#প্রাসাদকথন
পর্বঃ৪
#সুলতানা_তানি
( নোটঃ যাদের গল্প বুঝতে সমস্যা তাদের জন্য জুটির হিসেব লিখে দিলাম–
১.রাকিন-নওরা
২.তাসকিন-নাবিহা
৩.শামস্-মাহিরা
এই তিনটি জুটি থাকবে গল্পে। বাহার রাজ্যে তিন রাজকন্যা–নেহেরিন,নাবিহা,নওরা। নেহেরিন বিধবা। সম্ভার রাজ্যে প্রধানত তিন রাজপুত্র–তাসকিন,রাকিন,শামস্।)
…………
গোধূলির মায়া পেরিয়ে সাঁঝের আগমন ঘটেছে। রাজপ্রাসাদে শত শত প্রদীপ জ্বলছে। প্রদীপের শিখায় ঝলমল করছে প্রাসাদ। এই প্রাসাদটিও ত্রিতল। সম্ভার রাজ্যের রাজপ্রাসাদ এটি। নিচতলায় রাজদরবার,অতিথিশালা,পাঠাগার,রসুইঘর,দরবার নৃত্যের কক্ষসহ আরো কিছু কক্ষ আছে। রাজা থাকেন দোতলায় নিজস্ব কক্ষে। রাজমন্ত্রীও পরিবারসহ দোতলায়ই থাকেন। এই সম্ভার রাজ্যের রাজার আপন ছোট ভাই হচ্ছেন রাজমন্ত্রী। তিন তলায় রাজপুত্ররা থাকে। আজ নিচতলার অতিথিশালায় আছে বাহার রাজ্যের দুই রাজকন্যা। ওদের সেই দাদীও আছেন সেখানেই। আলাদা আলাদা কক্ষেই আছে তিনজন। সম্ভার রাজ্যের জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র তাসকিন এসেছে অতিথিশালায়। ধীর পায়ে এসে কড়া নেড়েছে নাবিহার কক্ষে। কড়ার আওয়াজ শুনে কৌতূহলী নাবিহা উঁকি দিয়েছে দরজার আড়াল থেকে। হবু বর তাসকিনকে দেখে শাহ্জাদী বেরিয়ে এসেছে হাসিমুখে। শাহ্জাদা এসে বসেছে অতিথিশালার হল রুমে। বসার অনুরোধ করেছে নাবিহাকেও। প্রেম প্রেম ভাব শাহ্জাদা তাসকিনের নয়ন-বদনে। প্রিয়তমার কাছে এসে হৃদয় ছুঁয়ে যাচ্ছে স্বপ্নীল ভালোলাগার উড়ু উড়ু এক আবেশে। মাখনের ন্যায় কোমল এক খুশির অনুভূতি এসেছে নাবিহার হৃদয়েও। সেই তুলতুলে খুশির আঁকাবাঁকা দোলায় শাহ্জাদীও আসন গ্রহণ করেছে সম্মুখে। সলজ্জ হেসে তাসকিনের পানে তাকাতেই বেচারা প্রশ্ন করেছে–“শুনলাম বিকেলে পুরো রাজপ্রাসাদ ঘুরে দেখেছো! কেমন লাগছে ভবিষ্যত শ্বশুরালয়?”
“ভীষণ সুন্দর।”
“তাই?”
“হুম। তবে এ প্রাসাদে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে এই শাহ্জাদাকেই।”–সলজ্জ হাসির বাঁকে রহস্যের ছন্দ লুকিয়ে জবাব দিয়েছে নাবিহা।
হবু স্ত্রীর মুখে প্রথমবার প্রশংসা শুনে যেনো অনাবিল আনন্দে উচ্ছ্বসিত তাসকিন। বাঁধভাঙা খুশির অনিন্দ্য ঝিলিক এসেছিলো তার নয়নে। তবে ক্ষণিকেই বিলীন হলো সে খুশি নয়নের অগোচরে। খানিক বিষণ্ণতার সাথে তাসকিন শুধিয়েছে–“তুমি কি আমার সম্পর্কে সবকিছু জানো নাবিহা?”
“জানি। আপনি জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র, তবে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নন। এটাই তো?”
“জ্বী, এটাই। আমার মেজো ভাই রাকিন মুনতাসির এই সম্ভার রাজ সিংহাসনের উত্তরাধিকার। ভবিষ্যতে রাকিনের কোনো অঘটন ঘটলে সেক্ষেত্রে বিকল্প উত্তরাধিকার শামস্।”
“আমি আগেই শুনেছি আপনার রোগ সম্পর্কে।”
“তারপরেও পছন্দ হলো আমায়?”–কৌতূহলী ভঙ্গিতে প্রশ্ন করেছে তাসকিন।
নাবিহা তৎক্ষনাৎ জবাব দিয়েছে –“রাজা হবার জন্য আপনাকে যেমন রাজকীয় শিক্ষা দেয়া হয় নি, আমাকেও তেমনি রানী হবার মতো কোনো শিক্ষাই দেয়া হয় নি।”
“তুমি তো শৈশবে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছো! তখন থেকেই নাকি বড্ড বেখেয়ালি আর মনভোলা! রানীর দায়িত্ব নিলে মনভোলা স্বভাবের কারণে তুমি ভুল করে বসতে।”
“এজন্যই তো সিংহাসনে আরোহন করবে এমন কোনো রাজপুত্রের সাথে আমার শাদী দিতে ইচ্ছুক ছিলেন না বাবা।”
“জানি তো এসব!”
“আচ্ছা শাহজাদা, আপনাকে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় নি?”
“স্থলযুদ্ধের সব প্রশিক্ষণ নিয়েছি। কিন্তু রাজা হতে হলে শারীরিক এবং মানসিক উভয় দিক থেকেই বলীয়ান হতে হয়। রাজ্যের প্রয়োজনে জলে-স্থলে যুদ্ধ করার ক্ষমতাও রাখতে হয়।”
“বুঝি নি।”–নাবিহার দায়সারা জবাব।
“বোঝো নি মানে! এটা তো জানো যে আমি মৃগী রোগী?”– মলিন বদনে তাসকিন শুধিয়েছে হবু বউকে।
“জ্বী, আপনার মৃগী রোগের কথা শুনেছি।”
“ধরো, আমি ভবিষ্যতে রাজা হলাম! কিন্তু আমার প্রাসাদেই গোপন শত্রু তৈরি হলো। ঘুমন্ত অবস্থায় আমায় উঠিয়ে নিয়ে এ রাজবাড়ির পুকুরেই ফেলে দিলো! সেক্ষেত্রে আমি কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই মা’রা যাবো। আমার রাজ্যও শত্রুর হাতে চলে যাবে।”
“সেটা ঠিক!”
“মৃগী রোগের কারণে সংকটাপন্ন অবস্থায় আমার মস্তিষ্কও ধীরে কাজ করে। চরম মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয়াও আমার জন্যও কষ্টসাধ্য।”
“ওহ্।”
“আমার মেজো ভাই রাকিনকে রাজকীয় সকল শিক্ষা দেয়া হয়েছে। রাকিন যেমন বুদ্ধিমান, তেমনি জলে,স্থলে সমানে যু’দ্ধ করতে পারে। আর শামস্ও জলে,স্থলে যু’দ্ধবিদ্যায় পারদর্শী। আমি শারীরিকভাবে অক্ষম তো! তাই আমার অনুজ রাকিনই এ সিংহাসনের উত্তরাধিকার। সম্ভার রাজ্যের ভবিষ্যত রাজা।”
“সে যাইহোক, আপনি কিন্তু একটি ভুল করেছেন শাহ্জাদা। আপনার প্রণয় নদ পেরিয়ে শাদী করার সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হয় নি। শ্বশুরালয়ে যাবার সময় নদে ঝড় উঠলে কি করবেন?”–দুষ্ট হেসে প্রশ্ন করেছে নাবিহা।
“মৃগী রোগ থাকার কারণে জলপথে যেতে হয় এমন কোথাও আমায় বিয়ে করাতে রাজী ছিলেন না বাবা। আমাদের এ সম্ভার রাজ্যের কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়েকেই আমার বউ করে আনতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমাদের এ রাজ্যের কোনো মেয়েকেই আমার মনে ধরে নি। হয়তো তকদীরে লেখা ছিলো বাহার রাজ্যের এই সুন্দরী রাজকুমারী। আর তোমার প্রশ্ন হচ্ছে- শ্বশুরালয়ে যাবার সময় প্রণয় নদে ঝড় উঠলে আমি কি করবো? তাহলে শোনো, একবার যে তোমায় বউ করে নিয়ে আসবো, তারপরে আর যাবোই না শ্বশুরের বাহার রাজ্যে। আমার বউটাকে বেশি বেশি আদর দিয়ে বাপের বাড়ির নামটাও ভুলিয়ে দেবো। প্রণয় নদের ঝড় আমায় কোথা থেকে পাবে! আদুরে বউ বাপের বাড়ির নাম ভুলে গেলে আমার তো আর যেতেই হবে না সেখানে!”–মৃদু হেসে জবাব দিয়েছে তাসকিন।
“আপনার বেখেয়ালি বউ কিন্তু বাবার বাড়ির চিন্তায় তার বরকেও ভুলে যাবে।”
“বউকে এমন করে ভালোবাসবো যেনো আমাকে ছাড়া অন্য সবকিছু ভুলে যায়!”
“ইশশ্, ভালোবাসার সাগর একদম!”
“হুম সাগরই হবো। বহু বছর বাঁচবো আমি। স্থলে তো আমার কোনো সমস্যা নেই। আমার রাজকীয় দায়িত্বও কম। জীবনে একটাই দায়িত্ব থাকবে, শুধু এই বউটাকে ভালোবাসা।”
“দেখা যাক!”
এক লাজহারা প্রণয় ছন্দ এসেছে তাসকিনের হৃদয়ঘরে। সে ছন্দে ছন্দিত শাহ্জাদা কাছে এসে নাবিহার কাঁধে হাত রেখেছে আলতো করে। কোমল স্বরে ফি’সফিসয়ে বলেছে–“প্রণয় নদের ঝড়ে ম’রে যাবার তরে তোমার হাত ধরবো না। এ হাতে হাত রাখবো প্রণয়োল্লাসে আমৃত্যু হারাবার তরে।”
…………….
শৈতী প্রভাত। ধোয়াশা,কুয়াশা আর মৃদু অমানিশা এখনো ঘিরে রেখেছে প্রকৃতিকে। শাহ্জাদী নওরা সবসময় প্রভাতের প্রথম প্রহরেই শয্যা ত্যাগ করে। আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি। গতকাল বিকেলে পুরো সম্ভার রাজপ্রাসাদ ঘুরে দেখেছে শাহ্জাদীরা। কিন্তু আশেপাশে কোথাও কোনো সমাধির অস্তিত্ব দেখে নি। ওদের ফুফু তো এই সম্ভার রাজ্যেরই রানী ছিলেন। ওদের জন্মের আগেই ফুফু ইহলোক ত্যাগ করেছে। একমাত্র ফুফুর দর্শন লাভ করে নি ওরা। আজ নওরার ভীষণ ইচ্ছে করছে ফুফুর সমাধি দর্শন করার। এ রাজ্যেরই তো মহারানী ছিলেন ফুফু, তাকে তো অবশ্যই রাজকীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়েছে। কিন্তু কোথায় সে সমাধি! ফুফুর সমাধি দর্শন করার আগ্রহ থেকেই সকাল সকাল প্রাসাদ ত্যাগ করেছে নওরা। নাবিহা আর দাদী শয্যা ত্যাগ করে নি। আলসেমি করে এখনো শায়িত হয়ে রয়েছে শয্যায়। প্রাসাদ থেকে বের হয়ে নওরা এদিক-সেদিক,সবদিকে দৃষ্টিপাত করছে! রাজসমাধি খুঁজে যাচ্ছে চুপিসারে। কোথাও কোনো সমাধির চিহ্নও নেই। বিষণ্ণ নাবিহার আলাপ করতে ইচ্ছে করছে না এখানকার পুরুষ প্রহরীদের সাথে। নিজেই খুঁজে যাচ্ছে আনমনে। আচানক কিছুটা সন্দিহান হলো শাহ্জাদী। কেন যেন মনে হচ্ছে রাজপ্রাসাদের পশ্চাতে থাকতে পারে রাজকীয় সমাধিস্থল। মন বাতায়নে উঁকি-ঝুঁকি দেয়া ভাবনার সন্দিহান দোলায় প্রাসাদের পশ্চাতে যাবার জন্য মনস্থির করেছে শাহ্জাদী। কিছুক্ষণের মধ্যেই ধীর কদমে চুপিচুপি চলে গেছে সেখানে। কোনো সমাধি নেই প্রাসাদের এই পশ্চাৎ অংশেও। কিন্তু খানিক দূরে একটি লোক নির্দিষ্ট লক্ষ্যে তীর নিক্ষেপ করছে। কুয়াশার মাঝেও লোকটিকে বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে দূর থেকে। কৌতূহলী নওরা এগিয়ে গেছে সম্মুখে। এ যুবককে চিনতে দেরি হয় নি শাহ্জাদীর। শাহ্জাদা রাকিনই দক্ষ হাতে তীর ছুঁ’ড়ছে বিশেষ নিশানায়। ফুফুর সমাধি সম্পর্কে জানতে শাহ্জাদী নওরা এগিয়ে যাচ্ছে সেদিকটায়। আলতো পায়ে খানিক হেঁটেই রাকিনের নিকটে গিয়ে দাঁড়িয়েছে নওরা। ভীষণ মনোযোগী শাহ্জাদা শুধু একবার তাকিয়েছে এ সুনয়নার বদনে। নওরার চাঁদমুখ একবার দর্শন শেষে তীর নিক্ষেপ করেছে সে বিশেষ নিশানায়। ছোট একটি নিশানা। তবুও রাকিন সহজেই তীর বি’দ্ধ করে যাচ্ছে দক্ষ হাতে। নওরা আগ বাড়িয়ে আলাপ শুরু করেছে–“আপনার নিশানা তো খুব নিখুঁত!”
“ধন্যবাদ শাহ্জাদী।”
“জানেন, আমাকেও না ধনুর্বিদ্যা শেখানোর চেষ্টা করা হয়েছিলো। খুব ভালো করে শেখা হয় নি। দেখি তো, আজ একটু তীর ছুঁ’ড়ে!”
পুলকিত বদন নিয়ে রাকিন স্বহস্তে তীর,ধনুক এগিয়ে দিচ্ছে নওরাকে। সুখময় প্রেম প্রেম ভাবনারা রয়েছে তার মনের গোপনেই। রাজপুত্রের মনের গোপন কথা আর জানার অভিপ্রায় নেই শাহ্জাদী নওরার। সে তীর,ধনুক হাতে নিয়েছে সন্তর্পণে। লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে প্রথমবার তীর নিক্ষেপ করেছে নওরা। নিশানা খুব ছোট। তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে সহসাই। আবারও তীর নিয়ে মেয়েটি নিক্ষেপ করেছে সেই বিশেষ নিশানায়। এবারও লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে শাহ্জাদীর অবাধ্য তীর। ভীষণ আগ্রহের সাথে রাকিন প্রশ্ন করেছে–“আমি শিখিয়ে দেবো?”
কোনো কিছু চিন্তা না করেই নওরা জবাব দিয়েছে –“দিতে পারেন!”
আচানক রাকিন পেছনে চলে গেছে নওরার। পেছন থেকে কাঁধের উপর দিয়ে হাত দিয়ে তীর নিক্ষেপণ শেখাতে চেয়েছিলো। এতোটা কাছাকাছি আসতে হবে,এমনটা ভাবতেও পারে নি নওরা। ইষৎ লাজে লাজনম্র বদন নিয়ে সরে গেছে ক্ষণিকেই। এ সুনয়নার লাজের কারণ বুঝতে পেরে রাকিনও তৎক্ষনাৎ বলে দিয়েছে– “আমি দুঃখিত।”
“না মানে, আমি পরে শিখে নেবো।”– সলজ্জ ভঙ্গিতেই জবাব দিয়েছে নওরা।
“ঠিক আছে।”
বিষণ্ণ হৃদয়েও যেন রুম ঝুম খুশির আবেশ এসেছে চুপটি করে। সে আবেশ নিয়ে খানিক দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছে শাহ্জাদী। নয়ি নয়ি করে মধুর বসন্তের বাঁশি বেজেছে রাকিনের হৃদয়ে। হৃদয়জ সুরের মূর্ছনায় এলোমেলো শাহ্জাদা একবার তাকিয়েছে প্রাণপ্রিয়ার বদনে। সব সুরগুলো হৃদয়ের গহীনে লুকায়িত রেখেই আবারও তীর হাতে নিয়েছিলো সে। শাহ্জাদাকে আবারও ব্যস্ত হতে দেখে ধীর কন্ঠে নওরা বলেছে–“আমার ফুফুর সমাধি দেখতে বের হয়েছিলাম। কোথাও দেখছি না যে!”
“আমাদের রাজ পরিবারের সমাধি পুরনো রাজপ্রাসাদের ওখানে। আমার আম্মিকেও সেখানেই সমাহিত করা হয়েছে।”–রাকিন জবাব দিয়েছে ধীর কণ্ঠে।
“আমায় নিয়ে যেতে পারবেন ফুফুর সমাধির কাছে?”
“জ্বী,পারবো। কখন যাবেন ?”
“এখনই।”
“তাহলে চলুন!”
দুজন হাঁটতে শুরু করেছে একসাথে। পুরনো রাজপ্রাসাদ প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার দূরে। নতুন রাজবাড়ির সীমানার বাইরে। হাঁটতে হাঁটতে নওরা বলছে–“আমি কিন্তু বয়সে আপনার চেয়ে ছোট। আমায় তুমি করে বলতে পারেন।”
“ভীনরাজ্যের শাহ্জাদীকে আপনি করেই বলা উচিত।”
“সম্পর্কে আপনি আমার ফুফাতো ভাই। তুমি করেই তো বলা উচিত আমায়। তুমি করেই বলুন না! খুব খুশি হবো।”
“সত্যিই খুব খুশি হবেন নাকি?”–কৌতূহলী ভঙ্গিতে রহস্যের সাথে প্রশ্ন করেছে রাকিন।
“না…না,সেরকম কিছু না।”–ই’তস্তত করে জবাব দিয়েছে নওরা।
“সেরকম কিছু হতে পারে না শাহ্জাদী?”
আচানক এমন প্রশ্ন মন বাতায়নে কড়া নেড়েছে নওরার। সহসাই নীরব হয়ে গেছে শাহ্জাদী। অধীর আগ্রহে রাকিনও জবাব শোনার অপেক্ষায় রয়েছে। মন বাতায়নে কড়াঘাত হওয়ায় শাহ্জাদী নওরা কিছুটা বিব্রত। তবে মলিনতা নেই এখন তার বদনে। গতকাল কিছু দুঃখের কথা শেয়ার করেছিলো রাকিনের সাথে। নিজ বাড়িতে থেকে নওশাদের বিরুদ্ধে মন খুলে কারো সাথে কিছু বলতেও পারে না মেয়েটি। প্রাসাদ বন্দিনীর ন্যায় দিনযাপন করতে হয়। দুঃখের কথাগুলো ব্যক্ত করার পর থেকে কিছুটা ফুরফুরে মেজাজে রয়েছে শাহ্জাদী। যেনো প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসতে চাচ্ছে বিষণ্ণ জীবনে। একসময় ভীষণ চঞ্চলা ছিলো শাহ্জাদী নওরা। বড়বোনের প্রেমিক নওশাদের সাথে বিয়ে ঠিক হবার পর থেকেই হতাশা আর যন্ত্রণারা ঘিরে ধরেছে। বিধবা বড় বোনকে দেখেও কষ্ট হয় নওরার। সবকিছু মিলিয়ে কয়েক বছর ধরেই ভীষণ বিষণ্ণ ছিলো মেয়েটি। আজ যেনো বিষণ্ণতারা একটু একটু করে কমতে শুরু করেছে চুপিসারে। মেজাজে ফুরফুরে হলেও শাহ্জাদী এখন আলাপচারিতা এগিয়ে নিচ্ছে না রাকিনের সাথে। সে প্রশ্নের জবাব দেয় নি বলে রাকিনও আর কথা বাড়ায় নি। পুরো সময়টা নির্বাক থেকেই দুজন চলে এসেছে রানীর সমাধির কাছে। পাশেই জীর্ণ-শীর্ণ পুরনো রাজপ্রাসাদ। একমাত্র ফুফুর সমাধির পাশে এসে অজানা ব্যথায় বুক ভরে গেছে শাহ্জাদীর। এ হারানো প্রিয়জনকে ভেবে নিশ্চুপ হয়ে আছে শাহ্জাদী। চুপিচুপি ভাবছে আমার আব্বার যমজ বোন ছিলো ফুফু। তেইশ বছর আগে মা’রা গিয়েছেন তিনি। অথচ আব্বা এখনও জীবিত আছেন, রাজকার্যও পরিচালনা করে যাচ্ছেন স্বহস্তে। আর ফুফু! যমজ রাজপুত্র জন্মদানকালে ইহলোক ত্যাগ করলো! সেই রাজপুত্রদ্বয় তো এখনো জীবিতই আছে। এক বুক ব্যথা নিয়ে এসব ভাবতে ভাবতে আশেপাশের অংশটা ফিরে দেখছে শাহ্জাদী। কৌতূহলী দৃষ্টি তার। হঠাৎ করেই শীতল কণ্ঠে রাকিনকে বলছে–“আমার ফুফুর মৃ’ত্যুর পরে আপনার বাবা তো আবার বিয়ে করেছিলেন। সে স্ত্রীকে নাকি তিনি হ’ত্যা করেছিলেন। আপনার সেই সৎ মায়ের সমাধিটা দেখছি না যে!”
“ঐ বে’ঈমানকে জঙ্গলে নিয়ে জ’ল্লাদ দিয়ে হ’ত্যা করা হয়েছে। ওকে সেখানেই কবর দেয়া হয়েছে। রাজকীয় মর্যাদায় বে’ঈমানকে সমাহিত করা হয় নি।”
শাহ্জাদার কথা শুনে নিশ্চুপ হয়েই দাঁড়িয়ে আছে নওরা। সমাধির পাশেই শানবাঁধানো ঘাটওয়ালা একটি বিশাল পুকুর। রাকিন ধীর স্বরে বলছে–“অনেক কথা ছিলো আপনার সাথে। চলুন না, পুকুরঘাটে গিয়ে বসি!”
দুজন এসে মুখোমুখি হয়ে বসেছে পুকুরঘাটে। ঘাটের বেঞ্চ থেকেই নওরা আবারও তাকিয়েছে পুরনো রাজপ্রাসাদের দিকে। প্রাসাদটি অনেকটাই দেবে গেছে ভূমিতে। পুরনো রাজপ্রাসাদটিকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসু সুরে নওরা বলছে–“এই প্রাসাদের অবস্থা এমন জীর্ণশীর্ণ কেনো?”
“ভূমিকম্পে মূল কাঠামোটাই ভেঙে পড়েছিলো। অনেকখানি দেবে যাওয়ায় আর রক্ষনাবেক্ষণও করা সম্ভব হয় নি। এটা এখন সাপ,গুইসাপ,শেয়ালসহ বিভিন্ন জীব-জন্তুর আবাসস্থল। ”
“ওহ্।”
শাহ্জাদী কথা শুনে যাচ্ছিলো অবনত নয়নে। হঠাৎ তার দৃষ্টিগোচর হলো কিছু ময়লা লেগে আছে পায়ে। তৎক্ষণাৎ পা ধোয়ার জন্য শাহ্জাদী ঝটপট নেমে যাচ্ছিলো সিঁড়ি বেয়ে। রাকিন সাবধান করার আগেই বেচারী পা পিছলে পড়ে গেছে পুকুরে। এবার! এবার কি হবে! আচানক যেনো এক ঘোমটাতোলা লাজ এসেছে শাহ্জাদীর বদনে। সিক্ত দেহে কি করে ফিরে যাবে প্রাসাদে! কত পুরুষলোক রাজবাড়িতে! রাকিনের সাথেই’বা কিভাবে ফিরে যাবে! এদিকে রাকিন ভাবছে এ মেয়েকে আমার হৃদয় রাজ্যের রানী করতে চাই। ওর ছোট-বড় সব সম্মান তো আমাকেই রক্ষা করতে হবে! সিক্ত দেহে রাজবাড়ির কর্মচারীদের সামনে দিয়ে ওকে কিছুতেই নেয়া যাবে না প্রাসাদে। এমনটা ভেবে কৌতূহলী ভঙ্গিতে রাকিন প্রশ্ন করেছে –“আপনার পোশাক কোথায় রেখেছেন শাহ্জাদী? আমি পোশাক আনতে পাঠাবো।”
“নাবিহা আপুর কাছে গেলেই হবে। আপু পোশাক দিতে পারবে।”
“আমি পোশাক আনার ব্যবস্থা করছি। আপনার বোনকেও নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠাচ্ছি।”–বলেই রাকিন এগিয়ে গিয়েছে খানিক দূরে। আরো দূরে ছিলো একজন প্রহরী। তাকে ডেকে শা্হজাদী নাবিহার কাছে যাবার আদেশ করেছে। ঘটনা বর্ণনা করে নাবিহাকে দাসীসহ পোশাক নিয়ে আগমনের জন্য বলে দিয়েছে। জোরকদমে প্রহরী ফিরে গেছে নতুন রাজপ্রাসাদে। রাকিন দাঁড়িয়েছিলো প্রহরীর পথ চেয়ে। নওরা লজ্জা পাবে বলে শাহ্জাদা আসে নি ঘাটের নিকটে। প্রহরী প্রাসাদে গিয়ে নাবিহাকে খুঁজে পায় নি। কি করে পাবে! প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়েছে নাবিহা। বয়োবৃদ্ধা দাদীর কাছে ঘটনা খুলে বলেছে প্রহরী। গভীর মনোযোগ নিয়ে সব শুনেছে বৃদ্ধা। পায়ে ব্যথা হয়েছে তার। এতো দূরে হেঁটে আসতে পারবেন না তিনি। শুধু চাদরে পেঁচিয়ে নওরার পোশাক দিয়েছে প্রহরীর হাতে। নওরাকে পুকুরে রেখে প্রাসাদে ফিরে যেতে পারতো রাকিন! কিন্তু এ জায়গাটা বর্তমান রাজবাড়ির সীমানার বাইরে। খুব বেশি নিরাপত্তাও নেই এখানে। রাকিন ভেবেছিলো নাবিহা আসবে দাসীদেরকে নিয়ে। এসে সাহায্য করবে নওরাকে। কিন্তু প্রহরী একাকী ফিরে এসেছে পোশাক নিয়ে। পুকুর পর্যন্ত আসতে পারে নি লোকটা। এখানে এলে সিক্ত নওরাকে দেখতে পাবে প্রহরী। তাই রাকিন নিজেই এগিয়ে গিয়েছে প্রহরীর নিকটে। ঘটনা শুনে শাহ্জাদা পোশাক নিয়ে এসেছে প্রহরীর হাত থেকে। ঘাটের কাছে এসে ধীর কণ্ঠে নওরাকে বলেছে–“শাহ্জাদী,আপনার বোনকে খুঁজে পায় নি প্রহরী। শুধু পোশাক নিয়ে এসেছে ছেলেটা। আপনি পানি থেকে উঠে আসুন তো এবার, তাড়াতাড়ি পোশাক বদলে নিন! নয়তো ঠাণ্ডা লেগে যাবে।”
“কিন্তু উপরে উঠে কোথায় পোশাক বদলাবো আমি?”
“পুরনো রাজপ্রাসাদে ঢুকে পোশাক বদলে নিন।”
কথা শেষে ঘাটের উপর পোশাক রেখে রাকিন সরে গিয়েছে খানিক দূরে। নওরা উঠে এসেছে পুকুর থেকে। শীত কাবু হয়ে আছে জলেসিক্ত মেয়েটি। দ্রুত পায়ে পোশাক নিয়ে সে প্রবেশ করেছে জীর্ণশীর্ণ রাজপ্রাসাদের একটি কক্ষে। প্রাসাদের বেশি ভেতরে প্রবেশ করে নি শাহ্জাদী। একদম শুরুর দিকের কক্ষেই ছিলো। শীতে কাবু হয়ে থাকায় ভেতরে এসে কোনোদিকে খেয়াল করারও অবকাশ পায় নি। তড়িঘড়ি করে জামা পাল্টে একটি স্লিভলেস জামা পরে নিয়েছে। তার উপরে ফুল স্লিভ আরেকটি জামা এখনই পরিধান করবে। সেই অভিপ্রায়ে হাতে নিচ্ছিলো জামাটি। আচানক খেয়াল হলো কক্ষের কোনেই রয়েছে একটি বিশালকার গুইসাপ। গুইসাপটি দেখে চিৎকার করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো নওরা। এহেন চিৎকার শুনে রাকিনও দৌড়ে এসেছিলো কক্ষে। ক্ষণিকের ভয়ে এলোমেলো শাহ্জাদী জড়িয়ে ধরেছে রাকিনকে। প্রাণপ্রিয়ার এই আচানক আলিঙ্গনে ধুক ধুক করছে শাহ্জাদার বুক লুকায়িত গোপনে। এ যেন এক ধারা হারা ক্ষণ। এ ক্ষণে হারাবার লোভ নেই শাহ্জাদার। গুইসাপটিকেই তো আগে তাড়াতে হবে। বুদ্ধিহীন নিরীহ একটি প্রাণী এটা। শাহ্জাদা তরবারি ব্যবহার করবে না এ বুদ্ধিহীন প্রাণীকে ভয় দেখাতে। বাহু উঁচু করে সে ভয় দেখিয়েছে গুইসাপকে। গুইসাপটি কালবিলম্ব না করে দেয়ালের ছিদ্র দিয়ে বের হয়ে গেছে। শাহ্জাদা শান্ত কণ্ঠে বলছে নওরাকে–“হুশে আসুন শাহ্জাদী! গুইসাপ কিন্তু ফিরে গেছে।”
নওরা ছেড়ে দিয়েছে শাহ্জাদাকে। বিনা অনুমতিতে ওভাবে আলিঙ্গন করায় বেশ অনুতপ্ত সে। অবনত বদনে ধীর স্বরে বলেছে–“আমি দুঃখিত শাহ্জাদা।”
“দুঃখপ্রকাশের প্রয়োজন নেই! এটা তো পরিস্থিতি। এবার বাকি পোশাক বদলে নিন তাড়াতাড়ি।”—কথাগুলো বলেই রাকিন বের হয়ে গেছে কক্ষ থেকে। কক্ষের জানালায় পোশাক রেখেছিলো নওরা। এবার এগিয়ে এসে ভেজা স্যালোয়ার পাল্টে নিয়েছে তড়িঘড়ি করে। ফুল স্লিভ জামাটি এখনো পরিধান করা হয় নি। পরিধানের জন্য জামাটি আবারও হাতে নিচ্ছিলো শাহ্জাদী। হঠাৎ দৃষ্টিগোচর হয় ঐ গুইসাপটি ফিরে এসেছে ছিদ্র দিয়ে। আবারও বুকফাটা চিৎকার করেছে নওরা। রাকিনও দৌড়ে এসেছে দিশেহারা হয়ে। শাহজাদীর এবারও হুশ নেই। যথারীতি গিয়ে জড়িয়ে ধরেছে রাকিনকে শক্ত করে। প্রাণপ্রিয়ার বারবার এমন আলিঙ্গনে শাহ্জাদার হৃদয়জ প্রণয়ের পালে হাওয়া লেগেছে একটু বেশি করে। ঝিরি ঝিরি করে সে প্রণয় হাওয়ার দোলায় দুলছে হৃদয় চুপিসারে। চুপিচুপি আসা এ প্রণয়দোলায় এলোমেলো মনকে বেসামাল করতে চায় না শাহ্জাদা। হৃদয়জ হারাবার অনুভূতিগুলোকে সামলে নিয়ে সে ব্যস্ত হয়েছে পরিস্থিতি সামাল দিতে। পুনরায় বাহু উঁচু করে ভয় দেখাতেই গুইসাপটি ফিরে গেছে দ্রুতগতিতে। নওরা এখনো চুপটি করে জড়িয়ে রয়েছে তার সাথে। এহেন কাণ্ডে শাহ্জাদা রাকিন আদেশের সুরে বলেছে–“শাহ্জাদী, গুইসাপ তো ফিরে গেছে! বাকী পোশাকগুলো এখনই পরে নিন আপনি! আমি আছি এখানেই।”
নওরা তৎক্ষণাৎ রাকিনকে ছেড়ে দিয়ে বলেছে–“আপনার সামনে আমি পোশাক পরবো নাকি!”
“সমস্যা কোথায়? আমি আপনাকে পোশাক পরতে বলেছি শাহ্জাদী, ছেড়ে দিতে কিন্তু বলি নি!”
আচানক এমন কথায় নওরা বেশ বিব্রত হলো। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক করে প্রশ্ন করেছে– “একজন পুরুষলোকের সামনে আমি কিভাবে পোশাক পরবো?”
“পোশাক পরতে খুব সমস্যা! দু’বার যে এ পুরুষ লোকটাকে আলিঙ্গন করলেন!”–ঠোঁট টিপে হেসে।
“সেটা তো বাধ্য হয়ে।”–মিনমিনে কণ্ঠে জবাব দিয়েছে নওরা।
“এখনো বাধ্য হয়েই বাকী কাপড় পরে ফেলুন না! কারণ গুইসাপটি এ কক্ষে ডিম দিয়েছে। ডিমগুলোর চিন্তায় ও আবারও ফিরে আসবে। বেচারী ভয়ে আছে ওর ডিমগুলো নিয়ে।”
নওরা অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নি’বদ্ধ করেছে চারপাশে। আসলেই তো! কক্ষের এক কোনে ধূলোময়লার মাঝে বেশ কয়েকটি ডিম। এগুলো দেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে মেয়েটি তাকিয়েছে রাজপুত্রের বদনে। রাজপুত্র গম্ভীর কন্ঠে বলছে–“এটা প্রাসাদের প্রথম দিকের কক্ষ। ভেতরের দিকের কক্ষে সাপও থাকতে পারে। সেদিকটায় ঠিকভাবে প্রবেশ করাও যায় না। এখানেই পোশাক বদলানো উচিত আপনার!”
পোশাক বুকে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে নওরা। শাহজাদা রহস্যের হাসি দিয়ে বলেছে–“সমস্যা নেই। আমি অন্য দিকে ফিরে থাকবো। দেয়ালের ছি’দ্রের মুখে আমি দাঁড়িয়ে থাকলে গুইসাপটি আর ফিরে আসবে না।”
“না, আপনি এখানে থাকলে আমি পোশাক পরবো না।”
“আরেহ্ ধুর! হাত বের করে এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে তাড়াতাড়ি পোশাক পরে নিন তো!”–দুষ্ট হেসে খোঁচা মে’রে কথাটা বলেছে রাকিন।
এহেন খোঁচায় আচানক র’ক্তিম লাজের ছাপ এসেছে শাহ্জাদীর বদনে। স্লিভলেস জামাই তো পরে রয়েছে এখন! বাকি পোশাক হাতে নিয়ে বুকে চেপে রেখেছে সে। পরনের স্লিভলেস জামাটার গলাটা একটু বড়। শাহ্জাদার সামনে নিলাজ দেখাতে পারতো তাকে। তাই বাকি পোশাক বুকে চেপে নিশ্চুপ হয়েই দাঁড়িয়ে রয়েছে শাহ্জাদী। রাকিন আরও দুষ্ট স্বরে আড়চোখে চেয়ে বলেছে–“আমি বাইরে গেলেই গুইসাপটি কিন্তু আবারও ফিরে আসবে। আপনিও হয়তো দৌড়ে গিয়েই আবারও আলিঙ্গন করবেন আমায়! দু’দুবার ছেড়ে দিয়েছি আপনাকে। এরপরে আলিঙ্গন করলে কিন্তু আমি একদমই ছাড়বো না।”
এমন ঠোঁটকা’টা কথা শুনে নওরার বোধোদয় হয়েছে। বেচারী ভাবছে গুইসাপটি হয়তো ঠিকই আবারও ফিরে আসবে! আর এ শাহ্জাদা যদি সত্যিই দুষ্টুমি করে! এসব ভেবেই মিনমিন করে নওরা বলেছে–“তাহলে অন্য দিকে ফিরে থাকুন তো! আমি বাকি কাপড়গুলো পরবো।”
শাহ্জাদা ঘুরে দাঁড়িয়েছে অন্য দিকে। হাফ স্লিভ জামার উপরে ঝটপট ফুল স্লিভ জামাটি পরে নিয়েছে নওরা। তার উপরে ওড়নাটা জড়িয়ে শাহ্জাদাকে ডেকেছে কোমল স্বরে। চুপিচুপি একবার চোরা দৃষ্টি বিনিময় হলো দুজনার মাঝে। আর কালক্ষেপণ না করে ওরা প্রস্থান করেছে পুরনো রাজপ্রাসাদ থেকে। প্রণয় রঙের লুকোচুরিতে নির্বাক দুজনই। হাঁটতে শুরু করেছে নতুন রাজপ্রাসাদের উদ্দেশ্যে। আলাপ না করে বেশিক্ষণ থাকতে পারে নি রাকিন। খুব বিনীতস্বরে বলেছে–“একটা কথা বলবো শাহজাদী?”
“জ্বী,বলুন।”
“আপনাকে কিন্তু এখনো হাসতে দেখে নি।”
“দুঃখের জীবন আমার! হাসি আসবে কোথা থেকে?”
“একটু হাসুন না আমার জন্য!”–অনুরোধের সুরে।
আচানক এমন অনুরোধে লাজরাঙা হয়েছে নওরার মৌন বদনখানি। কোনো আওয়াজ নেই কণ্ঠে। হাসিও নেই গোলাপরাঙা অধরে। তবুও শাহ্জাদীর এ লাজরাঙা বদন যেন রাগিনীর ন্যায় ভালোবাসার সুর তুলেছে রাকিনের হৃদয়ে। খুশির চাদরে মোড়ানো অধরা স্বপ্নগুলো বর্ণিল হতে শুরু করেছে। নেশা নেশা এক তনমনে আবেগ এসেছে শাহ্জাদার কণ্ঠে। সে আবেগে কৌতূহলের সাথে রাকিন প্রশ্ন করেছে–“আমায় পছন্দ করেন শাহ্জাদী?”
মন চুরির অভিপ্রায়ে শাহ্জাদা আবারও কড়াঘাত করেছে নওরার মন বাতায়নে। এ যেনো এক বজ্রাঘা’ত! কি জবাব দেবে সে এখন! সত্যিই তো একটু একটু ভালো লাগে শাহ্জাদাকে। কিন্তু নিজে তো বন্দী হয়ে আছে রাজ’শিকলে। এ শিকল,এ নিগড় থেকে মুক্ত হওয়া তো সম্ভব নয়। তাই নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে নওরা জবাব দিয়েছে–“একজনের সাথে আমার বাগদান হয়ে আছে পারিবারিকভাবে। তাকেই পছন্দ হয় নি! আর আপনাকে পছন্দ করবো কি করে!”
“আপনি মিথ্যে বলছেন শাহ্জাদী!”
হৃদয়জ অনুভূতিকে গোপন রেখে নওরা আছে চুপটি করে। রাকিন আত্মবিশ্বাস নিয়েই বলছে–” আপনি পছন্দ করেন আমায়!”
“আপনি ভুল ভেবেছেন।”
“যদি পছন্দ না করতেন তবে আমায় দেখে বারবার ওভাবে শ’রমিন্দা হতেন না!”
আর কোনো কথা নেই নওরার কণ্ঠে। রাকিন শান্তস্বরে ধীরে ধীরে বলছে–“আমার প্রশ্নের জবাব চাই শাহ্জাদী। আমি আপনার জবাবের আশায় রইবো।”
আলাপচারিতার মাঝেই ওরা চলে এসেছে নতুন রাজপ্রাসাদের নিকটে। কয়েকটি পায়রা উড়ে এসেছে রাকিনের কাছে। খুব সুন্দর দেখতে এই পায়রাগুলো। নওরা মুগ্ধ নয়নে দেখছে সেগুলোকে। রাকিন মৃদু হেসে বলেছে–“আমার পোষা পায়রা।”
………
দুপুর লুকিয়ে গিয়ে বিকেল এসেছে। বিকেলের প্রথম প্রহর এখন। রবিকিরণ ঝরছে ধরণী জুড়ে। এখন আর তেজোদীপ্ত নয় রবি। মৃদু কিরণ ঝরিযে বিদায়ী সুর শোনাতে উদ্যত হয়েছে। রাজকন্যারা বাহার রাজ্যে ফিরে যাবে আজ। এরই মাঝে রাজকার্যে ভীষণ ব্যস্ত ছিলো রাকিন। রাজা তারিকের কাছ থেকে দ্বিতীয় পক্ষের পুত্র আরশান দায়িত্ব নিয়েছে রাজকন্যাদের স্বরাজ্যে ফিরিয়ে দেবার। কিন্তু সৎ ভাই আরশানের সাথে রাজকন্যাদ্বয়কে পাঠাতে রাজি হয় নি রাকিন। বড় ভাই তাসকিন তো মৃগী রোগী। খুব প্রয়োজন ছাড়া জলপথে কোথাও যাতায়াত করে না। জলপথে কোথাও গেলেও নিজ ভাইদেরকে সফরসঙ্গী করে। অসুস্থ থাকায় তাসকিন নিজে রাজকন্যাদের ফিরিয়ে দিতে যেতে পারবে না। রাকিন আশায় ছিলো আজও যাত্রাপথে সে মহব্বতের আলাপ করবে নওরার সাথে। কিন্তু রাজকন্যাদেরকে বাহার রাজ্যে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব আগেই নিয়ে রেখেছে সৎ ভাই আরশান। আরশানকে তেমন বিশ্বাস করে না রাকিন। তাই ওকে বাদ দিয়েছে নৌযাত্রা থেকে। কিন্তু আরশান এসে অনুরোধের সুরে রাকিনকে বলছে–“ভাই, আপনার নানা বাড়িতে একটু যেতে চাই।”
“তাসকিন ভাইয়ের বিয়ের দিন যেতে পারবি বাহার রাজ্যে।”–রাকিনের সোজাসাপ্টা জবাব।
আরশান গিয়ে বায়না ধরেছে বাবার কাছে। সম্ভার রাজ তারিক আদেশ দিয়েছেন আরশানকেও সাথে নিয়ে যাবার জন্য। অবশেষে আরশানকে সঙ্গী করেই ওরা যাত্রা করেছে। রাজপ্রাসাদ থেকে বের হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই চলে এসেছে প্রণয় নদের তীরে। রাজকীয় নৌযান প্রস্তুতই ছিলো। বাহার রাজ্যের’দুই রাজকন্যা আর ওদের দাদী উঠে গিয়েছে নৌযানে। দাসীরা তো সাথেই আছে। ঝটপট দুই রাজপুত্র রাকিন আর আরশানও উঠে এসেছে। আরশান কিন্তু বিনা কারণে আসে নি আজ। আরশানেরও পছন্দ হয়েছে নওরাকে। রাকিন তো জানেই না আরশানের মনের গোপন কথা।
রাজতরী চলতে শুরু করেছে হেলেদুলে। প্রণয় নদ আজ তরঙ্গ সংকুল। চেনা-অচেনা ছন্দে ঢেউ কে’টে কে’টে সম্মুখে চলছে রাজতরী। সময় এখন বিকেল চারটা। এই অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সর্বসাধারণের কাছে ঘড়ি না থাকলেও ঘড়ি রয়েছে রাজপ্রাসাদগুলোতে। সময় জানার প্রয়োজনে রাজকীয় তরীতেও ঘড়ি অপরিহার্য। আজকের এই রাজকীয় নৌযানেও রয়েছে ঘড়ি। সময় এখন বিকেল চারটা। জলযানের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে নওরা। কক্ষ থেকে শাহ্জাদী একাই বেরিয়ে এসেছে চুপটি করে। নওশাদকে তার যতোটা খা’রাপ লাগে ঠিক ততোটাই ভালো লেগেছে রাকিনকে। শুধু ভালোলাগা নয়, ভালোবাসার স্বপ্ন এসেও ঝিলমিল ছন্দে লুকোচুরি খেলছে শাহ্জাদীর হৃদয় গহীনে। ষোড়শী নওরার সাথে ত্রিশ বছর বয়সী নওশাদ বড্ড বেমানান। শাহ্জাদীর বয়সের হিসেবে নওশাদকে বুড়োই বলা চলে। তেইশ বছর বয়সী সুদর্শন,সুপুরুষ রাকিনকে বেশ মনে ধরেছে শাহ্জাদীর। শাহ্জাদাও চুপিচুপি সুযোগ খুঁজছিলো শেষ বারের মতো প্রেম নিবেদনের। নওরাকে একাকী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক ধারাহারা প্রণয়োচ্ছাস হৃদয়ে ধারণ করে এগিয়ে এসেছে রাকিন। ধীরে ধীরে শাহ্জাদার উপশ্চিতি টের পাচ্ছে নওরা। চুপটি করে দাঁড়িয়ে রয়েছে শাহ্জাদী রহস্যময়ী বদনে। কাছে এসে রাকিন ডেকেছে–“শাহ্জাদী!”
আর কিছু বলা হয় নি রাকিনের। আচানক এক ধা’ক্কায় নওরা তাকে ফেলে দিয়েছে প্রণয় নদে। নিমিষেই শাহ্জাদীর অধর চিড়ে বের হলো খিলখিল শব্দের এক প্রাণচঞ্চলা হাসি। এ যেনো এক নয়ন জুড়ানো,মনভুলানো,মুক্তোঝরা বাঁধনহারা হাসি! প্রণয় নদের ঢেউখেলানো জলরাশি থেকে মাথা তুলে তাকিয়েছে রাকিন। নওরার এমন ছন্দময় ভুবন ভুলানো হাসি উপভোগ করে শাহ্জাদা ক্ষণিকেই হারিয়েছে মুগ্ধতার আবেশে। ঠোঁটের কোনে চঞ্চলা,দুষ্ট হাসি রেখেই নওরা বলছে–“উঠে আসুন শাহ্জাদা! কুমির আছে কিন্তু নদে।”
নওরাকে দেখে আরশানও এসেছিলো বারান্দায়। রাকিনের সাথে নওরার এমন জ্যোৎস্নাঝরা হাসি,এহেন বাঁধনহারা দুষ্টুমি নয়নগোচর হয়েছে আরশানের। চুপিচুপিই ঈর্ষান্বিত হয়েছে ছেলেটি। এদিকে পূর্ণতেজে রাকিন উঠে এসেছে নদ থেকে। জলেসিক্ত শরীর ছেলেটির। শাহজাদীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সেই সিক্ত শরীরেই। পিউ পিউ বাঁশির সুরে এক নতুন প্রণয় রাগিনী এসেছে তার হৃদয়ে। সে প্রণয় রাগিনীর চঞ্চলা সুরে বড্ড বাঁধনহারা তার হৃদয়। হৃদয়ের সব প্রণয় ছন্দে ছন্দিত হয়ে শাহ্জাদা আচানক রহস্যের হাসি দিয়ে বলেছে–” আমার জবাব কিন্তু আমি পেয়ে গেছি শাহ্জাদী!”
“কিসের জবাব?”–বিস্মিত বদনে নওরা শুধিয়েছে শাহ্জাদাকে।
“এক প্রশ্ন করেছিলাম আপনাকে। জানতে চেয়েছিলাম আমায় পছন্দ করেন কিনা! আজকে আপনার এই ছন্দময় নিদারুণ চঞ্চলতা জবাব দিয়েছে আমায়!”
শাহজাদী ঐন্দ্রজালিক লাজনম্র হাসি দিয়ে ফিরে যাচ্ছিলো কক্ষে। প্রণয়োচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বসিত রাকিন পেছন থেকে ডেকে বলেছে–“আমি কিন্তু সত্যিই জবাব পেয়ে গেছি শাহ্জাদী!”
ভীরু ভীরু লাজে নওরা ফিরে গেছে কক্ষে। পুরো নৌযাত্রায় আর একবারও বের হয় নি কক্ষ থেকে। আরেকটু প্রণয়ালাপের আশায় চাতক পাখি হয়ে রাকিন অপেক্ষা করেছিলো বারান্দাতেই। সিক্ত শরীর নিয়েও একবারও প্রস্থান করে নি সেখান থেকে। সন্ধ্যার খানিক পরে বাহার রাজ্যের তীরে এসে পৌঁছেছে রাজতরী। মাথায় বিশাল ঘোমটা টেনে নওরা বের হয়ে যাচ্ছিলো নৌযান থেকে। চুপিচুপি কাছে এসে রাকিন ফি’স’ফি’সিয়ে বলেছে–“মহব্বতের বার্তা নিয়ে আমার পায়রা যাবে তোমার কাছে। মহব্বতের সাথেই আমায় জবাব দিও!”
হঠাৎ করেই ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ সম্বোধনে চলে এসেছে শাহ্জাদা। এ পরিবর্তন আরো নতুন হিসেবের বার্তা দিচ্ছে। নওরা নির্বাক থেকেই নেমে গেছে নৌযান থেকে। ধীরে ধীরে অশ্বারোহণ করেছে সবাই। কিছুক্ষণ পরে ওরা পৌঁছে গেছে বাহার রাজ্যের প্রাসাদের নিকটে। সিক্ত দেহে থাকায় শাহ্জাদা প্রবেশ করে নি প্রাসাদে। ভীনরাজ্যের রাজপ্রাসাদে অগোছালোভাবে প্রবেশ করাটাও অশোভন। তাই সৎ ভাই আরশানের সঙ্গী করে বাহার রাজকন্যাদের পাঠিয়েছে প্রাসাদে। রাকিন একাকী ফিরে গিয়েছিলো প্রণয় নদের তীরে। বাহার রাজ্যের রাজপ্রাসাদে গিয়ে সৎ ভাই আরশান ঘটিয়েছে অন্য ঘটনা। সে সাক্ষাৎ করেছে বাহার রাজ্যের রাজার সাথে। ভবিষ্যৎ সকল সম্পর্কে বি’ষ ঢালতে শুরু করেছে আরশান।
চলবে