প্রমত্ত_হৃদয়❤️,৩১

0
1542

#প্রমত্ত_হৃদয়❤️,৩১
#লেখনীতে:সারা মেহেক

মৃ’ত্যু পথযাত্রী আফসার সাহেব নিজের চোখকে যেনো বিশ্বাস করাতে পারছেন না। জীবনের শেষ মুহূর্তে তিনি এতো সত্যের সম্মুখীন হবেন তা উনার কল্পনাতীত ছিলো। তিনি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছেন তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটির পানে। তার এ চাহনিতে ছেয়ে আছে তীব্র যন্ত্রণা, আর্তনাদ। কিন্তু আফসার সাহেবের এ চাহনি দেখেও না দেখার ভান করে উপেক্ষা করছে তার সম্মুখে দাঁড়ানো তিনটি মানুষ।
আফসার সাহেব যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে ভীষণ দূর্বল গলায় সালমা বেগমকে বললেন,
” শেষমেশ তুমি আমার উপর গু’লি চালালে!”

সালমা বেগমের গলার কাছে ধীরেধীরে কান্নার দলা যেনো জমতে শুরু করেছে। কিন্তু উনি নিজেকে যথাসম্ভব সামলানোর চেষ্টা করে শক্ত কণ্ঠে বললেন,
” আপনি কাজটাই এমন করেছিলেন যে আপনাকে না মে’রে ফেলা অব্দি আমি শান্তিতে থাকতে পারতাম না। ”

” তুমি এমন কিছু করবে এটা কখনোও ভাবিনি আমি সালমা!”

” আমিও কখনো ভাবিনি আপনি রে’পের মতো জঘন্য কাজ করবেন। তাও আবার নিজের মেয়ের বয়সী একটা মেয়েকে! ছিঃ।
আপনার কাজের জন্য এ শাস্তিই আপনার প্রাপ্য। আপনি না কখনো একজন ভালো স্বামী হয়ে উঠতে পেরেছেন না একজন ভালো বাবা হয়ে উঠতে পেরেছেন। আর ভালো মানুষ, সে তো দূরের কথা। ”

আফসার সাহেবের ভেতরের সবকিছু যেনো মুচড়ে আসছে। তিনি আর কথা বলতে পারলেন না। ঠোঁট নাড়ানোর শক্তিটাও ধীরে ধীরে হারিয়ে বসছেন। চোখের সামনে ধীরেধীরে সব ঝাপসা দেখতে লাগলেন তিনি। একেই বুঝি মরণ যন্ত্রণা বলে? মৃত্যুর সময় এতো কষ্ট হয়! বারবার তার মনে হচ্ছে এই বুঝি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন তিনি। তার ক্রমশ দূর্বল স্নায়বিক শক্তি দিয়ে তিনি বহু কষ্টে ঠোঁট নাড়িয়ে ভেঙে ভেঙে কথা বলার চেষ্টা করলেন,
” শেষবারের মতো সাবিহা আর সাবিতকে দেখতে দাও। ”

আফসার সাহেবের এ আকুতি শুনে অল্প বিস্তর কেঁপে উঠলেন সালমা বেগম। এবার কণ্ঠনালীতে কান্নার দলাগুলো রীতিমতো যুদ্ধ লাগিয়ে দিলো। যেনো এই বুঝি দু চোখ বেয়ে পড়ে যাবে তারা। আফসার সাহেবের এ আকুতি অগ্রাহ্য করলো তিনজনে। রাগীব বলে উঠলো,
” সে আশা দুরাশা মিস্টার আফসার সাহেব। কারণ ওদের কেউই এখানে নেই। আর আমি চাইও না ওরা আপনার এ অবস্থা দেখুক। ”

অসহনীয় যন্ত্রণায় আফসার সাহেবের দু চোখ বেয়ে অশ্রু ঝড়তে লাগলো। মৃত্যুর একেবারে দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এই প্রথমবারের মতো অনুশোচনা অনুভব করলেন তিনি। কিন্তু ততক্ষণে যে দেরি হয়ে গিয়েছে। রাগীব বিলম্ব না করে আফসার সাহেবের বুকের বাম পাশে গু’লি করলো। সেই গু’লি গিয়ে লাগলো আফসার সাহেবের হৃদপিণ্ড বরাবর। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দেহের সকল রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলো। মৃ’ত্যু’বরণ করলেন তিনি। তবে শেষ মুহূর্তে সাথে নিয়ে গেলেন অসীম অনুশোচনা, পাপের প্রায়শ্চিত্ততা।

আফসার সাহেবের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ হতে দেখে সালমা বেগম আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলেন না। ভেঙে পড়লেন তিনি। ফলস্বরূপ হাত হতে পি’স্ত’ল ফেলে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লেন তিনি। রাগীব এগিয়ে এলো তার দিকে। তার দু বাহু ধরে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু সালমা বেগম শান্ত হলেন না। উপরন্তু তার কান্নার বেগ বেড়ে গেলো। তিনি কাঁদতে কাঁদতেই বললেন,
” কেনো উনি ভালো হলেন না রাগীব? কেনো উনি এতো খারাপ কাজ করলেন? আজ যদি উনি এসব কাজ ছেড়ে আমাদের সাথে সুখী সংসার কাটাতো তবে আমার দ্বারা এ কাজ হতো না। ”
এই বলে উনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। কিয়ৎ বাদে পুনরায় বললেন,
” কিন্তু কি করবো রাগীব, বলো। আমার ধৈর্য্য, সহ্য যে সীমা পেরিয়ে গিয়েছিলো। বিয়ের পর থেকে উনার অত্যাচার, অবহেলা, খারাপ কাজগুলো মুখ বুজে সহ্য করে করে এতো বছর পার করলাম। আর এই বয়সে এসে উনার এ কাজ সম্পর্কে শোনা! এটা কখনোও আশা করিনি আমি।
হঠাৎ কি মনে হলো জানি না। তবে উনার প্রতি নতুন পুরাতন সব রাগ জেগে উঠলো যেনো আমার। কেমন যেনো প্রতিশোধপরায়ণা হয়ে উঠলাম আমি। এরই ফলে আজকের এই মা’র্ডার করতে বাধ্য হলাম আমি। ”
এই বলে সালমা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তাকে সান্ত্বনা দিলো রাগীব ও অনিক উভয়েই।

.

হোটেলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রশান্ত হৃদয়ে আকাশ দেখছে রাগীব। রাতের স্নিগ্ধ আকাশ দেখতে আজ তার ভীষণ ভালো লাগছে। বহুদিন পর আজ হৃদয়ে হালকা অনুভব করছে সে। এ মুহূর্তে তার মেজাজ ফুরফুরে। আফসার সাহেবের উপর নিজের বোনের খু’নের শোধ তুলতে পেরে আজ যে যেনো মুক্ত। তার এ ভালো সময়টাকে আরো উপভোগ্য করে তুলতে সে এক গ্লাস ড্রিংক নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পান করতে লাগলো।
হঠাৎ সে অনুভব করলো তাকে পিছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরেছে। তার পিঠে মাথা রেখেছে। ক্রমশ তার পিছে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটির হাত দুটো তার বুকের উপর এসে ভর করলো। তার আর বুঝতে বাকি রইলো না এ মুহূর্তে সে বাদে আর কে উপস্থিত রয়েছে রুমে।

রাগীব সাবিহার উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্রই পিছে ঘুরে সাবিহাকে জড়িয়ে ধরে। তার এক হাত ড্রিংকসের গ্লাসে। অপর হাত সাবিহার পিঠে। অকল্পনীয়ভাবে সাবিহাকে কাছে পেয়ে রাগীব কিয়ৎক্ষণের জন্য নিজের বাকশক্তি হারিয়ে ফেলে। শুধু খুশিতে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলতে লাগে সে। অতঃপর খানিক বাদে নিজেকে ধাতস্থ করে সে সাবিহাকে বললো,
” থ্যাংকইউ স্নিগ্ধময়ী। থ্যাংকইউ৷ আমার জীবনে ফিরে আসার জন্য। আমি যে কি খুশি হয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। ”

সাবিহা এতোক্ষণ নীরবে রাগীবকে জড়িয়ে ধরেছিলো। অনুভব করছিলো তার ভালোবাসার পুরুষটিকে। এতোদিনের দূরত্ব কিছুটা হলেও কমিয়ে আনার চেষ্টা করছিলো। রাগীবের কথা শুনে সে মৃদু শব্দে হেসে বললো,
” তোমার ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকাতেই বুঝতে পেরেছি তোমার খুশির মাত্রাটা।”

দুজনে আর কথা বললো না। এভাবেই নীরবে নিভৃতে কেটে গেলো কিছু মুহূর্ত। দুজন দুজনকে ওভাবে জড়িয়ে ধরিয়েই কাটিয়ে দিলো ভালোবাসায় মোড়ানো কিছু মুহূর্ত।
বেশ কিছুক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পর সাবিহা বললো,
” একটা রিকুয়েষ্ট রাখবে আমার?”

রাগীব জড়িয়ে ধরেই বললো,
” একটা না। তোমার হাজারটা রিকুয়েষ্ট রাখতে রাজি আমি। ”

” আমি তোমার সম্পর্কে যা জেনেছি এর বেশি আমাকে জানতে দিও না প্লিজ। তোমাকে আমি যতটুকু চিনি ততটুকুই থাকুক। এর বেশি আমি তোমার সম্পর্কে আর কিছু জানতে চাই না।”

রাগীব ঈষৎ হাসলো। বললো,
” ঠিক আছে। এই আমিকেই তুমি ভালোবাসো। আড়ালের আমিটাকে নাহয় আঁধারেই ঠেলে দেই তোমার জন্য। ”

সাবিহা নিশ্চুপ রইলো। রাগীবের কথা ভীষণ খুশি হলো সে। এরই ফলে রাগীবকে দ্বিতীয় অনুরোধ করার সাহস পেলো সে। এবার সে বললো,
” আরেকটা রিকুয়েষ্ট? ”

” হ্যাঁ বলো।”

” আমি আমার বাবাকে খুব ভালোবাসি রাগীব। আমি হাজার চেষ্টা করেও আব্বুকে ঘৃ’ণা করতে পারছি না। বারবার আব্বুর সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো ভেসে আসছে। সত্যি বলতে এ পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম আমার আব্বুকে। ইভেন এখনও বাসি। আম্মুর চেয়ে আব্বুকে সবসময় বেশি ভালোবেসেছি। এজন্য কখনোই চাইবো না আব্বুর কোনো ক্ষতি হোক। কিন্তু আব্বু খারাপ কাজ করেছে। খারাপ কাজ বললে ভুল হবে। পাপ করেছে। এ পাপের শাস্তিও যে দেওয়া উচিত সেটাও জানি। আমিও চাই আব্বু তার শাস্তি ভোগ করুক। কিন্তু কখনোই আব্বুর মৃ’ত্যু চাইবো না৷ কোনো মেয়েই স্বেচ্ছায় তার বাবার মৃ’ত্যু চাইবে না। সবচেয়ে বড় কথা আমি কখনোই আব্বুর মৃ’ত মুখ দেখতে পারবো না৷ সহ্য করতে পারবো না। তাই রাগীব তোমাকে রিকুয়েষ্ট করছি। আব্বুকে যা করার করো। কিন্তু মে’রো না দয়া করে। আমি পারবো না এটা সহ্য করতে।”

রাগীব মুহূর্তেই সাবিহাকে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ালো। তার চোখে চাপা ক্রোধ বিরাজ করছে৷ সাবিহা তা দেখেও উপেক্ষা করলো। পূর্বের ন্যায় বললো,
” প্লিজ রাগীব। আমার অনুরোধটা রাখো। আমি কখনো আমার বাবার মৃ’ত্যু দেখতে পারবো না। সবচেয়ে বড় কথা আমি এটা কখনোই মেনে নিতে পারবো না, আমার স্বামী আমার বাবার খু’নি। আমি কখনোই তোমার সাথে একই ছাদের নিচে থাকতে পারবো না। ”

রাগীব কিছু বলতে চাইলো। সাবিহাকে বুঝাতে চাইলো। কিন্তু সাবিহা যেনো আজ কিছুই না বুঝার পণ করে এসেছে। সে রাগীবকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই রাগীবের দু হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
” প্লিজ রাগীব। তুমি আব্বুকে যা শাস্তি দিবে আমি মেনে নিবো। কিন্তু মৃ’ত্যু না। আমি কখনোই মেনে নিতে পারবো না এটা।”

সাবিহার এসব কথা শুনে রাগীব যেনো এখন অথৈ সাগরে পড়লো। এখন কি করবে সে! সে যে আগেই আফসার সাহেবকে মে’রে ফেলেছে! এটা সাবিহাকে বুঝাবে কি করে সে! সাবিহা এখন প্রায় উন্মাদ হয়ে আছে। এ মুহূর্তে সাবিহাকে শত বুঝিয়েও লাভ হবে না তা জানে রাগীব। তাহলে কি এ কারণে সে সাবিহাকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলবে! এ কথা ভাবতেই শিউরে উঠলো রাগীব। নাহ, এমনটা হতে দেওয়া যাবে না। কিছুতেই সাবিহাকে নিজের থেকে দূরে সরানো যাবে না৷ সে যে তার স্নিগ্ধময়ীকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে!

রাগীব কিয়ৎক্ষণ সাবিহার দিকে চেয়ে রইলো। অতঃপর আচমকা সাবিহাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
” তুমি চিন্তা করো না সাবিহা। আমি এমন কিছুই করবো না। ”
মিথ্যে বললো রাগীব। নিজের মাঝে তীব্র সংকোচ ভাব অনুভব করলো। কিন্তু উপলব্ধি করলো সাবিহার স্বস্তি, সাবিহার হাসি।

.

নিজের রুমে সাবিহাকে ঘুম পারিয়ে রেখে রাগীব অনিকের রুমে প্রবেশ করলো। অনিকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হিনহিনে কণ্ঠে বললো,
” যেভাবেই হোক সাবিহার বাবার মৃ’ত্যু কার এক্সিডেন্ট হিসেবে দেখাবি। কোনোভাবেই যেনো সাবিহা জানতে না পারে যে ওর বাবার মৃ’ত্যুর জন্য আমি আর ওর মা দায়ী। ”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here