#প্রমত্ত_হৃদয়,০৮
#লেখনীতে:সারা মেহেক
#ক্যাটাগরি:রোমান্টিক সাসপেন্স থ্রিলার
গিয়াস সাহেবের জানাজা হতে মাত্রই অফিসে ফিরলেন আফসার সাহেব। তার মুখশ্রীর রূপরেখা একই সাথে চিন্তিত এবং গভীর তকলিফে জরাগ্রস্ত। এক প্রিয়জন হারানোর ধাক্কায় তার বয়স যেনো পঞ্চান্ন হতে হুট করে বেড়ে সত্তরের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে। সবসময়ের তারুণ্যপূর্ণ চেহারায় আজ বার্ধ্যকের ছাপ স্পষ্ট।
আফসার সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে কেবিনে পায়চারি করছেন। কিছুতেই নিজেকে শান্ত করাতে পারছেন না। উপরন্তু গিয়াস সাহেবের মৃ’ত্যুর খবর তাকে ভেতরে ভেতরে দুশ্চিন্তায় কুঁড়ে খাচ্ছে। মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী গিয়াস সাহেবের মৃ’ত্যু হার্ট অ্যাটাকে হয়েছে। কিন্তু এটি মানতে নারাজ তিনি৷ একজন সুস্থ সবল মানুষ, যার কোনো প্রকার রোগবালাই নেই, সে অকস্মাৎ হার্ট অ্যাটাকে কি করে মারা গেলো! এটিই তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না৷
” আসবো খালু?”
দরজার ওপার হতে কিঞ্চিৎ মাথা ঢুকিয়ে জিজ্ঞেস করলো সামাদ। অপ্রত্যাশিতভাবে সামাদের কণ্ঠস্বর শুনে ভড়কে উঠলেন আফসার সাহেব। মুহূর্তমধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে মলিন মুখে বললো,
” হ্যাঁ, এসো এসো। ”
সামাদ কেবিনের ভেতরে চলে এলো। আফসার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো,
” লাঞ্চ কোথায় করবেন খালু? ব্রেকফাস্টও তো করেননি। ”
আফসার সাহেব হেঁটে গিয়ে নিজের চেয়ারে বসলেন। টেবিলের উপর হাত রেখে কপাল ভর দিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে এলেন। ম্লানমুখে বললেন,
” পেটে একটুও ক্ষুধা নেই সামাদ। গিয়াস সাহেব এভাবে হুট করে মারা যাবেন, এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না। ”
সামাদ নরম গলায় সান্ত্বনামূলক বাণী শোনাতে উদ্যত হলো৷ বললো,
” মেনে নেওয়ার চেষ্টা করুন খালু। যে চলে গিয়েছে তাকে তো আর ফিরিয়ে আনা যায় না। আজ হোক কাল হোক মেনে নিতেই হবে। ”
” তা ঠিক বলেছো তুমি। উনি আমার সব কাজের পার্টনার ছিলো। তবে আমাদের মধ্যে পার্টনারশিপ কম বন্ধুত্ব ছিলো বেশি। ও খুব ভালো ছিলো। ”
আফসার সাহেবের শেষোক্ত কথায় সামাদ আড়ালে নাক সিঁটকালো। সে জানে গিয়াস সাহেবের আসল রূপ। মেয়ে ঘটিত বিষয়ে গিয়াস সাহেব শীর্ষে থাকে। এটা সামাদের অজানা নয়। কিন্তু আফসার সাহেবের সামনে এ বিষয়টি কখনো সে তুলতে পারেনি। তুলতে পারেনি বললে ভুল হবে। সে ইচ্ছে করেই সত্যটা লুক্কায়িত রেখেছে। কারণটা ব্যবসায়িক সম্পর্ক।
সামাদ আফসার সাহেবের কথার সাথে সম্মত জানানোর ভান করলো। বললো,
” ঠিক বলেছেন খালু। আমাদেরকে বিজনেস ম্যাটারে অনেক হেল্প করতেন তিনি। এখন শুধু আফসোস ছাড়া আর কিছুই করা সম্ভব নয়। ”
আফসার সাহেব সামাদের কথার প্রত্যুত্তর করলো না। বরং ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে টেবিলের উপর হতে একটি ফাইল নিয়ে তাতে মনোযোগ নিবিষ্ট করার চেষ্টা করলেন। সামাদ বললো,
” লাঞ্চের ব্যবস্থা এখানেই করলাম খালু। আর হ্যারিকে কি বলবো কালকের মিটিংটা ফিক্সড করতে?”
আফসার সাহেব ফাইলে মুখ গুঁজেই বললেন,
” হ্যাঁ বলে দিও। মিটিং এর ইচ এণ্ড এভরি ডিটেইল আমাকে সন্ধ্যায় জানিয়ে দিও। ”
” ওকে খালু।” এই বলে সামাদ কেবিন হতে বেরিয়ে গেলো। সে চলে যেতেই আফসার সাহেব পুনরায় কাজে মনোযোগী হতে প্রচেষ্টা চালালেন।
.
দিনটি বেশ ঝকঝকে। নভস্থলে উষ্ণ সূর্যের হাতছানি। তবে তার উষ্ণতা হিম শীতল পরিবেশের প্রকোপে ঢাকা পড়েছে। চারপাশে সোঁ সোঁ করে হিম অনল বইছে। সেই অনলের ছোঁয়ায় মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে সাবিহা। L’Osteria di Santa Marina এর বহিরাংশে বসে আছে সে ও সোফিয়া। তাদের আশেপাশে এমনই অনেক টেবিলে বসে আছে বহু মানুষজন। তাদের মাঝে অনেকে স্থানীয় এবং অনেকেই পর্যটক। প্রত্যেকেই নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত। L’Osteria di Santa Marina এর পাশে বয়ে চলা রাস্তা ধরে হেঁটে চলছে নানান পেশা ও বয়সের মানুষ। প্রত্যেকের চালচলনে দেখা মিলছে সুক্ষ্ম ব্যস্ততার ছাপ। তবে কারোর মাঝে নেই কোনো তাড়াহুড়োর চিহ্ন।
সেখানের চেয়ারে বসে হট কফি খাচ্ছে সাবিহা আর সোফিয়া। কফির উষ্ণতা শরীরের মধ্যকার আস্তরণে মৃদু ষদুষ্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। শরীরকে করে তুলছে চাঙা। আজ সাবিহার মননে সতেজতা বিরাজ করছে। মেজাজটাও বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। সে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেই সোফিয়া তার সামনে ব্লাইন্ড ডেটের প্রস্তাব রাখে। প্রথম দফায় বার কয়েক ‘না’ বললেও পরবর্তীতে সাবিহা এতে ঠিকই রাজি হয়ে যায়। কারণ সে জীবনটা কিছু আমোদপ্রমোদে কাটাতে চায়। আর কতদিন এ রঙহীন জীবন যাপন করবে সে! বাপ ভাইয়ের ভয়ে নিজেকে ছেলেঘটিত সকল ব্যাপার থেকে সর্বদা গুটিয়ে রেখেছে সে। কিন্তু আর কতদিন!
সোফিয়া জানায় জর্জের সাহায্য নিয়ে সে ব্লাইন্ড ডেটের জন্য ছেলে খুঁজবে। সাবিহাও এতে রাজি হয়ে যায়। তবে এই প্রথম এ ধরণের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হওয়ার কথা মাথায় এনে সে খানিক চিন্তিত হয়ে পড়ে। দ্বিধাদ্বন্দ নিয়ে সোফিয়াকে জিজ্ঞেস করে,
” আচ্ছা, ছেলেটার ক্যারেক্টার যদি খুব খারাপ হয় তবে?”
সাবিহার প্রশ্নে সোফিয়া মৃদু শব্দে হেসে উঠলো। বললো,
” দ্যাটস হোয়াই ইটস কল্ড ব্লাইন্ড ডেট সাবিহা। এখানে তোমরা একে অপরের সম্পর্কে কিছুই জানবে না। তোমাদের ফার্স্ট মিটিংই হবে ডেটের দিন। ”
সাবিহা প্রত্যুত্তর করলো না। সে এই ব্লাইন্ড ডেট নিয়ে একদিকে যেমন উদ্রিত তেমনি অপরদিকে চিন্তিত। সোফিয়া পুনরায় হাসিমুখে বললো,
” আই থিংক হি উইল বি গুড। বাট প্লিজ ডোন্ট ওয়ারি। তুমি যাস্ট নিজের মতো প্রিপারেশন নিতে থাকো। ”
সাবিহা ছোট্ট করে উত্তর দিলো,
” হুম। ”
সোফিয়া সাবিহার এ উদ্বেগপূর্ণ ভাব দূর করতেই উৎসাহমূলক কণ্ঠে বললো,
” খুব বেশি ডাউট থাকলে নিজের সাথে প্রটেকটিভ কিছু রাখতে পারো। আর তোমার কিসের চিন্তা সাবিহা? তুমি ক্যারাটে পারো, শ্যুট করতে পারো। সেল্ফ প্রটেকশনের জন্য আর কি দরকার বলো। তবে আমার মনে হয় না এসব কিছুর প্রয়োজন হবে। ”
এ পর্যায়ে সাবিহা নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়। কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে সোফিয়াকে বলে,
” জর্জকে বলে দিও, সে যেনো ছেলেটাকে বলে রাখে, আমি কোনোপ্রকার রুম ডেটে যেতে পারবো না। আমাদের মিটআপ যাস্ট এ রেস্টুরেন্ট এরিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ হবে। ”
সোফিয়া হাসিমুখে বললো,
” ওকে ডান। এ বিষয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। তুমি শুধু ব্লাইন্ড ডেটের দিকে নিজেকে ফোকাস রাখো। আর কালকেই কিন্তু ডেট ফিক্সড করবো আমি। কারণ আগামীকাল হলিডে। আজ আমরা বিকেলে শপিং করে বাসায় ফিরবো। আর কালকে তুমি ডেটের জন্য বের হবে। উফ,সাবিহা, আই এম সো এক্সাইটেড। ”
সাবিহা তাল মিলিয়ে বললো,
” আই এম অলসো। ”
এ বলার পরমুহূর্তেই তার মুখটা কালো হয়ে এলো। সে পুনরায় উদ্বিগ্নতার সহিত বললো,
” আমি বাসায় কি বলবো সোফিয়া? তোমার বার্থডের দিন যে কান্ড হয়েছে, এরপর আমাকে রাতে বাড়ির বাইরে থাকতে দিবে কি না সন্দেহ। ”
” ডোন্ট ওয়ারি সাবিহা। আই উইল ম্যানেজ। ”
সোফিয়ার অসংশয়মূলক বাচনে সাবিহা দূর্ভাবনাহীন হলো। মিষ্টি হেসে সোফিয়াকে ধন্যবাদ জানালো।
সে রাতেই সাবিহা ও সোফিয়া একত্রে শপিং করলো। চলমান আবহাওয়া শীতল হওয়ায় পরিচিত এক ফ্যাশন হাউজের উইন্টার আউটফিট কালেকশন হতে সাবিহার জন্য ড্রেস কেনা হলো। লাইট ব্লু রঙের জিনস, স্কাই ব্লু রঙের ছোট হাতার ছোট টপস ও অফ হোয়াইট রঙের একটি জ্যাকেট ও স্কার্ফ পছন্দ করে কিনলো সাবিহা। তার সাথে সোফিয়াও নিজের জন্য দুটো টপস কিনলো।
.
স্বল্প সময়ের অপেক্ষায় হাজির হলো দিনটি। সাবিহার ব্লাইন্ড ডেটের দিন। ব্লাইন্ড ডেট নিয়ে আজ চরম উতলা সে। আজ তার মাঝে ভীত ভীত সে অনুভূতিটি নেই। কারণ সে সোফিয়ার বাসায় আজ রাতে থেকে মুভি দেখার পরিকল্পনা সম্পর্কে তার বাবা ও মা’ বলেছে। দুজনই সাবিহাকে এ ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছে। ব্যস এখন ব্লাইন্ড ডেট নিয়ে আর চিন্তার কারণ কি!
ভেনিসের আকাশে সন্ধ্যে নামতেই নির্দিষ্ট পোশাক পরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সাবিহা। গন্তব্য সেই
L’Osteria di Santa Marina রেস্টুরেন্ট। বেছে বেছে সে পরিচিত রেস্টুরেন্টেই দেখা করতে চেয়েছে। কারণ প্রথম দফায় ব্লাইন্ড ডেটের অপরিচিত ব্যক্তি, অপরিচিত রেস্টুরেন্ট, সব মিলিয়ে নিদারুণ এক বিদঘুটে এবং অস্বস্তিকর পরিবেশে পড়ে সে দিশেহারা হয়ে পড়তো। এজন্যই পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিতে পূর্ব পরিচিত রেস্টুরেন্টকেই বেছে নিয়েছে সে।
গাড়ি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে সাবিহা রেস্টুরেন্টের বহিরাংশের নির্দিষ্ট নাম্বারের টেবিলের দিকে দৃষ্টিপাত করে। কালো জ্যাকেট পরিহিত একটি লোককে সেই নির্দিষ্ট চেয়ারে বসে থাকতে দেখে ক্ষণিকের জন্য তার হৃদপিণ্ড ধক করে উঠে। কণ্ঠনালী অল্পবিস্তর শুকিয়ে আসে। তবে শুকনো একটি ঢোক গিলতেই কণ্ঠনালী তুলনামূলক স্বাভাবিক হয়ে আসে। লোকটি সাবিহার দিকে পিঠ করে বসে আছে। ফলে দূর হতে সাবিহা তার চেহারার দর্শন করতে ব্যর্থ হলো। দু কদম অগ্রসর হওয়ার পরও সে লোকটির পশ্চাত অংশ দেখা ব্যতিত পার্শ্ব চেহারা দেখতে ব্যর্থ হলো। ফলে সে লোকটির সম্মুখ দর্শন করতে টেবিলের দিকে অগ্রসর হলো। ধীর পদে টেবিলের নিকটে দাঁড়িয়ে লোকটির সম্মুখে দাঁড়াতেই সাবিহা ………
চলবে