#প্রমত্ত_হৃদয়❤️২৫
#লেখনীতে:সারা মেহেক
আফসার সাহেবের নাম বলার পর সার্জো নিশ্চুপ রইলো। নত মস্তকে বসে রইলো সে। রাগীবের পরিকল্পনা অনুযায়ী সাবিহাকে তার বাবার নাম বলার কিছুক্ষণ পর তার সাহচর্যরা সার্জোর হাতের বাঁধন শিথিল করে দিবে। সেই সুযোগে সার্জো পালিয়ে যাবে। যেনো সাবিহা দ্বিতীয় কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ পায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাগীব তার সাহচর্যদের ইশারা করলো। তার সাহচর্যরা তাদের উপর অর্পিত কাজ করলো। সার্জোও সুযোগ বুঝে পালাতে চেষ্টা করলো। কিন্তু এর পূর্বেই ঘটে গেলো অপরিকল্পনীয় একটি ঘটনা৷ পার্টিতে আগত লোকমুখের চাপা গুঞ্জন, সাবিহার অবিশ্বাস, সব মিলিয়ে সাবিহা দিশেহারা হয়ে পড়লো, ক্রোধান্বিত হলো। নিজের বাবার নামে এ অপবাদ সে সহ্য করতে না পেরে হাতের গ্লাসটি মেঝেতে ছুঁড়ে সে সার্জোর দিকে এগিয়ে গেলো। সার্জো পালিয়ে যাওয়ার পূর্বেই সে হাঁটু দিয়ে আধবসা সার্জোর মুখ বরাবর এক লা’থি মা’রলো। ফলে ভারসাম্য হারিয়ে সার্জো মাটিতে পড়ে যেতে নিলো। কিন্তু এর পূর্বেই সাবিহা এগিয়ে সার্জোর পরনের শার্টের কলার চেপে ধরলো। এবার সার্জোর গালে এক থা’পড় বসিয়ে ক্রোধিত স্বরে বললো,
” হাউ ডেয়ার ইউ রা’স’কেল! আমার বাবার নামে এমন মিথ্যে কথা বলার সাহস পেলে কোথা থেকে?”
সাবিহার আকস্মিক আ’ক্র’মনে সার্জো, রাগীব ও তার সাহচর্যরা থতমত খেয়ে গেলো। কারণ তাদের পরিকল্পনায় এমন কিছুই ছিলো না৷ ফলে সার্জো সাবিহার এ হা’ম’লায় যেনো আকাশ হতে পড়লো। তৎক্ষণাৎ সাবিহার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সে সাবিহাকে ছাপিয়ে খানিক ক্রোধিত মিশ্রিত চাহনিতে রাগীবের দিকে চাইলো। রাগীব সাবিহার এ আ’ক্র’মণের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। ফলে সার্জোর এমন চাহনিতে সে নিজের মুখ লুকিয়ে কিছুটা পিছিয়ে এলো।
সার্জোর নিকট হতে কোনো জবাব না পেয়ে সাবিহা পুনরায় তাকে মা’র’লো। এ পর্যায়ে সার্জো এক প্রকার বাধ্য হয়েই নিজের পকেট হতে ফোন বের করে তাতে নিজের এবং আফসার সাহেবের কয়েকটি ছবি দেখালো। সাথে ড্রা’গসহ আফসার সাহেবের আমোদপ্রমোদে সময় কাটানো কয়েকটি মুহূর্তের ছবিও দেখালো এবং বললো,
” এ ছবিগুলো দেখার পর নিশ্চয়ই তুমি আমার কথায় সন্দেহ করবে না। তোমার বাবা যদি ড্রা’গ স্মা’গ’লার না হতো তবে আমার সাথে ছবি তুলতো না নিশ্চয়ই? ”
সার্জোর ফোনে ছবিগুলো দেখার পর সাবিহা পুরোপুরি নিশ্চিত হলো। এবার সন্দেহের আর কোনো অবকাশ রইলো না। সে নিজের স্থানেই থমথমে মুখে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। এরই সু্যোগে সার্জো পালিয়ে গেলো। পার্টিতে উপস্থিত লোকেরা তাকে পালিয়ে যেতে দেখে হইহট্টগোল মাতিয়ে দিলো। রাগীব তা দেখে তার সাহচর্যদের ইশারা করতেই তারা সার্জোর পিছু ধরলো।
সাবিহা নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে। আফসার সাহেবের এ গুপ্ত ব্যবসা সম্পর্কে জেনে সে নিস্তেজ হয়ে পড়লো। এ মুহূর্তে ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত তা নিয়েও সে যথেষ্ট বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো। কারণ অন্যান্য মেয়েদের মতো তার কাছেও তার বাবা একজন ‘পারফেক্ট ড্যাড’ এর প্রতিমূর্তি ছিলো। কিংবা আচমকা আগত এক ঝড়ে ক্ষুদ্র দুটি শব্দ তার কল্পিত সে প্রতিমূর্তি হতে আফসার সাহেবকে হটিয়ে দিতে বাধ্য হলো।
সাবিহাকে এরূপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাগীব ধীর পায়ে তার নিকট এগিয়ে গেলো। সাবিহার দু বাহুতে হাত রেখে মোলায়েম কণ্ঠে বললো,
” সাবিহা? এখানে থাকা আর ঠিক হবে না৷ বাড়িতে চলো। ”
সাবিহা কোনোরূপ জবাব দিলো না। নির্বাক চিত্তে রাগীবের সাথে হেঁটে পার্টি হতে বেরিয়ে এলো। রাগীব পার্কিং লট হতে গাড়ি বের করে সাবিহাকে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। তবে নিজে বসার পূর্বে একজনকে ম্যাসেজ দিয়ে বললো এঞ্জোকে যেভাবেই হোক তাদের নির্ধারিত স্থানে খুব শীঘ্রই যেনো নিয়ে আসে। এ ম্যাসেজ দিয়ে সে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো। কাল বিলম্ব বাদে নিশ্চুপ রয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
.
সাবিত নিজের রুমে বসে পড়াশোনা করছে। সামাদ ও আফসার সাহেব অফিসে গিয়েছেন। দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি কাটিয়ে দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে তারা অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন। এ মুহূর্তে সালমা বেগম রিডিং রুমে বসে আছেন। তার মস্তিষ্কে আনাগোনা করছে অভাবনীয় এক কার্য পরিকল্পনা। যার পরিণাম হবে ভয়াবহ এবং এ সম্পর্কে সালমা বেগম ভালোভাবেই অবগত রয়েছেন।
সালমা বেগম রিডিং রুমের অভ্যন্তরে আফসার সাহেবের ছোট রুমে গেলেন। ট্যুর হতে ফেরার পর আফসার সাহেব এখনও এ রুমে প্রবেশ করেননি। যদি উনি এরূপ কিছু করতেন তবে নিশ্চিত জেনে যেতেন এ বাড়ির সদস্যরা তার আড়ালে লুকিয়ে রাখা সত্য সম্পর্কে অবগত হয়েছে। তবে এমন কিছু না হওয়ায় উত্তম একটি সুযোগ পেলেন সালমা বেগম৷
তিনি গতকাল রাতে এ রুমে অবস্থিত টেবিলের ড্রয়ারে বেশ কিছু ড্রা’গের প্যাকেট দেখেছিলেন। অতঃপর সময় নিয়ে নিজের মাঝে যথেষ্ট সাহস সঞ্চারিত করে তিনি সেই অকল্পনীয় পরিকল্পনা সাজিয়েছেন। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী আফসার সাহেবের নাকে দম করে দেওয়ার জন্য হলেও তিনি এ অতি মূল্যবান ড্রা’গ’সগুলো মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে নষ্ট করে দিবেন। তিনি জানেন এতে করে তিরিক্ষি মেজাজের মানুষটি তার জীবন অতিষ্ঠ করে দিবেন। কিন্তু এতেও যেনো কোথাও না কোথাও এক আত্মিক শান্তি লুকিয়ে থাকবে।
সালমা বেগম রুমে পৌঁছে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লেন। অতঃপর ড্রয়ার হতে ড্রা’গ’সের প্যাকেটগুলো বের করে তা ছিঁড়ে ফেললেন এবং পুরো রুমের মেঝেতে ছড়িয়ে দিলেন। এ কার্য সাধনের পর তিনি এতে যে পৈ’শা’চিক আনন্দ খুঁজে পেলেন তা ভেবে উঠতেই তিনি কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলেন। নিজের এ পরিবর্তনটা ঢের উপলব্ধি করতে পারলেন তিনি।
সালমা বেগম জানেন, তার মাঝে এ পরিবর্তন অযথাই হয়নি। যদিও এ পরিবর্তনে যৎসামান্য সময়ের প্রয়োজন হয়েছে। জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাতটা পেয়ে তিনি নিজের অজান্তেই পরিবর্তন হয়েছেন। হয়তো এ পরিবর্তনে কোথাও না কোথাও প্রতিশোধের ছিঁটেফোঁটা ছিলো।
মানুষ ততক্ষণই নরম থাকে যতক্ষণ তার চারপাশের পরিস্থিতি ও মানুষ স্বাভাবিক থাকে। কিন্তু চারপাশের পরিবেশ ও মানুষগুলো যখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায় তখন নিজের মাঝে পরিবর্তন আনতে হয়। না চাইতেও কঠোর হতে হয়। পাথরের ন্যায় দৃঢ় হতে হয়। সালমা বেগমের ক্ষেত্রেও ঠিক এমনটি হয়েছে। তিনি নিজের এ পরিবর্তনে কোনো আফসোস বোধ করছেন না। তিনি এ-ও জানেন সাবিহাকে তার বাবার সম্পর্কে সবটা বলার পর তিনি সাবিহাকে সামলাতে পারবেন। দৃঢ় চিত্তের সাবিহাকে তিনি প্রস্তরের ন্যায় অতি দৃঢ় এবং দৃঢ় মানসিকতায় রূপান্তর করতে পারবেন।
সালমা বেগম মেঝেতে একবার নজর বুলিয়ে নিলেন। আফসার সাহেবের সাধের ড্রা’গ আজ ধুলোয় মিশে যাচ্ছে। তিনি দেখতে পাচ্ছেন অদূর ভবিষ্যতে আফসার সাহেব হারবেন। মুখ থুবড়ে হেরে যাবেন।
.
রাগীব ও সাবিহা বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে গাড়ি নিয়ে বসে আছে। সাবিহা তখন হতেই ঝিম মে’রে বসে আছে। তার মুখ হতে নিঃসৃত হচ্ছে না টু শব্দটুকুও। রাগীব ক্ষণিকের জন্য সাবিহার পানে চেয়ে রইলো। অতঃপর স্টিয়ারিং এর দিকে চেয়ে বললো,
” সাবিহা, তুমি রুমে যাও। আমার জরুরি কিছু কাজ আছে। শেষ করেই দেখা করছি তোমার সাথে। ”
সাবিহা কথা বললো না। নির্বাক ভঙ্গিতে সিটবেল্ট খুলে গাড়ি হতে বেরিয়ে পড়লো সে। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো বাড়ির ভেতরে। সাবিহা চলে যেতেই রাগীব গাড়ি স্টার্ট দিয়ে সে স্থান ত্যাগ করলো।
.
সাবিহা বাড়িতে প্রবেশ মাত্র দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কিয়ৎক্ষণ প্রথম সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রইলো সে। অতঃপর নিজের রুমে যাওয়ার বদলে সে সালমা বেগমের রুমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
সালমা বেগমের রুমে কোনোপ্রকার কড়াঘাত ব্যতিত ঢুকে পড়লো সে। অকস্মাৎ মেয়ের আগমনে খানিক চমকিত হলেন সালমা বেগম। হাতের চায়ের কাপ হতে দু ফোঁটা চা তার পরনের জামায় লেগে গেলো। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করলেন না তিনি। পার্টি হতে আগত সাবিহার শুষ্ক মুখখানা দেখে সালমা বেগম অনুমান করলেন, রাগীব নিশ্চয়ই সাবিহাকে তার বাবার সম্পর্কে কিছু বলেছে। এ বিষয়ে তিনি পুরোপুরি নিশ্চিত হলেন যখন সাবিহা তার নিকটে এসে দু পা ভাঁজ করে বসে বললো,
” আম্মু? তুমি কি জানো? বাবা একজন ড্রা’গ স্মা’গ’লার? ”
সালমা বেগম অনবগত হওয়ার ভান ধরলেন না। শান্ত কণ্ঠে বললেন,
” হ্যাঁ জানি। ”
সাবিহা এবার কিয়ৎ বিস্মিত হলো। চমকিত কণ্ঠে বললো,
” তুমি আগে থেকেই জানতে আম্মু? আমাকে বলোনি কেনো?”
” দু দিন হলো তোর বাবার সম্পর্কে সব কিছু জানতে পেরেছি। তোর বাবার চরিত্র, কাজ সম্পর্কে সব সত্য জানতে পেরেছি। তোর বাবার চরিত্র যে কতোটা নিচ তা ঐ মৃ’ত মেয়েগুলোর কাছ থেকে যদি শোনা যেতো তবে বিশ্বাস করতি তুই। ”
মায়ের এহেন কথায় সাবিহা বিবশ হয়ে পড়লো। হতবিহ্বল কণ্ঠে বললো,
” এসব কি বলছো আম্মু? মৃ’ত মেয়ে মানে? আমাকে ভালোভাবে বলো আম্মু৷ তোমার কথা বুঝতে পারছি না। ”
সালমা বেগম মেয়ের মায়াভরা মুখখানা দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মেয়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নত মস্তকে কিয়ৎক্ষণ বসে রইলেন তিনি। অতঃপর দুরুদুরু বুক নিয়ে অবসন্ন গলায় বললেন,
” তোর বাবা একজন রে’পি’স্ট পুতুল। ”
মায়ের মুখ নিঃসৃত গভীর ও ঘৃ’ণি’ত শব্দটি শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না সাবিহা। তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে এলো। চিন্তাশক্তি কিয়ৎক্ষণের জন্য লোপ পেলো। মস্তিষ্কে আনাগোনা করতে লাগলো এই একটি শব্দ। যা তীরের ন্যায় তার মস্তিষ্ক ও হৃদয়ে বিঁধিত হয়েছে। সালমা বেগম মেয়ের এ হতবিহ্বল দূর্বল অবস্থা নিমিষের মাঝে পর্যবেক্ষণ করলেন। কাল বিলম্ব বাদে তিনি পুনরায় বললেন,
” তোর বাবা রাগীবের আপন ছোট বোন রামিশাকে ড্রা’গ দিয়ে রে’প করেছে। এ ঘটনা শুধু রে’পের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো না। তোর বাবা রে’পের পর রামিশার মা’র্ডা’র করেছে। ”
#চলবে