#প্রমত্ত_হৃদয়❤️,৯(প্রথমাংশ)
#লেখনীতে:সারা মেহেক
ধীর পদে টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে লোকটির সম্মুখে দাঁড়াতেই সাবিহা আশ্চর্যান্বিত হয়ে গেলো। লোকটি আর কেউ নয় বরং রাগীব। ব্লাইন্ড ডেটের পার্টনার হিসেবে রাগীবকে দেখে সাবিহার নেত্রজোড়া বিস্ময়ে চোখের কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। সে কণ্ঠে আকাশসমান আশ্চর্য ভাব নিয়ে রাগীবকে বলল,
” আপনি এখানে! ”
রাগীও সাবিহার ন্যায় আশ্চর্য ভাব নিয়ে একই কথা বললো। তাদের মধ্যকার ক্ষীণ মুহূর্তের আশ্চর্যান্বিত ভাব প্রকাশ দেখে আশেপাশের লোকজন খানিকটা বিব্রত বোধ করল। কিন্তু অপরের ব্যাপারে তারা নাক না গলিয়ে পরমুহুর্তেই নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পরলো। সাবিহা আশেপাশের চেয়ারের লোকদের উপর এক নজর বুলিয়ে নিলো। অতঃপর রাগীবের সম্মুখে চেয়ার টেনে দ্রুত তাতে বসে পরলো। রাগীবকে পার্টনার হিসেবে পেয়ে তার ভয়ডর, দুশ্চিন্তা মুহূর্তেই উবে গেলো। অতঃপর তার আশ্চর্যান্বিত ভাবটি শিথীল হয়ে তার মাঝে প্রচন্ড উদ্দীপিত ভাব লক্ষ্য করা গেলো। সে দারুণ উত্তেজনায় রাগীবকে বললো,
” আপনাকে এখানে মোটেও আশা করিনি আমি। রাগীবও একই কথা হাসিমুখে বললো। তবে তার মাঝে সাবিহার ন্যায় উদ্দীপিত ভাবটি লক্ষ্য করা গেলো না৷ তবুও কণ্ঠে সামান্যতম চমকিত ভাব প্রকাশ করে বললো,
” আপনাকেও এখানে আমি আশা করিনি সাবিহা। হোয়াট এ কোইন্সিডেন্স, রাইট?”
” রাইট। কোইন্সিডেন্স হোক বা ইনটেনশনালিই হোক, আমাকে ডেটের পার্টনার হিসেবে পেয়ে আমি একেবারেই চিন্তামুক্ত। এতোক্ষণ আমি প্রচণ্ড ভয়ে ছিলাম। বারবার চিন্তা করছিলাম, যদি আমার ব্লাইন্ড ডেটের পার্টনার ভালো না হয়, তার চরিত্র যদি খারাপ হয়, সে যদি আমাকে বাজেভাবে টিজ করার ট্রাই করে তখন আমি কি করবো। বাট নাও আই এম টেনশন ফ্রি। ”
সাবিহার সম্পূর্ণ কথা শেষ হওয়ার পরমুহূর্তেই রাগিব সশব্দে হেসে উঠলো। কণ্ঠে ঈষৎ তবে যথেষ্ট অন্তরালে প্রহেলিকার ন্যায় ধোঁয়াশা রেখে বললো,
” আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন যে আমার চরিত্র ভালো। আমি যদি খারাপ হই তবে? ”
রাগীবের এহেন কথায় সাবিহা থতমত খেলো। খানিক হকচকালো। দৃঢ়তাহীনভাবে আমতাআমতা করে বললো,
” না মানে, আপনি আমাদের পেইং গেস্ট বলে…..”
রাগীব সাবিহার আচরণে ঈষৎ বাঁকা হেসে বললো,
” আমি আপনাদের পেইং গেস্ট বলে কি আমার উপর এত বিশ্বাস করবেন? কারোর উপর এতটা বিশ্বাস করা কি ঠিক?”
সাবিহা পরিস্থিতির যাঁতাকলে পড়ে বিমূঢ় হয়ে রইলো। নিরুত্তর দৃষ্টিতে রাগীবের দিকে ক্ষণিকের জন্য চেয়ে রইলো। অতঃপর মৃদু হাসার চেষ্টা করে অভ্রান্তচিত্তে বললো,
” কাউকে না কাউকে তো বিশ্বাস করতেই হবে। না হলে এ পৃথিবীতে টিকে থাকা খুব কষ্ট হয়ে যাবে। যদিও যুগটা ভালো না। কিন্তু সবাইকে অবিশ্বাস করার চেয়ে গুটিকয়েকের উপর বিশ্বাস করা ঢের ভালো। সেই গুটিকয়েকের মাঝে না হয় আপনিও পড়লেন। আশা করি,আপনাকে বিশ্বাস করে আমি ঠকবো না।”
সাবিহার প্রতিটি কথা দারুণ মুগ্ধতার সহিত শুনলো রাগীব। অতঃপর প্রত্যুত্তরস্বরূপ বিস্তৃত হেসে বললো,
” আমাকে বিশ্বাস করে আপনার লাভ না হলেও এটলিস্ট কোনো ক্ষতি হবে না। আই এশিওর ইউ।”
সাবিহা মৃদু হাসলো। অতঃপর নিরব চাহনিতে ক্ষণিকের জন্য রাগীবের দিকে চেয়ে রইলো। রাগীবের দৃষ্টি ম্যেনু কার্ডের উপর এবং সাবিহার দৃষ্টি তার উপর। সাবিহা রাগীবকে খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার সে রাগীবকে এভাবে দেখছে। প্রথমদিন ভার্সিটি যাওয়ার পূর্বে ফর্মাল লুকআপে এক নজর দেখেছিলো। কিন্তু প্রথমদিন দেখার বিস্তৃতকাল ছিলো কয়েক সেকেন্ড হতে এক মিনিট। তবে আজকে সে যেনো পুরো রাগীবকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। ব্লাইন্ড ডেট উপলক্ষে আজ রাগীব সাদা-কালো মিশ্রিত রঙের পোশাক পরেছে। তার পরনে সাদা রঙের টারটেল নেকের সোয়েটার ও তার উপরে কালো ব্লেজার এবং কালো প্যান্ট। মাথার চুলগুলো জেল দিয়ে বিন্যস্ত করা। ফর্সা গালে খোঁচা খোঁচা কালো দাঁড়ি। সাবিহা অদ্ভুত চাহনিতে লক্ষ্য করলো রাগীবের বাম গালে টোল পড়ছে। সে হাসছে না। তবে নিচের ঠোঁট কামড়ে কুঞ্চিত ঘন ভ্রুজুগল দ্বারা ম্যেনু কার্ড দেখছে। এতেই তার বাম গালের টোল দারুণভাবে নজর কাড়ছে। সাবিহা মুগ্ধ চাহনিতে রাগীবকে দেখছে। এই প্রথম একটি ছেলেকে অন্য নজরে দেখার দুঃসাহসীক কাজ সাধন করছে সে। এর পূর্বে সে কোনো ছেলেকে এতো নিকট হতে পর্যবেক্ষণ করেনি। কোনো ছেলের চেহারায় মুগ্ধ হয়নি। কোনো ছেলের শৌখিনতায় মুগ্ধ হয়নি। কোনো ছেলের সাজপোশাকে মুগ্ধ হয়নি। তবে আজ সে মুগ্ধ হয়েছে। একদম আকাশসম মুগ্ধতায় ভাসছে সে। আজ সব বাঁধা-বিপত্তি পার করে কারোর প্রেমে পড়তে মন চাইছে। আচ্ছা, ছেলেটা যদি রাগীব হয় তাতে দোষ কি। কিন্তু ভয়ংকর এ প্রেম নামক দুঃসাহসীক কাজে পরিণাম যদি খারাপ হয় তবে? না, এতো দ্বিধাদ্বন্দ্বে থেকে প্রেম করা যায় না। শুধু মুগ্ধ হলেই হবে। সময় অসময়ে রাগীবের অগোচরে নাহয় একটু দেখে নিবে তাকে। এই-ই হবে।
” ব্লাইন্ড ডেটের পার্টনারকে পছন্দ-টছন্দ করে ফেললেন না কি?”
অকস্মাৎ রাগীবের অকপটে করা প্রশ্নের তীরে বিদ্ধ হলো সাবিহা। হকচকিয়ে তৎক্ষনাৎ প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে নিতে বললো,
” কি ওর্ডার করবেন?”
সাবিহার প্রসঙ্গ পাল্টানোর দ্রুততা দেখে রাগীব মুখ লুকিয়ে হেসে ফেললো। বললো,
” রেড শ্রিম্প আর তিরামিসু ওর্ডার করবো ভাবছি। হ্যাভ ইউ এনি প্রবলেম উইথ দ্যাট?”
সাবিহা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ফলে মৃদু হেসে জবাব দিলো,
” নো নো। আপনি ওর্ডার করুন। ”
সাবিহার সম্মতি পেয়ে রাগীব ওয়েটারকে ডেকে ওর্ডার দিলো। অতঃপর রাগীব টেবিলে দু হাত রেখে সাবিহাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে উদ্যত হতেই সাবিহা চট করে জিজ্ঞেস করে বসলো,
” আপনার চোখটা এমন কেনো?”
রাগীব ঈষৎ হকচকালো। জিজ্ঞেস করলো,
” কেমন? আপনার কথা বুঝতে পারিনি ”
সাবিহা জহুরি নজরে রাগীবের দু চোখের দিকে চাইলো। আজই প্রথম সে রাগীবের চোখের মনির রঙটা ধরতে পেরেছে। হালকা খয়েরী রঙের চোখের মনি তার ফর্সা চেহারার সাথে মিলে গিয়েছে দারুণভাবে।
সাবিহা জিজ্ঞেস করলো,
” আপনার চোখের মনির রঙ লাইট ব্রাউন কালারের। এমন কেনো?”
সাবিহার বাচ্চামো ধরণের প্রশ্নে রাগীব সশব্দে হেসে উঠলো। সহাস্যে বললো,
” এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই মিস সাবিহা। ভালো হয় আপনি আমার মা’কে জিজ্ঞেস করুন। ”
সাবিহা রাগীবের প্রত্যুত্তরের তোয়াক্কা না করেই ফিরতি প্রশ্ন করলো,
” আপনার চেহারাটাও দেখতে ফরেইনারদের মতো লাগে। অদ্ভুত তো! আপনার জন্ম কি বিদেশে না কি?”
রাগীব ক্ষীণ ভড়কালো। তৎক্ষনাৎ নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
” দেশেই এমন অনেক ছেলেমেয়ে পাবেন যাদের চেহারা দেখতে অনেকটা ফরেইনারদের মতো। আমিও হয়তো তাদের মধ্যে একজন। ”
অতঃপর সে সাবিহাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
” আপনার ব্লাইন্ড ডেটের এরেঞ্জমেন্ট কে করেছে?”
প্রসঙ্গ পাল্টে যেতে দেখে সাবিহা কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হলো। তবে এতে জোর না দিয়ে সে রাগীবের প্রশ্নের জবাব দিলো,
” সোফিয়া। আর আপনি যে জর্জের বন্ধু তা জানতাম না৷ ”
রাগীব মৃদু হেসে বললো,
” এই যে এখন জেনে নিলেন। ”
” হ্যাঁ। বাই দা ওয়ে আপনি তো ভেনিসে এসেছেন বেশিদিন হয়নি৷ এই অল্প সময়ে আপনার সাথে জর্জের বন্ধুত্বও হয়ে গেলো আর সে আপনাকে ব্লাইন্ড ডেটের এরেঞ্জমেন্টও করে দিলো! কিভাবে পসিবল হলো?”
” নাথিং ইজ ইম্পসিবল মিস সাবিহা তাসনিম। আমি….”
রাগীবের কথার মাঝেই ওয়েটার ওর্ডারকৃত খাবার দিয়ে গেলো। খাবার পেয়ে দুজনই খাবার খাওয়ার পূর্ব প্রস্তুতি নিতে লাগলো। ইতোমধ্যে সাবিহা কিঞ্চিৎ বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে বসলো,
” আপনি আমার ফুল নেম জানলেন কি করে?”
রাগীব চামচ হাতে নিতে নিতে বললো,
” ব্লাইন্ড ডেটে পার্টনার সম্পর্কে আর কিছু জানা হোক বা না হোক, তার নাম জানাটা মাস্ট। ”
সাবিহা আর প্রত্যুত্তর করলো না। দুজনে খাবার খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। খাওয়া শেষে রাগীব বিল মিটিয়ে সাবিহাকে নিয়ে রেস্টুরেন্ট হতে বেরিয়ে পড়লো। পথিমধ্যে রাগীব বললো,
” মিস সাবিহা, আমার কাছে অন্যান্যদের মতো লং ড্রাইভে যাওয়ার জন্য গাড়ি নেই। সো আমরা কি ভেনিসের নির্জন রাস্তা ধরে পাশাপাশি হাঁটতে পারি?”
সাবিহা মিষ্টি হেসে বললো,
” হোয়াই নট। যদিও আমার গাড়ি আছে। তবে রাতের নির্জন পরিবেশে হাঁটার মজাই আলাদা। তো দেরি কেনো, চলুন। ভেনিসের নির্জনতম রাস্তার সৌন্দর্যের সাক্ষী হই দুজনে। ”
” চলুন। ”
তারা দুজনে হাঁটছে। ধীর পদে হাঁটছে। তাদের পথ চলা হচ্ছে পাশাপাশি। ভেনিসের রাতের সৌন্দর্য নিজের সর্বস্ব যেনো বিলিয়ে দিতে চাইছে রাগীব ও সাবিহার প্রতি। দুজনে নিরবে হাঁটছে। সাবিহা মাঝে মাঝে কোনো এক কারণে লাজুক হাসছে। এদিকে রাগীবের মন চাইছে তার স্নিগ্ধময়ীর হাতটা আলতো করে ধরে এ নির্জনতম পথ অতিক্রম করতে। তার মন চাইছে এ রূপসী রাতে একটি অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে, সাবিহাকে নিজের মনের কথা বলতে। কিন্তু এ শুভ কাজের সঠিক সময় এখনই নয়। এ মুহূর্তে তার দরকার কিছু ধৈর্যের।
রাগীব ও সাবিহা নিজ মনের অন্তরালে কল্পনায় একে অপরকে নিয়ে মুগ্ধতায় ঘেরা কিছু সময় কাটাতে লাগলো। নিশ্চুপে তাদের মধ্যকার সময়টা দিব্যি কেটে গেলো। হাঁটতে হাঁটতে তারা প্রায় জনমানবশূন্য একটি রাস্তায় এসে পৌঁছালো। আচমকা কোনো কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই একজন ইতালীয় লোক তাদের দিকে ছুরি ধরে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,
” নিজেদের কাছে যা যা আছে সব দিয়ে দাও। ”
হঠাৎ উদিত হওয়া বিপদাপন্ন পরিস্থিতিতে পড়ে সাবিহা ঘাবড়ে গেলো। তবে রাগীবের মাঝে কোনো পরিবর্তন হলো না। সে দিব্যি পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। না সে হঠাৎ উদিত হওয়া লোকটিকে কিছু করছে, না সে লোকটির কথা মান্য করছে। রাগীবের এমন গা ছাড়া ভাব দেখে সাবিহা ও লোকটি উভয়জনই বিস্মিত হলো। লোকটি আরো ঘাবড়ে আশেপাশে এক নজর বুলিয়ে এবার রাগীবের দিকে ছুরি ধরে বললো,
” চুপচাপ দাঁড়িয়ে না থেকে আমাকে সব দিয়ে দাও। আর তোমার গার্লফ্রেন্ডকেও বলো সব দিয়ে দিতে। ”
এই বলে সে সাবিহার দিকে ছুরি তাক করলো। কিন্তু অকস্মাৎ মুহূর্তমধ্যেই সাবিহা দু হাত মুঠো করে ডান পা শূন্যে তুলে লোকটির ঘাড়ে সজোরে আঘাত করলো। সাথে সাথে ঘাড় মটকে যাওয়ার শব্দ হলো। চলমান পরিস্থিতি বুঝে উঠার পূর্বেই লোকটি দূর্বল হয়ে ছুরি ফেলে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। এদিকে সাবিহার এ কান্ডে রাগীব বিস্মিত চাহনিতে তার দিকে চেয়ে রইলো।
#চলবে