেশী মোহিনীর
করুন অবস্থা রক্ত বিন্দু গুলো চিৎকার করে সাহায্য চাইছে।
আফ্রামের এহেন হঠাৎ আগমনে পাল্টে গেল কারো সাজানো গুটি।
আবার,
দূর থেকে ওদের দিকে পানে চেয়ে কেউ রাগে ফুঁসতে লাগল।
৪ বছর পর…….
আজ ৪ বছর পর নিজের পরিবারের কাছে ফিরে যখন নিজেকে মৃত শুনলাম তখন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। খবর শুনার সাথে সাথে মাথা ঘুরে উঠল আমার। আমার সামনে দাড়িয়ে থাকা মহিলাটি আমায় ধরে বসান।
আমি ওনাকে ধরে জিজ্ঞেস করি,
— আন্টি এই বাড়ির মেয়ে কী ভাবে মারা গেসে? যতটুকু শুনেছি সে তো ঢাকায় থাকত? তার মৃত্যুর কথা কেন বলসে? তার লাঁশ আনা হয়নি? বাড়ির বাকি রা কোথায়? একটু বলবেন?
মহিলাটি প্রথমে বলতে চান নি, পরে অনেক জোর করে কাকুতি মিনতি করায় তিনি বললেন,
— নূর মেয়েটা ভালো আসিলো। ঢাকায় পড়ত হোস্টেলে থাইকা। কিন্তু ৪ বছর আগে কে জানি বলসে ঢাকায় নাকি সে মারা গেসে। তারপর লাশ নাকি পুলিশে নিসে। প্রথমে বিশ্বাস করতে না চাইলেও পুলিশ অফিসার কী কী জানু কইসিলো তারপর বিশ্বাস করে৷ জানো নূরের মা- বাবা কেমন জানি মাইয়া ডার প্রতি তেমন কোনো আগ্রহ দেখায় না। ভাইগো তো খোজ ই নাই। নূরের বাবা মা র তো ডিবোর্স হয়ে গেসে আর তারা এখন আলাদা থাকে। তাদের আবার বিয়ে ও হইসে। সেই ঘরে নাকি দু জনেরই বাচ্চা হইসে। কেউ ই ভালো না। মেয়ে ডা মরে ভালোই করসে নাহলে এই সব দেখতে হইলো তারে। এইসব দেখলে মরেই যাইতো৷
আন্টিটা চলে গেলেন। আন্টি টা আমাদলর পাশের বাড়ির। নেকাপ লাগানো থাকায় চিনতে পারেননি৷ ওনার বলা কথা গুলো শুনে আমি নির্বাক। কী লাভ হলো এত গুলো বছর মৃত্যু র সাথে লড়াই করে এদের কাছে ফিরে। এরা এত সহজে আমার মৃত্যু মেনে নিল সাথে আমার লাশও দেখতে চাইলো না। যার তার কথা বিশ্বাস করে আমায় মৃত মানতে লাগল।
আর দুজনই আবার বিয়ে ও করে ফেলল ছিঃ৷আমার ভাইরাও বিশ্বাস করল সব। আমাকে খুজতে হবে কে এই কাজ করল। কেন আমি এত বড় শাস্তি পেলাম। সবাইকে এর জবাব দিতে হবে।
এগুলো ভাবতে ভাবতে নিজেকে আড়াল করে একবার বাড়ির ভীতর চোখ৷বুলালাম। অচনা এক মহিলা ২/৩ বছরের এক বাচ্চাকে গোসল করাচ্ছেন। হয়ত ইনিই আমার সৎ মা। কিন্তু কোথাও বাবা কে দেখলাম না।হয়ত কাজে আছে। আর ভাবতে পারলাম না। আসতে আসতে হেটে রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে। যেখান থেকে এই মিথ্যে রহস্যের শুরু।
[ আমি নূর ইয়াসমিন। আমার বাবা আলী হোসেন আর মা রিপা বেগমের একমাএ মেয়ে।
আমার বড় দুজন ভাই আছে নিবির হোসেন ও নিশান হোসেন।
আমি যখন ক্লাস টেন এ পড়ি তখন থেকেই আমি ঢাকার মতো অচেনা শহরে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করি। নিবির ভাইয়া চট্টগ্রামের ক্যান্টমেন্ট এর কলেজে পড়াশোনা করত আর নিশান ভাইয়া ভারতের একটা ভার্সিটিতে পড়াশোনা করত।
মোট কথা বাবা মা আমাদের সবসময় নিজেদের থেকে দূরে রাখতেন।
গত ৪ বছর আগে এক দূর্ঘটনার কারনে আমি অসুস্থ ছিলাম। দীর্ষ ৩ বছর প্যারালাইজ্ড থাকার পর যখন সুস্থ হই তখন আমি নিজেকে সিঙ্গাপুর এর এক হসপিটালে আবিষ্কার করি এক বাঙালী দম্পতির বোনের পরিচয়ে। তারপর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বাংলাদেশে এসেই নিজের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় গিয়ে জানতে পারি আমি নাকি মৃত। বাকিটা আপনাদের জানা। ]
???
শেষ বিকালে বৃষ্টির আনাগোনা। লুকোচুরি খেলছে আবহাওয়া। হঠাৎ আকাশের ঘন কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে সূর্য তো আবার আধার সরিয়ে হয়ে যাচ্ছে শুভ্র নির্মল গোধূলি বিকাল।
লুকোচুরি খেলতে খেলতেই এই বুঝি ঝপঝপ করে বৃষ্টি নামলো! ঠান্ডা বাতাসের সাথে গা ভাসিয়ে আফ্রাম দাঁড়িয়ে ছিলো ঘরের বারান্দাটাতে।
মিনিট দশেক হলো সে চেম্বার থেকে ফিরেছে।
হাতে ধোঁয়া উঠা কফির মগ…বাতাসে বৃষ্টির ছন্দ… প্রেম প্রেম ভাব…চারিপাশে সব ঠিকঠাক।
শুধু যথার্থ মানুষের অভাবে এই প্রেমময় সময়টাকে ভাগাভাগি করে নেওয়া যাচ্ছে না।
ইশশ দুঃখ!
পেছন থেকে ডেকে উঠলো আসফিহা খান,
— আফ্রাম….!
মোলায়েম বৃষ্টি বৃষ্টি আবহাওয়া থেকে চোখ সরিয়ে আফ্রাম মায়ের পানে তাকালো। আসফিয়া খান বললেন,
— তোর সাথে দেখা করতে এসেছে ঐ মেয়ের বাবা। আমি নীচে ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রেখেছি।
বিরক্তিতে চোখ মুখ কুচকে উঠলো আফ্রামের। বিরক্তিতে আরক্তনয়নে বলল,
‘ সারাদিন কী করসিলো যে রাত ১২ টায় ই দেখা করতে আসতে হবে। তুমি তাকে খাবারের কিছু দাও আমি আসছি।
আফ্রামের কথা শুনে চলে যেতে লাগলেন আসফিহা খান। আফ্রাম আবারো বৃষ্টি আবেগ পরিবেশে মগ্ন হলো। ধোঁয়া উঠা কফির মগ টা থেকে এখন আর ধোঁয়া উঠছে না।
কফিতে মুখ দিলেই দেখা গেলো কফি ঠান্ডা পানি হয়ে গেছে। তিক্ততায় আফ্রাম বলল,
— কফিটা ঠান্ডা হয়ে গেছে মা, নিয়ে চলে যাও।
আসফিয়া খান ছেলেকে একবার ঠিকঠাক পরখ করে চলে গেলেন। মা চলে যেতেই আফ্রাম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বারান্দার রেলিং ধরে ওই প্রেম প্রেম ভাব পরিবেশটার দিকে তাকিয়ে রইল বিষন্ন মুখে। কেউ কেনো বুঝে না লাইফে একটা প্রপার টাইম থাকে আর সেই টাইমে পারফেক্ট মানুষের এন্ট্রি ঘটে। প্রপার টাইম টা পাওয়ার জন্য লাইফকে এনাফ সময় দিতে হয়। কিন্তু এই বাবা-মা রা না সবসময় তারাহুরো করে। আফ্রামের বিরক্ত লাগে।
এই যে বৃষ্টিশেষে আবারো বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব। আকাশে ঘোমট মেঘে ছাই রঙা রং এ সজ্জিত হওয়ার আভাস। বাতাসে প্রেম প্রেম ছন্দ। ইশশ কি দারুন অনুভূতির গন্ধ! এই সময়টার পার্ফেক্ট একটা নাম দেওয়া উচিত। যে নামে থাকবে বৃষ্টি, প্রেম, ছন্দ এবং তার শুরু ও শেষ।
আফ্রাম তার হালকা গোলাপি ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে মোহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আওড়ালো, প্রনয়ের ছন্দ।
চলবে