প্রমত্ত_হৃদয়❤️,৩৪(সমাপ্তি পর্ব)

0
2130

#প্রমত্ত_হৃদয়❤️,৩৪(সমাপ্তি পর্ব)
#লেখনীতে:সারা মেহেক

রাগীবের দৃষ্টি শান্ত ও স্থির। তবে তার চাহনিতে হাজারো প্রশ্ন। সাবিহার চাহনিতে দুঃখ, কষ্ট, রাগ ও অভিমানের এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তার দৃষ্টি অস্থির৷ তার হাত দুটো অবিরাম কাঁপছে। রাগীবের দিকে কাঠিন্যের সহিত পি’স্ত’ল তাক করলেও তার স্থায়ীত্ব দীর্ঘ করতে পারছে না সে। ট্রিগার চাপতে তার হাতজোড়া কাঁপছে। সে তীব্রভাবে অনুভব করছে, তার অন্তর আত্মা তাকে বাঁধা দিচ্ছে। কিন্তু সে যে রাগীবের উপর প্রতিশোধ নিতে এসেছে। অথচ তার মন এ মুহূর্তে তাকে এ কাজে সায় দিচ্ছে না। কিন্তু সে সময় প্রচণ্ড জৌলুশে সে রাগীবের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। এখন যেনো নিজের কাজে নিজেই পস্তাচ্ছে সে। কিন্তু এখনও সে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকতে চাইছে। এক প্রকার মনের বিরুদ্ধে গিয়ে মারতে চাইছে রাগীবকে।

রাগীব সাবিহার এরূপ অচল ভঙ্গিমা দেখে প্রতিক্রিয়াহীন মুখ ভঙ্গিমায় বললো,
” কি ব্যাপার স্নিগ্ধময়ী? হাত চলছে না? না কি মাথা ঠিক কাজ করছে না?”

সাবিহা নির্বাক রইলো। সন্দেহ নেই, রাগীবের বলা ‘স্নিগ্ধময়ী’ শব্দটি তার কানে আঘাতপ্রাপ্ত হলো। হয়তো হৃদয়ের অন্তঃস্থলে গিয়েও তা ছু’রি বসালো। সাবিহার ওষ্ঠদ্বয় ঈষৎ কেঁপে উঠলো। কিন্তু সে এখনও তার পূর্বের অবস্থানে টিকে রইলো। রাগীব এবার তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলো,
” বাবার প্রতি ভালোবাসাটা এতোই তীব্র যে ভুল আর সঠিকের পার্থক্য ভুলে বসেছো তুমি?”

সাবিহা এবার জবান খুললো। পি’স্ত’লটা পূর্বের ন্যায় রেখেই বললো,
” তোমাকে বলেছিলাম, আমি এ পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি আমার বাবাকে। তোমাকে এও বলেছিলাম, আব্বুর সাথে আর যা-ই করো না কেনো, উনার জীবন নিও না। আমি কখনো চাইনি উনার মৃ’ত মুখ দেখতে। আমি সবসময় চাইতাম, আড়ালে হোক বা সম্মুখে হোক, আব্বুর চেহারা আমি সবসময় দেখতে চাই। ”

রাগীব কিছুটা তীক্ষ্ণ স্বরে প্রশ্ন করলো,
” তোমার বয়সী একটা মেয়ের রে’প করার পরও তুমি এমনটা চাইছো? আর শুধু কি রে’প? তোমার বাবা তো আমার বোনের মা’র্ডা’রও করেছে…”

” আমি বলিনি আমার বাবাকে ছেড়ে দাও। আমি বলেছিলাম আমার বাবাকে একটু ছাড় দাও। মৃ’ত্যু নামক সাজা থেকে ছাড়৷ আর মার্ডারের কথা উঠলে শুধু আব্বু না, তোমার কথাও উঠে এখানে, রাগীব। তুমি একজন মাফিয়া জানা সত্ত্বেও আমি তোমাকে ভালোবেসেছি৷ তোমার সাথে সারাজীবন কাটাতে চেয়েছি। তুমি কি পারতে না, আমার কথা ভেবে আব্বুকে বাঁচিয়ে রাখতে? কি বলো? পারতে না?”
শেষোক্ত প্রশ্নগুলো চিৎকার করে বললো সাবিহা৷ অতঃপর আচমকাই কান্নায় ভেঙে পড়লো। সরিয়ে নিলো রাগীবের উপর তাক করা পি’স্ত’লটিও। আজ রাগীব সাবিহাকে সামাল দিলো না। কাঁদতে দিলো তার স্নিগ্ধময়ীকে। সে চাইছে, অন্ততপক্ষে কান্নার মাধ্যমেও হোক, সাবিহা যেনো তার মনটা হালকা করতে পারে। আফসার সাহেবের কৃতকর্মের কথা ভালোমতো মনে গেঁথে নিতে পারে।
ক্রন্দনরত সাবিহা পুনরায় জিজ্ঞেস করলো রাগীবকে,
” কি রাগীব? বলো….তুমি কি পারতে না আমার কথা ভেবে আব্বুকে ছেড়ে দিতে? কেনো, মৃ’ত্যুর মতো শাস্তিই দিতে হলো তাকে? একটু কি ছাড় দেওয়া যেতো না?”

এ পর্যায়ে রাগীব কাঠিন্যের সহিত বললো,
” কখনোই না। উনার মতো মানুষকে কখনো ছাড় দেওয়ার কথা কল্পনাতেও আনতে পারতাম না আমি। আজ তুমি যেমন তোমার বাবার মৃ’ত্যুর প্রতিশোধ নিতে চাইছো আমার কাছ থেকে, ঠিক তেমনই আমি রামিশার রে’পের প্রতিশোধ নিয়েছি তোমার বাবার কাছ থেকে। এভাবে সবকিছু জানার পরও যদি তুমি আমাকে মারতে চাও, ওকে, আই এম ফাইন উইথ দ্যাট।”
এই বলে রাগীব খানিকক্ষণ সাবিহার পানে নিষ্পলক চেয়ে রইলো। অতঃপর ভঙ্গুর হৃদয় নিয়ে পুনরায় বললো,
” বাবার প্রতি ভালোবাসার সামনে ভুল ও সঠিকের পার্থক্য ভুলে এমন কাজ করতে পারবে তা কল্পনাও করিনি আমি। ”

সাবিহা এখনও কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতেই হঠাৎ সে শক্ত হয়ে এলো। পুনরায় রাগীবের দিকে পি’স্ত’ল তাক করে প্রায় দূর্বল কণ্ঠে বললো,
” ছোটবেলা থেকে আদরে বেড়ে ওঠা মেয়েটা কি তার বাবাকে ভালোবাসবে না? ২৫ বছর ধরে পরম আদর স্নেহের ছায়া তলে বড় করে তোলা মানুষটার প্রতি কি ভালোবাসা আসবে না? এটা কি স্বাভাবিক না রাগীব? তুমি জানো,আব্বুকে যখনই আমি হাসতে দেখতাম, তখন নিজের সব দুঃখ ভুলে যেতাম। আবার আব্বুকে যখন রেগে থাকতে দেখতাম তখন ভয় পেতাম ঠিকই তবে সবার আগে আমিই এগিয়ে যেতাম আব্বুর রাগ ভাঙাতে। চারপাশের বোধ জ্ঞান হওয়ার পর হয়তো কখনো এমন হয়নি যে, আব্বু আমার কোনো আবদার রাখেনি। সবসময় সাবিতের চেয়ে আমাকে বেশি ভালোবাসা দিয়েছে। সবসময় আমার কষ্টগুলো নিজের মনে করেছে। তো, সে মানুষটার প্রতি আমার কেনো ভালোবাসা থাকবে না? আব্বুর জন্য আমার এতো ভালোবাসা আছে যে, তার করা প্রতিটা পাপের কথা আমি মনের কোনো এক কোনায় দাফন করে রেখেছি। যেনো, তার প্রতি আমার ভালোবাসা একটুও না কমে। আর আমি চাইওনা যে, আব্বুর প্রতি আমার ভালোবাসা কমে যাক৷ কখনোই চাই না। কখনো না।”
উন্মাদের ন্যায় প্রতিটা কথা বললো সাবিহা৷ তার এরূপ কথা ও ভঙ্গিমা দেখে রাগীব কিয়ৎ শক্ত কণ্ঠে বললো,
” সাবিহা, তুমি মেন্টালি আনস্টেবল হয়ে পড়েছো। নিজ বুদ্ধিতে ভালো মন্দের বিচার করা ভুলে বসেছো। ”
সাবিহা চিৎকার করে বললো,
” হ্যাঁ, ভুলে বসেছি। আমি পাগল হয়ে গিয়েছি রাগীব। আমি উন্মাদ গিয়েছি।”

” সাবিহা? তুমি কি একবারও নিজেকে রামিশার জায়গায় কল্পনা করে দেখোনি? একটা মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের অবস্থা বুঝতে পারোনি?”
রাগীবের কণ্ঠে তীব্র কষ্ট ও হাহাকার।

সাবিহা তখন উন্মাদের মতো ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললো,
” করেছি তো। আমি বুঝতে পেরেছি ওর কষ্ট। এও জানি, ওর এ সর্বনাশের জন্য আমার আব্বু দায়ী। কিন্তু তবুও আমি নিজেকে বুঝাতে পারছি না যে, আমার আব্বুকে তুমি মেরেছো। আমি জানি না তুমি ভালো করেছো না কি মন্দ করেছো। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি রাগীব৷ আমার ভেতরে সব আউলিয়ে গিয়েছে। ”
এই বলে হাতের পি’স্ত’ল ফেলে দু হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলো সাবিহা৷ ধপ করে মাটিতে বসে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো সে। তার এ অবস্থা সচক্ষে দেখে প্রায় দিশেহারা হয়ে পড়লো রাগীব। দ্রুত এগিয়ে এসে নিজের বুকের মাঝে নিয়ে নিলো সাবিহাকে। এক হাতে সাবিহাকে আঁকড়ে ধরে অপর হাত দিয়ে পি’স্ত’লটা তুলে ওভার কোটের পকেটে রেখে দিলো সে।

সাবিহা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে সে রাগীবের বুকেই জ্ঞান হারালো। অজ্ঞান সাবিহাকে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে সামাদকে কল করলো সে। মিনিট দশেকের মাঝেই সামাদ গাড়ি নিয়ে সে স্থানে হাজির হলো। অতঃপর সামাদ ও রাগীব একত্রে সাবিহাকে গাড়িতে উঠিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

.

সাবিহার জ্ঞান ফিরলো আধ ঘণ্টার মাঝেই। সালমা বেগম সাবিহার পাশেই বসে ছিলেন। সাবিহার জ্ঞান ফেরার পর তিনি বেশ কিছুক্ষণ সময় চুপচাপ বসে ছিলেন। মূলত তিনি সাবিহাকে ধীরস্থির হওয়ার সুযোগ দিচ্ছিলেন। অতঃপর কিয়ৎ সময় বাদে যখন তিনি বুঝলেন সাবিহা কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, তখন তিনি কঠোর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” তোর কি বিবেক বোধ সব লোপ পেয়ে গিয়েছে পুতুল? তুই ঐ মানুষটার জন্য কি করে রাগীবকে মারতে যাচ্ছিলি?”

সাবিহা জবাব দিলো না। নত মস্তকে নির্বাক চাহনিতে বসে রইলো। সালমা বেগম পুনরায় বললেন,
” তোর বাবা কি কোনো ভালো মানুষ ছিলো যে উনার জন্য তুই রাগীবকে খু’ন করতে যাচ্ছিলি?
এই যে তোর বাবাকে তুই এতো ভালোবাসিস, বলিস যে, তোর বাবাও তোকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু তুই কি উনার স্বার্থ সম্পর্কে জানিস? তোর বাবা যে কতোটা স্বার্থপর সে সম্পর্কে তোর একটুও ধারণা আছে কি?”

মায়ের এরূপ প্রশ্ন শুনে মাথা তুলে চাইলো সাবিহা৷ তার চাহনিতে বিরাজ করছে গুটি কয়েক প্রশ্ন। সালমা বেগম মেয়ের এ চাহনি পড়তে পারলেন। সাবিহার প্রশ্নের জবাব দিতে তিনি ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” তুই যখন ছোট ছিলি তখন তোর বাবা অন্য একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলো। মেয়েটার প্রেমে পাগল হয়ে সে আমাকে এমনকি তোকে ছেড়ে যেতেও রাজি হয়েছিলো। কিন্তু আমি বারবার অনুরোধ করায় তোর বাবা থেকে গিয়েছিলো।
আবার আদিলের সাথে তোর বিয়ে দেওয়াটাও কিন্তু একটা বিজনেস ডিলের অংশ ছিলো। আদিল আগে থেকে বিবাহিত ছিলো। আর এটা তোর বাবাও জানতো। কিন্তু এতো কিছু জানার পরও তোর বাবা তোর সাথে আদিলের বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। কারণ তার বিজনেস ডিল। তোদের দুজনের বিয়ে হলে আদিলের বাবা তোর বাবার কোম্পানিতে বড় অঙ্কের ইনভেস্টমেন্ট করতো। এ কারণে, নিজের লোভের জন্য তোর বাবা তোকে বলি দিতেও পিছ পা হচ্ছিলো না। তো, এ মানুষটার প্রতি তুই কিভাবে এতো ভালোবাসা পোষন করতে পারিস পুতুল? যে মানুষটা পাপ করেছে, নিজ স্বার্থের আগে কখনো নিজ পরিবার, সন্তানের কথা ভাবেনি তার প্রতি এতো ভালোবাসা কি করে জমা থাকে তোর বুকে?
ভেবে দেখে পুতুল। নিজের বিবেক বুদ্ধি দিয়ে একটু ভেবে দেখ। ”
এই বলে সালমা বেগম কিয়ৎক্ষণ চুপ করে রইলেন।
এদিকে সাবিহা মায়ের কথাগুলো শোনার পর একদম বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লো। সে বিশ্বাস করতে পারছে না যে তার বাবা এতোটা স্বার্থান্বেষী একজন মানুষ। সে ভাবতে পারছে না তার বাবা নিজ স্বার্থের জন্য তাকে বলি দিতে বসেছিলো। সে অবাক হলো, এই ভেবে যে, এই মানুষটা তার বাবা! যে বাবার হাজারো পাপ জানা সত্ত্বেও সে সম্মান করেছে, ভালোবেসেছে, সেই মানুষটাই না কি নিজ স্বার্থে তাকে ব্যবহার করেছে! সত্যিই দুনিয়াটা অদ্ভুত, ভীষণ অদ্ভুত।

খানিক বাদে সালমা বেগম পুনরায় বললেন,
” এখন এসব জানার পরও যদি ঐ অমানুষটার জন্য তোর মনে ভালোবাসা থাকে, তাহলে আমার আর কিছু বলার থাকবে না। এরপরও যদি তুই রাগীবকে মা’রতে চাস, তাহলে সাথে আমাকেও মেরে ফেলিস। কারণ তোর বাবার খু’নের পিছনে আমারও হাত আছে। আমিও তোর বাবাকে গু’লি মে’রেছিলাম। ”
এই বলে সালমা বেগম তৎক্ষনাৎ সে স্থান ত্যাগ করলেন। আপাতত এ তিক্ত সত্যের স্বীকারোক্তি করে মেয়ের চোখে চোখ রাখতে পারতেন না তিনি। যত যা-ই হোক, দিনশেষে তিনিও একজন খু’নি।

সাবিহা নিজের বাকশক্তি যেনো হারিয়ে বসেছে। একের পর এক ধাক্কার সম্মুখীন হতে হতে সে প্রতিক্রিয়াহীন হয়ে পড়েছে। হয়ে পড়েছে অনুভূতিশূন্য৷ কান্না করার শক্তিও হারিয়ে বসেছে সে। তার কানে বাজছে সালমা বেগমের বলা প্রতিটা কথা। সে বিশ্বাস করতে পারছে না, এসব তিক্ত সত্য।
সাবিহা কিয়ৎক্ষণ একাধারে নিচের দিকে কম্বলের উপর চেয়ে রইলো। অতঃপর নিঃশব্দে প্রতিকারহীন রূপে কম্বল গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো। বুজে ফেললো নিজের ফোলা চোখজোড়া। মুহূর্তেই হারিয়ে গেলো অদৃশ্য, অস্পৃশ্য এক রাজ্যে, যেখানে আবেগ অনুভূতি বলতে কিছুই নেই। আছে শুধু শূন্যতা। নিরন্তর শূন্যতা৷

.

গ্যাব্রিয়েলের আস্তানায় ঢুকে তারই বাবাসহ তার সকল সাথীকে নিজ হাতে গু’লি করে মেরে ফেললো রাগীব। এ কাজটা সে সম্পন্ন করেছে পরেরদিন সকালেই।
রাগীব গোপন সূত্রে খবর পেয়েছিলো, গ্যাব্রিয়েলই সাবিহাকে ওসব ছবি পাঠায়। মূলত গ্যাব্রিয়েলের লোকেরা ভিন্ন বেশে অনেকদিন যাবত রাগীবের পিছু নিয়েছিলো। রাগীব যেখানে যেখানে যেতো প্রায় প্রতি জায়গাই গ্যাব্রিয়েলের এক নতুন সাথী ভিন্ন বেশে রাগীবকে অনুসরণ করতো। সেদিন কার্নিভাল ফেস্টিভ্যালেও এর ব্যতিক্রম হয়নি৷ এ কারনেই মূলত আফসার সাহেবকে গু’লি করার দৃশ্যগুলো ক্যামেরায় বন্দি করতে পেরেছিলো গ্যাব্রিয়েলের সেই লোক।

গ্যাব্রিয়েলের মতলব ছিলো, সিসিলিতে সাবিহা ও রাজীব সাহেবকে মে’রে রাগীবকে দূর্বল করে তোলা এবং সুযোগ বুঝে মাফিয়া দলের উপর নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করা৷ কিন্তু যখন সে এই প্ল্যানে ব্যর্থ হলো, তখন সে ছবিগুলো ব্যবহার করে সাবিহাকে পথ ভুলিয়ে রাগীবের ক্ষতি করতে চাইছিলো। তার মতলব ছিলো, সাবিহার মাধ্যমেই রাগীবকে দূর্বল করে তোলা বা মে’রে ফেলা। কিন্তু রাগীবের কিছু হওয়ার পূর্বেই গ্যাব্রিয়েল প্রাণ হারালো স্বয়ং রাগীবের হাতে।
অতঃপর গ্যাব্রিয়েলকে মেরে এতো বছরের শত্রুতার ইতি টানলো রাগীব৷

.

কেটে গিয়েছে প্রায় এক মাস। এই এক মাসে বদলেছে অনেক কিছু। সুস্থ স্বাভাবিক সাবিহা হয়ে উঠেছে অসুস্থ। গত এক মাস যাবত সে পিটিএসডি নামক মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে আছে। বাবার মৃত্যু, আড়ালে লুকিয়ে থাকা সত্য সব মিলিয়ে সাবিহার মানসিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। আর এ অবনতির প্রথম ধাপ শুরু হয়েছিলো যখন সে তার বাবার মৃ’ত্যুর খবর শুনতে পায়। তখন অবস্থা তুলনামূলক কিছুটা ভালো হলেও পরবর্তীতে এ অবস্থা আরো খারাপ হয়।
এ মানসিক অবস্থার কারণে সাবিহা প্রায়শই রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতো। কখনো সে দেখতে সে তার বাবাকে নিজ হাতে মেরে ফেলছ, কখনো মেরে ফেলছে রাগীবকে। আবার কখনো দেখতো, তার বাবা তাকে মারতে এসেছে, কখনো দেখতে রামিশা তাকে মারতে এসেছে। এসব দুঃস্বপ্নের কারণে তার অবস্থা দিনে দিনে আরো খারাপ হতে থাকে। তার এ অবস্থার জন্য শুরুতেই রাগীব ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছিলো। কিন্তু সাবিহা উন্মাদের ন্যায় আচরণ করে নিজেকে ডাক্তারদের কাছ থেকে দূরে রেখেছে। পরবর্তীতে সাবিহার অবস্থা যখন আরো খারাপ হতে থাকে তখন রাগীব এক প্রকার জোর করেই সাবিহাকে ডাক্তারের শরণাপন্ন করেছিলো। এরপর থেকে সাবিহার মানসিক অবস্থার জন্য নানারকম ওষুধ চলতে থাকে। চলতে থাকে কিছু থেরাপি। কিন্তু এসব ওষুধ ও থেরাপিও যেনো সঠিক কাজ করতে পারছিলো না। এর কারণ হিসেবে ডাক্তাররা বলেছিলো, মূলত সাবিহা নিজ থেকেই সুস্থ হতে চাইছে না। সে যেনো ইচ্ছে করেই নিজেকে আরো অসুস্থতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর মাঝে অবশ্য সাবিহা বেশ ক’বার নানাভাবে আ’ত্মহ’ত্যা করার বা নিজের ক্ষতি করারও চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রতিবার নানা উসিলায় সে বেঁচেও গিয়েছে।

যেখানে পিটিএসডি নামক মানসিক রোগ ওষুধপত্র নিয়ে এক মাসের মধ্যে সেরে যাওয়ার কথা সেখানে সাবিহার ক্ষেত্রে এক মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে যাচ্ছে। অথচ উন্নতির কোনো নাম নিশানা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ সাবিহার এ অবস্থা দেখে মরণপ্রায় অবস্থা সালমা বেগমের। তিনি প্রায় প্রতিদিনই রুমের মাঝেই একা একাই বিলাপ জুড়ে বসেন। কখনো কখনো সাবিহার রুমে গিয়ে সাবিহার সামনেই এ কাজ করেন৷ তখন সাবিহা চুপচাপ বসে তা দেখে।

উষ্কখুষ্ক চুল, কালি পড়া চোখের গর্ত, রুক্ষ শুষ্ক ত্বক ও ঠোঁট, এ নিয়ে ব্যালকনিতে বসে আছে সাবিহা। তার চাহনিতে অদ্ভুত শূন্যতা৷ এক আকাশ পরিমাণ শূন্যতা। আবেগহীন হৃদয়ে একরাশ খালি জায়গা। যেখানে ধূ ধূ মরুভূমির ন্যায় আছে শুধু বালু।
রাগীব নীরবে এসে সাবিহার পাশে বসলো। সাবিহা তাকে না দেখেই ধীর স্বরে বললো,
” এসেছো রাগীব?”

রাগীব ছোট্ট করে জবাব দিলো,
” হ্যাঁ।”

সাবিহা আর কথা বাড়ালো না। আলতো করে তার মাথাটা রাগীবের কাঁধে রাখলো। নিষ্প্রাণ কণ্ঠে ভেঙে ভেঙে বললো,
” আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারিনি রাগীব। মাফ করে দিও আমাকে। ”

সাবিহার এ শূন্যতায় ঘেরা কথায় বুক চিরে কান্না বেরিয়ে এলো রাগীবের। মুহূর্তেই নিঃশব্দে কেঁদে উঠলো সে। বুকে পাথর চেপে কোনোমতে কান্নার শব্দ আটকে রেখে আলতো করে সাবিহার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিলো। অতঃপর শান্ত ও ধীর স্বরে ভালোবাসা মিশিয়ে বললো,
” কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসতে পেরেছি স্নিগ্ধময়ী। আর আমার এ ভালোবাসা আমৃত্যু বহাল থাকবে। আমার ভালোবাসার কমতি কখনো দেখতে পাবে না তুমি। তোমার ভালোবাসায় শুরু হতে আজ পর্যন্ত আমার হৃদয় মোহগ্রস্ত, প্রমত্ত। তোমায় ভালোবাসি স্নিগ্ধময়ী, ভালোবাসি।

❤️সমাপ্ত❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here