#প্রার্থনায় রবে তুমি
#পর্ব ২৫
#Saji Afroz
ইধার সামনে বসে আছেন শারমীন আক্তার। সাদ্দামের মা অসুস্থ। ও বাড়িতে সবাই গেছে। ইধা এখানে একা আছে তিনি জানতেন। তাই তিনি এসেছেন ইধার সঙ্গে কথা বলতে। ইধা বুঝতে পেরেছে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা তিনি বলবেন। তাই বোনের অসুস্থতার কথা জেনে ওখানে না গিয়ে আগে এখানেই এসেছেন। তবে যে এই গুরুত্বপূর্ণ কথা ইধার জীবনটা উলোটপালোট করে দেবে ভাবেনি ও। ইধা বলল, আমি চা করে আনি।
-বসো তুমি। আমার বোনের কাছে যেতে হবে। তার আগে তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।
-বলুন আন্টি?
-রুজাইনের বাবা কথা বলতে চান তোমার সঙ্গে।
ইধা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তার দিকে৷ তিনি আর কিছু না বলেই ফোনটা এগিয়ে দিলেন ইধার দিকে।
রিং বাজছিল। ইধা হাতে নিতেই ওপাশ থেকে রিসিভ করা হয়। রুজাইনের বাবা হ্যালো বলতেই ইধা বলল, সালাম আঙ্কেল।
ওপাশ থেকে ব্যঙ্গসুরে রমজিদ শাহ বললেন, এভাবে সালাম জানায় না। অবশ্য তুমি জানবেও কীভাবে! হিন্দু তুমি। তাই তোমরা যেভাবে বলো সেভাবেই বলো না!
ইধা নিশ্চুপ হয়ে যায়। রমজিদ শাহ বললেন, শারমিন আমায় কিছু না জানালেও আশামনি সব জানিয়েছে। আমি শারমিনের উপরে খুবই হতাশ। ওর উপরে ভরসা করে ছেলেটাকে ওখানে রেখেছি। নতুবা আমার কাছে নিয়ে আসতাম। এই দিন দেখার জন্য আমি বিদেশে এত কষ্ট করছি!
ইধা এইবার সবটা বুঝতে পারে। রমজিদ শাহ সব জেনে ক্ষেপে আছেন। এই মুহুর্তে ও কী বলবে বুঝতে না পেরে নিশ্চুপই থাকে। এতে রমজিদ শাহ আরও ক্ষিপ্ত হলেন। তিনি বললেন, এই মেয়ে? কিছু কেন বলছ না তুমি!
শারমিন আক্তারের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকায় ইধা। তিনি মুখটা ঘুরিয়ে নিলেন। রমজিদ শাহ বললেন, যা বলব সব কানের বাইরে রেখে আমার ছেলেকে বশে নিয়ে নেবে। এটাই প্লান তোমার?
এইবার মুখ খুললো ইধা। ও বলল, এমন কিছু না আঙ্কেল।
-তবে কেমন কিছু? আমি ভাবতে পারছি না রুজাইন এসব করেছে আর ও মা ওকে সাহায্য করছে!
তার কর্কশ কণ্ঠ শুনে ইধা বলল, প্লিজ আপনি উত্তেজিত হবেন না।
-উত্তেজিত আমি হচ্ছি না। তবে হতে বেশিক্ষণ লাগবে না। আমাকে তুমি চেনো না মেয়ে।
ইধা আবারও নিশ্চুপ। রমজিদ শাহ বললেন, রুজাইনের এরূপ কর্মকাণ্ডের জন্য ওকে আমি ত্যাজ্যপুত্র করব। আর ওর মা কে তালাক দেব আমি। তোমরা যেদিকে খুশি চলে যেতে পারো।
-আঙ্কেল!
-সেটাই করব আমি। আল্লাহ এর পবিত্র স্থানে থেকে শপথ করলাম। এতদূরে থেকে এত কষ্ট করে এই দিন আমি দেখতে চাই না। চাই না আমার ছেলে অন্য ধর্মের মেয়েকে বিয়ে করে নিক। এইবার তুমি যা খুশি করতে পারো।
-কিন্তু আঙ্কেল! আমি মুসলিম হব বলেছি!
-নাটক কম করো! ওসব তোমার অভিনয়। তাছাড়া হলেও তোমার কোনো জাত বংশের ঠিক আছে! আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি তোমার বাবারও ঠিক নেই!
-আঙ্কেল!
-শোনো! তোমাকে আমি বেশি সময় দেব না৷ যত তাড়াতাড়ি পারো ছাড়ো রুজাইনকে। নাহলে আমি যা বলেছি তা তো করবই আর তোমাদের কাউকে শান্তিতে থাকতে দেব না।
রমজিদ শাহ ফোন রাখলে ইধা অস্থির হয়ে বলল, আঙ্কেল এসব কী বলছেন?
শারমিন আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, আশা সবটা তাকে বলে দিয়েছে। আমাকে ফোনকলে খুব বকেছেন। অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছেন। আমার একটা কথাও বোঝার চেষ্টা করেননি।
এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। ইধা তার পাশে বসে বলল, প্লিজ কাঁদবেন না!
ভাঙা গলায় তিনি বললেন, তবে কী করব বলতে পারো? আমাকে তালাক দেবে বলেছেন তিনি।
ইধা নিশ্চুপ।
তিনি বললেন-
বিয়ের অনেক বছর পর রুজাইন আমার কোল আলো করে এসেছিল। এত বছরেও যখন বাচ্চা হচ্ছিলো না, অনেকেই তাকে বলেছেন আমায় তালাক দিতে। তার একটাই কথা ছিল, বাচ্চা দত্তক নেবেন তাও আমায় ছাড়বেন না৷ দ্বিতীয় বিয়ে করতেও তিনি রাজি ছিলেন না৷ আমি কষ্ট পাব তাই! আমার শাশুড়ী কথা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তারপরেও আমায় ছাড়েনি৷ অথচ আজ! তোমাদের জন্য সেই মানুষটাকে হারাতে বসেছি আমি।
-আন্টি!
-উনার কথা শুনে মনে হচ্ছে না কতটা সিরিয়াস? শপথ করেছেন! আর উনি এক কথার মানুষ। এর নড়চড় হবে না জানি আমি।
তিনি আবারও বলতে শুরু করলেন-
তোমরা তো আর আমার জন্য সেক্রিফাইস করবে না। আমার এত বছরের সংসার নষ্ট হবে। এই সাথে যে রুজাইনের ফিউচার নষ্ট হবে এটা ভেবেছ?
ইধা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। তিনি বললেন, বাবার টাকার জোরে চলে যাচ্ছে ও। কিন্তু যখন সেই টাকার জোর থাকবে না তখন কী করবে? ত্যাজ্যপুত্ররা বাবার কিছুই পায় না। এখনো ওর পড়াশোনা শেষ হয়নি। এসব জানাজানি হলে তোমার টিউশনি তো যাবেই রুজাইনও কোনো টিউশনি পাবে না। কারণ বাবার নামে পাওয়া সম্মানটাই যে থাকবে না! তোমাকে, আমাকে সামলিয়ে নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি ক্যারিয়ার নিয়ে ভাববে কখন! আমার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটার ফিউচারও শেষ!
শাড়ির আঁচল মুখে দিয়ে কেঁদে চলেছেন তিনি অনবরত। ইধা নীরবে চোখে বুঝে কিছুক্ষণ ভাবলো। আসলেই তো! ওর জন্যে অন্ধকার এক ভবিষ্যতে পড়ে যাবে রুজাইন! যেটা ও চায় না। বাবার পরিচয় ছাড়া সমাজে চলতে কতটা কষ্ট হয় ইধার চেয়ে ভালো আর কে বুঝতে পারবে? ওর মতো রুজাইনের জীবনটা এলোমেলো হয়ে যাক এটা ও চায় না!
ইধার চোখও অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে। কাঁপাকণ্ঠে ও বলল, আমার কী করা উচিত আন্টি? রুজাইনকে ছেড়ে দেওয়া?
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন-
ক’দিনের ভালোবাসা তোমাদের? এই ক’দিনের ভালোবাসার কাছে যদি আমার এতদিনের ভালোবাসাকে হারাতে হয় তবে হারিয়ে যাক! তবুও আমি তোমাকে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে জোর করব না। যা ইচ্ছে হয় করো।
অনেকটা অভিমান নিয়ে তিনি কথাটি বলেছেন বুঝতে পেরেছে ইধা। ও বলল, আমি রুজাইনকে ছাড়তে চাই। তবে এতে আপনার সাহায্য প্রয়োজন। নতুবা আমার পক্ষে একা সবটা সামলানো মুশকিল হবে।
তিনি অবাক হয়ে বললেন, কী বলছ?
-ভালোবাসা মানেই তাকে পেয়ে যাওয়া নয়৷ আমার কাছে ভালোবাসা মানে মানুষটা ভালো থাকা। আমাকে না পেলে কদিন হয়তো কষ্টে থাকবে৷ কিন্তু ওর ক্যারিয়ারে বাঁধা পড়লে উঠে দাঁড়ানো হয়ে যাবে কষ্টকর। আর মা বাবার বিচ্ছেদ সন্তানের উপরে কতটা প্রভাব ফেলে আমি জানি৷ তাই চাই না, ওর সাথেও এমন কিছু হোক।
শারমিন আক্তার ইধার মাথায় হাত রেখে বলল, তুমি আমায় বাঁচিয়ে দিলে মা! বাঁচিয়ে দিলে আমায়!
ইধার ফোন বেজে উঠতেই স্মৃতির জগৎ থেকে বেরিয়ে আসলো ও। ক’দিন আগের ঘটে যাওয়া ঘটনা স্মৃতিচারণ করছিল ইধা। রুজাইনের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করার এটাই কারণ ওর। ওর ছোটো মামা মা কে কিছু জানানোর আগেই এসব ঘটে গেছে। পরবর্তীতে ইধা ওর মামাকে কিছু না জানাতে বলে দেয়। মামাও এসব শুনে ইধাকে পরামর্শ দেয়, রুজাইন থেকে দূরে সরে আসতে। কারণ ওদের জন্যে রুজাইনের মা এর সংসার ও রুজাইনের ভবিষ্যৎ হুমকির দিকে যাবে। সবমিলিয়ে ইধা পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেয়।
এদিকে ইধার এমন আচরণে রুজাইন প্রায় পাগলপ্রায়। ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইধার মা এর সঙ্গে দেখা করার। তাই মাইশাকে ওর মা এর ফোন নাম্বার জোগাড় করে দিতে বলে।
মাইশার শাশুড়ী অসুস্থ তাই ও সেখানে রয়েছে। ব্যস্ততা কাটিয়ে রুজাইনের সাহায্য ও করবে বলেছে। কিন্তু রুজাইন জানে না, এই সত্যিটা মাইশাও জানে না। ইধা মাইশাকেও কিছু জানায়নি। যদি রুজাইনকে সব বলে দেয় এই ভয়েই!
.
চলবে
বি:দ্র: কাল থেকে মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা শুরু আমার। চেয়েছিলাম এক্সামের আগেই গল্পটা শেষ করতে। কিন্তু ব্যস্ততায় আর পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে পরীক্ষা ত্রিশ তারিখ৷ পরবর্তী পর্ব এর পরে দেওয়া হবে। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন।