#প্রমত্ত_হৃদয়❤️,২০
#লেখনীতে:সারা মেহেক
আফসার সাহেবের গুপ্ত সেই রুমটিতে সালমা বেগম হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দৃষ্টি স্তব্ধ ও অবিশ্বাস্যে পূর্ণ। বাক্সে এমন কিছু থাকবে তা তিনি অনুমানও করতে পারেননি।
বাক্সটিতে একটি র’ক্তা’ক্ত কাপড়ের অংশ ও কয়েকটি ছবি রাখা। ছবিগুলো আর কারোর নয় বরং আফসার সাহেব ও রামিশার। রামিশাকে চিনতে প্রথমে একটু অসুবিধা হলেও কিছুক্ষণের মাঝেই তিনি রামিশাকে পুরোপুরি চিনে ফেলেন। বাক্সে রাখা ছবিগুলোর মাঝে কয়েকটি ছবিতে রামিশা চোখ বুজে আফসার সাহেবের কাঁধে মাথা রেখে বসে আছে। কয়েকটি ছবিতে দুজন বেশ ঘ’নি’ষ্ঠ অবস্থায় বসে আছে। তবে সেসব ছবিতেও রামিশার চোখজোড়া বন্ধ। ছবির পারিপার্শ্বিক পরিবেশ দেখে মুহূর্তেই অনুমান করা যায় ছবিগুলো কোনো ক্লাবে তোলা হয়েছে। সালমা বেগম মিলিয়ে দেখলেন, বাক্সে থাকা র’ক্তা’ক্ত কাপড়ের অংশটি রামিশার গলায় ঝুলে থাকা শর্ট স্কার্ফের একটি অংশ।
এসব দেখে সালমা বেগম স্থির থাকতে পারলেন না। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লেন। তার মুখ দিয়ে টু শব্দটুকুও বের হচ্ছে না৷ ভেতরটা অবিশ্বাস্যকর এই ছবিগুলো দেখে ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে যেনো। তিনি আফসার সাহেব ও রামিশার এ ধরণের ছবি মোটেও আশা করেননি। সালমা বেগম শূন্য মস্তিষ্কে কিয়ৎক্ষণ বসে রইলেন। অনুভব করলেন চারপাশের কঠোর নীরব পরিবেশ। অনুভব করলেন তার অন্তরের সকল বিশ্বাস, আশা আজ ভোঁতা হয়ে গিয়েছে। নিজের স্বামীকে এমন আপত্তিকর ছবিতে দেখে সালমা বেগমের শরীর গুলিয়ে এলো। মুহূর্তেই আফসার সাহেব ও রামিশার জন্য তার হৃদয়ে একরাশ ঘৃ’ণার জন্ম নিলো। আঁখিজোড়া বেয়ে গড়িয়ে পড়লো আস্থা ভঙ্গের যন্ত্রণার অশ্রু। তিনি কাঁদতে লাগলেন। নীরবে কাঁদতে লাগলেন।
কত সময় গড়িয়ে গিয়েছে তা জানা নেই সালমা বেগমের। চাপা কান্নার ফলে মাথাটা ভারী হয়ে এসেছে। নাকের উপরাংশে মৃদু ব্যাথা অমুভব হচ্ছে। নোনাজলের অশ্রুতে দু গালও আঠালো হয়ে এসেছে। কিয়ৎক্ষণ হাতে থাকা বাক্সটির দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। বাক্সটি পুনরায় ভালোভাবে ফিতা দিয়ে মুড়িয়ে সেটিসহ রুম হতে বেরিয়ে এলেন তিনি। তার দৃষ্টি দৃঢ়। যেনো ভেঙে পুনরায় গড়ে উঠা একটি মূর্তি তিনি।
বাক্সটি নিয়ে রুমে এসে দরজা আটকে দিলেন তিনি৷ সেটি বিছানার উপর অবহেলায় রেখে ওয়াশরুমে চলে গেলেন তিনি। মুখে মুখে ঘনঘন পানির ঝাপটা দিয়ে ফোলা চোখে আয়নায় তাকালেন। মনস্থির করলেন রামিশার সম্পর্কে রাগীবকে সব জিজ্ঞেস করবেন। এমনকি আফসার সাহেব ও রামিশার মধ্যকার সম্পর্ক নিয়েও জিজ্ঞেস করবেন। নিজের বোন সম্পর্কে রাগীব নিশ্চয়ই এসব তথ্য জানবে। মোটকথা, সালমা বেগম এ সব ছবির সত্যতা জানার জন্য আফসার সাহেবের ফেরার অপেক্ষা করতে পারবেন না। অধৈর্য্য হয়ে পড়বেন। আর নিশ্চয়ই এ ধরণের কথা ফোনে বলা যায় না।
সালমা বেগম হাতমুখ ধুয়ে রুমে চলে আসলেন। বাক্সটি নিয়ে আলমারিতে রেখে দিলেন। অতঃপর অবসন্ন শরীরটা নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলেন তিনি।
.
দুপুরে বাইরে থেকে খাওয়াদাওয়া শেষে বাড়ি ফিরেছে রাগীব ও সাবিহা। তাদের বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেলো। সাবিহা পোশাক বদলিয়ে রাগীবের পাশে সোফায় বসলো। অনেকটা অনুরোধের সুরে রাগীবকে বললো,
” আচ্ছা শোনো, পরশুদিন আমার এক ফ্রেন্ডের বার্থডে পার্টি। আমাকে ইনভাইট করেছে। তুমিও চলো না আমার সাথে। ”
রাগীব ফোনে মগ্ন ছিলো। সাবিহার কথা শুনে সে ফোন রেখে তার দিকে চাইলো। মৃদু হেসে বললো,
” যাওয়া কি খুব জরুরি? ”
সাবিহা তৎক্ষনাৎ ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
” গেলে কোনো সমস্যা? ”
” অবভিয়েসলি নট। কোনো সমস্যা নেই। ”
” গুড। আসলে আমি তোমাকে আমার ফ্রেন্ডদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে চাইছিলাম। দেখাতে হবে না আমার হাজবেন্ড কত হ্যান্ডসাম। ”
সাবিহার শেষোক্ত কথা শুনে রাগীব ফোন রেখে সাবিহার দিকে ফিরে বসলো। সোফার ব্যাকরেস্টের উপরাংশে ডান হাত রেখে পায়ের উপর পা তুলে চমকপ্রদ গলায় বললো,
” ওয়াও! আজ প্রথম তোমার কাছ থেকে নিজের প্রশংসা শুনলাম! ভালো লাগলো। ”
রাগীবের এহেন কথার ধরনে সাবিহা কিছুটা লজ্জা পেলো। তবে নিজের লাজুক ভাব দমিত রেখে বললো,
” এখন থেকে ডেইলি শুনবে। ”
” ডেইলি! সিরিয়াসলি, ডেইলি তোমার মুখে আমার প্রশংসা শুনলে আমি হাওয়ায় উড়বো। ”
রাগীবের কথায় সাবিহা সশব্দে হেসে উঠলো। খানিক বাদে বললো,
” তুমি কি জানো, এই ফেব্রুয়ারী মাসে এখানে কার্নিভাল ফেস্টিভ্যাল হয়?”
রাগীব এ ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে অনবগত হওয়ার ভান করে বললো,
” না তো। কি হয় এই ফেস্টিভ্যালে?”
সাবিহা অতি আগ্রহের সহিত রাগীবকে বললো,
” কার্নিভাল ফেস্টিভ্যাল ভেনিসের ওয়ান অফ দা এনসিয়েন্ট ট্রেডিশনের একটি। এখানে সবাই মাস্ক পরে। বিভিন্ন ডিজাইনের ড্রেস পরে। মাস্কগুলোর ডিজাইনও নজরকাড়া হয়। সবচেয়ে বড় কথা, এখানে ফুল ফেসড মাস্কগুলো বেশি থাকে। এর কারণে কেউ কাউকে খুব একটা চিনতে পারে না।”
” বাহ, বেশ ইন্টারেস্টিং একটা ফেস্টিভ্যাল তো!”
” হ্যাঁ। আমরা ফেস্টিভ্যালে এ যাবো। ওকে?”
” ওকে। ”
এই বলে রাগীব সাবিহার দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রইলো। অতঃপর জিজ্ঞেস করলো,
” তুমি কি সিসিলি গিয়েছো কখনও?”
” উঁহু। ভেনিসের বাইরে কখনো যাওয়া হয়নি আমার। ”
” আচ্ছা, তোমাকে একদিন সিসিলি নিয়ে যাবো আমি। শহরটা অনেক সুন্দর। ”
” তুমি গিয়েছো?”
” হ্যাঁ। আমার এক ফ্রেন্ড ওখানে থাকে। ”
” ওহ, তাহলে সিসিলি গিয়ে একদিন ঘুরে আসা যায়। ”
এভাবে রাগীব ও সাবিহার মাঝে কথাবার্তা চলতে লাগলো।
রাত দশটা নাগাদ প্রত্যেকে রাতের খাবার খেয়ে নিজের রুমে চলে গেলো। সাবিহা আগামীকালের ক্লাসের পড়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়লো। রাগীবও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। তবে দরজায় কারোর কড়াঘাতে তার প্রস্তুতি বিঘ্নিত হলো। সে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখলো সালমা বেগম শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। সালমা বেগম প্রথমে রাগীবকে কিছু বললেন না। রাগীবের দিকে শীতল চাহনিতে চেয়ে তার কাঁধ ছাপিয়ে সাবিহাকে একবার দেখে নিলেন। সাবিহাকে ঘুমাতে দেখে সালমা বেগম গমগমে গলায় বললেন,
” রাগীব, আমার রুমে একটু এসো। জরুরি কথা আছে। ”
এই বলে সালমা বেগম পিছন ফিরে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন। এদিকে তার এহেন কথার ধরণে রাগীব কিছুটা চিন্তিত হলো। তবে বেশি চিন্তা ভাবনা না করে সালমা বেগমের পিছু পিছু গেলো সে।
রাগীব রুমে আসতেই সালমা বেগম রুমের দরজা আটকিয়ে দিলেন। কোনোরূপ ভূমিকা ছাড়াই বললেন,
” রাগীব, তোমার বোনকে নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার ছিলো। যে প্রশ্নটা করবো, আশা করি তুমি কিছু মনে করবে না এবং এ বিষয়ে জানলে আমাকে জানাবে। ”
অকস্মাৎ সালমা বেগমের এহেন কথায় রাগীব নড়েচড়ে দাঁড়ালো। কিছুটা সতর্ক হলো সে। জিজ্ঞেস করলো,
” কি জিজ্ঞেস করবেন আন্টি?”
সালমা বেগম তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞেস করলেন,
” তোমার বোনের চরিত্র সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা আছে?”
রাগীব খানিক রেগে গেলো। সালমা বেগমের কথার সুরেই সে চট করে ধরে ফেললো, সালমা বেগম রামিশার চরিত্র সম্পর্কে নেতিবাচক ধরনের মন্তব্য করছেন। সে চটে যাওয়া মেজাজ নিয়ে সালমা বেগমকে বললো,
” আমার বোনের চরিত্র সম্পর্কে আমি যথেষ্ট জানি আন্টি। আপনার কথার ধরণ শুনে মোটেও মনে হচ্ছে না আপনি ভালো কোনো মিনিং এ কথা বলছেন। ”
সালমা বেগম তৎক্ষনাৎ কোনো কথা বললেন না। রাগীবকে পাশ কাটিয়ে বেড সাইড টেবিল থেকে বাক্সটা নিয়ে এলেন তিনি। অতঃপর সেখান থেকে আফসার সাহেব ও রামিশার ছবিগুলো রাগীবের সম্মুখে ধরে উদ্ধত গলায় বললেন,
” তাহলে এগুলো কি রাগীব? একজন বয়স্ক মানুষের সাথে এতোটা ঘ’নিষ্ঠ অবস্থায় কেনো আছে তোমার বোন?”
সালমা বেগমের হাতে বাক্সটা দেখে ভীষণ অবাক হলো রাগীব। কারন আফসার সাহেবকে সে-ই পার্সেলটা পাঠিয়েছিলো। সে সালমা বেগমের নিকট হতে বাক্সটা হাতে নিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনি এটা কোথায় পেলেন?”
সালমা বেগম দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,
” কোথায় পেলাম সেটা বড় কথা না। বড় কথা, বক্সে থাকা ছবিটা নিয়ে। এ ছবি নিয়ে কোনো ব্যাখা দিতে পারবে তুমি? ”
রাগীব এবার কঠিন দৃষ্টিতে সালমা বেগমের পানে চাইলো। দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে বললো,
” অবশ্যই পারবো। কারণ আমার বোনের চরিত্র সম্পর্কে আমার যথেষ্ট জ্ঞান আছে। ও কেমন তা আমার জানা আছে। কিন্তু আপনার স্বামী সম্পর্কে হয়তো আপনার জানা নেই আন্টি। আপনার হাজবেন্ড কতটা লো কোয়ালিটির লোক তা আপনি আন্দাজও করতে পারবেন না। ”
সালমা বেগম তেতে উঠলেন এবার। ঝাঁঝালো গলায় বললেন,
” মুখ সামলে কথা বলো রাগীব। ভুলে যেও না উনি সাবিহার বাবা। ”
” ভুলে যাবো কেনো আন্টি। তবে কারোর সম্পর্কে না জেনে শুধুমাত্র কয়েকটা ছবি দেখে কারোর চরিত্র সম্পর্কে বিচার করে ঠিক কাজ করেননি আপনি। কারণ সবসময় চোখের দেখায় সব সত্য হয় না। আর এ ছবিতে শুধুমাত্র রামিশা নেই। আপনার স্বামীও আছে। আর নিশ্চয়ই আপনার স্বামীর মুখের অবস্থা আর রামিশার মুখের অবস্থা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন? এখানে কি আপনার মনে হয় রামিশার কোনো ভুল আছে? আসলে রামিশার কোনো ভুল নেই। সমস্ত ভুল, উঁহু সমস্ত পা’প আপনার স্বামী করেছে। হি ইজ দা ক্রি’মি’না’ল। ”
” কি যা তা বলছো রাগীব!”
” যা তা নয় আন্টি। আপনি জাননেও না আপনার স্বামী কি জ’ঘ’ন্য’তম কাজটা করেছে। হি ইজ এ রে’পি’স্ট। হি রে’প’ড মাই সিস্টার। হি কি’ল’ড মাই সিস্টার।”
রাগীবের মুখে ‘রে’প’ড’ শব্দটি শুনে সালমা বেগম স্তম্ভিত হলেন। হতবিহ্বল হলেন। বিবশ হয়ে এলো তার গোটা শরীর।
#চলবে