#প্রমত্ত_হৃদয়❤️,১১
লেখনীতে:সারা মেহেক
কৃষ্ণকায় অম্বরে গাঢ় ধূসর রঙের মেঘপুঞ্জের মেলা বসেছে। কনকনে শীতল আবহাওয়াতেও গোটা ভেনিস নগরী আঁধারে নিমজ্জিত নগরীতে পরিণত হয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে গোটা শহর সিক্ত করে দিয়ে যাবে। সেই সাথে দিয়ে যাবে কয়েকদিনের হাড়কাঁপানো শীতের আগমনী বার্তা। বাংলাদেশের ন্যায় ভেনিসেও শীতকালে বর্ষার আগমন হয়। তবে তার স্থায়িত্ব ক্ষণিকের। কিন্তু ফল সুদূরপ্রসারী।
আমেরিকান একটি কোম্পানির সাথে বিজনেস মিটিং বলে আজ আফসার সাহেব ও সামাদ নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে অফিসে পৌঁছে গিয়েছে। সালমা বেগম একা একা রুমে বসে মেয়ের বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের তালিকা তৈরী করছেন৷ গতকাল রাতেই সাবিহার সাথে তাঁর কথা হয়েছে। তবে এ কথোপকথনের স্থায়ীত্ব খুব বেশিক্ষণের ছিলো না। সাবিহার সিদ্ধান্ত শোনামাত্র সালমা বেগম কিছু প্রশ্ন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আফসার সাহেবের ডাক পড়ায় মেয়ের সাথে বসে সম্পূর্ণ খোলামেলা আলাপ করতে পারনেনি তিনি। তবে যেহেতু আফসার সাহেব একবার এ বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন, সেহেতু সাবিহা ‘হ্যাঁ’ বলুক বা ‘না’ বলুক, আফসার সাহেব নিজ পছন্দ অনুযায়ী এ বিয়ে দিয়েই ছাড়বেন। এক্ষেত্রে সাবিহার একমত থাকায় আফসার সাহেবের সুবিধাই হয়েছে। জোরজবরদস্তি করতে হবে না মা -মেয়ের সাথে।
সাবিহা কিছু বলার উদ্দেশ্য নিয়ে তার বাবা মায়ের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। রুমের বাইরে হতেই সালমা বেগমকে কিছু লিখতে দেখে সে রুমের ভেতর অগ্রসর হলো না। উল্টো পায়ে ব্যাগ কাঁধে নিচে নেমে এলো। অপূর্ণ ইচ্ছেগুলির ভারে তার মনটা ভীষণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত। গতকাল হতেই নয়া অনুভূতির জাগানিয়া তার মনটা উদাসীনতায় ছেয়ে আছে। তার মন কুঠির সুখী নেই। বরং এটি দুঃখের ছায়ায় ছেয়ে গিয়েছে। আর এ দুঃখ কেনো যেনো অস্থায়ী নয়, স্থায়ী। এমনটা অবশ্য সাবিহা ভাবছে। কারণ তার মনের অরণ্যে যে ‘রাগীব’ নামক সুপুরুষটি স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করে দিয়েছে৷ সে ভাবছে, কি করে তার মন হতে রাগীবের আবাসস্থল মিটিয়ে দেওয়া যায়। কি করে তার নতুন জীবনে আগ্রহী হওয়া যায়। উঁহু, গতকাল সম্পূর্ণ রাত ভেবেও কোনো কাজ হলো না। তবে কি আজীবন রাগীব তার হৃদয়ে স্থায়ী সিলমোহরের ন্যায় ছেপে থাকবে?
সাবিহা অন্যমনস্ক হয়ে দরজা খুললো। অমনিই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামতে আরম্ভ হলো। মন খারাপের মেঘমালা চিঁড়ে অকস্মাৎ বর্ষিত হওয়া ক্রন্দন স্বরূপ বাদলের বিন্দু বিন্দু ফোঁটা দিয়ে মুহূর্তেই চারিধার অস্পষ্ট হয়ে এলো। সাবিহা কিয়ৎক্ষণ বর্ষণমুখর বাতাবরণের দিকে চেয়ে রইলো। অতঃপর ক্ষীণ তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
” আমি কাঁদতে পারছি না বলে তুমি কাঁদছো?”
সাবিহার কথার প্রত্যুত্তর স্বরূপই যেনো আন্তরীক্ষ হতে আলোর ঝলকানি দিয়ে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। গগন কাঁপানো শব্দে বাতাবরণ কেঁপে উঠলেও কেঁপে উঠলো না সাবিহা। এ সামান্য বিদ্যুৎ চমকানোতে ভীত হয় না সে। অন্যান্য সাধারণ মেয়েরা যেখানে ভয়ে চমকে উঠে, চিৎকার করে উঠে, সেখানে সাবিহা স্বাভাবিক থাকে। এটা আজই প্রথম নয়। ছোটবেলা হতেই সে এমন। তার চরিত্র কখনো প্রস্তরের ন্যায় দৃঢ়, মজবুত তো কখনো কর্দমের ন্যায় মোলায়েম, ভঙ্গুর। প্রিয়দের সামনে সে কর্দম। তবে অপ্রিয়দের সামনে সে প্রস্তর।
অকস্মাৎ রাগীবের কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলো সাবিহা। চমকিত দৃষ্টিতে সম্মুখ পানে চাইলো। কালো গাড়ির ড্রাইভিং সিটের জানালা দিয়ে রাগীবকে দেখা যাচ্ছে। মোলায়েম হাসিতে লেপ্টে থাকা তার গাঢ় বাদামী বর্ণবিশিষ্ট ঠোঁটজোড়া স্থির। দৃষ্টিজোড়ায় খানিক কৌতূহল, খানিক ব্যস্ততা। ঘোর বর্ষনের অস্পষ্ট ছোঁয়ায় ছেয়ে উঠা পরিবেশে রাগীব সাবিহার সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাবিহাকে ছাতা হাতে দেখে রাগীব গলার স্বর উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে বললো,
” চলুন, আপনাকে ভার্সিটি ড্রপ করে দিয়ে আসি। সাবিতও যাচ্ছে। ”
রাগীবের কথা শেষ হওয়া মাত্রই সাবিত ব্যাগ কাঁধে নিয়ে এক প্রকার দৌড়ে এসে গাড়ির ব্যাক সিটে বসে পড়লো। অতি দ্রুততার সহিত ছুটে চলা সাবিতের ছোট্ট দেহটিতে বৃষ্টির কয়েক ফোঁটা লেপ্টে রইলো। গাড়িতে উঠেই সে ফোঁটাগুলোকে চামড়ার জ্যাকেট হতে ছিটকে ছিটকে দূরে সরিয়ে দিলো। রাগীবকে বললো,
” রাগীব ভাই, হারি আপ। না হলে ক্লাসে লেট হয়ে যাবো। ”
রাগীব সাবিতের কথা কর্ণগ্রাহ্য করলো। ফলে পূর্বরে তুলনায় দ্বিগুণ ব্যস্ততার সহিত সাবিহাকে বললো,
” সাবিহা দ্রুত উঠে বসুন। সবারই লেট হয়ে যাচ্ছে।”
সাবিহা কোনোরূপ কথা উচ্চারণ করলো না।মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় হেঁটে গিয়ে রাগীবের পাশে গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসে পড়লো। তার এহেন কাজে বৃষ্টির ফোঁটাগুলি তাকে একান্তভাবে আপন করে নিলো। ফলে পুরু উলের সোয়েটারটার অর্ধেকাংশই ভিজে গেলো। তবে সে এর পরোয়া করলো না। সে যে এখন মন্ত্রমুগ্ধ! অদ্ভুত, যে মানুষটির নিকট হতে সে নিজেকে বিরত রাখবে সে মানুষটির প্রেমেই ঘনঘন নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলছে সে! রাগীব যেনো তার জাদুর কাঠি নাড়িয়ে সাবিহাকে মুহূর্তেই ব’শ করে ফেলেছে! সাবিহা ঢের টের পাচ্ছে, রাগীব তার প্রিয়দের তালিকায় নাম ছাপিয়েছে। ফলে সে ইচ্ছে সত্ত্বেও রাগীবের সাথে কঠোর হতে পারছে না। বরং সে ফুলের ন্যায় মোলায়েম হয়ে রাগীবের সামনে থাকতে চাইছে। রাগীবের ভালোবাসা পেতে চাইছে। সে জানতে চাইছে না এর ভবিষ্যত। সে শুধু মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে চাইছে। গভীর হতে গভীরতরভাবে রাগীবের প্রেমের পড়তে চাইছে সে। তার জন্য কাল নতে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া রাগীবকে পেতে চাইছে সে। আদৌ কি তার এ চাওয়া-পাওয়া পূর্ণ হওয়ার যোগ্য? সে জানে না। কারণ এ মুহূর্তে সে ঘোরে আছে। রাগীবের ঘোরে।
গাড়ি আপন গতিতে ছুটে চলছে। চলমান গাড়ির কাঁচের জানালায় বেরঙা বৃষ্টির ফোঁটা সম্মিলিত হয়েছে। গাড়ির গতির ফলে বৃষ্টির ফোঁটাগুলি বেয়ে বেয়ে একে অপরের সাথে মিশে নিম্নমুখে বেয়ে পড়ছে। নব্য আগত বৃষ্টির ফোঁটাগুলি কাঁচের জানালায় বাড়ি খেয়ে মৃদু ধ্বনির সূচনা ঘটাচ্ছে। সেই ধ্বনিরই তালে বিমোহিত হয়ে রাগীব আড়চোখে সাবিহাকে দেখছে। আধো আঁধারিয়া পরিবেশে সাবিহার স্নিগ্ধ চেহারাখানা আরো স্নিগ্ধ হয়ে উঠেছে। কি স্নিগ্ধ লাগছে সাবিহাকে দেখতে!
সাবিহাও রাগীবকে দেখছে। তবে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে দেখছে সে। এ প্রেমময় দর্শনের ফলে মাঝে মাঝে রাগীবের আঁখিজোড়ায় তার স্নিগ্ধ আঁখিজোড়া আবদ্ধ হচ্ছে। তৎক্ষনাৎ নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে সে। কিয়ৎক্ষণ বাদে পুনরায় রাগীবকে দেখছে সে।
সাবিহার ভার্সিটির সামনে এসে রাগীব গাড়ি থামালো। সাবিতকে আরো প্রায় পনেরো মিনিট আগে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে এসেছে সে। এবার সাবিহার পালা৷ গাড়ি ভার্সিটিতে থামিয়ে রাগীব বললো,
” আপনার ভার্সিটি চলে এসেছি। নামবেন না?”
সাবিহার মিষ্টি ঘোর কাটলো। বার কয়েক আঁখিপল্লব ফেললো সে। অতঃপর নিমিষের জন্য বিস্তৃত হেসে বললো,
” হ্যাঁ, নামবো। ”
এই বলে সে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজা খুললো। নামার পূর্বে ছাতাটা মেলে ধরে সাবধানে পা ফেললো। কংক্রিটের রাস্তায় তৈরী হওয়া ক্ষুদ্রতর একটি গর্তে জমে থাকা পানিতে মুহূর্তেই তার সাদা ধবধবে কেডস সিক্ত হয়ে পড়লো। অন্য সময় হলে সাবিহা খানিক বিরক্তি প্রকাশ করতো। তবে আজ করলো না। দু পা নামিয়ে গাড়ি হতে বেরিয়ে পড়লো সে। ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক পিছনে ফিরে রাগীবের পানে চাইলো। অতঃপর মুচকি হেসে নিজ গন্তব্যে যাত্রা আরম্ভ করলো। রাগীব অগোচরে সাবিহাকে ফিরতি হিসেবে মৃদু হাসি উপহার দিলো। কিয়ৎক্ষণ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে গাড়ি ঘুরাতে লাগলো সে৷ হঠাৎ ফোনের রিংটোন কর্ণপাত হতেই সে গাড়ি পূর্বের জায়গায় ফিরিয়ে আনলো। কোটের পকেট হতে ফোন বের করতেই স্ক্রিনে ‘এন্ড্রু’ নামটি জ্বলজ্বল করে ভেসে উঠলো। কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঞ্চিত করে কোনো প্রকার কালবিলম্ব বাদে সে কল রিসিভ করলো। তৎক্ষনাৎ ওপাশে এন্ড্রু’র অস্থির কণ্ঠ ভেসে এলো,
” স্যার, আপনাকে অতি দ্রুত সিসিলি ব্যাক করতে হবে। ”
®
#চলবে