#প্রমত্ত_হৃদয়❤️২৭
#লেখনীতে:সারা মেহেক
সাবিহার কঠিন ও দৃঢ় চাহনিতে আফসার সাহেবের ভস্মীভূত হয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়ে এলো। তিনি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে মেয়ের পানে তাকিয়ে আছেন। সালমা বেগমের চাহনিও অতি আশ্চর্যান্বিত। কিন্তু সাবিহা তার স্থানে দৃঢ় ও অচল। তার দৃষ্টি অকুতোভয়। কোমল, স্নিগ্ধ চেহারায় চোয়াল দুটো কঠিন হয়ে এসেছে। এ মুহূর্তে তাকে কোনো ভয় ঘেরাও করেনি। কিন্তু তার অন্তরাত্মা বারংবার কেঁপে উঠছে। ভেতরটা কেমন অগোছালো, এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। রক্তিমাভাব আঁখিজোড়া অসহায় অশ্রু টলমল করছে। সে কখনো ভাবেনি তার নিজেরই বাবাকে কোনো এক অনিবারনীয় পরিস্থিতিতে পড়ে এভাবে গান পয়েন্টে রাখতে হবে।
এদিকে আফসার সাহেব আড়ষ্ট গলায় বিপন্ন চাহনিতে চেয়ে বললেন,
” এটা কি করলি পুতুল? তোর কি মাথা ঠিক আছে? আমার…..”
আফসার সাহেবের কথা সম্পূর্ণ হতে না দিয়েই সাবিহা শক্ত ও ক্রুদ্ধ গলায় বললো,
” খবরদার ঐ নামে ডাকবে না আমাকে। পুতুল নাম ততক্ষণই তোমার মুখে মানায় যতক্ষণ তুমি আমাকে ভালোবাসো, স্নেহে আগলে রাখো। কিন্তু তুমি আমাকে মোটেও ভালোবাসতে না। ভালোবাসলে নিজের মেয়ের বয়সী একটা মেয়ের সাথে এই জ’ঘ’ন্য কাজটা করতে পারতে না। ”
সাবিহার কথা শুনে আফসার সাহেব নিশ্চুপ রইলেন। কারন তার নিজের পক্ষে সাফাই গাওয়ার মতো কোনো পথ বাকি নেই৷
কথা বলার মাঝে সাবিহা অনুভব করলো তার গলায় কান্নার দলা আটকে আসছে৷ বুকের উপর ভারী কিছু অনুভূত হচ্ছে। তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও এ পর্যায়ে তার দু চোখ বেয়ে দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। এ অশ্রুকে দৃষ্টির অগোচরে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে বললো,
” তোমাকে বাবা বলতেও রুচিতে বাঁধছে। কি করে তোমাকে বাবা বলি, বলো তো? তোমার কি একবারও বুক কাঁপেনি নিজের মেয়ের মতো আরেকটা মেয়ের সাথে এই খারাপ কাজ করতে? রামিশার সাথে যা হয়েছে তা যদি কেউ আমার সাথে করতো তাহলে….. ”
সাবিহার কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই আফসার সাহেব সশব্দে ধমক দিয়ে বলে উঠলেন,
” সবার সাথে নিজেকে তুলনা করতে যাস কেনো?”
আফসার সাহেবের হেন প্রশ্নে সাবিহা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,
” কেনো তুলনা করবো না? রামিশা কি আমার মতো মানুষ ছিলো না?”
আফসার সাহেব নিরুত্তর। উনি এ প্রশ্নের পিঠে আর কোনো কথা বলার শব্দ পেলেন না। কিন্তু এ সওয়াল জওয়াব এর মোড়া পাল্টাতে ঠিকই তিনি অন্য কথা চলে গেলেন। সাবিহার হাতের পি’স্ত’ল এখনও আফসার সাহেবের দিকে তাক করা। উপরন্তু তার আঙুল একদম ট্রিগারের উপরে রাখা। আফসার সাহেব সাবিহার হাতের পি’স্ত’লের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
” পি’স্ত’লটা ফেলে দে মা। যেকোনো মুহূর্তে অঘটন ঘটে যেতে পারে।”
সাবিহা এ কথার প্রেক্ষিতে তেরছা কণ্ঠে বললো,
” একটা অঘটন ঘটুক। তুমি যেমন অঘটন ঘটিয়েছো। তেমনি আমিও একটা অঘটন ঘটাই। ”
” মাথা ঠাণ্ডা কর পুতুল। ” এই বলে আফসার সাহেব সাবিহার কাঁধ পেরিয়ে সালমা বেগমের পানে চেয়ে অনেকটা ধমকের সহিত বললেন,
” কি ব্যাপার সালমা? তুমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছো কেনো? ওর হাত থেকে পি’স্ত’ল কেড়ে নিতে পারছো না?”
সালমা বেগম প্রশ্ন শোনার পরও ইচ্ছাপূর্বক নিশ্চুপ রইলেন। মায়ের হয়েই যেনো সাবিহা বলে উঠলো,
” আম্মুকে হুকুম করছো কেনো? বরং আমার জায়গায় এখানে আম্মু থাকলে মন্দ হতো না৷ এক ড্রা’গের জন্য তুমি তোমার এতো বছরের সঙ্গীকে মা’রতে যাচ্ছিলে! তাহলে তোমার জীবনে আম্মুর জায়গাটা কোথায়? আর আমারই বা জায়গা কোথায়? ”
” দেখ, পুতুল। এসব ড্রা’গ, মা’র্ডা’রের কথা বাদ দিয়ে একটু শান্ত হয়ে বোস না৷ তোর সাথে ভালোভাবে কথা বলি।”
আফসার সাহেবের হেন কথায় সাবিহা গর্জে উঠলো। বললো,
” ” শান্ত ভাবে কথা বলার মতো কিছুই রাখোনি তুমি। ”
আফসার সাহেব এবার ভীষণ বিস্ময়কর কণ্ঠে বললেন,
” তোর বাবার সাথে এভাবে কথা বলছিস তুই! এতো সাহস কে দিলো তোকে? আর আমার হাত ধরেই শিখানো শ্যু’টিং স্কিলগুলো এখন আমার উপর খাটাচ্ছিস তুই!”
” খাটাতে হচ্ছে। তুমি আমার সামনে আর পথ খোলা রাখোনি৷ এ মুহূর্তে তোমাকে একটুও সহ্য হচ্ছে না আমার৷ তুমি প্লিজ চলে যাও। ”
আফসার সাহেবের প্রত্যুত্তর দেওয়ার পূর্বেই সে রুমে হুড়োহুড়ি করে প্রবেশ করলো রাগীব ও সামাদ। সামাদ অফিস হতে ফিরেই নিজের রুমে দরজা আটকিয়ে ছিলো। আর রাগীব মাত্রই বাহির হতে বাড়িতে ফিরেছিলো। বাড়িতে ঢুকেই উপর হতে জোরালো কণ্ঠস্বরের কথাবার্তা শুনতে পায় রাগীব। এ কথাবার্তার উৎস জানতে প্রচণ্ড উৎসুকতার সহিত রাগীব সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে। দু সিঁড়ি পার হতেই তার পিছু পিছু সামাদও চলে এলো। এদিকে উপরের রুম হতে সাবিত সব শুনে আফসার সাহেবের রুমে যেতে নিলেই সামাদ তাকে রুমে আটকে বাহির হতে দরজা আটকিয়ে দিয়ে৷ অতঃপর সে ও রাগীব আফসার সাহেবের রুমে পৌঁছায়।
রাগীবকে রুমে প্রবেশ করতে দেখে সাবিহার দৃষ্টি ক্ষণিকের জন্য সেদিকে চলে যায়। রাগীবকে দেখে, তার সম্পর্কে সকল সত্য জানায় সাবিহার মেজাজ মুহূর্তেই উত্তপ্ত হয়ে উঠে। প্রচণ্ড ক্রোধে তার দু চোখ বেয়ে পুনরায় অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কিন্তু এ অশ্রু উপেক্ষা করে আফসার সাহেবের উদ্দেশ্যে উচ্চ স্বরে বলে,
” প্লিজ চলে যাও এখান থেকে। তোমাকে চোখের সামনে একটু সময়ের জন্যও দেখতে পারছি না। তুমি সময়মতো না গেলে আজ আমার হাতে নিশ্চিত একটা অঘটন ঘটে যাবে। প্লিজ আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও। ”
আফসার সাহেব আর কথা বাড়ালেন না। সালমা বেগমের প্রতি পুষে রাখা তীব্র চাপা ক্রোধ নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে স্থান ত্যাগ করলেন তিনি। আফসার সাহেব চলে যেতেই সাবিহা যেনো একদম ভেঙে পড়লো। কঠিন ইমারত মুহূর্তে কাঁদা মাটির ন্যায় মাটিতে মিশে গেলো। হাত থেকে পি’স্ত’ল ফেলে সাবিহা ধপ করে মাটিতে বসে পড়তেই সালমা বেগম পিছন হতে সাবিহাকে আগলে ধরেন। আলতো করে সাবিহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম সুরে তিনি বললেন,
” যে যেমন কাজ করেছে তার সাথে তেমন ব্যবহারই প্রাপ্য। ”
সাবিহা মুখ দিয়ে টু শব্দটুকুও উচ্চারণ করলো না। বরং নিঃশব্দে কান্নায় ভেঙে পড়লো। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে চাপা শব্দে কান্না করলো সে। তার বুক ভেঙে যেনো কান্নার স্রোত বইতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে ঘুরে নিজের মাকে ধরে কাঁদতে লাগলো সে। এদিকে কিছুক্ষণ পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনার আগামাথা কিছুই বুঝতে না পেরে সামাদ হতভম্ব হয়ে সালমা বেগমকে জিজ্ঞেস করলো,
” এসব কি হচ্ছে খালা?”
ক্রন্দনরত মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সালমা বেগম বললেন,
” পরে সব বিস্তারিত বলবো তোকে। ”
সামাদ আর কথা বাড়ায় না। বরং সাবিহার দিকে অগ্রসর হয়৷ তবে সাবিহার নিকটে যাওয়ার পূর্বেই নিকটবর্তী রাগীব সাবিহার সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে বললো,
” সাবিহা, নিজেকে সামলাও। এতো কান্না করলো শরীর অসুস্থ হয়ে যাবে। ”
রাগীবের কথা শেষ হওয়া মাত্র সাবিহা চট করে মাথা তুললো। অকস্মাৎ অনেকটা চিৎকার করেই রাগীবকে বললো,
” আমার সাথে এসব অভিনয় করো না। তোমার নাটক, তোমার মিথ্যেগুলো খুব ভয়ানক। তুমিও চলে যাও আমার সামনে থেকে। প্লিজ রাগীব চলে যাও। ”
সাবিহার কথা কর্ণপাত হওয়া মাত্রই রাগীবের দুনিয়া যেনো থমকে এলো। সে হতভম্ব চাহনিতে সাবিহার পানে চেয়ে রইলো। সাবিহা তার এ দৃষ্টির অন্তর্নিহিত কথা উপলব্ধি করে বললো,
” তোমার সম্পর্কে সব জানি আমি। সব। আম্মু আমাকে সব বলেছে। এবার দয়া করে, নিজের নাটক বন্ধ করে এসব মিথ্যে নিয়ে বেরোয় এ বাড়ি থেকে। তোমার ছায়াও আমার উপর দেখতে চাচ্ছি না আমি। যাস্ট গেট লস্ট রাগীব। ”
ঘৃ’ণায় ভরপুর সাবিহার প্রতিটি কথা শুনে রাগীব দিশেহারা হয়ে পড়লো। এই ভয়টাই সে নিজের মাঝে পুষে রেখেছিলো এতোদিন। আজ যে ঘটনা হওয়ার ভয় ছিলো সেটাই হলো। রাগীব তো এমনটা চায়নি। তাহলে এমনটা হলো কেনো? এখন সে এ অগোছালো জিনিসগুলো গুছাবে কি করে? কি করে সাবিহাকে নিজের ভালোবাসা বুঝাবে? সে ভেবে পেলো না৷ তার মস্তিষ্ক যেনো শূন্য হয়ে পড়লো।
সাবিহা পুনরায় কিছু বলার পূর্বে ভগ্নহৃদয় নিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। ধীর পদে হেঁটে রুম হতে বেড়িয়ে যাওয়ার পূর্বে ক্রন্দনরত অসহায় সাবিহাকে এক নজর দেখে নিলো। অতঃপর রুম হতে বেরিয়ে সিঁড়িঘরে আসতেই কাঁচের জানালা দিয়ে সে দেখলো, আফসার সাহেব নিজের গাড়ি নিয়ে বাড়ি হতে বেরিয়ে পড়ছে। আফসার সাহেবক বেরোতে দেখেই রাগীব মুহূর্তেই ফোন নিয়ে এন্ড্রুকে কল দিলো। এন্ড্রু কল রিসিভ করতেই রাগীব ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
” সাবিহার বাবা মাত্রই বেরিয়েছে বাড়ি থেকে। কালো কালারের গাড়ি নিয়ে। গাড়ি চিনো তো এন্ড্রু, ঠিক না?”
ওপাশ হতে বাধ্য ছেলের ন্যায় এন্ড্রু বললো,
” জি স্যার চিনি। আপনি নিশ্চিত থাকুন। এ নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। বাকি কাজ খুব শীঘ্রই হয়ে যাবে। ”
” কাজ শেষে ফোন দিও আমাকে। ”
” ওকে স্যার।”
রাগীব এন্ড্রুর কথার প্রত্যুত্তর না দিয়ে কল কেটে দিলো। কাঁচের জানালা ভেদ করে অদূরে চলমান আফসার সাহেবের গাড়ির দিকে চেয়ে স্বগোতক্তি করে বললো,
” ইউ হ্যাভ টু পে ফর দিস বা’স্টা’র্ড। ”
#চলবে