প্রমত্ত_হৃদয়❤️,১৩

0
1400

#প্রমত্ত_হৃদয়❤️,১৩
লেখনীতে:সারা মেহেক

চারপাশে আলোর উপস্থিতি নগন্য। আবছা রঙবেরঙের আলোয় ছেয়ে আছে জায়গাটি৷ যেনো পরিবেশটিতে কোনো সম্মোহনী রেখা টানা হয়েছে। ভেতরে বিরাজ করছে পিনপতন নীরবতা। অথচ দরজার ওপাশে তুমুল শব্দে বাজছে গান। মিস্টার মার্কে ও তার দলবল এবং রাগীব, অনিকসহ তাদের দলবল একটি বৃহৎ রুমে অবস্থান করছে। স্থানটি মিস্টার মার্কোর অধীনে থাকা একটি না’ই’ট ক্লা’বের অভ্যন্তরীণ রুম। রাগীব, অনিক ও মিস্টার মার্কো মুখোমুখি বসে আছে। নীরবতার চাদরে ঢেকে কিছু সময় অতিবাহিত হলো। দু দলের কেউই কোনোরূপ কথা বললো না৷ যেনো তাদের মাঝে কোনো অরব ঠাণ্ডা যু’দ্ধ চলছে। কিয়ৎক্ষণ এভাবেই অতিবাহিত হওয়ার পর মিস্টার মার্কো বাঁকা হেসে ইতালিয় ভাষায় বলে উঠলেন,
” অনেকদিন পর তোমায় দেখলাম, মিস্টার রাগীব শাহরিয়ার। ”

রাগীব গম্ভীর মুখশ্রী ধারণ করলো। থুতনি ও গালে হাতের আঙুলগুলো ঠেকিয়ে বললো,
” সেইম টু ইউ মিস্টার মার্কো। ”

দু দুলের প্রধানের মাঝে কথোপকথন আরম্ভ হলো। মিস্টার মার্কো পুনরায় বললেন,
” কি কারণে আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছো রাগীব ?”

রাগীব পূর্বের ভঙ্গিতে বললো,
” কারণটা তোমার ভালো করেই জানা আছে মার্কো। শুধু শুধু পরিস্থিতি সম্পর্কে অজানা হওয়ার ভান ধরো না। ”

মিস্টার মার্কো কৃত্রিম অজ্ঞতার ভান ধরে বললেন,
” ভান ধরেনি রাগীব। তুমি ডিটেইলস না বললে আমি কি করে বুঝবো তুমি কি ব্যাপারে কথা বলতে চাইছো। ”

রাগীবের মেজাজ খানিক চটে গেলো। তবে প্রলম্বিত একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখলো সে। অনিক তার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে মার্কোকে কিছু বলতে উদ্যত হলো। কিন্তু রাগীব তৎক্ষনাৎ তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেই বললো,
” আমাদের ডিলের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে? ”

মার্কো এ পর্যায়ে একটু নড়েচড়ে বসলো। বললো,
” অবশ্যই মনে আছে। ”

” তাহলে ডিল অনুযায়ী নিজের সীমার মধ্যে থাকছো না কেনো?”

” যতটুকু সীমার মধ্যে থাকা উচিত ততোটুকুই আছি। ”

মিস্টার মার্কোর এরূপ কথায় রাগীব ধুম করে সামনের টেবিলে হাত রাখলো। বললো,
” মিথ্যে বলো না মার্কো। তুমি অনেক আগেই নিজের সীমা অতিক্রম করেছো। ”

” মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম অনুযায়ী সে কি চাইবে না অতিরিক্ত কিছু লাভ করতে? আমিও তেমনটাই চাইছি। ”

” চাইছো ভালো কথা। তবে আমাদের না জানিয়ে কেনো? আর অতিরিক্ত লাভ করতে গিয়ে আমাদেরই ক্ষতি বয়ে আনছো তুমি। ”

” এতে আমার কোনো ক্ষতি হচ্ছে না৷ উল্টো কিছু ট্রিক এপ্লাই করে আমি লাভবান হচ্ছি। আর তোমার এতে কি ক্ষতি হলো বা লাভ হলো তাতে আমার তো কোনো যায় আসে না। এসব তো আমাদের ডিলে লেখা ছিলো না। সো, ডিলের বাইরে আমি তোমার লাভ ক্ষতি কিছুই দেখছি না।”

মার্কোর বাঁকা বাঁকা কথায় রাগীবের মেজাজ প্রচণ্ড বিগড়ে গেলো। ফলে নিজের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে সে তৎক্ষনাৎ নিজের কোটের পকেট হতে পি’স্তল বের করে মার্কোর মাথায় তাক করলো। তার কার্যের প্রতিফলনে মার্কোর দলবলের প্রতিটি সদস্য নিজ নিজ পিস্তল বের করতে উদ্যত হলো। কিন্তু মার্কো তাদেরকে থামিয়ে দিলো।
আচমকা কপালে পি’স্তল তাক হতে দেখে মার্কো বেশ ঘাবড়ে গেলো। এতোক্ষণের জৌলুশ মুহূর্তেই হাওয়া হয়ে গেলো। চেহারা পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো। শুকনো একটা ঢোক গিলে সে কিছু বলতে উদ্যত হতেই রাগীব শক্ত কণ্ঠে বললো,
” আমার সম্পর্কে সবকিছু জানার পরও পায়ে পায়ে লাগতো আসো কেনো মার্কো? এতো তেজ আসে কোথা থেকে? তুমি কি জানো না, এই পি’স্তলের একটা গু’লিতেই তোমার মাথার ঘি’লু এপার ওপার হয়ে যাবে? ”

মার্কো এ পর্যায়ে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,
” আচ্ছা, আমরা শান্তভাবে কথা বলি? এভাবে পি’স্তল তাক করে কথা বলা যায় না। ”

রাগীব মার্কোর কথা কানে তুলতে চাইলো না। কিন্তু পাশ হতে অনিকের কথায় সে পি’স্তল হটিয়ে চেয়ারে বসে পড়লো। তৎক্ষনাৎ মিস্টার মার্কোর উদ্দেশ্যে শক্ত কণ্ঠে বললো,
” আই হোপ, তুমি এবার নিজেকে শুধরে নিবে। যতটুকু কাজ করার কথা ততটুকুই করবে। না হলে তোমার লা’শের এতো বী’ভ’ৎ’স অবস্থা তৈরী করবো যে সিসিলি শহরের প্রতিটা মানুষ তোমার লা’শ দেখে ভয়ে ছুটে যাবে। মাইন্ড ইট মার্কো।”

এই বলে রাগীব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মার্কো দ্বিতীয় কোনো কথা বলার সুযোগ পেলো না। মাথায় পি’স্তল দেখে ভয়ে তার নাক মুখ বেয়ে ঘাম ছুটে পড়ছে। সে রাগীবের আচার আচরণ, প্রকৃতি সম্পর্কে অবগত৷ তবুও রাগীবের বিপক্ষে গিয়ে সে কিছু কাজ করেছে। কারণ, লোভ। প্রচণ্ড লোভী প্রকৃতির মার্কো অতিরিক্ত লাভ ও টাকার আশায় নিজেকে আটকে রাখতে পারেনি। ফলে রাগীবকে না জানিয়েই সে নিজেদের মাঝে হওয়া ডিলের বাইরে গিয়েও কাজ করেছে। অতিরিক্ত টাকা লাভ করেছে। মার্কো জানতো রাগীবের কান অব্দি এ খবর ঠিকই পৌঁছাবে এবং রাগীব প্রচণ্ড ক্রোধিতও হবে। এজন্য মার্কো ভেবে রেখেছিলো, রাগীবকে এ ব্যাপারে বুঝাবে। কিন্তু তার বুঝদানের পূর্বেই রাগীব নিজের কাজ সেরে ফেলেছে। এবার আর সে এ ডিলের বাইরে গিয়ে কোনোপ্রকার কাজ করার সাহস দেখাবে না।

রাগীব উঠে আসলে অনিক ও তাদের দলবলও উঠে চলে আসে। সেই রুম থেকে বেরিয়ে অনিক দেখলো, রাগীব ক্লা’বের চেয়ারে বসে ড্রি’ঙ্ক করছে। রাগীবকে ড্রি’ঙ্ক করতে দেখে অনিক তার অনুগামীদের বললো ক্লা’বের বাইরে অপেক্ষা করতে। তারা অনিকের কথার যথাযথ মান্য করলো। নিশ্চুপ হয়ে ক্লা’বের বাইরে বেরিয়ে গেলো।
অনিক গিয়ে রাগীবের পাশে বসলো। ওয়েটারকে বললো তার জন্যও ড্রি’ঙ্ক তৈরী করতে। রাগীব তখন ধীরেধীরে গ্লাসের পানিয় খাচ্ছে। খাওয়ার এক পর্যায়ে অনিককে সে বললো,
” সবদিকের অবস্থা ঠিকঠাক তো তাই না?”

অনিক গ্লাসে প্রথম চুমুকটি দিয়ে বললো,
” হ্যাঁ। সবকিছু আন্ডার কন্ট্রোল। বাই দা ওয়ে তুই ভেনিসে ব্যাক করছিস কবে?”

” কাল দুপুরে হয়তো রওনা দিবো। ”

” সিসিলি আসার আগে ঐ বুড়োকে কি বলে এসেছিস?”

” কিছুই বলিনি। আমাদের দেখা হয়নি। সাবিহাকে ভার্সিটিতে ছেড়ে বাড়িতে গিয়ে ব্যাগ গুছাতে গুছাতে শুনলাম শ্বশুর আব্বা ও তার প্রিয় ভাগ্নে বিজনেসের কাজে আমেরিকা পাড়ি জমিয়েছে। ”

” তা, কয়দিনের জন্য?”

” চারদিনের ট্যূর বলে। ”

” গুড। ভালোই হয়েছে, তোকে এক্সট্রা কোনো কাহিনি বানাতে হয়নি। ”

রাগীব গ্লাসে শেষ চুমুকটুকু দিয়ে গ্লাস সরিয়ে রাখলো। বললো,
” হয়নি। বাট হবে। তুই কি ভেবেছিস, ঐ বুড়োটা এতো সহজেই মানবে, আমি ভেনিস ছেড়ে আমার বন্ধুর সাথে দেখা করতে এসেছি৷ অবশ্যই এর উপযুক্ত প্রমাণ চাইবে। তবে আমিও কম না কি। প্রমাণ, ঘটনা, ক্যারেক্টার, সবই বানানো আছে। যাস্ট সময়মত সবকিছু এক্সিকিউট করার পালা।”

রাগীবের পরিকল্পনা শুনে অনিক বিস্তৃত হাসলো। রাগীবের পিঠে সশব্দে একটি চাপড় দিয়ে বললো,
” তোর সাথে কেউ পেরে উঠবে না দোস্ত। ইশ, ঐ বুড়োটা যদি জানতো, কোন চক্রের পাল্লায় পড়েছে সে। আহা, সেই ফিলিংসটাই হবে অন্যরকম। ”
এই বলে অনিকসহ রাগীবও হেসে উঠলো।

.

” আম্মু আসবো?”

অকস্মাৎ মেয়ের কণ্ঠস্বর কর্ণপাত হতেই উলের বুননে বাঁধা পড়লো সালমা বেগমের। অর্ধ বুননকৃত সোয়েটারটা রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার ওপারে দৃষ্টি রাখলেন তিনি৷ মৃদু হেসে বললেন,
” মায়ের রুমে আসতে কি জিজ্ঞেস করতে হয়। পাগল মেয়ে….আয়।”

অনুমতি পেয়ে সাবিহা রুমে প্রবেশ করলো। মায়ের সম্মুখ প্রান্তে বসে কোনোরূপ ভণিতা ছাড়াই ম্লান হেসে জিজ্ঞেস করলো,
” আম্মু? তুমি কি বিয়েতে একমত?”

অকস্মাৎ মেয়ের নিকট হতে এমন প্রশ্ন শুনের আশা করেননি সালমা বেগম। ফলস্বরূপ কিঞ্চিৎ হকচকিয়ে গেলেন তিনি। বললেন,
” হঠাৎ এমন প্রশ্ন করছিস কেনো পুতুল?”

” এ প্রশ্ন কেনো করছি সেটা জানার চেয়ে তোমার উত্তরটা আমার জানা বেশি দরকার আম্মু। বলো।”

সালমা বেগম ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। কিয়ৎক্ষণ সময় নিয়ে বললেন,
” তোর বাবার সামনে আমার চলে না রে পুতুল। তোর বাবা যা বলবে তাই। ”

সাবিহা হতাশ হলো। ফিরতি কোনো প্রশ্ন করলো না। তবে নিমিষের মাঝেই মুখশ্রীর ভাবভঙ্গি বদলে অত্যন্ত দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
” আমি রাগীবকে পছন্দ করি আম্মু। হয়তো উনাকে ভালোবাসতেও শুরু করেছি। এখন তুমিই বলো, কি করবো আমি। ”

মেয়ের কথা কর্ণপাত হওয়া মাত্র সালমা বেগম বিস্ময়ে নেত্রজুগল বৃহদাকার করলেন। তিনি ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেননি, সাবিহা হঠাৎ এসে এভাবে রাগীবের সম্পর্কে কথা বলবে। সালমা বেগম আকাশসম বিস্ময়ের সহিত চিন্তা করলেন,আশ্চর্য! এতো ঘটনা ঘটলো কবে? সাবিহা যেমন রাগীবকে পছন্দ করে, রাগীবও কি সাবিহাকে সেভাবে পছন্দ করে? যদি সত্যিই দুজন দুজনাকে পছন্দ করে, ভালোবাসে, তাহলে সাবিহার বিয়ে অন্য ছেলের সাথে কি করে হতে পারে? এ বিষয়ে কি সালমা বেগম তার স্বামীর সাথে কথা বলবেন? কিন্তু এতো সাহস যে তার মাঝে নেই। তাহলে?

.

” ছেলেটার নাম আদিল। ভেনিসে সপরিবারে বসবাস করে। বাসায় বাবা, মা ও ছোট ভাই আছে।তবে সবার আড়ালে ওর ওয়াইফও আছে। আই মিন, আদিল বিবাহিত। তবে এ ব্যাপারে ওর পরিবারের কেউ জানে না। আর ওর ওয়াইফের সাথে অনেকদিন যাবত দেখা করে না। তবে ফোনে মাঝে মাঝেই কথা বলে। ”
এক নিঃশ্বাসে তথ্যগুলো দিয়ে দম ফেললো এন্ড্রু। তার কথা শুনে আনন্দিত হলো রাগীব। আদিলের সম্পর্কে এমন তথ্য জানবে, এটা সে কল্পনাও করেনি৷ রাগীব পহেলা হতেই ভেবে রেখেছিলো, আদিলকে অন্যভাবে সামলাবে সে। কিন্তু ওর বিবাহিত হওয়ার কথা শুনে পুরো পরিকল্পনাই অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিলো। কিয়ৎক্ষণ বাদে স্বগোতক্তি করে বললো,
” ইট উইল বি এ স্মুথ গেইম। এতো স্মুথ গেইম খেলে মজা নেই। কিন্তু কি আর করার তোমার ভাগ্য ভালোয় ভালোয় কেটে যাওয়ার ছিলো মিস্টার আদিল। ভাগ্যের সামনে তো কারোর জোর নেই। হোয়াটএভার, বি রেডি মিস্টার আদিল। ”
এই বলে বাঁকা হাসলো রাগীব।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here