প্রমত্ত_হৃদয়❤️,১৮

0
911

#প্রমত্ত_হৃদয়❤️,১৮
#লেখনীতে:সারা মেহেক

আপাদমস্তক কালো পোশাকে আচ্ছাদিত, মুখে মাস্ক পরিহিত আগন্তুকের অ’ত’র্কিত হা’ম’লায় ভারসাম্য হারিয়ে রাগীব মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। অকস্মাৎ ভ’য়ং’কর এ ঘটনার সম্মুখীন হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লো সাবিহা। সে স্তব্ধ দৃষ্টিতে রাগীব ও অজ্ঞাত লোকটির দিকে চেয়ে রইলো। এদিকে রাগীব ঘটনার আকস্মিকতায় শূন্য মস্তিষ্কের হয়ে পড়লো। ফলে আত্মরক্ষার্থে লোকটির উপর ফিরতি আক্রমণ করে উঠতে পারলো না সে। তার এ নিরাধার অবস্থার সুযোগ নিয়ে অজ্ঞাত লোকটি পুনরায় তার উপর হামলা চালালো। এ পর্যায়ে সে রাগীবের মুখে একটি ঘুষি দিয়ে তাকে দূর্বল করার প্রচেষ্টা চালালো। ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেখে রাগীব লোকটিকে নিজের উপর হতে সরিয়ে এক ধাক্কায় পাশে ফেলে দিলো এবং নিজে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আগন্তুকও পূর্বের ন্যায় সর্বশক্তিতে উঠে গিয়ে পুনরায় রাগীবের উপর আক্রমণ চালালো। কিন্তু এ পর্যায়ে রাগীব সে আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হলো। সে আগন্তুকের হাত আটকে মুখ বরাবর একটি ঘুষি মারলো। ফলে আগন্তুক কয়েক কদম পিছিয়ে ছিটকে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। তৎক্ষনাৎ রাগীব তাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলো,
” হু আর ইউ ম্যান?”

আগন্তুক জবাব দিলো না। বরং ক্ষণেই কোমড়ের পাশ হতে পি’স্ত’ল বের করে রাগীবের উপর তাক করলো। আকস্মিক এ ঘটনায় থতমত খেয়ে গেলো রাগীব ও সাবিহা৷ তাদের কিছু বুঝে উঠার পূূর্বেই আগন্তুক ট্রিগার চেপে একটি গুলি চালালো। কিন্তু ভাগ্যের পরিক্রমায় গুলিটি রাগীবকে স্পর্শ করতে পারলো না। আগন্তুকের নীরব আক্রমনে সাবিহা ও রাগীব ঠিক বুঝে উঠতে পারলো, সে কি চাইছে। চোর ডাকাত হলে নিশ্চয়ই এতোক্ষণে টাকা চাইতো কিংবা টাকা ছিনিয়ে নিয়ে চলে যেত। কিন্তু এ পর্যন্তও আগন্তুক ছিনতাইপূর্ণ কোনো কাজ করলো না। অবাক হওয়ার বিষয় বটে।

মুহূর্তেই আগন্তুক পুনরায় ট্রিগার চাপতে উদ্যত হলো। তার এ চেষ্টা বিফল করতে রাগীব দৌড়ে আগন্তুকের দিকে এগিয়ে গেলো। কিন্তু তার পৌঁছানোর পূর্বেই সাবিহা এগিয়ে এসে সর্বশক্তি দিয়ে আগন্তুকের কব্জিতে পা দিয়ে আঘাত দিলো। ফলে আগন্তুকের হাত হতে পি’স্ত’ল দূরে গিয়ে পড়লো। এরই সুযোগে রাগীব তার উপর ঝাপিয়ে পড়লো। আগন্তুককে দুটো ঘুষি দিতেই আগন্তুক ফিরতি মা’রলো রাগীবকে। এভাবে দুজনের মাঝে ধস্তাধস্তি চললো। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে রাগীব আগন্তুকের মাস্ক খুলতে নিলো, এটি দেখার জন্য যে লোকটি প্রকৃতপক্ষে কে। কিন্তু আগন্তুক রাগীবের সে প্রচেষ্টা বিফল করে দিলো। তবে রাগীবও পুনরায় চেষ্টা চালালো এবং এ চেষ্টায় সে সফল হলো। আগন্তুকের মাস্ক খুলে তার চেহারা দর্শন করতেই রাগীব আশ্চর্যান্বিত হলো। কারণ আগন্তুক আর কেউ নয় বরং তার বহু পুরোনো শত্রু আর্নল্ড। সে আর্নল্ডকে দেখে ভীষণ আশ্চর্য হলো। কারণ তার কাছে থাকা তথ্যমতে আর্নল্ডের বেঁচে থাকা অসম্ভব। তাহলে আর্নল্ড বেঁচে আছে কি করে! এ চিন্তা করে রাগীবের বিস্ময়াভাব যেনো কাটছেই না৷ এদিকে আর্নল্ডের চেহারা রাগীবের সম্মুখে বহিঃপ্রকাশ হতেই সে মাস্ক দিয়ে নিজের চেহারা আবৃত করে ফেললো। অতঃপর রাগীবের নিকট হতে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে সে স্থান ত্যাগ করলো। রাগীব তখনও মাটিতে বসে আছে। সে আর্নল্ডের বেঁচে ফেরার অঙ্ক কষতে ব্যস্ত।

শেষ মুহূর্তে রাগীবকে এরূপ নিস্তেজ হতে দেখে খানিক অবাকই হলো সাবিহা। সে কোনা থেকে এগিয়ে রাগীবের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালো। কণ্ঠে বিস্ময় ভাব প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করলো,
” শেষ সময়ে এসে ওভাবে ছেড়ে দিলেন কেনো লোকটাকে?”

রাগীব ফ্যালফ্যাল করে সাবিহার পানে চাইলো। এখন সে সাবিহাকে কি জবাব দিবে তা ভাবতে লাগলো। সাবিহা তার কাছে কোনো জবাব না পেয়ে মাটিতে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লো। জিজ্ঞেস করলো,
” কি ভাবছেন এতো?”

খানিক বাদে রাগীব জবাব দিলো,
” কিছুই না। চলো, বাড়িতে ফিরে যাই। এখন জায়গাটা খুব রিস্কি লাগছে। ”

এই বলে সে উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়ালো সাবিহাও। অতঃপর রাগীব সাবিহার হাত ধরে নীরবে হাঁটতে লাগলো। রাগীবের মস্তিষ্কে চলছে নানা প্রশ্নের জোয়ার। যার সবটাই আর্নল্ডকে ঘিরে। যেহেতু আর্নল্ড জানে রাগীব সিসিলি ছেড়ে ভেনিসে অবস্থান করছে সেহেতু সে এটাও জানে রাগীব সাবিহাকে বিয়ে করেছে। আর তার সাথে রাগীবের যে পর্যায়ের শত্রুতা আছে তাতে সে নিশ্চয়ই এবার বড় কোনো পরিকল্পনা নিয়ে ফিরে এসেছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই আর্নল্ড রাগীবের পাশাপাশি সাবিহার ক্ষতি করারও চেষ্টা করবে। রাগীব ভিতরে ভিতরে ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লো। সাবিহাকে নিয়ে আকাশ পাতাল চিন্তাভাবনা তাকে আবিষ্ট করে ফেললো। ভেবে রাখলো, আজ বাড়িতে পৌঁছে সর্বপ্রথম এন্ড্রুকে ফোন করে আর্নল্ডের সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে জানবে এবং বাড়ির আশেপাশে গুপ্ত লোকেদের দ্বারা নিরাপত্তার ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এতে আফসার সাহেবের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে।

সাবিহার বিপদপূর্ণ এক ভবিষ্যতের ভাবনা রাগীবের মস্তিষ্কে আসতেই সে শিউরে উঠলো। নিজের হাতের মুঠোয় সাবিহার হাত নিয়ে দৃঢ়ভাবে চেপে ধরলো। তার দৃঢ় স্পর্শে কিঞ্চিৎ ব্যাথা পেলো সাবিহা। ক্ষণেই মুখ দিয়ে ‘আহ’ শব্দ নির্গত করতেই রাগীব তটস্থ হলো। তৎক্ষনাৎ তার হাত ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লো রাগীব। চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” ক-কি হয়েছে সাবিহা? ”

সাবিহা মৃদু হাসার চেষ্টা করে বললো,
” কিছু না। আপনি হাতটা একটু জোরে ধরায় ব্যাথা পেয়েছিলাম। দ্যাটস ইট। ”

রাগীব নিজের ভুল বুঝতে পারলো। খানিক লজ্জিত হলো। নিচু স্বরে বললো,
” সরি। বুঝতে পারিনি। আসলে…..”

রাগীবকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সাবিহা আশ্বস্ত করে বললো,
” বুঝতে পেরেছি। কিছুক্ষণ আগের ইন্সিডেন্টটা নিয়ে চিন্তা করছেন তাই তো। এতো চিন্তা করার কি আছে! আর আমার কিছু হবে না। কারণ আপনি সবসময় আমার সাথে আছেন। ”

রাগীব দূর্বল চিত্তে হাসলো। পুনরায় প্রিয় মানুষকে হারানোর ভয় তাকে গ্রাস করে ফেলেছে তা ঢের বুঝতে পারছে রাগীব। সে কিয়ৎক্ষণ সাবিহার পানে চেয়ে রইলো। হঠাৎ কি মনে করে বললো,
” এ ঘটনা সম্পর্কে তোমার বাবাকে কিছু বলো না সাবিহা। আঙ্কেল ভাবতে পারে, হয়তো আমাকে বিয়ে করে তোমার বিপদ বেড়েছে।”

” আপনি এ ব্যাপারে নিশ্চিত থাকুন। আব্বু এ নিয়ে কিছুই জনতে পারবে না। ”

” থ্যাংকস সাবিহা। ”

” আচ্ছা, আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?”

” হ্যাঁ করো। ”

” আপনি কি লোকটাকে চিনতেন?”

সাবিহার এমন সন্দেহজনক প্রশ্নে রাগীবের বুক ধক করে উঠলো। ঠোঁটজোড়া শুকিয়ে এলো। নিজের এ অস্থির চিত্ত সাবিহার দৃষ্টির অগোচরে রাখতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলো সে। প্রশ্নটিকে হেসে উড়িয়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো,
” আরে কি যে বলো না। আমি লোকটাকে চিনবো কি করে!”

সাবিহার সন্দেহ পুরোপুরি দূর হলো না। সে পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,
” তাহলে আপনি লোকটিকে যেতে দিলেন কেনো?”

রাগীব হাস্যজ্জ্বল মুখে জবাব দিলো,
” ইচ্ছা করে যেতে দিয়েছি না কি। আমার পক্ষে আর হাত চালানো সম্ভব ছিলো না। শরীর ছেড়ে দিয়েছিলো। এজন্যই লোকটা ছাড়া পেয়ে গেলো। আমার মধ্যে ফুল এনার্জি লোডেড থাকলে আমি ঐ বদমাশকে ছাড়তাম না কি!”

সাবিহা প্রত্যুত্তর করলো না। মুচকি হাসলো। তার চেহারার প্রতিক্রিয়া বলে দিলো সে রাগীবকে আর সন্দেহ করছে না। তার হাসি দেখে স্বস্তি মিললো রাগীবের। চিন্তা মুক্ত হলো সে।

.

সারাদিনের ঘুরাঘুরি শেষে ক্লান্ত হয়ে দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়লো সাবিহা। কিন্তু শরীর ক্লান্ত থাকা সত্ত্বেও রাগীবের আঁখিজোড়ায় ঘুম হানা দিলো না। সে শুয়ে শুয়ে সাবিহার গভীর ঘুমের অপেক্ষা করলো। আধ ঘণ্টা পেরোতেই সাবিহা দুনিয়া ভুলে গভীর ঘুমে মগ্ন হলো। সে সুযোগে রাগীব চুপিসারে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পাঁচদিনের বিজনেস ট্যুরে আফসার সাহেব ও সামাদ শহরের বাইরে অবস্থান করায় রাগীব নিশ্চিন্ত হয়ে এন্ড্রুকে কল করলো। এন্ড্রু কল রিসিভ করতেই রাগীব গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,
” এন্ড্রু? তুমি কি আর্নল্ডের ডে’থের নিউজ সম্পর্কে শিওর?”

অকস্মাৎ রাগীবের ফোন, উপরন্তু তার এ প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো এন্ড্রু। আকাশ হতে পড়েছে এমন ভাব ধরে বললো,
” জি স্যার? আপনি হঠাৎ আর্নল্ডের সম্পর্কে জানতে চাইছেন কেনো?”

” যা প্রশ্ন করেছি তার জবাবটা আগে দাও এন্ড্রু। তুমি কি ওর ডে’থের ব্যাপারে শিওর?”

এন্ড্রু নিজেকে সামলে নিলো। বললো,
” জি স্যার। একদম শিওর। কার এ’ক্সি’ডে’ন্টেই আর্নল্ড মা’রা গিয়েছে। ওর সাথে বাকি যে দুজন ছিলো তারাও মা’রা গিয়েছে। অতো উঁচু পাহাড় থেকে পড়ে যাওয়ার পর বেঁচে থাকার নূন্যতম চান্সটুকুও থাকে না স্যার। ”

” তাহলে আর্নল্ড বেঁচে গেলো কি করে? আমার সামনেই বা এলো কি করে?”

রাগীবের এহেন কথায় থতমত খেলো এন্ড্রু। বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
” তা কি করে সম্ভব স্যার! আমরা গাড়িতে তিনজনরেই ডে’ড বডি দেখেছিলাম। ”

” আচ্ছা, এসব বাদ দাও। আর্নল্ড যেহেতু বেঁচে আছে সেহেতু আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। বাড়িতে সিকিউরিটি আরো কড়া করো। আর ভেনিসেও পর্যাপ্ত সিকিউরিটি এরেঞ্জ করো। তবে এট ফার্স্ট আর্নল্ডের পজিশন জানতে কয়েকজনকে কাজে পাঠাও। বাকিটা তুমি দেখে নাও। পারবে তো?”

” জি স্যার। অবশ্যই পারবো। আপনি নিশ্চিত থাকুন। আচ্ছা স্যার? অনিক স্যারকে কি এ ব্যাপারে জানাবো?”

” হ্যাঁ জানাও। ওকেও এলার্ট থাকতে বলো। ”

” ওকে স্যার।”

কল কেটে দিলো রাগীব। তার চেহারায় চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। সাবিহাকে নিয়ে তার অন্তঃস্থলে নানারূপ খারাপ চিন্তা উঁকি দিলো। তার স্নিগ্ধময়ীকে হারানোর ভয় তাকে গ্রাস করে ফেললো৷ দৃঢ় চিত্তের রাগীব পরিণত হলো দূর্বল চিত্তে। সব পরিস্থিতিতে যে নিজেকে সর্বোচ্চ সামলে রাখতে সক্ষম সেও প্রিয়জনকে হারানোর ভয়ে নিস্তব্ধ হয়ে পড়লো।

.

সাবিহাকে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিতে গিয়েছে রাগীব। দুদিন বাদে আজ গেস্ট হাউজ থেকে সাবিহার রুমে সবকিছু স্থানান্তর করতে ব্যস্ত ছিলো রাগীব ও সাবিহা। এরই মাঝে ভার্সিটি যাওয়ার সময় হয়ে যাওয়ায় দুজনে বেরিয়ে পড়ে। এদিকে তাদের এ অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করতে হাত বাড়ায় সালমা বেগম। রাগীবে অনুপস্থিতিতে তিনি রাগীবের অগোছালো জিনিসগুলো গুছিয়ে সাবিহার রুমে নিয়ে যেতে লাগলেন। তার সাথে কাজে নেমে পড়লো একজন সার্ভেন্টও।
গোছগাছের এক পর্যায়ে ছোট্ট বুকশেলফ থেকে বইগুলো নামিয়ে কার্টনে ভরতে লাগলেন সালমা বেগম। বই নামানোর একদম শেষ পর্যায়ে দুটো বইয়ের মাঝে অপর একটি কাগজ জাতীয় কিছু আবিষ্কার করলেন তিনি। উপরের বইটি সরাতেই তার হাতে একটি প্রিন্টেড ছবি এলো। ছবিটিতে রাগীব ও প্রায় তারই বয়সের হাস্যজ্জ্বল চেহারার একটি মেয়ে একে অপরের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে।
রাগীবের পাশে অচেনা মেয়েটিকে দেখে তৎক্ষণাৎ সালমা বেগমের মাঝে সন্দেহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। তার জানামতে রাগীবের কোনো ভাই বোন নেই। দেশে শুধু সে আর তার বাবা থাকতো। তাহলে এ মেয়েটি কে? মেয়েটি কি রাগীবের………

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here