প্রমত্ত_হৃদয়,০২

0
2628

#প্রমত্ত_হৃদয়,০২
#জনরা: রোমান্টিক সাসপেন্স থ্রিলার
#লেখনীতে:সারা মেহেক

সকাল হতেই সূর্য্যিমামার দেখা নেই৷ উপরন্তু আজ ভেনিসের আকাশটা গুমোট হয়ে আছে৷ দেখে মনে হচ্ছে, এই বুঝি বুক চিড়ে কেঁদেকেটে সে শহরটা ভাসিয়ে দিবে। এমনই মেঘলা শীতল দিনে প্রত্যহের অলস সকালটা পূর্বের তুলনায় আরো বেশি অলসতায় ছেঁয়ে উঠে।
আজ সকালে ভেনিসের তাপমাত্রা চার ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত রেকর্ড করা হয়েছে। সাধারণত জানুয়ারি মাসে এখানকার তাপমাত্রা এমনই শীতল থাকে। কখনও কখনও তাপমাত্রা শূন্যের নিচে নেমে আসে।

অলস সকালের অলস সময়টা ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে সাবিহা৷ কিন্তু তার শান্তির ঘুমে এক বালতি জল ঢেলে দিলো সাবিত। সাবিহার অগোচরে চুপিচুপি রুমে প্রবেশ করলো সাবিত। ধুপধাপ পা ফেলে সাবিহার পাশে এসে দাঁড়ালো সে। অতঃপর সাবিহার কানের কাছে স্বাভাবিকের চেয়ে উচ্চ আওয়াজে বলে উঠলো,
” আপু….. সকাল হয়ে গিয়েছে! তাড়াতাড়ি ওঠো।”

আচমকা কানের কাছে সাবিতের কণ্ঠস্বর শুনে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো সাবিহা। বিস্মিত চাহনিতে চারপাশ তাকিয়ে পরিবেশ সম্পর্কে অবগত হলো সে। বড় বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো। অতঃপর চট করে পাশ ফিরে সাবিতের উদ্দেশ্যে গরম চোখে চেয়ে বললো,
” সাবিতের বাচ্চা সাবিত। তোর সমস্যাটা কি? ছুটির দিনটাতেও শান্তিতে ঘুমাতে দিবি না?”

সাবিত দাঁত কেলিয়ে বললো,
” নাহ৷ আমার ঘুম ভেঙে গিয়েছে, তো তোমাকে আরামে কি করে ঘুমাতে দেই বলো। ”

সাবিহা আর কথা বাড়ালো না। এভাবে হঠাৎ ঘুম ভাঙায় তার মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। এ খিটখিটে মেজাজ নিয়েই সে ব্ল্যাঙ্কেট সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে পড়লো। সাবিতের দিকে তীক্ষ্ণ নজর নিক্ষেপ করে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো৷

ডাইনিং এ বসে ব্রেড ও বাটার খাচ্ছে সাবিহা। তার এক হাতে ফোন ও অপর হাতে ব্রেড। ধীরেসুস্থে খেতে খেতে নিউজফিড স্ক্রল করছে সে৷
বাড়ির বাকি সদস্যদের সকালের খাবার শেষ হয়েছে আরো আগে। রোজ রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় সাবিহা একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠে। এজন্য এ দিনটায় পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে তার সকালের নাস্তা করা হয়ে উঠে না৷

সাবিহার খাবার খাওয়ার মাঝেই ডাইনিং এ এসে বসলো সামাদ। তার চোখে এখনও ঘুমের রেশ রয়েছে। এই সাবিত যদি আজ তাকে ডেকে না তুলতো তবে নির্ঘাত দুপুর বারোটা পর্যন্ত ঘুমাতো সে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি।
সামাদকে ডাইনিং এ দেখে সাবিহা জিজ্ঞেস করলো,
” কি সামাদ ভাই? আজ মনে হচ্ছে একটু জলদিই উঠে পড়লে?”

সামাদ লম্বা একটা হাই ছেড়ে অলস ভঙ্গিতে বললো,
” আর বলিস না। সাবিত আমাকে ঘুমাতে দিলো না। ছুটির দিনের ঘুমটাও নষ্ট করে দিলো ও। ওকে যে কিভাবে শিক্ষা দিবো বুঝে পাই না৷ ”

সামাদের সাথে সাবিহাও তাল মিলিয়ে বললো,
” আমিও তাই ভাবছি সামাদ ভাই। ওকে একটা শিক্ষা দিতেই হবে। নিজে তো ঘুমায় না৷ আবার আমাদেরও ঘুমাতে দেয় না। ”

তাদের কথার মাঝে হঠাৎ উদয় হলো সাবিত। আফসার সাহেবের জন্য নির্দিষ্ট রাখা চেয়ারটায় বসলো সে। ভ্রু নাচিয়ে বাঁকা হেসে জিজ্ঞেস করলো,
” আমাকে নিয়ে ডিসকাস করছো মনে হয়?”

সামাদ বিরক্তিভরা চাহনিতে সাবিতের দিকে একবার তাকালো। অতঃপর আচমকা সাবিতের মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
” নেক্সট স্যারাটডে থেকে তোকে রাতে খাটের সাথে বেঁধে রেখে তারপর আমরা ঘুমাবো। এতে করে যদি সানডেটা একটু শান্তিতে কাটাতে পারি তো…..”

সামাদের মারা গাট্টায় ব্যাথায় ‘আহ’ শব্দ করে উঠলো সাবিত। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে চোখমুখ কুঁচকে অভিযোগের সুরে বললো,
” হোয়াট ইজ দিজ সামাদ ভাই? আমাকে এভাবে মারছো কেনো? ”
এই বলে সে মাথার অবিন্যস্ত চুলগুলো বিন্যস্ত করতে করতে স্বগোতক্তি করে বললো,
” উফ! আমার চুলগুলোই নষ্ট করে দিলো এরা। ”

বারো বছর বয়সী সাবিতের এ ফ্যাশনসচেনতা দেখে সামাদ ও সাবিহা মিটিমিটি হাসতে লাগলো। সাবিতের এ ফ্যাশন সচেতনতা সম্পন্ন মনমানসিকতা সম্পর্কে বাড়ির প্রত্যেকেই অবগত৷ এই বয়সে সাবিতের এমন আচরণ নিয়ে সামাদ ও সাবিহা মাঝে মাঝেই মজা করে। কিন্তু এ ব্যাপারটা অবশ্য সাবিতের একটুও পছন্দ না। তার অভিযোগ, ছোট হয়েছি বলে কি একটু আধটু স্টাইলও করতে পারবো না! ব্যস, সাবিতের এ কথা নিয়েও সামাদ ও সাবিহা মজা করা শুরু করে দেয়।

” আচ্ছা তোরা থাক। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি। ”
এই বলে সামাদ চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো। ততক্ষণে সাবিহার খাওয়াদাওয়াও শেষ হয়ে গিয়েছে। খাওয়া শেষে ডাইনিং এর চেয়ারে বসে বসে সে ফোন চালাতে লাগলো। বেশ কিছুক্ষণ পর পানি খাওয়ার জন্য গ্লাস হাতে নিতেই তার চোখ আটকে গেলো ব্যাক ইয়ার্ডে অবস্থিত গেস্ট হাউজের উপর।
গেস্ট হাউজের দরজার সামনে বেশ কিছু জিনিসপত্র রাখা। সেগুলো দেখে সাবিহা কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো। সন্দেহের সুরে সাবিতকে জিজ্ঞেস করলো,
” সাবিত? গেস্ট হাউজ পরিষ্কার করছে না কি?”

সাবিতও ফোনে মনোযোগী হয়ে উঠেছিলো। সাবিহার প্রশ্নে তার মনোযোগ ভাঙলো। কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো। মুখ দিয়ে ‘চ’ বর্ণের ন্যায় শব্দ উচ্চারণ করে ফোন রেখে গেস্ট হাউজের দিকে তাকালো সে। নিমিষের পর্যবেক্ষণ শেষে পুনরায় সে ফোনে মনোযোগী হলো। হেলাফেলা করে বললো,
” নতুন পেইং গেস্ট এসেছে৷ তারই জিনিসপত্র রাখা ওখানে। ”

পেইং গেস্টের কথা শুনে সাবিহা ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। সাবিতকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
” কবে এসেছে? ”

সাবিত ফোনে মুখ গুঁজেই বললো,
” আজই এসেছে। ”

” ইতালীয়ান?”

” উঁহু। বাঙালী। ”

পেইং গেস্ট হিসেবে তাদের বাসায় বাঙালী উঠেছে বলে খুশিতে সাবিহার চোখজোড়া চকচক করে উঠলো। কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” নাম কি রে?”

” জানি না। তবে এটুকু জানি, উনি ছেলে। ”

সাবিহা এবার ফাটা বেলুনের ন্যায় চুপসে গেলো। তার অতি উৎসাহী, কৌতূহলী ভাবটা নিমিষেই উবে গেলো। কারণ পেইং গেস্ট হিসেবে সে একজন মেয়েকে আশা করেছিলো৷ ভেবেছিলো, নিজের বাড়িতে সার্বক্ষণিক একজন বান্ধবী হিসেবে একটা মেয়েকে পাবে সে। ইশ কতদিন বাঙালি কোনো মেয়ে বন্ধুর সাথে মন খুলে কথা বলে না সে! কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। শেষমেশ পেইং গেস্ট হিসেবে কি না একটা ছেলে তাদের বাড়িতে উঠলো! কিন্তু সে ভেবে পেলো না, তাদের বাবা পেইং গেস্ট হিসেবে একজন ছেলেকে রাখলো কি করে? বাবাকে এ নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবে সে? নাহ, এ নিয়ে জিজ্ঞেস করাটা কেমন যেনো হয়ে যায়।
এসব ভাবতে ভাবতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সাবিহা। উদ্দেশ্য গেস্ট হাউজে গিয়ে নতুন আগত পেইং গেস্টের চেহারা দর্শন করা।

.

বন্ধ ফ্যাক্টরির ভেতরে খালি একটা জায়গায় চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে সামাদ। তার হাতে লোডেড পি’স্তল। তার চোখেমুখে সুপ্ত রাগ, চোখজোড়া রক্তবর্ণ। তার সামনে আতঙ্কে সময় কাটাচ্ছে সেই যুবকটি যে সাবিহাকে গতকাল উ’ক্ত্য’ক্ত করেছিলো।
যুবকটির পুরো শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার। প্রাণের ভয়ে তার দু চোখ বেয়ে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সে হাতজোড় করে সামাদের উদ্দেশ্যে বললো,
” ভাই আমারে ছেড়ে দেন। আমি তো আপনাদের দেশের মানুষ। দেশের মানুষ হিসেবে ছেড়ে দেন।”
প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে আকুতি করা যুবকটির কথায় গললো না সামাদ। হিং’স্র চাহনিতে চেয়ে ফিচেল হাসি দিয়ে বললো,
” সাবিহাকে ডিস্টার্ব করার সময় এই ‘দেশের মানুষ’ কথাটা মাথায় আসেনি তোর?”

যুবকটি ত্রস্ত কণ্ঠে বললো,
” ভুলে গেছিলাম ভাই। আর জীবনেও এমন করবো না। এবারের মতো মাফ করে দেন৷ ”
এই বলে সে তৎক্ষনাৎ এগিয়ে এসে সামাদের পা ধরে কাঁদতে থাকে। বলে,
” ভাই,আমারে মারবেন না। ভাই…..”

সামাদ যুবকটির আকুতিভরা কণ্ঠ সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করে ধাক্কা দিয়ে বললো,
” দেশ থেকে এখানে এসেছিস আয় রোজগারের জন্য। কিন্তু এখানে এসেও তুই সেই নিচু স্বভাবটা ছাড়তে পারিসনি। তোকে তো একটা শাস্তি না দিলেই না। ”

” ভাই, আমার ভুল হয়ে গেছে। আপনি বললে আমি কালকেই দেশে ফিরে যাবো। ”

সামাদ যুবকটির কথায় গুরুত্ব দিলো না। জিজ্ঞেস করলো,
” তোর সাথে আরেকটা ছিলো না? ঐটা কোথায়? ঐ ইতালিয়ানটা?”

যুবকটি পূর্বের ন্যায় বললো,
” ও কোথায় জানি না আমি। আমারে ছেড়ে দেন ভাই। আমি এ দেশ ছেড়ে চলে যাবো। মাফ করে…. ”

সামাদ যুবকটিকে স্বপক্ষের কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে হাতে থাকা পি’স্তলটি যুবকটির দিকে তাক করলো। আচমকা নিজের দিকে পি’স্তল তাক হতে দেখে যুবকটির আত্মা শুকিয়ে গেলো। ক্ষণিকের জন্য সে যেনো বাকশক্তিহীন হয়ে পড়লো। কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই তার বুকে পরপর দুটো গু’লি বিঁধিয়ে দিলো সামাদ। গু’লির শব্দে নিস্তব্ধ পরিবেশটা হঠাৎ-ই সরব হয়ে উঠলো। ক্ষণিকের মাঝেই যুবকটি তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো। অতঃপর সামাদের ঠোঁটের কোনে ফুটলো তৃপ্তির হাসি।

যুবকটির লা’শ বদ্ধ ফ্যাক্টরিতেই ফেলে সামাদ বেরিয়ে এলো। রাস্তা পেরিয়ে গাড়িতে উঠতে নিলো সে। কিন্তু গাড়িতে উঠার পূর্বেই তার চোখ আটকে গেলো অদূরে অবস্থিত গাছের আড়ালে থাকা শায়িত একটি শরীরের উপর। আচমকা প্রায় এ জনমানবশূন্য এলাকায় এভাবে কাউকে শুয়ে থাকতে দেখে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো সে। ক্ষণিকের চিন্তা ভাবনা শেষে কৌতুহলবশত সে এগিয়ে গেলো সেদিকে। গিয়ে দেখলো এটা কোনো মানুষ নয়। এটি লা’শ এবং লা’শটি অন্য কারোর নয়, বরং সেই ইতালিয় যুবকটির যার নাম লুকা।লুকাকে মৃত অবস্থায় দেখে বিস্ময়ে সামাদের চক্ষুজোড়া বড় হয়ে এলো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here