#প্রমত্ত_হৃদয়❤️,৩০
#লেখনীতে:সারা মেহেক
পাশ্চাত্যের অভিজাত শহর ভেনিস উৎসবের আমেজে মুখোরিত। পুরো ভেনিস শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে রঙ বেরঙের পোশাকে আচ্ছাদিত বিভিন্ন পেশার মানুষজন। যাদের প্রত্যেকের মুখে রয়েছে বাহারি রঙ ও ডিজাইনের মাস্ক। পোশাকের সাথে মিল রেখে বানানো মাস্কগুলো তাদের আসল পরিচয় ঢেকে দিচ্ছে। তাদের বানিয়ে দিচ্ছে আগন্তুক। কেউ জানতে পারছে না মাস্কের ওপাশের মানুষটি কে। সকলে দেখছে তাদের বহিঃরূপ। এ মাস্ক পরা উৎসবের নাম কার্নিভাল উৎসব। প্রতি বছর সারা বিশ্বের ন্যায় ভেনিসেও এ উৎসব জমজমাটভাবে পালন করা হয়। এটি হয় প্রতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। যার ব্যাপ্তিকাল দু সপ্তাহেরও বেশি থাকে। এগারো শতক থেকে প্রতি বছর ভেনিসে কার্নিভাল ফেস্টিভ্যাল হয়। সেখানকার স্থানীয়রা বিশ্বাস করে এ উৎসব সাম্য ও ঔদার্যের প্রতীক।
এ বছর সেইন্ট মার্ক স্কয়ারে কার্নিভাল ফেস্টিভ্যালের আয়োজন করা হয়েছে। যেখানে কস্টিউম শো ও কস্টিউম কনটেস্টের আয়োজন করা হয়েছে। এখানে বিনামূল্যে প্রবেশের সুবিধা রয়েছে বলে অগণিত মানুষের ভীড় দেখা যাবে এখানে।
আফসার সাহেব গতকাল রাতে পালিয়েছেন৷ তার পালিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া মাত্র অনিক ও রাগীব সেখানে ছুটে চলে যায়। সেখানে গিয়ে জানতে পারে আফসার সাহেবকে দুজন গার্ডের হাতে রেখে বাকি গার্ডরা খাওয়াদাওয়া করতে বেরিয়েছিলো। এরই মাঝে আফসার সাহেব কিভাবে যেনো নিজের বাঁধন হতে মুক্তি পেয়ে যায়। উনি হাত ও পায়ের বাঁধন খুলে পালিয়ে গেলে সেই দুজন গার্ড তাকে ধাওয়া করে। পথে তাকে পাকড়াও করলেও উনি গার্ডদের উপর হা’মলা করে পুনরায় পালিয়ে যান৷ তবে বেশ কয়েক কদম যেতেই হা’ম’লার শিকার হওয়া একজন গার্ড তার পায়ে গু’লি চালিয়ে বসে। এতে আফসার সাহেব আহত হলেও নিজের মধ্যে থাকা তেজ হারাননি। আঘাতপ্রাপ্ত পা নিয়েই উনি কোনোমতে সে স্থান হতে ছুটে চলে যান।
আফসার সাহেবের এ কান্ডের কথা জেনে রাগীবের মেজাজ গরম হয়ে উঠেছিলো। ফলস্বরূপ গার্ডদের আচ্ছামতো কিছু কথা শুনিয়ে দেয় সে। তবে তার এ তিরিক্ষি মেজাজ ঠান্ডা করতে সাহায্য করে অনিক। অনিকের কথা শুনে রাগীব শান্তও হয়। পরে গার্ডদের নির্দেশ দেয় আফসার সাহেবকে খুঁজে বের করতে। কিন্তু গতকাল রাত হতে আজ দুপুর অব্দিও তারা আফসার সাহেবকে খুঁজে পায়নি৷ রাগীব নিশ্চিত, আফসার সাহেব রাগীবের চেনা পরিচিত কোনো জায়গায় অবস্থান করেনি। তাহলে উনি আশ্রয় নিয়েছেন কোথায়?
দুপুরের দিকে রাগীবের ফোনে মিস্টার ডেভিডের কল এলো। মিস্টার ডেভিড তাকে জানালেন, আফসার সাহেব তাদের কাছে এসেছিলেন। কিন্তু ভালোভাবে বসে বিস্তারিত কথা বলার পূর্বেই তিনি ভীত চেহারা নিয়ে সেখান থেকে চলে যান। মিস্টার ডেভিডের নিকট এ তথ্য শোনার পর রাগীব নিশ্চিত হতে পারলো আফসার সাহেব ভেনিসেই আছেন৷ ভেনিস হতে পালিয়ে যাননি তিনি। তাহলে এ মুহূর্তে কোথায় অবস্থান করতে পারেন তিনি? এ ভাবতে ভাবতে অকস্মাৎ তার মাথায় কার্নিভাল ফেস্টিভ্যালের কথা মনে পড়লো। সে ভাবলো, এ মুহূর্তে আফসার সাহেব চেনা পরিচিত কোনো জায়গায় যাবেন না। একা থাকতে ভয় পাবেন। কারন এতে তার উপর হা’মলা করতে সুবিধা হবে। এক্ষেত্রে উনি ভিড়ভাট্টা পূর্ণ জায়গায় থাকতে চাইবেন। আর ভিড়ভাট্টা পূর্ণ জায়গা বলতে এ মুহূর্তে কার্নিভাল ফেস্টিভ্যালের চেয়ে ভালো কোনো জায়গা হয় না। কিন্তু এতো মানুষের মুখোশের আড়ালে সে আফসার সাহেবকে চিনবে কি করে? এ নিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলো সে।
” আ’ম শিওর ঐ বুড়ো ব্যাটা কার্নিভাল ফেস্টিভ্যালেই থাকবে। ” বললো রাগীব।
অনিক এক চুমুক ও’য়া’ইন খেয়ে বললো,
” কিন্তু এতো মুখোশের ভীড়ে ঐ ব্যাটাকে খোঁজা কম না। ”
” সেটাই চিন্তার বিষয়। এর মধ্যে উনাকে খুঁজবো কি করে?”
নিচের ঠোঁট কামড়ে ভাবনায় মশগুল হলো রাগীব। তার ভাবনায় যোগ দিলো অনিকও। হঠাৎ অনিক ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে করতে পেরেছে এমন উৎসুকতা নিয়ে বললো,
” আরে, শহরের টেলার্সগুলোয় খোঁজ নিলেই পেয়ে যাবি শিওর। ”
অনিকের কথা শুনে রাগীব মাথা তুললো। কপাল কুঞ্চিত হয়ে এলো তার। অনিক পুনরায় বললো,
” কার্নিভাল ফেস্টিভ্যালে থাকার অর্থ ফেস্টিভ্যালেট পোশাক পরে থাকা। আর এ পোশাকগুলো টেলার্স থেকেই ধার করতে হবে। সো, শহরের প্রতিটা টেলার্সে ব্যাটার ছবি দেখিয়ে আমাদের লোক দিয়ে খোঁজ নিলেই ইজিলি খোঁজ পাওয়া যাবে ওর। আবার প্লাস পয়েন্ট হিসেবে ওর পায়ে একটা গু’লিও লেগেছে। সো, নরমালি তো সে হাঁটতে পারবে না৷ নিশ্চয়ই খুঁড়িয়ে হাঁটবে। এতে করে ইজিলি ব্যাটাকে ধরতে পারবো আমরা। ”
অনিকের কথায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো রাগীব। নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে সে অনিকের পিঠে একটি কিল বসিয়ে উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো,
” বাহ! এতোটা ইজিলি ব্যাটাকে খুঁজতে পারবো ভাবিনি। ইউ আর গ্রেট অনিক ব্রো। মাথার ঘিলু একদম উপচে উপচে পড়ছে মনে হয়। ”
রাগীবের শেষোক্ত কথা শুনে সরু চোখে চাইলো অনিক। বললো,
” এটা কমপ্লিমেন্ট ছিলো না কি ইনসাল্ট ছিলো আমার জন্য?”
রাগীব তখন ফোনে কল লাগাতে ব্যস্ত। অনিকের এ প্রশ্ন শুনে সে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে অনিকের পিঠে আরেকটি ঘা বসিয়ে দিলো। বললো,
” ওভিয়েসলি, ইটস আ কমপ্লিমেন্ট।”
এই বলে সে উঠে পড়লো। অনিক তাকে কিছু বলতে গিয়েও বললো না। রাগীবের এ কিলে অনিকের পিঠ যে জ্বলজ্বল করছে এটা বলার পূর্বেই রাগীব ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এদিকে রাগীবের উপর রাগান্বিত হয়ে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে অনিক আরেক পে’গ ওয়াইন নিলো।
রাগীব তার সাহচর্যদের সব কাজ বুঝিয়ে বললো। নির্দেশ দিলো, শহরের একটা টেলার্সও যেনো ছুটে না যায়৷ তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ সব নির্দেশ দিয়ে আফসার সাহেবের একটি ছবি তাদের কাছে পাঠিয়ে দিলো। অতঃপর ফোন কেটে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছেড়ে ধারালো গলায় বললো,
” যে কাজটা সহজেই করতে চেয়েছিলাম তা তুই জটিল বানিয়ে ফেললি। কিন্তু কি আর করার। এর ফলও ভোগ করবি তুই। ”
.
আফসার সাহেব উদ্বিগ্ন হৃদয়ে হাঁটছেন। তার হৃদকম্পন ক্রমশ উর্ধ্বমান৷ প্রচণ্ড ভয়ে আছেন তিনি৷ এই বুঝি তাকে রাগীব ধরে ফেললো! পুরোনো আমলের লাল সাদা রাজ ঘরানার পোশাকে নিজেকে আচ্ছাদিত করে রেখেছেন তিনি। পুরো মুখশ্রী জুড়ে সাদা মাস্ক। যার দু চোখের অংশ লাল ডিজাইনে অঙ্কিত। মাস্কের মাথার অংশের এক পাশে রয়েছে লাল সাদা মিশ্রিত রঙের পালক। তার মতো এমনই বিভিন্ন সাজ পোশাকে আবৃত হয়ে আছে কতিপয় মানুষ। আর তাদের ছবি তুলছে ঘুরতে আসা বিভিন্ন পর্যটকেরা। ইতোমধ্যে আফসার সাহেবের পোশাকের ডিজাইনে আকৃষ্ট হয়ে গুটি কয়েক মানুষজন তার ছবিও তুলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রাণের ভয় নিয়ে চলাচল করতে থাকায় লোকগুলোর এ ছবি তোলার পর্বে রাগত হয়েছিলেন তিনি। ফলস্বরূপ বিনা বাক্যে তাদের উপেক্ষা করে যান তিনি।
ভারী পোশাক পরে গু’লি খাওয়া পা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন আফসার সাহেব। হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। কিছুদূর হাঁটার পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় বাইরে রাখা টেবিলগুলোর একটি চেয়ারে বসে পড়েন তিনি।
ভেনিসে রাত নেমেছে বহুক্ষণ পূর্বেই। রাতের দীর্ঘতার সাথে বাড়ছে মানুষের আনাগোনা। জমে উঠছে কার্নিভাল ফেস্টিভ্যাল। আশেপাশে কার্নিভাল ফেস্টিভ্যালের পোশাক পরহিতা বিভিন্ন মানুষজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘুরে বেড়াচ্ছে অসংখ্য পর্যটক। রেস্তোরাঁয় বসে এক কাপ কফি ওর্ডার করে বিল মিটিয়ে দিলেন আফসার সাহেব। চারপাশে এক নজর বুলিয়ে পরনের মাস্কটা খুলে মাথায় ঝুলিয়ে রাখলেন তিনি। দীর্ঘ সময় পর প্রাণ ভরে শ্বাস নিয়ে প্রলম্বিত নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি। এ লুকোচুরি খেলা আর ভালো লাগছে না তার। কিন্তু প্রাণ বাঁচানোর দায়ে এ খেলা তো চালিয়ে যেতেই হবে। যতক্ষণ লুকিয়ে থাকবে প্রাণ বেঁচে থাকবে ততক্ষণ। যখন এ খেলার সমাপ্তি ঘটবে, তখন সমাপ্তি ঘটবে তার প্রাণেরও।
দশ মিনিটের মাঝে টেবিলে কফি চলে এলো। কফির কাপে এক চুমুক দিয়ে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন তিনি। কিন্তু দ্বিতীয় চুমুক দিতেই হঠাৎ তার কাঁধে হাত রাখলো কেউ। চমকে উঠলেন আফসার সাহেব। বেসামালতার দরুন পুড়িয়ে ফেললেন ঠোঁটজোড়া। তার কাঁধে হাত রাখা লোকটি বলে উঠলো,
” হেই ম্যান!”
সামান্য এ কথায় প্রাণ বাঁচানোর দায়ে পালিয়ে বেড়ানো আফসার সাহেবের মনে ভয়ের উদ্রেক ঘটালো। তিনি ভাবলেন, পিছনের মানুষটি রাগীব বা তার কোনো লোক নয় তো! এই ভেবে আতঙ্কে কফির কাপ ফেলে পুড়ে যাওয়া ঠোঁট নিয়েই হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি৷ নিজেকে বাঁচানোর ভয়ে পিছনের লোকটিকে না দেখেই খুঁড়াতে খুঁড়াতে পালালেন তিনি। এদিকে তার এ ব্যবহারে সেই লোকটি কিছুটা আশ্চর্যান্বিত হলো। লোকটি মূলত আফসার সাহেবের সাজপোশাক দেখে নিজের একজন সহকর্মীকে সন্দেহ করেছিলেন৷ সে সন্দেহের জোরেই তিনি আফসার সাহেবের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পিছন হতে আফসার সাহেবকে ডাকা মাত্র তিনি ছুটে পালালেন৷
গু’লি খাওয়া পা নিয়ে কোনোমতে দৌড়ে সেইন্ট মার্ক স্কয়ারে পৌঁছালেন আফসার সাহেব। এখানে মানুষজনের ভীড় অগণিত। ঘড়িতে সময় হয়েছে রাত একটা। অথচ এখানে লোকজনের ভীড় কমেনি একটুও। এদিকে অবিরাম দৌড়ানোর ফলে পায়ে চিনচিন ব্যাথা অনুভব করলেন তিনি। এ মুহূর্তে এই ভীড়ে দাঁড়িয়ে থাকা দায় হয়ে পড়লো তার জন্য৷ ফলস্বরূপ হাঁপাতে হাঁপাতে ভীড় হতে খানিক দূরে একটি বেঞ্চে বসলেন তিনি৷ এখানেও অবশ্য ভীড়ের কমতি নেই।
হাঁপিয়ে উঠা আফসার সাহেবকে মাস্কে আবৃত হতে দেখে কয়েকজন পর্যটক ছুটে এলেন তার সম্মুখে। নিজেদের ফোন দিয়ে ছবি তুলতে লাগলেন তার। এ ছবি তোলার পর্ব দেখে ভীষণ বিরক্ত হলেন আফসার সাহেব। কিন্তু পরিস্থিতির যাঁতাকলে পরে মুখ বুজে সব সহ্য করে গেলেন তিনি।
পাঁচ মিনিট অতিবাহিত হলো। আফসার সাহেব পূর্বের তুলনায় খানিক স্বাভাবিক হয়ে এসেছেন। তবে তার পায়ের আঘাতের চিনচিনে ব্যাথা এখনও কমেনি। গতকাল রাতে গু’লি খাওয়ার পর একটা ডিসপেনসারি শপ হতে কিছু ওষুধ, ব্যান্ড এইড নিয়েছিলেন নিজের জন্য। গু’লি ছুঁয়ে চলে যাওয়ায় পা হতে গু’লি বের করার ঝামেলা পোহাতে হয়নি তাকে। গড়িয়ে পড়া রক্ত পরিষ্কার করেই তিনি ব্যান্ডেজ করেন সেখানে।
ব্যান্ডেজ করার পর হতে এখনও ধীর স্থিরভাবে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেননি তিনি। ফলে পায়ের ব্যাথা বেড়েছে বৈকি কমছে না। এ পায়ের ব্যাথার ফলেই যন্ত্রণায় ক্ষীণ শব্দে আতর্নাদ করতে থাকেন তিনি। বেশ কিছুক্ষণ পর নিঃশ্বাস নিতে খানিক বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় পরনের মাস্ক খুলে মাথায় ঝুলিয়ে রাখেন তিনি। ভুলে যান নিজেকে আবৃত করার কথা, প্রাণ বাঁচানোর কথা।
” পানি খাবেন শ্বশুর মশাই?”
অকস্মাৎ পাশ হতে চিরপরিচিত সেই কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলেন আফসার সাহেব। ধক করে উঠলো তার ক্ষুদ্র হৃদয়খানা। মুহূর্তেই ভয়েরা এসে জড়ো হলো তার চারপাশে। ক্ষণিকের জন্য নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলেন তিনি। চিরপরিচিত সেই কণ্ঠস্বরের মালিক কে তা পুরোপুরি নিশ্চিত হতেই তিনি ঘাড় ঘুরালেন। অমনিই সম্মুখীন হলেন রাগীবের গা শীতল করা এক হাসির। ভয়ে চমকে উঠলেন তিনি।
গাঢ় নীল রঙের পুরোনো রাজ পোশাকে সজ্জিত হয়েছে রাগীব। মাথা হতে গলা অব্দি রয়েছে নীলের উপর সোনালী কারুকার্য খচিত একটি মাস্ক। তবে এ মুহূর্তে সেই মাস্কটি তার মুখে নেই। বরং রয়েছে তার হাতে। এদিকে তাকে দেখে আফসার সাহেবের মুখশ্রী পাংশুটে বর্ণ ধারণ করলো। চোখের পলকেই তিনি মাস্কসহ উঠে পালালেন। কিন্তু রাগীব বসে রইলো। কারণ সে জানে, আফসার সাহেবের দৌড় কতদূর পর্যন্ত। বেঞ্চের কাছে দাঁড়িয়ে থেকেই সে দেখলো আফসার সাহেব কোন গলি দিয়ে পালান।
আফসার সাহেব ডান পাশের একটি গলি ধরে পালালেন। ডান পাশের গলি ধরতেই রাগীব সেদিকে এক ছুট লাগালো। দৌড়াতে দৌড়াতে কল দিলো অনিককে। বললো, এ রাস্তার মাথায় দাঁড়াতে।
আফসার সাহেব ছুটছেন। ব্যাথায় জর্জরিত পা নিয়ে অবিরাম ছুটছেন। দু বার পিছনে ফিরে দেখলেন রাগীব তাকে ধাওয়া করছে। রাগীবকে দেখে তার যেনো ক’লিজা শুকিয়ে এলো। তিনি নিজের সাধ্যমতো যথেষ্ট চেষ্টা করে দৌঁড়ানোর গতি বাড়ালেন। দৌড়াতে দৌড়াতে এ গলি পেরিয়ে পরের গলিতে গেলেন। কিন্তু রাগীবের নিকট হতে লুকিয়ে পড়ার জায়গা খুঁজে পেলেন না। হঠাৎ দেখলেন, সামান্য দূরেই কার্নিভাল ফেস্টিভ্যালের পোশাক পরহিতা কয়েকজন ব্যক্তি ভীড় জমিয়েছে। তিনি দ্রুত গিয়ে সেই ভীড়ে ঢুকে পড়লেন। এদিকে পরের গলি হতে এ গলিতে ঢুকতে ঢুকতেই আফসার সাহেবকে হাত ছাড়া করে ফেললো রাগীব। তার অতি ব্যস্ত অনুসন্ধানী দৃষ্টিজোড়া আফসার সাহেবকে খুঁজতে লাগলো। কিন্তু পেলো না। অতঃপর তার নজর গিয়ে ঠেকলো সেই ভীড়ের উপর। কাল বিলম্ব না করে সে ছুটে গেলো ভীড়ের দিকে। রাগীবকে ছুটে আসতে দেখে আফসার সাহেব আতঙ্কে হতবুদ্ধি হয়ে পরলেন। কোনো রকম চিন্তা ভাবনা ছাড়াই নিজেকে যথাসম্ভব আড়াল করে সেই ভীড় হতে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
আফসার সাহেবকে হন্যে হয়ে ভীড়ের মধ্যে খুঁজতে লাগলো রাগীব৷ কিন্তু পেলো না৷ তবে ক্ষণিকের মাঝেই লক্ষ্য করলো ভীড় হতে বেরিয়ে একটি লোক দৌঁড়াচ্ছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই লোকটা আফসার সাহেব। রাগীব পুনরায় ছুট লাগালো।
আফসার সাহেব দৌঁড়াচ্ছেন। যতোটা পারছেন শরীরে জোর দিয়ে দৌঁড়াচ্ছেন। তার পিছে দৌড়াচ্ছে রাগীব। আফসার সাহেবের দৌড়ানোর এ গতি দেখে অবাক হলো রাগীব। সে ভেবে পেলো না, আফসার সাহেবের শরীরে এতো শক্তি এলো কি করে!
আফসার সাহেব দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে প্রায় জনমানবশূন্য একটি গলিতে ঢুকে পড়লেন। সুযোগ পেলো রাগীব। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হয়রান হয়ে যাওয়া বিরক্ত হলো সে। ফলে মুহূর্তেই পরনের পোশাকের আস্তিন হতে পি’স্ত’ল বের করে আফসার সাহেবের আহত পায়েই গু’লি চালালো সে। লুটিয়ে পড়লেন আফসার সাহেব। তীব্র ব্যাথায় আর্তনাদ করলেন তিনি। রাগীব ততক্ষণে দৌড়ে আফসার সাহেবের নিকট চলে এলো। আফসার সাহেবের নাগালে এসে হাঁটুতে হাত ভর দিয়ে হাঁপাতে লাগলো সে। ব্যাথায় জর্জরিত আফসার সাহেবের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে হাঁপিয়ে উঠা কণ্ঠে নিয়ে বললো,
” তোর দৌড় এতোটুকুই। আর কত পালাবি বুড়ো ব্যাটা?”
শেষ মুহূর্তে এসেও আফসার সাহেবের রাগ ও তেজ যেনো কমলো না। তিনি ঘৃণা ভরা চাহনিতে রাগীবের পানে চাইলেন। দাঁত কিড়মিড় করে ক্ষীণ স্বরে কিছু বললেন। কিন্তু রাগীবের কানে তা গেলো না। রাগীব বললো,
” অনেক ভাগিয়েছিস আমাকে। যেখানে তোকে এক গু’লিতেই মারতে চেয়েছিলাম। সেখানে এই পি’স্ত’লের সব কটা গু’লি তোর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বিঁধিয়ে মারবো তোকে। তোর মৃ’ত্যুটা হবে যন্ত্রণার। কঠিন যন্ত্রণার। যন্ত্রণার মৃ’ত্যু কাকে বলে দেখবি না? স্বচক্ষে দেখাবো তোকে। ”
রাগীবের কথা শেষ হওয়া মাত্রই ধূর্ত আফসার সাহেব ক্ষণিকের মাঝেই একটি কাজ করে বসলেন। হাত দিয়ে হাঁটুতে ভর দিয়ে থাকা রাগীবকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দিলেন তিনি। অতঃপর গু’লি খাওয়া পা নিয়ে দ্রুত উঠে দৌড়াতে লাগলেন তিনি৷ এবারের দৌঁড়ানোর গতি পূর্বের তুলনায় বহু কম। তিনি জানেন, এ দৌড়ে কিছু হবে না৷ বাঁচতে পারবেন না তিনি। তবুও তিনি চেষ্টা করবেন৷ বাঁচার তীব্র চেষ্টা করবেন। এক মিনিটও যদি বেশি বাঁচা যায় তিনি তাই চেষ্টা করবেন।
আফসার সাহেবের এ কাজে মাটিতে পড়েই উচ্চ শব্দে হাসতে লাগলো রাগীব। অট্ট হেসে গলা উঁচিয়ে বললো,
” বেশিদূর যেতে পারবি না রা’স’কে’ল। খুব শীঘ্রই আরেকটা গু’লি খাবি হয়তো। আর ওখানেই লুটিয়ে পড়বি। ”
রাগীবের কথা শেষ হতে দেরি হলো। তবে আফসার সাহেবের শরীরে দ্বিতীয় গু’লি লাগতে দেরি হলো না। দ্বিতীয় গু’লিটা চালালো অনিক। আচমকা পাশের আগত একটি গাড়ি হতে নেমে আফসার সাহেবের পেটে গু’লি চালালো অনিক। লুটিয়ে পড়লেন আফসার সাহেব। পূর্বের তুলনায় আরো যন্ত্রণায় কাতরালেন তিনি। ওদিকে রাগীব উঠে এলো। আফসার সাহেবের নিকটে এসে পেটের বাম পাশে একটি গু’লি চালালো সে। আফসার সাহেবের অবস্থা এখনো শোচনীয়। মৃ’ত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। আর ব্যাথা সহ্য করতে পারছেন না। চিৎকার শব্দটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন তিনি।
রাগীব আফসার সাহেবের এ যন্ত্রণায় কাতরানো মুখখানা দেখলো। একটু মায়া হলো না ঐ মুখের উপর। আর হবেই বা কেনো। ঐ লোকটা যে তার বোনের খুনি!
অনিক আফসার সাহেবের দিকে তাকিয়ে প্রশান্তির হাসি হাসলো। বিড়বিড় করে বললো,
” এট লাস্ট। আই টেক মাই রিভেঞ্জ।”
এই বলে সে আফসার সাহেবকে শোয়া হতে উঠিয়ে পাশের দেয়ালের উপর হেলান দিয়ে বসালো। তবে ঠিকমতো বসে থাকতে পারলেন না তিনি। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে দু হাত শূন্যে তুলে দূর্বল কণ্ঠে বললেন,
” আমাকে মাফ করে দাও। এ যন্ত্রণা আর নিতে পারছি না। বাঁচাও আমাকে। অনেক যন্ত্রণা হচ্ছে। ”
এই বলতে বলতে তিনি লক্ষ্য করলেন তার সম্মুখে সাদা কালো কার্নিভাল ফেস্টিভ্যালে পোশাকে আচ্ছাদিত একটি ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছে। আগন্তুক ব্যক্তিটির মুখ মাস্কে ঢাকা। পরনে মহিলাদের পোশাক। অর্থাৎ আগন্তুকটি মহিলা।
আফসার সাহেব পুরোপুরিভাবে কিছু অনুমান করার পূর্বেই আগন্তুক ব্যক্তিটি তার বরাবর পি’স্ত’ল ধরলো। মুহূর্তেই তার বুকের ডান পাশে সেই পি’স্ত’ল হতে গু’লি চালিয়ে ফেললেন আগন্তুক। তীব্র ব্যাথায় বুক ঝাঁঝড়া হয়ে এলো তার। মৃ’ত্যু পথযাত্রী আফসার সাহেব বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে এলেন। তবে তার বিস্ময়ের মাত্রা আকাশ স্পর্শ করলো তখন যখন তিনি মাস্কের আড়ালের আগন্তুককে দেখলেন। তিনি দেখলেন মাস্কের আড়ালে আর কেউ নয় বরং সালমা বেগম। অর্থাৎ সালমা বেগমই গু’লিটা চালিয়েছেন। বিস্ময়ে হতবাক আফসার সাহেব তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে আমতা আমতা করে বললেন,
” সালমা! তুমি!”
#চলবে