প্রমত্ত_হৃদয়❤️,১২

0
1286

#প্রমত্ত_হৃদয়❤️,১২
লেখনীতে:সারা মেহেক

সিসিলি শহরের অভ্যন্তরে সুবিশাল এক রাজপ্রাসাদের ন্যায় বাসভবনে প্রবেশ করলো রাগীব। পরনে তার কালো প্যান্ট, সাদা শার্ট ও কালো কোট। চাহনি গম্ভীর এবং উদ্বিগ্ন। অন্তস্থলে বিরাজমান তীব্র অস্থিরতা। তার এ অস্থিরতার কারণ তার প্রিয়জন। যে প্রিয়জনের টানে সে কোনোরূপ বিচারবিবেচনা ব্যতিত ভেনাস হতে সিসিলি ছুটে এসেছে।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে কব্জির কাছে কোটের স্লিভ উঠিয়ে ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। এগারোটা পঞ্চাশ বাজে। বাহিরে ঘুটঘুটে কালো আঁধার। যা রাতের অন্যতম প্রতীক। সিসিলির আবহাওয়া অনেকটা ভেনিসের মতোই। আজ সিসিলিতেও বৃষ্টি হচ্ছে। তবে তার গতি ধীর। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে গগন কাঁপিয়ে নামছে বজ্রপাত। দেখা মিলছে আলোর ঝলকানি।
রাগীব সিঁড়ি বেয়ে উঠে দোতলার তিন নাম্বার রুমে প্রবেশ করলো। তার পিছু পিছু প্রবেশ করলো তার দেহরক্ষীগণও। রুমে প্রবেশ করতেই রাগীবের অস্থির দৃষ্টিজোড়া গিয়ে ঠেকলো বিছানায় শুয়ে থাকা বৃদ্ধ লোকটির উপর। যে লোকটি সম্পর্কে তার বাবা হয়। যার নাম রাজীব শাহরিয়ার।

রাগীব ধীর পায়ে তার বাবার দিকে এগিয়ে গেলো। তার বাবার পাশে কর্তব্যরত একজন ডাক্তার বসে আছেন। রাগীবকে এগিয়ে আসতে দেখে তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। রাগীব বিনাবাক্যে সেই চেয়ারে গিয়ে বসলো। কিয়ৎক্ষণ তার বাবার দিকে অপলক চাহনিতে চেয়ে রইলো। অতঃপর ধীর এবং গম্ভীর তবে সিক্ত কণ্ঠে বললো,
” আমাকে ছেড়ে যেতে খুব ইচ্ছা করে তোমার?”

রাজীব সাহেব কোনো জবাব দিলেন না। নির্বাক রইলেন। তার এ নির্বাক পরিস্থিতির পিছনের কারণ, তিনি কোমায় আছেন। বাবার কাছে কোনো জবাব না পেয়ে রাগীব প্রশ্নটি পুনরায় করলো। কিন্তু এবারও সে জবাব পেতে ব্যর্থ হলো। অতঃপর সুদীর্ঘ তপ্ত শ্বাস ফেলে ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” হাউ ইজ দ্য ফিজিক্যাল কন্ডিশন?”

ডাক্তার স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন,
” আফটার দ্য ইঞ্জেকশন, নাউ হি ইজ কোয়াইট স্ট্যাবল।”

রাগীব হতাশার নিঃশ্বাস ছাড়লো। জিজ্ঞেস করলো,
” এনি ইম্প্রুভমেন্ট ডক্টর?”

ডাক্তার নত মস্তকে অতি দুঃখের সহিত বললো,
” নো, মিস্টার রাগীব। দেয়ার ইজ নো ইম্প্রুভমেন্ট ফ্রম প্রিভিয়াস কন্ডিশন৷ হি ইজ এজ বিফোর। ”

রাগীব আর কথা বাড়ালো না। কিয়ৎক্ষণ রাজীব সাহেবের দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইলো। অতঃপর তাঁর মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বললো,
” দ্রুত সুস্থ হয়ে যাও বাবা। আই ব্যাডলি নিড ইউ।”
রাগীবের আঁখিজোড়া সিক্ত হয়ে এলো। চোখের কোনায় জমলো এক বিন্দু জল। কিন্তু তা গড়িয়ে পড়ার পূর্বেই হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চক্ষুকোটরে আবদ্ধ অশ্রু মুছে ফেললো সে। অতঃপর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। কর্তব্যরত ডাক্তারের নিকটে গিয়ে আবেগঘন কণ্ঠে বললো,
” আই ডোন্ট নো, হাউ টু থ্যাংক ইউ ডক্টর। বাট…..”

রাগীবের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই মধ্য বয়স্ক ডাক্তারটি অমায়িক হেসে বললো,
” ইটস ওকে ডিয়ার। যাস্ট প্রে ফর ইউর ফাদার। নাথিং এলস। ”

রাগীব মৃদু হেসে ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক রাজিব সাহেবের দিকে চাইলো। অতঃপর রুম থেকে বেরিয়ে চলে এলো। তার পিছু পিছু বেরিয়ে এলো তার দেহরক্ষীগণ। তন্মধ্যে একজনকে উদ্দেশ্য করে ইতালিয় ভাষায় রাগীব বললো,
” অনিককে আমার সিসিলি আসার কথা জানিয়ে দাও। আর বলো, আমি আগামীকাল সকালে ওর সাথে দেখা করবো। আপাতত আমি রুমে যাচ্ছি রেস্ট করতে। কেউ যেনো আমাকে ডিস্টার্ব না করে। আর আধঘণ্টা পর আমার রুমে যেনো রাতের খাবার পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ”

এই বলে রাগীব স্বাভাবিক পায়ে হেঁটে নিজের রুমে চলে এলো। রাজিব সাহেবের এক রুম পরেই রাগীবের রুম। রাগীব রুমে এসে পরনের পোশাক খুলে শাওয়ারে প্রবেশ করলো। দীর্ঘ সময়ের শাওয়ার শেষে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো সে। তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুলগুলো মুছতে মুছতে ফোনটা হাতে নিলো। স্ক্রিন অন করতেই সাবিহার নামটা জ্বলজ্বল করে উঠলো। সাবিহা তাকে ম্যাসেজ দিয়েছে,
” আপনি এভাবে না বলে হুটহাট কোথায় চলে গেলেন রাগীব? বাসায় এসে জানলাম আপনি আপনার ফ্রেন্ডের বাসায় গিয়েছেন। বাট কজ কি?”

সাবিহার ম্যাসেজ দেখে রাগীব মুচকি হাসলো। অতঃপর এক হাতে টাইপিং করে ম্যাসেজ দিলো,
” আপনার কাছে এসে একেবারে বলবো সব৷ ততদিন না হয় হাতে কলমে দিন গুনুন। ”

ম্যাসেজ পাঠিয়ে রাগীব ফোনটা রেখে দিলো। আদ্র তোয়ালেটা ব্যালকনিতে মেলে দিয়ে এসে আলমারি হতে সাদা একটি টিশার্ট ও কালো ট্রাউজার পরে নিলো। অতঃপর ফোন নিয়ে নিজের অসম্পূর্ণ কাজগুলো করার উদ্যোগ নিলো।

.

আভিজাত্যে ভরপুর রুমের সোফায় বসে এন্ড্রুর সাথে কথা বলছে রাগীব। এন্ড্রুকে বললো,
” আজ সন্ধ্যায় মিস্টার হ্যারির সাথে আমার মিটিং ফিক্স করো এন্ড্রু। ”

এন্ড্রু বাধ্যগত অনুগামীর ন্যায় বললো,
” ওকে স্যার। আর আপনাকে আরো একটি কথা বলার ছিলো। ”

” হ্যাঁ বলো। কি বলতে চাইছো তুমি। ”

” স্যার, মিস্টার মার্কো রিসেন্টলি বেশ ঝামেলা তৈরী করছে। তাকে শতবার বুঝানোর পরও সে বুঝতে চাইছে না। ”

রাগীব তৎক্ষণাৎ শক্ত কণ্ঠে বললো,
” মিস্টার মার্কো শুরু থেকেই ঝামেলা তৈরী করে আসছে। উনাকে কোনোভাবেই শুধরানো যাচ্ছে না। এবার অন্য পথে চলতে হবে। তবেই যদি সব সলভ হয়। আজ রাতের ডিনারটা মিস্টার মার্কোর সাথে ফিক্স করো। আমি……”
রাগীবের কথা সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার পূর্বেই দরজায় বাড়ি না দিয়েই রুমে প্রবেশ করলো অনিক। বহুদিন পর রাগীবকে দেখে তার আঁখিজোড়ায় উৎফুল্লতার দেখা মিললো। ঠোঁট চিড়ে বেরিয়ে এলো স্বস্তির নিঃশ্বাস। সে এগিয়ে এসে রাগীবকে জড়িয়ে ধরে বললো,
” কতদিন পর তোর সাথে দেখা দোস্ত! কেমন আছিস?”

রাগীবও অনিককে জড়িয়ে ধরে বললো,
” এই তো একদম ফিট এন্ড ফাইন। তুই?”

অনিক রাগীবকে ছেড়ে বললো,
” যেভাবে রেখে গিয়েছিলি সেভাবেই আছি। ”

রাগীব অনিকের কথার প্রত্যুত্তর করলো না। বরল এন্ড্রুকে বললো,
” আমাদের জন্য ডাইনিং এ ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করো এন্ড্রু। ”

এন্ড্রু নত মস্তকে বললো,
” ওকে স্যার। ”
এই বলে রুম হতে বেরিয়ে গেলো সে। এ পর্যায়ে অনিক চট করে জিজ্ঞেস করে বসলো,
” তোদের প্রেমকাহিনী কতদূর?”

রাগীব সহাস্যে জবাব দিলো,
” গাড়িটা আগের চেয়ে একটু এগিয়েছিলো। বাট শ্বশুর মশাইয়ের কারণে মাঝপথে আটকিয়ে আছে। ”

অনিক ভ্রু কুঞ্চিত করে সন্দেহাতীত কণ্ঠে বললো,
” কেনো? কি করলো ঐ বুড়ো ব্যাটা?”

” তার বিজনেস পার্টনারের ছেলের সাথে সাবিহার বিয়ে ঠিক করে বসে আছে সে।”

রাগীবের এহেন কথায় অনিকের কুঞ্চিত ভ্রুজুগল সিধা হয়ে এলো। সন্দেহের জায়গায় দেখা মিললো আকাশসম বিস্ময়ের। বললো,
” সর্বনাশ! বলিস কি! বিয়ে একদম ফিক্সড? আর ভাবী রাজি? তুই কিছু করবি না?”

অনিকের প্রশ্নের ভারত্ব শুনে রাগীব হাসলো। বললো,
” তো? তুই কি মনে করিস আমি চুপচাপ বসে থাকবো?”

অনিক এবার বিস্তৃত হাসলো। বললো,
” অবভিয়েসলি নট। তুই আর এমন সিচুয়েশনে বসে থাকবি, ইটস টোটালি আনবিলেভএবল।”

” ইয়েস। আমি অলরেডি কাজ শুরু করে দিয়েছি৷ খোঁজখবর নেওয়া চলছে। সব ইনফরমেশন কালেক্ট করে তবেই মাঠে নামবো। ”

” গুড। বাই দা ওয়ে, ভাবী কি তোকে পছন্দ করতে শুরু করেছে? নিজের ফিলিং কি কনফেস করেছে?”

” কনফেস করেনি। তবে ওর আচার-আচরণে স্পষ্ট বুঝতে পারছি ওর মনেও আমাকে নিয়ে ফিলিংস আছে। ”

” ওহ ম্যান….তাহলে তো রাস্তা ক্লিয়ার। এবার তোদের বিয়ে করতে ঠেকায় কে! স্বয়ং তোর বুড়ো শ্বশুর এসেও ঠেকাতে পারবে না। ”
এই বলে দুজনে হেসে উঠলো। কথা শেষে রাগীব উঠে গিয়ে আলমারি খুললো। সেখান হতে খালি একটা পিস্তল নিয়ে তার ম্যাগাজিন খুললো। তাতে পরপর ছয়টি গুলি ভরে পুনরায় সেটি পিস্তলে ঢুকিয়ে দিলো সে। অতঃপর হাতের তালুয় পিস্তল রেখে অনিককে বললো,
” আজ রাতে ঐ মার্কোর বা’চ্চার সাথে দেখা করবো। বে’য়া’দ’বটা অতিরিক্ত বাঁ’দ’রামি করছে। ওকে লাইনে আনা ফরজ হয়ে গিয়েছে। ”

ফোনে প্রেয়সীর হাসিমাখা মুখশ্রীর ছবি দেখতে ব্যস্ত অনিক। অকস্মাৎ রাগীবের কণ্ঠস্বর শুনে সে তৎক্ষনাৎ ফোন পকেটে পুরে বললো,
” ওকে ডান। আজ তাহলে তোর সাথেই থাকছি। ”

” ওকে। তাহলে মিস্টার হ্যারির সাথে ফিক্সড মিটিং এ তুইও আসিস। আর মার্কোর সাথে তো থাকবিই।

” সে আর বলতে। মার্কোর সাথে দেখা করা ফরজ হয়ে গিয়েছে। বুঝেছিস রাগীব, অনেকদিন আমার হাত দুটো চালানো হয় না। আজ যদি একটু সুযোগ পাই তাহলে আমাকে ঠেকাবি না তুই। ”

অনিককের কথার ভঙ্গিতে রাগীব সশব্দে হাসলো। বললো,
” যা করতে মন চায় করিস। আমি আটকাবো না তোকে। কারণ আমার কাজে বাঁধা তৈরী করা মানুষগুলোকে আমার একটু পছন্দ না। ”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here