প্রমত্ত_হৃদয়❤️,১০

0
1018

#প্রমত্ত_হৃদয়❤️,১০
#লেখনীতে:সারা মেহেক

ধীরে ধীরে রাগীবের অন্তঃস্থলে ক্রোধের অনল পুঞ্জীভূত হলো। কিন্তু সাবিহার সম্মুখে নিজের অন্তরালের প্রবল ক্রোধ সে বহিঃপ্রকাশ হতে দিতে চায় না৷ ফলে ক্রোধের অনল মেটাতে দু হাতের মুঠো শক্ত করে ধরলো সে। কিন্তু তার সম্মুখ পানে সাবিহা দাঁড়িয়ে থাকায় চেহারার অঙ্গভঙ্গি স্বাভাবিক রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালালো সে। এদিকে সাবিহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাগীবকে জিজ্ঞেস করলো,
” আব্বুর খুশির জন্য আমার কি বিয়েতে রাজি হয়ে যাওয়া উচিত?”

রাগীব চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলো। মৃদু হাসার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে বললো,
” চলুন, আমার রুমে বসে এ ব্যাপারে ডিটেইলস এ কথা বলি। ”

রাগীবের নিকট জবাবের অপেক্ষা থাকা সাবিহা ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
” আচ্ছা চলুন৷ ”

রাগীব সাবিহার সম্মুখ প্রান্ত হতে সরে গিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
” আফটার ইউ। ”

সাবিহা আর কথা বাড়ালো না৷ ধীর পদে হেঁটে হেঁটে রাগীবের রুমে প্রবেশ করলো। পিছে রাগীব শক্ত হাতের মুঠোয় আরো জোর দিয়ে নিজের ক্রোধ প্রশমিত করার চেষ্টা করলো। সাথে ঠোঁট দিয়ে বড় বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে এ চেষ্টাকে আরো সফল করার চেষ্টা করলো। বিড়বিড় করে স্বগোতক্তি করলো,
” এটা আপনি ঠিক করেননি। মোটেও ভালো কাজ করেননি আপনি। ”
এই বলে সে রুমে প্রবেশ করেই ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি পান করলো৷ ওদিকে সাবিহা রুমে অবস্থিত সোফাটিতে বসে উদাস চাহনিতে রুমের প্রতিটি জিনিস দেখতে লাগলো। রুমের জানালার ধারে অবস্থিত সোনালি রঙের উইন্ড কাইমটা মৃদু শব্দে টুংটাং ধ্বনি তুলছে। মিষ্টি এ ধ্বনি বাতাসে যেনো কোনো বিরহের ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে। হয়তো এরই মাধ্যমে চলমান হাওয়া সাবিহার মনোবস্থার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
রাগীব গ্লাস রেখে অস্থিরতার সহিত ছোট্ট একটি টুল টেনে সাবিহার সম্মুখপানে বসলো। কালবিলম্ব না করে সাবিহাকে জিজ্ঞেস করলো,
” বিয়েতে আপনার কি মত? ”

সাবিহা রাগীবের পানে চাইলো। স্মিত হাসলো। বললো,
” আমি আমার আব্বু আর আম্মুকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি৷ এই দুইজন আমার কাছে যা চাইবে আমি স্বেচ্ছায় তাই দিয়ে দিবো। আব্বু খুশিমনে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আবার এ বিয়ের সাথে আব্বুর মান সম্মানও জড়িত। সো, একজন মেয়ে হিসেবে আমি কখনোই চাইবো না আব্বুর মান সম্মান হার্ট হোক। রাইট?”

রাগীব সন্দেহাতীত চাহনিতে সাবিহার পানে চেয়ে আছে। সাবিহার কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন ও কথার মোড় পরিবর্তিত হতে দেখে তার মাঝে সন্দেহের পরিমাণ গাঢ় হতে লাগলো। সে অনুমান করলো, সাবিহা নিশ্চয়ই তার অপছন্দের সিদ্ধান্তটিই নিবে। রাগীবের এই সন্দেহকেই যেনো হাতেনাতে প্রমাণ করতে চাইলো সাবিহা। ফলস্বরূপ সে বললো,
” আমিও চাই না আব্বুর মান সম্মানে কোনো আঘাত আসুক। এজন্য আমি বিয়েটা করবো।”

রাগীবের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো। সে সাবিহার নিকট হতে এমন সিদ্ধান্ত মোটেও আশা করেনি। হ্যাঁ, সে অনুমান করেছে এ ব্যাপারে। কিন্তু সে কখনোই চায়নি তার অনুমান সঠিক হোক। এটা তো কখনো হওয়ার কথা ছিলো না৷ অকস্মাৎ সাবিহার বিয়ের খবরটা যেনো বিনা মেঘে বজ্রপাতের ন্যায় আঘাত হানলো। রাগীব যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা চালালো। কিঞ্চিৎ বিস্মিত কণ্ঠে সাবিহাকে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনি কি শিওরলি ডিসিশনটা নিলেন?”

” ইয়াহ। ”

” এতো বড় ডিসিশন নিলেন কখন? প্রথমে আপনাকে দেখে মনে হয়নি, আপনি বিয়েতে একমত। কিন্তু এখন এভাবে হুটহাট ডিসিশন শুনিয়ে দিলেন!”

সাবিহা ম্লান হাসলো৷ বললো,
” মাঝেমধ্যে কিছু কিছু ডিসিশন এভাবে হুটহাটই নিতে হয় এবং শুনিয়ে দিতে হয়। এখন তাহলে আসি।”
এই বলে সে উঠে দাঁড়ালো। রাগীবকে দ্বিতীয় কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে দরজার দিকে পা বাড়ালো৷ দু পদ এগিয়েই তার কদম থমকে গেলো। তার যে যেতে মন চাইছে না। মন চাইছে, আজীবন এখানেই রয়ে যাক সে৷ কিন্তু বাস্তবতার বেড়াজালে যেমন সব স্বপ্ন পূরণ হয় না৷ তেমনই রাগীবকে চিরতরে নিজের করে পাওয়ার যে নব্য অভিপ্রায় তার মনে জেগে উঠেছিলো সেটাও পূরণ হওয়ার নয়৷ সাবিহাই একমাত্র জানে, তার মনের মাঝে কেমন উথাল-পাতাল ঝড় আরম্ভ হয়েছে। অস্থির অনুভব করছে সে৷ এ অশান্ত ঝড়কে সে থামাবে কি করে। কিভাবে নিজেকে সান্ত্বনা দিবে?
সাবিহা কিয়ৎক্ষণ সে স্থানেই দাঁড়িয়ে রইলো। ক্ষণিক বাদে ঘাড় ঘুরিয়ে রাগীবরে পানে চাইলো৷ অতঃপর নিজেকে সান্ত্বনা দিতেই রাগীবকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো,
” আমি বিয়ে করবো, সে যতই পিছুটান থাকুক না কেনো। ”

সাবিহার এহেন কথায় রাগীব হকচকালো। প্রশ্নাতুর চাহনিতে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” কোন পিছুটানের কথা বলছেন সাবিহা?”

” সব প্রশ্নের উত্তর দিতে নেই। ”
এই বলে সে কোনোপ্রকার কালবিলম্ব না করে গেস্ট হাউজ হতে বেরিয়ে গেলো। রাগীব সাবিহার এ অদ্ভুত আচরণে ভীষণ অবাক হলো। স্বগোতক্তি করে বললো,
” হঠাৎ সাবিহা এমন উদ্ভট আচরণ করলো কেনো? ও কি কিছু মিন করে গেলো?”

রাগীব ভাবতে লাগলো। সাবিহার আচরণ, চাহনি, বাচনভঙ্গি, তার প্রতিটা পদক্ষেপ কল্পনায় চলমান রেখে কিছু অনুমান করলো। অবশেষে তার অনুমান ও প্রত্যাশা দুয়ে দুয়ে মিলে চার হলো। ভীষণ খুশিতে প্রজ্জ্বলিত নয়নে হাত মুঠো করে ‘ইয়েস’ বলে উৎফুল্লতা প্রকাশ করলো রাগীব। সাবিহার উদ্দেশ্যে হাওয়ায় মিলিয়ে বললো,
” এটলাস্ট, আই এম সাকসেসফুল। ইফ আই এম নট রং, ইউ আর ইন লাভ মিস সাবিহা তাসনিম। এই দিনটারই তো অপেক্ষায় ছিলাম। নাউ ওয়েট এন্ড ওয়াচ শ্বশুর মশাই। আপনার মেয়েকে কিভাবে আপনার নাকেরই নিচ দিয়ে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করি। ”
এই বলে রাগীব বাঁকা হাসলো। সে তার পরিকল্পায় সফল এবং তার অনুমানকৃত সময়ের তুলনায় সে দ্রুতই সফলতা পেয়ে গিয়েছে।

.

পাখির কিচিরমিচির ধ্বনির মাধ্যমে ভেনিসে হিম প্রভাতের আরম্ভ হলো। সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়লো নিজ নিজ কাজে। সাবিহা গ্রুপ এসাইনমেন্টের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের দু ঘণ্টা পূর্বেই ভার্সিটি চলে গিয়েছে। সালমা বেগম সার্ভেন্টদের বলে সকালের নাস্তা রেডি করাচ্ছেন৷ আজ তার শরীর খারাপ বলে রান্নার কাজটা সার্ভেন্ট দিয়েই করিয়ে নিচ্ছেন। অন্যান্য সময় হলে নিজ হাতেই রান্না করে স্বামী সন্তানকে খাওয়াতেন তিনি।

ব্যাক ইয়ার্ডের লনে মনমরা হয়ে একা একা ফুটবল খেলছে সাবিত। আজ তার স্কুল বন্ধ। পাশে নেই কোনো খেলার সঙ্গী। হঠাৎ ফুটবলে পা চালাতে চালাতে তার রাগীবের কথা মনে পড়লো। কোনোপ্রকার কালবিলম্ব না করেই ফুটবল ফেলে সে গেস্ট হাউজের ভেতর চলে এলো। রাগীব তখন গেস্ট হাউজের ছোট্ট রান্নাঘরে ওমলেট বানাতে ব্যস্ত। আর ঘন্টাখানেকের মাঝে অফিসে ছুটতে হবে তার। এরই মাঝে সাবিতকে রুমে উপস্থিত হতে দেখে রাগীব রান্নাঘর থেকেই হাঁক ছেড়ে বললো,
” কি ব্যাপার ডুড? হঠাৎ এখানে কেনো?”

রাগীবের কণ্ঠস্বর শোনামাত্রই সাবিত রান্নাঘরে ছুটে গেলো। খানিক হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
” ব্রেকফাস্ট করছো রাগীব ভাই?”

রাগীবের তখন ওমলেট বানানো শেষ। সে ওমলেটটা প্লেটে তুলে কিচেন টাওয়াল দিয়ে হাত মুছতে মুছতে সাবিতের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। বললো,
” এখনও করিনি। করবো। চলো, তোমার সাথেই আজকের ব্রেকফাস্ট করি। ”

সাবিত বললো,
” না রাগীব ভাই। আমি এখনই ব্রেকফাস্ট করবো না। চলো না, আমার সাথে একটু ফুটবল খেলো। একা একা খেলতে ভালো লাগছে না।”

” এখন?”

” হুম এখন। অফিসে যাওয়া তো দেরি আছে। চলো না একটু খেলি। ”

সাবিতের কাছে রাগীবকে হার মানতে হয়। সে ওমলেটটা রেখেই সাবিতের সাথে লনে চলে এলো। অতঃপর দুজনে ব্যাক ইয়ার্ডেই ফুটবল খেলতে লাগলো। তাদের খেলার মাঝে প্রবেশ করলো সামাদ। সাবিতের উদ্দেশ্যে কৃত্রিম দুঃখ প্রকাশ করে বললো,
” কি ব্যাপার সাবিত? নতুন পার্টনারকে পেয়ে পুরোনোকে ভুলে গেলি। গুড গুড। আমার কাছে আর কিছুর আবদার করে দেখিস। ”

সামাদের কথায় রাগীব ঠোঁট টিপে হাসতে লাগলো। এদিকে সাবিত পড়লো বিপাকে। সামাদের এরূপ হুমকিতে সে খানিক ঘাবড়ে গেলো। তৎক্ষনাৎ রাগীবকে উপেক্ষা করে সামাদের নিকট চলে এসে বললো,
” এমন কিছুই না সামাদ ভাই। আমি একটু বোর হচ্ছিলাম বলেই রাগীব ভাইকে খেলার জন্য ডেকেছি। তুমিও তো আজকাল সময় দাও না৷ তো কার সাথে খেলবো আমি বলো। ”
এই বলে সে ঠোঁট উল্টে দুঃখ প্রকাশ করলো। সাবিতের এহেন দুঃখ প্রকাশের ভঙ্গি দেখে রাগীব ও সামাদ একত্রে হো হো করে হেসে উঠলো। সামাদ বললো,
” চল তিনজনে একটু খেলি। ”

সামাদের এ প্রস্তাবে সাবিতের চোখ চকচক করে উঠলো। সে উত্তেজিত হয়ে বললো,
” ওকে ওকে ডান। ”
এই বলে সে সামাদের দিকে বল পাঠিয়ে দিলো। অতঃপর তিনজনে একত্রে ফুটবল খেলতে লাগলো। আধ ঘণ্টার খেলাধুলা শেষে রাগীব ও সামাদ অফিসের জন্য রেডি হতে চলে গেলো। বিশ মিনিটের মাঝেই তারা রেডি হয়ে ব্যাক ইয়ার্ডে উপস্থিত হলো। সামাদ রাগীবকে গাড়িতে উঠার জন্য অফার করলে রাগীব সে প্রস্তাব আর নাকচ করলো না। অতঃপর দুজন একত্রে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। পথিমধ্যে চললো দুজনার মাঝে ব্যবসা বিষয়ক আলাপ আলোচনা, চললো নিজেদের পরিবার সম্পর্কে টুকটাক জানাশোনা। এতে করে তাদের মাঝে একে অপরকে নিয়ে সহানুভূতি তৈরী হলো। তাদের সম্পর্কের খানিক উন্নতি হলো। এতে অবশ্য সামাদের কোনো সুবিধা লুক্কায়িত না থাকলেও রাগীবের স্বার্থ ও সুবিধা লুকিয়ে ছিলো, যা সামাদ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here