প্রমত্ত_হৃদয় #পর্বসংখ্যা-১

0
6123

#প্রমত্ত_হৃদয়
#পর্বসংখ্যা-১
#জনরাঃ রোমান্টিক সাসপেন্স থ্রিলার
#লেখনীতে:সারা মেহেক

“শুধু একটা রাত কাটাতে হবে আমাদের সাথে। ব্যস, আর কিছু চাচ্ছি না৷ ”
বাঙালী যুবকটির অসৎ প্রস্তাবে সাবিহা প্রচণ্ড বিস্মিত হলো। কিন্তু তার বিস্ময়ের মাত্রা তার ক্রোধের মাত্রাকে ছাড়াতে পারলো না।

বান্ধবী সোফিয়ার বাসায় বার্থডে পার্টি শেষ করে বাড়ি ফিরছিলো সাবিহা। কথা ছিলো, বাকি বন্ধুদের সাথে পার্টি শেষে একত্রে বাড়ি ফিরবে সে৷ কিন্তু পার্টি শেষে তার বন্ধুরা বাড়িতে ফেরার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলে। তারা সকলেই আজ সোফিয়ার বাসায় রাত কাটাতে আগ্রহী হয়। কিন্তু সাবিহা এতে রাজি হয় না। কারণ রাতে বাড়ির বাইরে থাকতে তার ভালো লাগে না৷ এজন্যই সে একাই নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। প্রথমে সে ভেবেছিলো বাড়িতে ফোন করে গাড়ি পাঠিয়ে দিতে বলবে। কিন্তু পূর্ণিমা রাতে ভেনিসের ছিমছাম রাস্তা ধরে হাঁটার লোভ সে সামলিয়ে উঠতে পারেনি। ফলস্বরূপ পায়ে হেঁটেই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সে। এরই মাঝে হঠাৎ একটি বাঙালী ও একটি ইতালীয় যুবক এসে তার পথ আগলে ধরে। তাকে দিয়ে বসে এক সাথে রাত কাটানোর বাজে প্রস্তাব।

সাবিহা যুবকটির উদ্দেশ্যে ক্রুদ্ধ গলায় বললো,
” আপনার সাহস কি করে হলো আমাকে এমন প্রস্তাব দেওয়ার? ”

যুবকটি সাবিহাকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ শেষে হলদেটে দাঁত বের করে বি’শ্রীভাবে হাসলো। তার নিকটে দাঁড়িয়ে থাকা ইতালীয় যুবকটিও একই ভঙ্গিতে হাসলো। দুজনের উদ্দেশ্য একই৷ আজকের রাত এই মেয়েটার সাথে কাটিয়ে দেওয়া। যুবকটি হালকা হাতে দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে পুনরায় বললো,
” এতে সাহসের কি দেখলে তুমি? চলো আমাদের সাথে। শুধু একটা রাতেরই তো ব্যাপার। আজ রাতের বিনিময়ে তুমি যা চাইবে তা-ই দেওয়ার চেষ্টা করবো আমরা। কি? ঠিক বলেছি লুকা?”

শেষোক্ত কথাটি ইতালীয় ভাষায় বললো যুবকটি। সাবিহা ঘৃণাপূর্ণ চাহনিতে চেয়ে যুবকটির উদ্দেশ্যে বললো,
” বাঙালী হিসেবে এটলিস্ট ভদ্রতামূলক আচরণ করা উচিত ছিলো আপনার। কিন্তু নর্দমার কিটদের এটা কে বুঝাবে?”
এই বলে সাবিহা উল্টো পথে হাঁটা শুরু করলো। কিন্তু দু কদম যেতে না যেতেই যুবকটি পিছন থেকে সাবিহার হাত চেপে ধরে। এতে সাবিহা কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গেলেও তৎক্ষনাৎ আত্মরক্ষা করতে যুবকটির দিকে ফিরলো সে৷

মুহূর্তমধ্যেই সাবিহা যুবকটির হাত ঘুরিয়ে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো এবং যুবকটির কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই সে যুবকটির হাত নিজের নিয়ন্ত্রণে নিলো। অতঃপর পা দিয়ে যুবকটির পু’রু’ষা’ঙ্গে লাথি দিয়ে তাকে ধরা’শায়ী করে ফেললো। সাবিহার এ আত্মরক্ষামূলক কাজে দুজনেই হতবুদ্ধি হয়ে পড়লো। তারা বিস্ফোরিত নয়নে সাবিহার দিকে চেয়ে রইলো। এরই সুযোগে সাবিহা পা বাড়িয়ে পালিয়ে যেতে দৌড় দিলো।

যুবক দুটি এ হতবুদ্ধিকর পরিস্থিতি এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যতক্ষণে তারা পরিস্থিতি বুঝতে পারলো ততক্ষণে সাবিহা তাদের হাতের নাগাল হতে বেড়িয়ে গিয়েছে। এদিকে ব’খা’টে যুবক দুটির নাগাল হতে বেরিয়ে কিছুদূর আসতেই ব্যাথায় তার পা দুটো থমকে গেলো। পাশেই একটি গাছের গুঁড়ির কাছে বসে ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো সে। বহুদিন পর এতো দূরত্ব দৌড়ে অতিক্রম করায় হাঁপিয়ে উঠেছে সাবিহা। দু হাত দিয়ে মাথা ধরে বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়ছে সে।

শ্বাসপ্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিক হয়ে এলে আশেপাশে এক নজর বুলিয়ে নিলো সাবিহা। অতঃপর অনিশ্চিত বিপদের শঙ্কায় সে তার বাবাকে কল দিয়ে নির্দিষ্ট ঠিকানায় গাড়ি পাঠিয়ে দিতে বললো।

.

” তোকে স্বাধীনতা দিয়েছি। এর মানে এই নয় যে তুই এতো রাত করে বাসায় ফিরবি। তাও আবার একা! তোর সাহস কি করে হলো পুতুল!”
আফসার সাহেবের রোষানলে পড়ে নুয়ে পড়ার পাতার ন্যায় মিইয়ে গিয়েছে সাবিহা। চুপটি করে রিডিং রুমের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে আছে সে। তার সামনে রাজকীয় ধাঁচের একটা সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন আফসার সাহেব। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে আছে সামাদ।

সাবিহা অতি কোমল গলায় বললো,
” অনেকদিন একা হাঁটি না। আজ খুব ইচ্ছে করেছিলো এ কারণেই….”

সাবিহার সপক্ষের যুক্তি সম্পূর্ণ না শুনেই আফসার সাহেব পূর্বের ন্যায় বললেন,
” ইচ্ছেটাকে সময় সুযোগ বুঝে ব্যবহার করতে হয়। এটা শিখবি কবে তুই?”

সাবিহা পুনরায় আত্মপক্ষে কিছু বলতে যাবে কিন্তু এর পূর্বেই সামাদ নিতান্তই দুষ্টুমির ছলে বললো,
” সাবিহাকে একটু টাইট দিতে হবে খালু। তবেই যদি ওর দূরন্তপনা কমে।”

সামাদের এরূপ কথা শুনে মুহূর্তে তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে সাবিহা বললো,
” সামাদ ভাই, তুমি বেশি বেশি বলছো কেনো! কিসের দূরন্তপনা করলাম আমি!”

আফসার সাহেব সাবিহাকে থামিয়ে সামাদের পক্ষ নিয়ে বললেন,
” সামাদ ঠিক বলেছে। তোকে একটু টাইট দেওয়া খুব জরুরি হয়ে গিয়েছে। ”

এ পর্যায়ে সাবিহা ঝেঁঝে উঠে বললো,
” আমি যথেষ্ট ভালো আছি আব্বু। আর তুমি আমাকে সেল্ফ প্রটেকশনের জন্য যা যা শিখা দরকার সব শিখিয়েছো। আজ কারাটের ছোট একটা স্টেপ নিয়ে ওদেরকে হারিয়ে এসেছি। তারপরও এতো চিন্তা করো কেনো!”

আফসার সাহেব মেয়ের ক্রোধের মুখে পড়ে কিছুটা নরম হলেন। বললেন,
” আজ ছোট একটা পরিস্থিতিতে দুজন মানুষের সামনে পরেছিলি। এজন্যই কারাটের দুটো স্টেপ এপ্লাই করে পার পেয়ে গিয়েছিস। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি……”

বাবার কথা সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার পূর্বেই সাবিহা ক্ষিপ্রতার সহিত রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। সাবিহা বেরিয়ে যেতেই আফসার সাহেব কিছুক্ষণের জন্য চিন্তার সাগরে ডুব দিলেন। অতঃপর সামাদকে বললেন,
” সামাদ, ছেলে দুটোর খোঁজ করো। ”

মুহূর্তেই সামাদ বাধ্য ছেলের ন্যায় বলে উঠলো,
” আচ্ছা খালু।”

.

” মিস্টার রাগীব শাহরিয়ার। রাইট?”
কুঞ্চিত কপাল নিয়ে ক্ষীণ সন্দেহের সুরে বললেন আফসার সাহেব৷
রাগীব ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে বললো,
” জি। ”

ড্রইং রুমের দামী সোফায় বসে আছেন আফসার সাহেব। বয়স তার পঞ্চান্ন ছুঁই ছুঁই। মাথার চুল, গালের দাঁড়িতে বেশ ভালোই পাক ধরেছে। ইতালীর ভেনিস শহরের স্বনামধন্য ব্যবসায়ীর মধ্যে তিনি একজন৷ আজ থেকে প্রায় চৌদ্দ বছর পূর্বে সাবিহার বয়স যখন দশ তখন সপরিবারে বাংলাদেশ থেকে ভেনিসে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তারা। প্রথমে ভেনিসে এসে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তাঁকে। কিন্তু কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বছর দুয়েকের মাঝেই ছোট জায়গা জুড়ে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। দিন যেতে যেতে এ সুনাম শহর ছাড়িয়ে দেশ এবং দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে।
স্ত্রী সালমা বেগম, একমাত্র মেয়ে সাবিহা, বারো বছরের ছেলে সাবিত ও সালমার বড় বোনের শেষ চিহ্ন সামাদকে নিয়ে তাঁর সংসার জীবন।

রাগীব আফসার সাহেবের দিকে কৃত্রিম হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে। আফসার সাহেব রাগীবকে জিজ্ঞেস করলেন,
” পড়ালেখা সব কমপ্লিট। তাই তো?”

রাগীব পূর্বের ন্যায় জবাব দিলো,
” জি স্যার।”

রাগীবের মুখে ‘স্যার’ সম্বোধন শুনে আফসার সাহেব সহাস্যে বললেন,
” আরে এখনই স্যার বলছো কেনো! আগে আমাদের কোম্পানিতে জয়েন হয়ে নাও তারপর এসব ‘স্যার ট্যার’ ডাকবে। ”

রাগীব প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না৷ মৃদু হেসে চুপটি করে বসে রইলো। এরই ফাঁকে তাকে এক নজর দেখে নিলেন আফসার সাহেব। ছেলেটি দেখতে ভীষণ সুন্দর৷ মাথায় স্বাভাবিক ছাঁটের কালো কালো চুল। ফর্সা মুখশ্রীতে ঘন ভ্রুজুগল সমন্বিত দু জোড়া চোখ। সে দু চোখের গভীরতা অনেক। যেনো কোনো প্রহেলিকা ছেয়ে আছে তাতে। ফর্সা গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর হাসিতে বাম গালে পড়া ছোট্ট একটা টোল৷ সব মিলিয়ে চেহারায় কেমন এক বিদেশি বিদেশি ভাব৷ হাসিটাও তার চেহারার সাথে একদম খাপ খাইয়ে মানিয়ে নিয়েছে।
আফসার সাহেব মনে মনে ভাবলেন, এই ছেলেকে কোনে মেয়ে প্রথম দেখায় নিজের মন দিয়ে বসবে৷ আচ্ছা? সাবিহাও যদি এমনটা করে বসে? নিজেকে এমন উদ্ভট প্রশ্ন করে পরমুহূর্তেই সামলে নিলেন নিজেকে। সাবিহা কেমন তা তিনি খুব ভালো করে চিনেন। কিন্তু তবুও সে তো মেয়ে। নিজেদের বাড়িতে পেইং গেস্ট হিসেবে এতো সুদর্শন ছেলেকে দেখে যদি সাবিহা প্রেমে পড়ে যায় তবে? তাহলে কি রাগীবকে পেইং গেস্ট হিসেবে রাখবেন না তিনি? কিন্তু পূর্ব পরিচিত গিয়াস সাহেবের অনুরোধও যে ফেলতে পারছেন না তিনি। ইশ, এ যেনো উভয় সংকট।

শেষমেশ নানা চিন্তাভাবনা শেষে আফসার সাহেব ছোট দম ফেলে বললেন,
” আচ্ছা, রাগীব। আগামী পরশু থেকে তুমি অফিসে জয়েন করো। আজ তোমার রুমের সব গোছগাছ করে নাও। ”
এই বলে তিনি ড্রাইং রুমের থাই গ্লাস ভেদ করে দৃশ্যমান গেস্ট হাউজটা দেখিয়ে বললেন,
” ওখানেই তুমি থাকবে এখন থেকে। গেস্ট হাউজে সব ব্যবস্থা করে দেওয়া আছে। ওখানে রান্নাঘরও আছে। তুমি চাইলে নিজের খাবার রান্না করতে পারো। বাই দা ওয়ে রান্না করতে পারো তো?”

আফসার সাহেবের প্রশ্নের পিঠে রাগীব চট করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
” যদি বলি রান্না করতে পারি না, তাহলে কি আপনাদের এখানে খাওয়াদাওয়া করতে দিবেন আমায়?”

রাগীবের এহেন প্রশ্নে হতবিহ্বল হয়ে পড়লেন আফসার সাহেব। ছেলেটি যে আচমকা এ প্রশ্ন করে বসবে তা তিনি অনুমান করতে পারেননি। ফলে আমতাআমতা করে তিনি বললেন,
” করতে পারো…..”

আফসার সাহেবকে সম্পূর্ণ কথা বলতে না দিয়ে রাগীব সশব্দে হেসে বললেন,
” আরে ভয় পাবেন না আংকেল। আমি যাস্ট মজা করলাম। এমন একটু আধটু মজা করা আমার স্বভাব। আচ্ছা, এখন তাহলে আমি উঠি। ”
এই বলে রাগীব সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আফসার সাহেবও তা দেখে উঠে দাঁড়ালেন। দুজনেই ভদ্রতাসূচক হাসি বিনিময় করলো। অতঃপর রাগীব তার ফাইল নিয়ে ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। রাগীব যেতেই আফসার সাহেব ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” ছেলেটা বেশ চালু আছে। যা বুঝলাম, আপনার সম্পর্কে পুরো খোঁজ খবর নিতে হবে মিস্টার রাগীব শাহরিয়ার। ”

#চলবে কি?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here