#প্রমত্ত_হৃদয়,পর্বসংখ্যা:৩
#লেখনীতে:সারা মেহেক
কুয়াশার চাদরে মোড়া ভেনিস শহর। আকাশে সূর্য্যিমামা লুকোচুরি খেলতে ব্যস্ত। আজ তার শরীরে নেই উত্তাপ। আজ সে ভালোবাসার এ শহরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাতে ব্যস্ত। অথচ গতকাল সে নিজেকে কুয়াশার আড়ালে পুরোপুরি লুকিয়ে ফেলেছিলো। চারপাশ পাখির কিচিরমিচির মিষ্টি মধুর ধ্বনিতে গুঞ্জিত হচ্ছে। সেই সাথে মৃদুমন্দ হাওয়ায় দোল খাচ্ছে ব্যাক ইয়ার্ডে অবস্থিত গাছগুলি।
সূর্যের পানে চেয়ে নিশ্চুপ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে রাগীব৷ ব্যাক ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে নরম সকালের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ব্যস্ত সে। পরনে তার সাদা কালো ট্র্যাকস্যুট। ট্র্যাকস্যুটের উপর দিয়ে বলিষ্ঠ হাতের মাংসপেশি স্পষ্ট চোখে পড়ছে। সূর্যের রূপ উপভোগ শেষে ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়লো সে৷ মৃদু হেসে বিড়বিড় করে বললো,
” লক্ষ্যের দিকে আরো এক ধাপ এগিয়ে আরেকটি শুভ দিনের সূচনা হলো। ”
এই বলে সে শরীর ওয়ার্মআপ করে নিলো। অতঃপর একে একে রোজকার রুটিন অনুযায়ী ব্যায়াম শুরু করলো। ব্যায়ামের ফলে তার বলিষ্ঠ শরীরের মাংসপেশিগুলো প্রতিবার দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। দূর থেকে সেটাই দেখছে সাবিত। তার নজর রাগীবের শরীরে দৃশ্যমান মাংসপেশিগুলো। তার খুব ইচ্ছা ব্যায়াম করে এমন শরীর বানাবে সে। কিন্তু তার বয়স তাকে এ কাজে বাঁধা দিচ্ছে। বারো বছর বয়সে বডি বানানো আর পানির উপর হেঁটে চলা সমান পর্যায়ের অসম্ভব কাজের মধ্যে পড়ে। আর সে অসম্ভব কাজটাকেই মনেপ্রাণে ধারণ করে আছে সাবিত। সামাদকেও সে ব্যায়াম করতে দেখে। রাগীবের মতোও সামাদের এ ধরণের বাইসেপস আছে। সামাদ যখন ব্যায়াম করে তখন সাবিত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখে। আজ অবশ্য ব্যতিক্রম হয়েছে। কারণ আজ সামাদের পরিবর্তে রাগীবের ব্যায়াম করা দেখছে সে।
রাগীব ব্যায়াম করতে করতে দূর থেকে সাবিতকে দেখতে পেলো। সাবিতকে দেখামাত্রই মৃদু হেসে সে ইশারায় তাকে ডাকলো। সাবিত প্রথম দফায় একটু হকচকালো। অতঃপর খানিক ইতস্ততবোধ নিয়ে রাগীবের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। রাগীব ব্যায়াম করা থামিয়ে ভ্রু নাচিয়ে সাবিতকে জিজ্ঞেস করলো,
” কি ব্যাপার ডুড? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছো? ”
সাবিত ইতস্ততভাবে বললো,
” আপনার ওয়ার্কআউট করা দেখছিলাম।”
” ইচ্ছা না কি বাইসেপস বানানোর?”
সাবিত তৎক্ষনাৎ মাথা ঝাঁকিয়ে কৌতূহলী ভঙ্গিতে সম্মতি দিয়ে বললো,
” হ্যাঁ হ্যাঁ খুব ইচ্ছা৷ কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?”
রাগীব মুখ লুকিয়ে হেসে ফেললো। বললো,
” তোমার চোখে স্পষ্ট দেখতে পারছি তোমার ইচ্ছাগুলো। ”
রাগীবের জবাবে সাবিতের কৌতূহল বেড়ে গেলো। সে বললো,
” আপনি দূর থেকেই বুঝে গেলেন!”
” হ্যাঁ। কোনো সন্দেহ? আচ্ছা?তোমার নাম সাবিত না?”
সাবিত এবার চমকালো এবং পূর্বের ন্যায় কৌতূহলী কণ্ঠে আশ্চর্যান্বিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনি আমার নাম জানালেন কি করে!”
রাগীব মুখ লুকিয়ে হেসে ফেললো। অতঃপর কণ্ঠে কৃত্রিম রহস্য প্রকাশ করে বললো,
” টপ সিক্রেট। ”
এই বলে ফিক করে হেসে ফেললো সে। পুনরায় বললো,
” যে বাড়িতে উঠেছি সে বাড়ির হ্যান্ডসাম ছেলেটার নাম জানবো না!”
সাবিত এবার কিছুটা লজ্জা পেলো। এই প্রথম কেউ তাকে হ্যান্ডসাম বলেছে! ইশ তার কত ইচ্ছা, নিজের ক্লাসমেটদের কাছে শুনবে যে সে হ্যান্ডসাম। কিন্তু তার ক্লাসমেটরা এসবের থোরাই কেয়ার করে!
সাবিত নিজের লাজুক ভাবটা লুকাতে বললো,
” আপনিও অনেক হ্যান্ডসাম ভাই। ”
রাগীব প্রত্যুত্তর করলো না। একটু এগিয়ে সাবিতের কাঁধে হাত রাখলো। কণ্ঠে কিঞ্চিৎ বিস্মিত ভাব প্রকাশ করে বললো,
” ডুড! ইতালি থেকেও এতো ফ্লুয়েন্টলি বাংলা কিভাবে বলো তুমি?”
সাবিত মুচকি হাসলো। বললো,
” আমাদের বাসায় কেউ ইতালিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলে না। ছোট থেকেই আমাকে বাংলা বলা শিখিয়েছে। এ কারণেই এতো ভালো বাংলা বলি। কিন্তু বাড়ির বাইরে বের হলে আবার ইতালিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলি। ”
” গ্রেট! তোমার স্কুল নেই?”
” হ্যাঁ। দশটার সময় স্কুল। ”
এভাবে গল্প করতে করতে রাগীব ও সাবিত ব্যাক ইয়ার্ডের সবুজ ঘাসের উপর বসে পড়লো। দুজনের মাঝে টুকটাক গল্প চলতে লাগলো। এটুকু সময়ের মধ্যেই সাবিত রাগীবের সাথে একদম ফ্রি হয়ে গিয়েছে। তারা দুজনে এমন ভাবে কথা বলছে যেনো তারা একে অপরের বহু পুরোনো বন্ধু।
হঠাৎ উপর থেকে ঝিরঝির করে পানি পড়ায় চমকে উঠলো দুজনে৷ তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়িয়ে পানির উৎস খুঁজতে উপর তাকালো তারা।
সাবিত দেখলো ব্যালকনিতে বড় স্প্রে বোতল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সাবিহা। তার বুঝতে বাকি রইলো না, সাবিহা ব্যালকনিতে তার সযত্নে রাখা গাছগুলোয় পানি দিতে দিতে তাদের প্রায় ভিজিয়ে দিয়েছে। সাবিত কিছুটা রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,
” কি আপু! চারপাশ দেখে পানি দিবে তো! আমাদেরকে তো ভিজিয়ে দিলে।”
সাবিহা জিহ্বা কামড়ে বললো,
” সরি রে। আমি দেখতে পাইনি তোকে। ”
এই বলে সে সাবিতের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় এক সুদর্শন পুরুষকে দেখতে পেলো। কিয়ৎক্ষণের জন্য তার দৃষ্টি স্থির হলে। কিন্তু তৎক্ষনাৎ সে নিজেকে সামলে নিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলো,
” এই সকাল সকাল কোন স্ট্রেঞ্জারকে ঘরে ডুকিয়ে এনেছিস সাবিত? আব্বুকে জানাবো তোর এ কাজের কথা?”
সাবিত কোমড়ে হাত দিয়ে ক্ষীণ প্রতিবাদী সুরে বললো,
” রাগীব ভাই কোনো স্ট্রেঞ্জার না। আমাদের নিউ পেইং গেস্ট। ”
সাবিহা কিছু বলার প্রস্তুতি নিলেও নিজেকে সামলে নিলো। ছোট্ট করে জবাব দিলো,
” ওহ। ”
পরমুহূর্তেই পূর্ণ উদ্যমে বললে উঠলো,
” স্কুলে যাওয়ার প্রিপারেশন না নিয়ে সকাল সকাল আড্ডা দিতে বসেছিস! আব্বু জানলে কানের নিচে দু চারটা ঘা বসিয়ে দিবে একদম। ভেতরে আয় জলদি। ”
এই বলে সে আড় চোখে রাগীবের দিকে তাকালো। রাগীব এক দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। সে তাকাতেই এক নিমিষের জন্য তাদের দৃষ্টি বিনিময় হলো। কিঞ্চিৎ হকচকিয়ে উঠলো সাবিহা৷ অতঃপর তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে রুমের ভেতরে চলে গেলো সে। তার যাওয়ার পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রাগীব৷ মুগ্ধ হেসে বিড়বিড় করে বললো,
” টুডে ইজ মাই সানসাইন ডে। ”
.
আঁধারে ঘেরা রিডিং রুমে বসে আছেন আফসার সাহেব৷ ল্যাম্পের হলদে আলোতে মোটা একটা বইয়ে মুখ গুঁজে আছেন তিনি। তাঁর চেহারায় অস্বাভাবিক গাম্ভীর্যতা৷ দৃষ্টি তীক্ষ্ণ।
কিছুক্ষণ বাদে অনুমতি নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো সামাদ। আফসার সাহেবের সামনে অবস্থিত একটি চেয়ারে বসলো সে৷ তাকে দেখে দৃষ্টি উঠালেন না আফসার সাহেব৷ তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এখনও বইয়ের প্রতিটা অক্ষরে নিবদ্ধ।
রিডিং রুমে অস্বাভাবিক নিরবতা বিরাজ করছে। এই নিরবতা গমগমে কণ্ঠ দ্বারা ভাঙলেন আফসার সাহেব। দৃষ্টি বইয়ের পাতায় রেখে সামাদকে জিজ্ঞেস করলেন,
” যা বলেছিলাম তা করেছো? ”
সামাদ বাধ্য ছেলের ন্যায় জবাব দিলো,
” হ্যাঁ খালু। একদম সেইফভাবে করেছি। ”
আফসার সাহেব প্রত্যুত্তর করলেন না৷ ঠোঁটের কোনে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে পুনরায় মনোযোগী হয়ে উঠলেন।
#চলবে