#প্রমত্ত_হৃদয়-৫
#লেখনীতে:সারা মেহেক
আজ ভেনিসের তাপমাত্রা তুলনামূলকভাবে একটু বেশি। ফলে সকলের মধ্যে তীব্র শীতে জবুথবু হয়ে ঘুরে বেড়ানোর ভাবটুকু নেই। সকলেই স্বাভাবিকভাবে যাতায়াত করছে। সাবিহা তার বন্ধুরাও একত্রে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলছে।
ভেনিসের সুদৃশ্য রাস্তা দিয়ে তারা হেঁটে চলছে৷ স্যান সারভোলো দ্বীপ থেকে প্রত্যেকের বাসায়ই নিকটে। শুধু সাবিহাদের বাসা তুলনামূলক একটু দূরে। এজন্য সে প্রত্যহ গাড়ি দিয়েই আসাযাওয়া করে। কিন্তু মাঝে মাঝে ভেনিসের লোভনীয় সৌন্দর্য তাকে মারাত্মক আকৃষ্ট করে। তার মন চায় এ সৌন্দর্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে৷ মাঝেমধ্যে অবশ্য এ কাজটা করেও বসে সে৷ কোনো এক ছুটির দিনে বাসা থেকে একা হাঁটতে হাঁটতে বের হয় সে। দুপাশের রঙিন দালানের রাস্তা ধরে হেঁটে চলে৷ কখনো খালের পাশে বেঞ্চিতে বসে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে, চলমান গন্ডোলায় যাতায়াতরত যাত্রীদের দেখে৷ মাঝে মাঝে সে যাত্রীদের মাঝে বাঙালীদের দেখলে তার মনে কেমন যেনো শূণ্যতা অনুভব হয়। মন চায় ছুটে দেশে চলে যেতে। কত বছর কেটে গেলো দেশের মাটি স্পর্শ করা হয় না। বৃষ্টির পরমুহূর্তে সে সোঁদা মাটির গন্ধ নাকে আসে না। ইশ, নিজের দেশ মানেই অন্যকিছু৷ বিদেশে থেকে কি দেশের স্বাদ মেটানো যায়!
সাবিহা ও সোফিয়া পাশাপাশি হাঁটছে। তাদের দল থেকে কিছুটা দূরে৷ এর অবশ্য কারণও আছে। সোফিয়া তার বার্থডে পার্টির সম্পর্কে সাবিহাকে কিছু বলতে চাইছে। তার মধ্যে পহেলা হতেই চরম উৎসুকতার দেখা মিলছে। বিষয়টা সাবিহা লক্ষ্য করেছে। কিন্তু এতোক্ষণ একান্ত ব্যক্তিগত সময় সুযোগ না পাওয়ায় সে আগ বাড়িয়ে সোফিয়াকে এ নিয়ে জিজ্ঞেস করেনি এবং সোফিয়াও বলেনি৷ কিন্তু নিজের উৎসুকতা দমাতে না পেরে সোফিয়া বন্ধুদের ভীড় থেকে একটু দূরে সরে আসে। তাকে দেখে সাবিহাও এগিয়ে আসে।
সাবিহা আসতেই সোফিয়া আগ্রহী হয়ে বললো,
” সাবিহা, তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো। ”
সাবিহা কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে সোফিয়ার দিকে চাইলো। সন্দেহাতীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” কি ব্যাপার সোফিয়া? এতো এক্সাইটেড কেনো তুমি?”
সোফিয়া এবার কিছুটা লাজুক চাহনিতে সাবিহার দিকে তাকালো। বললো,
” আমার বার্থডে পার্টির রাতে জর্জ আমাকে প্রপোজ করেছে৷ ”
সাবিহা মুহূর্তেই আনন্দে ফেটে পড়লো। থমকে দাঁড়িয়ে সোফিয়াকে জড়িয়ে ধরে তীব্র আনন্দে বললো,
” কংগ্রাচুলেশনস সোফিয়া৷ এটলাস্ট তোমার মনের ইচ্ছা পূরণ হলো৷ আমি কবে থেকে চাইছিলাম, তোমার আর জর্জের মধ্যে কিছু হোক। অবশেষে সুসংবাদ শুনতে পেলাম। ”
এই বলে সে সোফিয়াকে ছেড়ে দিলো৷ সোফিয়া বললো,
” আমি খুব খুশি হয়েছি সাবিহা। আমি ভাবতেও পারিনি জর্জও আমাকে পছন্দ করে।”
” আমি আগে……”
সাবিহা তার কথা শেষ করতে পারলো না৷ এর পূর্বেই সাবিহার পিছন হতে অপরিচিত এক কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
” হেই প্রিটি লেডি।”
আচমকা পুরুষালি কণ্ঠে চমকে উঠলো সাবিহা। মূল জায়গা হতে ছিটকে দু কদম দূরে সরে এলো সে৷ তৎক্ষনাৎ পিছনে তাকিয়ে দেখলো ঠোঁটের কোনে স্নিগ্ধ হাসি নিয়ে রাগীব দাঁড়িয়ে আছে। সাবিহা মুহূর্তেই রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,
” সমস্যা কি আপনার? এভাবে পেছন থেকে আমাকে ডাকার মানে কি!”
রাগীব বিস্তৃত হাসলো। দু কদম এগিয়ে এসে সোফিয়ার সম্মুখে দাঁড়ালো। সাবিহাকে উদ্দেশ্য করে সোফিয়ার পানে চেয়ে বললো,
” আমি আপনাকে বলেনি৷ আমি তো সোফিয়াকে বলেছি৷ ”
এই বলে রাগীব সোফিয়ার দিকে নিজের হাত বাড়ালো। পরিস্থিতি সম্পর্কে অনবগত সোফিয়া ক্ষণিকের জন্য কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়লো। তবে রাগীবের হাত বাড়ানো দেখে সে জোরপূর্বক হেসে নিজের হাত রাগীবের হাতে রাখলো। অতঃপর রাগীব সোফিয়ার হাতের পিঠে আলতো করে চুমু দিয়ে ভদ্রতাসূচক কণ্ঠে বললো,
” আমার সামনে এই প্রিটি লেডি থাকতে আমি অন্য কাউকে দেখবো কেনো!”
রাগীবের এহেন কথায় অপমানে থমথমে হয়ে এলো সাবিহার মুখশ্রী। সে তীক্ষ্ণ চাহনিতে রাগীবের দিকে চাইলো। চাহনি এমন যে, এখনই বোধহয় চোখের আগুন দিয়ে রাগীবকে ঝলসে দিবে। রাগীব অবশ্য সাবিহার এ চাহনি লক্ষ্য করলো। কিন্তু সরাসরিই এ চাহনি উপেক্ষা করে বললো,
” মিস সাবিহা, আপনার এমন কেনো মনে হলো যে আমি আপনাকেই প্রিটি লেডি বলছি? নিজেকে প্রিটি মনে করেন বুঝি?”
রাগীবের গা জ্বালানো কথাবার্তায় সাবিহা ক্ষেপে উঠলো। তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদী বালিকার ন্যায় বললো,
” অবশ্যই প্রিটি মনে করি নিজেকে। হ্যাভ ইউ এনি প্রবলেম উইথ দ্যাট?”
রাগীব বাম কাতে মুখ লুকিয়ে হেসে ফেললো। বললো,
” আপনার কনফিডেন্স লেভেলটা দারুন মিস সাবিহা৷ কিপ ইট আপ। ”
” এ নিয়ে আপনাকে বলতে হবে না মিস্টার রাগীব শাহরিয়ার। ”
রাগীব প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না। মৃদু হেসে বিড়বিড় করে কিছু স্বগতক্তি করলো। কিন্তু পার্শ্ববর্তী পরিবেশের কোলাহলে সাবিহার কানে তা এলো না এবং সে এ বিষয়ে আর মাথাও ঘামালো না। এদিকে সোফিয়া পহেলা হতেই বেকুব বনে দাঁড়িয়ে আছে। রাগীব ও সাবিহার মাঝে বাংলা ভাষায় চলমান কথোপকথনের পুরোটাই তার মাথার উপর দিয়ে চলে গেলো। সে চেহারায় অদ্ভুত অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলে সাবিহাকে জিজ্ঞেস করলো,
” তোমরা কি নিয়ে কথা বলছো? তোমাদের কোনো কথাই আমি বুঝতে পারিনি। ”
সাবিহা প্রতিক্রিয়া স্বরূপ সরু চোখে রাগীবের দিকে চাইলো। দু হাত বুকে গুঁজে অনিহার সহিত বললো,
” নাথিং সোফিয়া। ”
এ পর্যায়ে রাগীব সহাস্যে সোফিয়াকে বললো,
” এ ভাষা তোমার সময়ের প্রয়োজন সোফিয়া। ”
সোফিয়া রাগীবের সাথে সহমত প্রদর্শন করে ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
” ঠিক বলেছো। রাঘীব। রাইট?”
সোফিয়ার মুখে নিজের নামের বিকৃত উচ্চারণ শুনে রাগীবের মুখ ছোট হয়ে এলো। এদিকে সাবিহা ফিক করে হেসে ফেললো। এ পর্যায়ে রাগীব বেশ অপমানিত বোধ করলো। সোফিয়াকে নিজের নামের সঠিক উচ্চারণ শেখাতে ভেঙে ভেঙে নিজের নামটা বললো। ক্ষণিকের মাঝেই সোফিয়া রাগীবের নামের সঠিক উচ্চারণ বললো।
অতঃপর রাগীব মুচকি হেসে সাবিহা ও সোফিয়াকে প্রস্তাব দিয়ে বসলো,
” হেই লেডিস, উড ইউ হ্যাভ আ গন্ডোলা রাইড উইথ মি?”
সোফিয়া মুচকি হেসেস সম্মতি প্রদান করলো,
” ইয়েস হ্যান্ডসাম৷ হোয়াই নট। ”
সোফিয়া রাজি হতেই রাগীব সরাসরি সাবিহার দিকে তাকালো। সম্মতি পাবার আশায়৷ তৎক্ষণাৎ সাবিহা মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। যার অর্থ সে রাজি নয়। কিন্তু সোফিয়াকে তাকে অনুরোধ করলো। কয়েকবার বলায় সাবিহা রাজি হয়ে যেতেই রাগীবের ঠোঁটের কোনে প্রচ্ছন্ন হাসি ফুটলো।
রাগীব এগিয়ে একজন গন্ডোলিয়ারকে ডাকলো। রাগীবকে দেখে গন্ডোলিয়ারটি মৃদু হেসে তার গন্ডোলা থামালো। অতঃপর রাগীব, সোফিয়া ও সাবিহা গন্ডোলায় উঠলো। সোফিয়া ও সাবিহা রাগীবের মুখোমুখি বসতেই গন্ডোলা তার আপন গতিতে চলতে শুরু করলো।
গন্ডোলা ভেনিসের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং ঐতিহ্যবাহী একটি যান৷ এটি দেখতে অনেকটা দেশীয় নৌকার মতো৷ তবে এটি তুলনামূলক উন্নতমানের৷ ভেনিসের জনগণ গন্ডোলাকে তাদের প্রত্যহ যাতায়াতে ব্যবহার করে। এ শহরের এক স্থান হতে অন্য স্থানে যেতে গাড়ি কম গন্ডোলা বেশি ব্যবহৃত হয়।
দু পাশের রঙিন, রঙচটা দালানের মাঝ দিয়ে প্রবাহিত খাল দিয়ে গন্ডোলাটি ভেসে চলছে৷ চারপাশে আরো কয়েকটি গন্ডোলা রয়েছে। গন্ডোলিয়ার একটি বৈঠার দ্বারা গন্ডোলা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন৷ এর গতি খুব একটা দ্রুত না। বরং তুলনামূলক ধীর। তবে এ ধীর যানে উঠেও বেশ মজা। এতে চারপাশের পরিবেশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে ছোট্ট কিছু মুহূর্তের ভ্রমণ করা যায়।
সাবিহা ও সোফিয়া নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত। তাদের আলোচনার বিষয় আজকের ক্লাস৷ এদিকে রাগীব ব্যস্ত তার নিজস্ব কাজে, সাবিহাকে দেখতে। দু নয়ন ভরে দেখতে। মেয়েটা দারুন সুন্দর। তথাকথিত সুন্দরীদের চেয়েও সুন্দর৷ কেমন যেনো অদ্ভুত সুন্দর৷ ঘোর লাগা সুন্দর। মেয়েটার দিকে চাইলে রাগীবের পলক ফেলতে মন চায় না৷ কি অদ্ভুত মেয়েটার আকর্ষণ। প্রথম দেখাতেই রাগীবের সকল আকর্ষণের বিষয়বস্তু হয়ে আছে সাবিহার স্নিগ্ধ মায়াবী চেহারা। টানা টানা নেত্রজুগলের মায়ার সহিত মুখশ্রীতে স্নিগ্ধতা, মেয়েটিকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলেছে৷ কি স্নিগ্ধময়ী নারী সে! রাগীব স্মিতহাস্য বিড়বিড় করে বললো,
” স্নিগ্ধময়ী। আমার স্নিগ্ধময়ী। ”
অতঃপর আচমকা গলা ছেড়ে গাওয়া শুরু করলো,
” ওহে কী করিলে বলো, পাইব তোমারে
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে
ওহে কী করিলে বলো, পাইব তোমারে
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে
ওহে এত প্রেম আমি কোথাও পাব না
এত প্রেম আমি কোথাও পাব না
তোমারে হৃদয়ে রাখিতে
আমার সাধ্য কিবা তোমারে
দয়া না করিলে কে পারে
তুমি আপনি না এলে কে পারে
হৃদয়ে রাখিতে
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাই না
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাই না।……”
আচমকা রাগীবের গলায় বাংলা গান শুনে চমকে উঠলো সাবিহা। সাথে সোফিয়া ও গন্ডোলিয়ারসহ আশেপাশের কিছু মানুষজন। সকলে খানিক বিস্মিত নয়নে রাগীবকে দেখছে, রাগীবের গান শুনছে। এদিকে রাগীব নিজের গানে ব্যস্ত। সে চারপাশের পরিবেশ উপেক্ষা করে সমস্ত ধ্যান জ্ঞান সাবিহার দিকে দিলো। কারণ তাকে উদ্দেশ্য করেই যে গানটা গাওয়া।
.
” সামাদ? খোঁজ খবর নেওয়া শেষ? ”
রিডিং রুমের আধো আলোকিত পরিবেশে রাজকীয় গোছের চেয়ারে বসে গমগমে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন আফসার সাহেব।
সামাদ গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
” রাগীব ক্লিন চিট পেয়েছে খালু। অন্তত আমরা যে খোঁজ খবর নিয়েছি সে ভিত্তিতে। ”
” তোমার উপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে সামাদ। যেহেতু তুমি ওকে পজিটিভ বলছো সেহেতু আমিও সেদিকে যাচ্ছি। ”
” জি খালু। আমার মনে হয় ছেলেটা যথেষ্ট ভালো৷ চেহারা দেখে খুব ভদ্র মনে হয়।”
আফসার সাহেব তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললেন,
” কারোর চেহারায় ভদ্র লেখা থাকলেই কি সে ভদ্র হয়ে যায়? যেমন আমাকে দেখে ভদ্র মনে হলেও কি আমি আদৌ ভদ্র? ”
এই বলে আফসার সাহেব অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। সাথে যোগ দিলো সামাদ। ক্ষণিকের মাঝেই হাসি থামিয়ে আফসার সাহেব বললেন,
” আমারও মনে হয় রাগীব ছেলেটা ভালো, ভদ্র। গাট ফিলিং আর কি৷ আজ দেখলাম, ওর পদের কাজ ও বেশ ভালোই পারে। ”
” জি খালু। আমিও খেয়াল করেছি। কাল থেকে তাহলে রাগীব অফিশিয়ালি জয়েন করছে?”
” হ্যাঁ। তুমি সময় করে কালকে ওকে ভালোভাবে কাজ বুঝিয়ে দিও।”
” আচ্ছা খালু। ”
#চলবে