প্রমত্ত_হৃদয়❤️,২৮

1
1735

#প্রমত্ত_হৃদয়❤️,২৮
#লেখনীতে:সারা মেহেক

রাগীবের আস্তানার চিরপরিচিত সেই রুমটিতে আফসার সাহেব আটককৃত অবস্থায় আছেন।প্রাণপনে হাত ও পায়ের বাঁধন খোলার চেষ্টা করছেন তিনি। কিন্তু কাঠের চেয়ারের সাথে দড়ি দিয়ে শক্ত করে হাত পা বাঁধা থাকায় তিনি শত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। প্রচণ্ড ক্রোধে উচ্চস্বরে তিনি রাগীবকে বাংলা, ইংরেজি মিলিয়ে কয়েকটি গা’লিও দিলেন। তার বাংলা গা’লিগুলো ইতালিয় গার্ডদের মাথায় ঢুকলো না। তবে ইংরেজিগুলো বেশ ধরতে পারলো তারা। রাগীবের সম্পর্কে গা’লিগুলো শুনে একজন গার্ড নিজেকে শান্ত রাখতে পারলো না। ফলস্বরূপ আফসার সাহেবের ডান গালে একটা ঘুষি মেরে বসলো। আফসার সাহেবও কম নয়। আবদ্ধ হাত পা নিয়েও তার তেজ কমলো না একটুও। এবার ক্রোধিত স্বরে গার্ডটিকেও কয়েকটি গা’লি দিয়ে বসলেন। তার এ মুখের ভাষা শুনে গার্ডটির পায়ের রক্ত যেনো মাথায় উঠে গেলো। সে পুনরায় আফসার সাহেবকে মা’রতে উদ্যত হলো। কিন্তু অবস্থা বেগতিক হওয়ার পূর্বেই সে স্থানে রাগীবের আগমন ঘটলো। রাগীব দ্রুত এসে গার্ডটিকে থামিয়ে বললো,
” রিল্যাক্স আর্তো, আমার শ্বশুর মশাইকে এতো মে’রো না। তার জন্য আমি স্পেশাল খাতির যত্নের ব্যবস্থা করেছি।”
এই বলে সে পাশে থাকা চেয়ারটি টেনে আফসার সাহেবের সম্মুখে নিয়ে বসলো৷ গার্ডও রা’গে ফুঁসতে ফুঁসতে খানিক দূরে গিয়ে দাঁড়ালো।

এদিকে অকস্মাৎ রাগীবের আগমন দেখে আফসার সাহেব কিঞ্চিৎ স্তম্ভিত হলেন। তবে পরমুহূর্তেই তিনি প্রচন্ড ক্রোধে ফেটে পড়লেন। উগ্র ভাষায় রাগীবকে ইচ্ছেমতো গা’ল’ম’ন্দ করে তিনি বললেন,
” তোর জন্য আজ আমার মেয়ে আমার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে আছে। একবার ছাড়া পেয়ে নেই। তারপর তোর একদিন কি আমার একদিন। ”

আফসার সাহেবের এ গরম মস্তিষ্কের ঝলসে পড়া কথা শুনে রাগীব উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। অতঃপর অতি শান্ত স্বরে মৃদু হাসির সহিত আফসার সাহেবকে বললো,
” রিল্যাক্স শ্বশুর মশাই, রিল্যাক্স। এতো হাইপার হলে তো চলবে না৷ আর চোরের গলা এতো বড় হতে হয় না। শিখেননি বিষয়টা?”

আফসার সাহেব পুনরায় ক্রোধিত স্বরে দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
” এসবের মূল তুই। তুই এসব জানলি কি করে? আর তোর চারপাশে এরা কারা? তুই কে আসলে?”

রাগীব ক্ষীণ শব্দে হাসলো। অতঃপর বললো,
” রাজীব শাহরিয়ারকে চিনেন?”

আফসার সাহেব চিনলেন না। নামটি সম্পূর্ণরূপে অপরিচিত শোনালো তার কানে। ফলস্বরূপ প্রশ্নাতুর চাহনিতে চেয়ে রইলেন তিনি। তার এ চাহনি দেখে রাগীব পুনরায় ক্ষীণ শব্দে হাসলো। বাম পাশে মাথা ঘুরিয়ে খানিক বিরক্তির সহিত স্বগতোক্তি করে বললো,
” আসল নাম চিনে না কেনো, উফ! ঝামেলা। ”
এই বলে সে আফসার সাহেবের দিকে ফিরলো। দৃষ্টি কিয়ৎ কঠিন করে বললো,
” আলেজান্দ্রোকে চিনেন?”

আফসার সাহেবের চমকিত হলেন। দৃষ্টি স্থির হয়ে এলো। তবে তার স্থির দৃষ্টিতে আশ্চর্যান্বিত ভাব স্পষ্ট। তিনি কিয়ৎক্ষণ বিস্মিত দৃষ্টিতে রাগীবের পানে চেয়ে রইলেন। অতঃপর অস্ফুটস্বরে বলে উঠলেন,
” গ্যাং’স্টার আলেজান্দ্রো?”

রাগীব যেনো এবার হাফ ছেড়ে বাঁচলো এমন ভান করে বললো,
” যাক, চিনতে পারলেন তাহলে। ”
এই বলে সে আফসার সাহেবের দিকে চেয়ার খানিক এগিয়ে নিলো। বসে থাকা অবস্থাতেই সে আফসার সাহেবের দিকে সামান্য ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো,
” ইয়াহ, গ্যাং’স্টার আলেজান্দ্রো। আমি তার একমাত্র ছেলে আর রামিশা ছিলো তার একমাত্র মেয়ে। ”

রাগীবের হেন কথা কর্ণপাত হওয়া মাত্রই আফসার সাহেব থমকে গেলেন। চক্ষুপল্লব বিস্তার হলো বিস্ময়ে। মুখের ভাষা হারিয়ে ফেললেন তিনি। বারংবার রাগীবের শেষোক্তটিই কথাটি তার কানে ঝংকার তুললো। রামিশা আলেজান্দ্রো উর্ফে রাজীব শাহরিয়ারের মেয়ে! তিনি এটা জানতে পারলেন না কি করে! ভেনিসে ড্রা’গের ব্যবসা শুরু করার পর হতে তিনি বেশ ক’বার সিসিলির বিখ্যাত গ্যাং’স্টার আলেজান্দ্রোর নাম শুনেছেন৷ কিন্তু কখনো ভাবেননি অজান্তেই আলেজান্দ্রোর সাথে জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রুতা যেচে পড়ে নিবেন তিনি। রামিশা আলেজান্দ্রোর মেয়ে জানলে তিনি কখনোই রামিশার সংস্পর্শে যেতেন না৷ উপরন্তু এখন তিনি এ-ও জানলেন, রাগীব আলেজান্দ্রোর ছেলে। আর এই রাগীবকেই তিনি বিয়ের দিন গা’ন পয়েন্টে রেখেছিলেন! ভাবতেই গা শিউরে উঠলো তার। রাগীবের নিকট হতে সব জানার পর তিনি এখন নিশ্চিত যে এ যাত্রায় রক্ষা পাওয়া দায়। এ ভাবতেই তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে এলো। তিনি শুকনো একটা ঢোক গিলে রাগীবের পানে চাইলেন। রাগীব তার এ ভয়ার্ত ও স্তম্ভিত দৃষ্টি দেখে ভীষণ মজা পেলো। বললো,
” ঠিক এই রিয়েকশনটাই দেখতে চাচ্ছিলাম এতোদিন ধরে। সঠিক সময়ে সঠিক রিয়েকশন দেওয়ার জন্য থ্যাংকস, শ্ব-শু-র মশাই। ”
সম্বোধনে জোর দিয়ে বললো রাগীব। সে পুনরায় বললো,
” তাহলে নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন আপনার সাথে এরপর কি কি হতে চলেছে?”

আফসার সাহেব নির্বাক। তিনি এখনও সেই ধাক্কা হতে বেরিয়ে আসতে পারেননি৷ উপরন্তু নিজের কৃতকর্মের ফলে ভবিষ্যত পরিণতির কথা ভেবে তিনি আরোও শিউরে উঠলেন। রাগীব তার এ শোচনীয় প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করে বললো,
” নিশ্চয়ই চোখের সামনে অতীত ভাসছে। ঠিক না? এটা জেনে রাখুন যে আপনাকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না শ্বশুর মশাই। আমি এটার শিওরিটি দিতে পারি যে আপনার পরিণতি হবে সবচেয়ে ভয়াবহ। যা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। কারণ আপনি রামিশার রে’পি’স্ট ও খুনি।”
শেষোক্ত কথাটি বেশ কাঠিন্যের সহিত বললো সে। তার চাহনিতেও ছেয়ে উঠেছে তীব্র কাঠিন্যের ছাপ। আর সময় গড়িয়ে যেতে যেতে এ কাঠিন্য ক্রোধে পরিণত হতে লাগলো। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে করতে অকস্মাৎ রেগে যাওয়া রাগীবের স্বভাব। এ পরিস্থিতিতেও সে স্বভাবের ব্যতিক্রম হলো না। হুট করেই যেনো চরম পর্যায়ের ক্রোধান্বিত হলো সে৷ নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে অঘোষিতভাবে আফসার সাহেবের শার্টের কলার চেপে ধরলো সে। দড়ির বাঁধনে আবদ্ধ আফসার সাহেবের শার্টের কলার চেপে চেয়ারসহ খানিক এগিয়ে এনে চিবিয়ে চিবিয়ে রাগীব বললো,
” তোকে এমন জ’ঘ’ন্য মৃত্যু দিবো যে রাস্তার কু’কু’রও তোর লা’শের পাশ দিয়ে ঘেঁষতে ভয় পাবে। সেসময় হাজারো মাফ চাইলেও তোকে ছাড়বো না। মনে রাখিস। তোর কিন্তু উল্টো কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গিয়েছে। রামিশার মা’র্ডা’রের শাস্তি না দেওয়া পর্যন্ত আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবো না বা’স্টা’র্ড। ”
এই বলে সে আফসার সাহেবের মুখ বরাবর একটি ঘু’ষি মেরেই উঠে চলে যায়। আফসার সাহেব রাগীবরে এ মা’রে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চেয়ারসহ মেঝেতে পড়ে যান৷ ফলে ঠোঁট কেটে উষ্ণ রক্ত বেরিয়ে পড়ে। তীব্র ব্যাথায় ককিয়ে উঠেন তিনি।

রাগীব চেয়ার ছেড়ে উঠে কয়েক কদম এগুতেই অনিকের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। অনিক সিসিলি হতে কিছুক্ষণ পূর্বেই ভেনিসে এসেছে। ভেনিসে পৌঁছানো মাত্রই সে তাদের নির্দিষ্ট ঠিকানায় চলে আসে।
অনিক মেঝেতে পড়ে থাকা আফসার সাহেবের দিকে দৃষ্টি দিয়ে রাগীবকে জিজ্ঞেস করলো,
” মে’রে’ছিস না কি?”

রাগীব বি’তৃষ্ণা ভরা চাহনিতে একবার পিছে ফিরে আফসার সাহেবের পানে চাইলো। অতঃপর ভীষণ বিরক্ত সহকারে বললো,
” একটা পা’ঞ্চ মে’রে’ছি যাস্ট। মন চাইলো আরো কয়েকটা বসিয়ে দেই।”
এই বলে সে অনিকের পানে চাইলো। কণ্ঠে স্বাভাবিকতা এনে বললো,
” শোন অনিক, আমি খুব টায়ার্ড। এই ব্যাটার অলক্ষুণে মুখটা আর দেখতে মন চাইছে না। ওর সাথে যা করার তুই কর। কিন্তু একটা জিনিস মনে থাকে যেনো…..”

রাগীবের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই অনিক তাকে আশ্বস্ত করলো,
” টেনশন নিস না। আমার এতো মাসের শো’ধের আগুন আজ একটু নিভাবো। বাকিটা পরের জন্য।”
এই বলে সে আফসার সাহেবের দিকে এগিয়ে গেলো। তাকে চেয়ারসহ মেঝে হতে উঠিয়ে সোজা করিয়ে বসালো অনিক। এরপর রাগীব চলে যেতেই সে আফসার সাহেবের ডান চোয়ালে সর্বশক্তি দিয়ে একটা ঘু’ষি মা’রলো। আফসার সাহেব অনিকের এ আ’ক্র’মণের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। নিজেকে পরিপূর্ণ স্থির করার পূর্বেই অনিক তার গালে একটা ঘা মেরে বসলো। ফলস্বরূপ পুনরায় মেঝেতে পড়ে গেলেন তিনি। এ পর্যায়ে তার ডান পাশের ঠোঁটের অনেকাংশ কেটে গেলো। এক প্রকার গলগল করেই উষ্ণ রক্তের বয়ে গেলো সেখান হতে। অনিক সে অবস্থাতেই আফসার সাহেবের শরীরে বার কয়েক লা’থি মারলো। অতঃপর পুনরায় তাকে মেঝে হতে তুলে আরেকটা ঘু’ষি মেরে বললো,
” তোর সাথে আরো অনেক কিছু করার আছে। এগুলো তো কিছুই না। তুই রামিশাকে যেভাবে কষ্ট দিয়ে মে’রে’ছিস এর বদলে তো এগুলো কিছুই না। রাস্তার কু’কু’রদের তোকে জলজ্যান্ত কামড়ে খাওয়ার সুযোগ দিলেও বোধহয় কম হবে।
তুই কি জানিস আমি রামিশাকে কত ভালোবাসতাম? ও বেঁচে থাকলে এ বছরের জানুয়ারিতেই আমাদের বিয়ে হতো। কিন্তু তুই আমাদের সে সুখটা কেড়ে নিলি। সমস্যা নেই, যে কদিন এখানে বন্ধি আছিস, ম’রা’র মতো বেঁচে থাকবি তুই। ”
এই বলে অনিক যেতে নিলো। যাওয়ার পূর্বে গার্ডদের বলে গেলো আফসার সাহেবকে যেনো এক ফোঁটা পানিও না দেয় তারা৷

এ পুরো সময় আফসার সাহেব মুখ দিয়ে টু শব্দটুকুও করেননি৷ কারণ তিনি জানেন, হাজার চিৎকার করলেও লাভ হবে না কিছুই৷ বরং এই দুইজন আরো রেগে অবিশ্রাম মা’রধর করতো তাকে।

.

সালমা বেগমের নিকট হতে আফসার সাহেবের কালো কৃতকর্মের কথা শুনে হতভম্ব হলো সামাদ। সে যেনো কিছুতেই নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারলো না, তার শ্রদ্ধেয় খালু একজন রে’পি’স্ট! সে নির্বাক চিত্তে মেঝের দিকে চেয়ে রইলো। সে আফসার সাহেবের সকল কাজের সঙ্গী ছিলো৷ ফলে টুকটাক ড্রা’গ স্মা’গ’লি’ঙেও তার হাত ছিলো। কিন্তু কখনো মেয়েদের সম্মানের সমঝোতা করেনি সে৷ অথচ তারই গুরুজন, তার শ্রদ্ধার পাত্র খালু এ নিচ কাজ করে বসলো! এখনো নিজেকে বিশ্বাস করাতে পারছে না সে।

সামাদের এ বিস্ময়ে স্তম্ভিত রূপ দেখে সালমা বেগম অনেকটা খোঁচা দিয়েই বললেন,
” তোর বুঝি ড্রা’গ স্মা’গ’লিং এ হাত নেই সামাদ? থাকলে বলে দে। বিশ্বাস কর, একটুও অবাক হবো না আমি। কারণ তোর খালুর ওসব কালো সত্যের সামনে এটা কিছুই না। ”

সালমা বেগমের প্রশ্নে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো সামাদ। তার এ নিশ্চুপতা দিয়েই সে প্রশ্নের জবাব দিয়ে বসলো। সালমা বেগম সামাদের এ স্বীকারোক্তিতে মোটেও বিস্মিত হলেন না। উল্টো তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
” তুই না উনার ডান হাত ছিলি সামাদ? তাহলে তুই উনার বা হাতের খবর জানলি না কি করে?”

সামাদ নিরুত্তর। নিজেকে আজ বড্ড ব্যর্থ মনে করছে সে। এক ব্যর্থ পুরুষ যে নিজের বোনের ন্যায় অপর একটি মেয়ের মান সম্মান, প্রাণ কিছুই রক্ষা করতে পারেননি। সালমা বেগম তাকে আর দোষারোপ করলেন না। বরং জানালা হতে ঝকঝকে দিনের দৃশ্য দেখতে লাগলেন। খানিক বাদে নিজের ভাগ্যের উপর তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,
” ভাগ্যে খারাপ লেখা থাকলে আর কে কি করতে পারে। জন্ম থেকেই আমার ভাগ্যটা খারাপ। মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্ত এ ভাগ্য নিয়েই চলতে হবে আমার।”
এই বলে তিনি এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পরলো কয়েক ফোঁটা নোনা জল।

.

ব্যালকনির রেলিঙ ধরে ফুঁপিয়ে চলছে সাবিহা। রাত পেরিয়ে ভোর, ভোর পেরিয়ে সকালের স্নিগ্ধতা। এখনও অবিরাম কেঁদে চলছে সাবিহা। ভোর হওয়ার কিছু পূর্বে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কোলেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছিলো সে। কিন্তু ঘণ্টা খানেকের ঘুমেই রাগীব ও তার বাবাকে নিয়ে দেখা এক দুঃস্বপ্নে ঘুম ভেঙে যায় তার। তখনই নিজের রুমে চলে আসে সে।
রুমে এসেই আরেক দফা কান্না শুরু করে দেয় সে। আজ যেনো তার দু চোখের অশ্রুরা পাল্লা দিয়েছে।এমন যে, কে কার চেয়ে বেশি বেরুতে পারে।

সাবিহা ফুঁপাতে ফুঁপাতে ডান হাতের তালুর দিকে চাইলো। সেদিকেই দৃষ্টি রেখে আফসার সাহেবের অনুপস্থিতিতে তার উদ্দেশ্যে বললো,
” এমনটা না করলেও পারতে আব্বু। তুমি এতো খারাপ হলে কবে? একবারও কি আমাদের কথা মনে হয়নি তোমার? আমার এখনোও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আমি তোমাকে গা’ন পয়েন্টে রেখেছিলাম। আমার আপন বাবাকে! যে কি না একজন রে…..”
সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই ডুকরে কেঁদে উঠলো সাবিহা। কিয়ৎক্ষণ নীরবে কেঁদে স্বগোতক্তি করে বললো,
” আব্বু, তোমার এ সত্যটা কেনো জানলাম আমি?কি হতো যদি সারাজীবন তুমি আমার কাছে একজন হিরো হিসেবে থাকতে? কি হতো যদি সারাজীবন তোমাকে আদর্শ মেনে চলতাম। কিন্তু বাস্তবতা তো ভিন্ন। এ বাস্তবতা খুব তেতো। যা গলা দিয়ে গিলে ফেলা অসম্ভব। বরং এ তেতো সত্য আজীবন গলায় এসে আটকে থাকবে। আমি আর পারছি না আব্বু। তুমি আমাকে দূর্বল করে দিয়ে গেলে। আমার সব শক্তি মুহূর্তেই কেড়ে নিলে। আমার সব সুখ, ভালোবাসা কেড়ে নিলে। ”
এই বলে সে শূন্য দৃষ্টিতে আকাশপানে চাইলো। এখন আর কাঁদছে না সে। থেকে থেকে ফুঁপিয়ে উঠছে বরং। বাবাকে নিয়ে অতিত, বর্তমান, ভবিষ্যত কল্পনা করতে করতে তার কল্পনার কলম গিয়ে ঠেকলো রাগীবের স্মৃতিতে। তার স্মৃতিপটে ভেসে এলো রাগীবের সাথে তার প্রথম দেখা, প্রথম ব্লাইন্ড ডেট, প্রথম হাতে হাত রেখে চলা, প্রথম স্পর্শ। তার মনে পড়লো তাদের সেই ভালোবাসায় পূর্ণ সময়গুলো। যা তার সমস্ত শরীরে বিষাক্ত তীরের ন্যায় বিদ্ধ হলো। রাগীবের প্রতি একরাশ অবিশ্বাস্য, অভিমান নিয়ে অভিযোগের সুরে বললো,
” আমার প্রথম ভালোবাসা হয়ে এভাবে আমার অনুভূতির সাথে খেলার কি দরকার ছিলো রাগীব? আমি বুঝতেই পারিনি তুমি রিভেঞ্জের জন্য আমার সাথে এমন নাটক করবে। তোমাকে কখনও ক্ষমা করবো না আমি৷ তুমি আমার আরেক দূর্বলতা সুযোগ নিয়েছো। ”

” আমি তোমার কোনো দূর্বলতার সুযোগ নেইনি স্নিগ্ধময়ী। আমি তোমাকে ভালোবাসি। ”

অকস্মাৎ রাগীবের কণ্ঠস্বর কর্ণকুহরে এসে বাড়ি প্রাপ্ত হতেই চমকে উঠলো সাবিহা। মুহূর্তেই তার প্রতিবর্ত ক্রিয়ার ফলে পিছনে ফিরে রাগীবকে এক ধাক্কায় কয়েক কদম পিছিয়ে দিলো সে। তৎক্ষনাৎ গর্জে উঠে বলে উঠলো,
” খবরদার আমাকে ও নামে ডাকবে না। আর আমার কাছে আসারও চেষ্টা করবে না। এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাও। না হলে আমি নিজের কন্ট্রোল হারিয়ে খারাপ কিছু করে ফেলবো। ”

সাবিহার এ ব্যবহার রাগীবের হৃদয়ে বিষাক্ত ফলার ন্যায় বিঁধলো। সে অসহায় চাহনিতে সাবিহার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” সাবিহা? আমার কি দোষ এতে? আমি……”

রাগীবকে মাঝপথে থামিয়ে সাবিহা চিৎকার করে বললো,
” আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না এখন। আমার মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হয়ে আছে। আমি চাই না আমার দ্বারা খারাপ কোনো কাজ ঘটে যাক। তুমি প্লিজ চলে যাও রাগীব। চলে যাও।”
এই বলতে বলতে সাবিহা নতজানু হয়ে বসে কান্নায় ভেঙে পড়লো। রাগীব লক্ষ্য করলো, তার স্নিগ্ধময়ীর মলিন মুখখানা। তার ভীষণ মায়া হলো। এ মুহূর্তে সাবিহাকে দেখে রাখা, সাবিহার পাশে থাকা, সাবিহার মনোবল বাড়ানো উচিত ছিলো তার৷ কিন্তু সে ব্যর্থ। সে এসবের কিছুই করতে পারছে না৷ সে নিরুপায়। আজ বক্ষস্থলে আগলে রাখা মানুষটিই তাকে সেখানে আঘাত করে চলছে৷ কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছে না সে৷ আবার এ তীব্র ব্যাথাও সহ্য করতে পারছে না! কি এক দুর্বিষহ যন্ত্রণা! কেনো পারছে না সে তার স্নিগ্ধময়ীকে এসব দুঃখ কষ্ট হতে আগলে রাখতে!

রাগীব পুনরায় সাবিহার দিকে এগিয়ে গেলো। কিন্তু এ পর্যায়ে সাবিহা কাঁদতে কাঁদতে দূর্বল কণ্ঠে বললো,
” দয়া করে চলে যাও রাগীব। আমি আর কাঁদতে পারছি না। আমার শরীর আর আমার সাথে নেই।”
বলে সে উঠতে নিলো। কিন্তু পুরোপুরি উঠে দাঁড়াতে পারলো না। মুহূর্তেই তার চারপাশ আঁধারে ছেয়ে গেলো। মাথায় ঝিম ঝিম করতে লাগলো। সে বুঝতে পারলো, জ্ঞান হারাতে চলেছে সে। এ বুঝে উঠার নিমিষের মাঝেই জ্ঞান হারালো সে। ছেড়ে দেওয়ার শরীরের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টো হয়ে মেঝেতে পড়ে যেতে নিলেই রাগীব তাকে ধরে ফেললো।

#চলবে

1 COMMENT

  1. স্যার প্লিজ একটু তারাতারি নেক্সট এপিসোড টা দিন প্লিজ, আমার আর সহ্য হচ্ছে না। এটি যথেষ্ট ভালো গল্প দয়া করে আপনি এটি তাড়াতাড়ি পোস্ট করুন এর পরবর্তী এ বিষয়গুলো আমরা খুব মিস করছি প্লিজ স্যার তাড়াতাড়ি পোস্ট করুন। ❤️❤️❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here