প্রিয়_ডাক্তার – শেষ পর্ব

0
1969

#প্রিয়_ডাক্তার – শেষ পর্ব
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
____________________________
‘ মহুয়া, একবার বাড়ীর বাইরে আসবে? একটু কাজ ছিল। ‘
শিহাবের আচমকা জরুরি তলবে মহুয়া অবাক! গতকাল রাতে বিয়ে শেষ করে বেশ দেরি করে ঘরে ফিরেছে। এখন খুব ঘুম পাচ্ছে মহুয়ার! ঘুমে চোখ টেনে তুলতে পারছে না। হামি উঠছে শুধু! মহুয়া চোখ মুছে বলল,
‘ কেন? কোনো দরকার শিহাব ভাই? ‘
‘ হ্যাঁ, আদর ডেকেছে। ‘
আদর ডেকেছে শুনে মহুয়ার ঘুম এক লাফে আকাশে! ঘুম ছুটে ফকফকা চোখ! মহুয়া লাফ দিয়ে উঠে বসে। ওড়না গায়ে জড়াতে জড়াতে বলে,’ কেন ডেকেছে? ‘
‘ এসেই জানতে পারবে। দ্রুত আসো। আমরা অপেক্ষা করছি। ‘
শিহাব ফোন কেটে দেয়। মহুয়া অবাক হয়ে বিছানা ছাড়ে। সবে নয়টা বাজে। সাতসকালে আদরের মহুয়ার সাথে কি এমন জরুরি কাজ থাকতে পারে?

মহুয়া কাধে শাল চেপে বের হয় বাড়ি থেকে। ওই তো দূরে আদরের বাইক! মহুয়ার বুক ধক করে উঠে। আদরকে মারাত্মক লাগছে আজ। গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, জিন্সের প্যান্ট আর মাথায় ক্যাপ। মহুয়া পা টিপেটিপে এগিয়ে আসে।

‘ কি হয়েছে? কিসের জন্যে ডেকেছেন? ‘
আদর কথার উত্তর দেয়না। বরং বলে, ‘ বাইকে উঠে বস। ‘
মহুয়া বিস্মিত হয়। ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে বলে, ‘ আমি? আপনার বাইকে উঠব? ‘
আদর এবার ধমক দেয়। বলে, ‘ বেশি প্রশ্ন করিস কেন? উঠে বস বলছি। ‘
ধমক খেয়ে মহুয়ার বুক ধুকপুক ধুকপুক করে। এত জোড়ে কেউ ধমক দেয়? মহুয়া চুপ করে আদরের বাইকে উঠে বসে। আদর বাইক চালু করে বলে, ‘ ভালো করে ধরে বস। পড়ে যাবি।’
‘ না পড়ব না। ‘ মহুয়ার নাক লাল হয়ে গেছে। লজ্জায় তাকাতে অব্দি পারছে না। এমনিতেই আদরের গায়ের সাথে মহুয়ার গা ছুঁইছুঁই। এতেই মহুয়া কেমন লজ্জাবতী গাছের ন্যায় গুটিয়ে গেছে। আর আদরকে জড়িয়ে ধরলে তো মহুয়াকে খুঁজেই পাওয়া যাবে না। উড়ে যাবে মহুয়া! ইশ, ইশ, ইশ! এত লজ্জা মহুয়া কোথায় রাখবে। বুকের ভেতর পুষবে কি?

আদরের বাইক থামে একটি কাজী অফিসের সামনে। মহুয়া অবাক হয়। বাইক থেকে নেমে বলে, ‘ কাজী অফিস কেন? কার বিয়ে আজ? ‘
শিহাব কৌতুক করে বলে, ‘ তোমার। ‘
মহুয়ার বুক ধ্বক করে উঠে। তার বিয়ে? সে তো জানেই না। আদর মহুয়ার হাত চেপে ধরে। এই প্রথম আদরের স্পর্শ মহুয়া শরীরে অনুভব করে। নিমিষেই গরম হয়ে যায় হাত! ঘাম ছুটে হাত বেয়ে! কপোল ঘামে ভিজে উঠে। আদর কাজী অফিসের ভেতর প্রবেশ করতে করতে বলে, ‘ ভয় পাচ্ছিস? ভয় পাবি না। তোকে খেয়ে ফেলব না। যা করতে বলা হবে, চুপচাপ তাই করবি। নো সাউন্ড। ‘
মহুয়া বোকার মত এখনো হাতের দিকে চেয়ে। আদরের কথা তার মাথায় ঢুকলে ত!

‘ ছেলের নাম? ‘
‘ অনুরাগ ফারহান আদর। ‘
‘ মেয়ের নাম কি.? ‘
‘ মহুয়া ওয়াসিফা। ‘
‘ বয়স? ‘
‘ ১৭। ‘
‘ মেয়ের বয়স তো অনেক কম। আইন অনুযায়ী বিয়ে বৈধ হবে না। ‘
‘ আইন অনুযায়ী না হলেও চলবে। বিয়ে ধর্ম অনুযায়ী হবে। ‘
‘ কিন্তু….’
আদর বয়স্ক কাজীকে থামিয়ে দেয়। শিহাবের দিকে চেয়ে বলে, ‘ সম্মানী দে উনাকে। ‘
শিহাব এক বড় টাকার ব্যান্ডেল কাজীর দিকে এগিয়ে দেয়। কাজী দমে যায়। টাকার ব্যান্ডেল ড্রয়ারে পুড়ে বাকি কাজ চুপ করে সম্পন্ন করে।
এদিকে মহুয়া হতবাক! তার বিয়ে, আদরের সাথে? অসম্ভব ব্যাপার বটে! মহুয়া ভয় পেয়ে আদরের হাত খামচে ধরে। ভয়ার্ত কন্ঠে বলে, ‘ আমি বিয়ে করব না। ‘
আদর শুনে। মুচকি হেসে মহুয়াকে নিয়ে এক কর্নারে দাড়ায়। মহুয়ার চোখে জল। আদর মহুয়ার জল হাত দিয়ে মুছে দেয়। মিষ্টি কণ্ঠে শুধায়, ‘ ভালোবাসিস আমায়? ‘
মহুয়া কেপে উঠে। মাথা নিচু করে পা দিয়ে মাটি খামচে ধরে। বুক কাপছে মহুয়ার। আদর আবার বলে, ‘ বল। ভালোবাসিস আমায়? ‘
মহুয়া কিছুক্ষণ সময় নেয়। অতঃপর মাথা নত করে চোখ বুজে মাথা হেলিয়ে নিভু কণ্ঠে বলে, ‘ হু। ‘
আদর হাসে। যেন সে বিশ্ব জয় করে নিয়েছে। আদর মহুয়ার কপালে ঠোঁট রাখে। মহুয়ার পায়ের রক্ত ছলকে উঠে। আদরের প্রথম উষ্ণ স্পর্শে মহুয়ার মস্তিষ্কের রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে। আদর মহুয়ার কপালে ঠোঁট রেখে নেশাকণ্ঠে বলে, ‘ আমিও ভালোবাসি। ‘
ইশ, মহুয়ার কান স্বার্থক! আদর মহুয়াকে ভালোবাসে? সুখ, সুখ, সুখ! এ কেমন সুখ? মহুয়া উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায়! আদর বলে, ‘ বিয়ে করবি আমায়, ছোট্ট মহু? ‘
মহুয়া ভাবে না। সুখের সমুদ্রে পা ভিজে গেছে তার।আর সুখ চাই তার। মহুয়া মাথা নত করে নিভু স্বরে বলে, ‘ হু। ‘
‘ হু কি? সুন্দর করে বল।’
মহুয়া লজ্জা পায়। আর কত সুন্দর করে বলবে সে? এমনিতে লজ্জায় মারা যাচ্ছে। আরো সুন্দর করে বললে ত লজ্জায় আক্রান্ত মহুয়াকে খুজেই পাওয়া যাবে না। মহুয়া ভয়কে জয় করার চেষ্টা করে। বলে, ‘ হ.হ্যাঁ ব.বিয়ে ক.করব।’
আদর হেসে উঠে। অতঃপর আদরের কিছু বন্ধু বান্ধব, ও মহুয়ার কিছু বান্ধবীর সাক্ষী সহকারে আদর ও মহুয়ার বিয়ে হয়।
বিয়ে হয়ে গেছে। অথচ এখন মহুয়ার ভয়ে কাপছে। আদরের হাত খামচে ধরে কেঁদে বলছে, ‘ কিন্তু, মা? ‘
আদর মিষ্টি হেসে মহুয়ার কানের পেছনেচুল গুঁজে দেয়। বলে, ‘ তুই ডাক্তারি পড়বি তো? ডাক্তার হওয়ার পর তোর আর আমার আবার ধুমধাম করে বিয়ে হবে। তোর মাকে তখন জানানো হবে। চিন্তা করিস না। আমি আছি ত। ‘
মহুয়ার সকল ভয় নিমিষেই দূর হয়ে যায়।
আদর এবং মহুয়ার বিয়ের কদিনের মাথায় আদরের ছুটি শেষ হয়ে যায়। আদর মহুয়াকে একা রেখে শহরে চলে আসে। তবে মহুয়া একা নয়। আদরের চেলা সামন্ত মহুয়ার আশেপাশে সর্বদা লেগে থাকে। আদরের এই ভয়ঙ্কর ভালোবাসায় মহুয়া সুখে ভেসে থাকে। কপাল গুনে এমন একটা ভয়ংকর প্রেমিক তথা স্বামী পেয়েছে মহুয়া! জীবনে আর কি চাই তার!
_______________________
মহুয়া আজকাল এক অদ্ভুত কারণে আদরকে এড়িয়ে যাচ্ছে। আদর ঢাকা থেকে পারছে না মহুয়ার গালে চপাট করা এক মহা থাপ্পড় বসাতে। কদিন পেরিয়ে যেতেই অধৈর্য্য আদর ছুটে এল মহুয়ার কাছে।
মুখোমুখি বসে আছে আদর এবং মহুয়া। মহুয়ার কোলে একটি সাদা বিড়াল ছানা। আদরের ধমকে সেই বিড়ালটিও মহুয়ার কোলে গুটিয়ে গেছে। মিউ মিউ শব্দ তুলে মহুয়াকে হয়তো বলছে,
‘ এই মহু, তুমি এই বাজে ছেলেটার সাথে থাকো কিভাবে? দুটো মিষ্টি কথা বলতে পারে না। সারাক্ষণ শুধু ধমকা ধমকি, আর গাল টিপে দেওয়া। অসহ্য! ‘

অথচ আফসোস, বিড়ালকে কথা বলার শক্তি বিধাতা দেন নি। তাই সে কথা না বলে চুপটি করে বসে আছে। আদর এবার মহুয়ার চুল টেনে ধরল। মহুয়া ব্যথায় কুঁকড়ে গেল। মৃদু স্বরে বলল, ‘ আমার চুল ছাড়ুন, ব্যথা লাগছে তো। ‘
আদর ছেড়ে দিল না। বরং গম্ভীর সুরে বলল, ‘ আগে বল, আমার কল রিসিভ করলি কেন? কদিন ভালো করে কথা বলছি দেখে, পাখা গজিয়েছে? ‘
মহুয়া কণ্ঠে এবার জাদু এল। মুখ বাঁকিয়ে বলল,
‘ কেন বলব? আপনার সাথে কথা নেই। এখন তো আমার মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে ভুলাতে চাইছেন। পরে যখন ঢাকা চলে যান, তখন আমার খবর নিতে ইচ্ছে হয়না। মেম্বারের মেয়ে জুথি আছে না? সে বলেছে, আপনি নাকি চাকরি পেয়ে আবারও এক সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করবেন। আমাকে তখন ভুলে যাবেন। তাই আমি ঠিক করেছি, আপনি ভুলে যাওয়ার আগে আমিই আপনাকে ভুলে যাব! তাহলে বেশি কষ্ট পেতে হবে না। ‘
আদর সরু চোখে অভিমানী মহুয়াকে পর্যবেক্ষণ করল। মহুয়া আদরের বেহায়া চাওনি দেখে ওড়না টেনে ধরল। আদর এবার কণ্ঠে শীতলতা ঢেলে বলল,
‘ আচ্ছা, ভুলতে পারবি আমায়? ‘
মহুয়ার বুক কেপে উঠল। না তো! সে পারবে না, আদরের এই অস্থির, বেপরোয়া ভালোবাসাকে ভুলে যেতে। আদরের করা বেহায়া আদর, স্পর্শকে ভুলে যেতে। ইশ, কি হবে এখন মহুয়ার? আদর হেসে উঠে। অবাস্তব চিন্তা করা মহুয়াকে টেনে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে। মহুয়া গুটিয়ে যায় আদরের বুকে। আদর হিড়হিড় কণ্ঠে শুধায়, ‘ আজীবন চলে গেলেও তোকে ভুলে যাওয়া সম্ভব না আমার পক্ষে! তুই আছিস, যতদিন নিঃশ্বাস আছে ততদিন! ‘
মহুয়ার আবারও বুক কাপে! আদরের প্রতি শ্রদ্ধা জন্মে।

পুনশ্চ….
আদর এবং মহুয়ার গোপনে বিয়ে হওয়ার তিন বছর পর মহুয়া মাকে নিয়ে একেবারে ঢাকা চলে আসে। ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছে মহুয়া। এবার মহুয়ার সকল স্বপ্ন পূর্ন হবার সময়। বাবা এখনো বোধহয় মদ খেয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। পড়ে থাকুক। মহুয়া কি করবে তাতে? মহুয়ার সুখ দেখার সময় কোথায় তার? মহুয়া এই পৃথিবীতে এই একটা মানুষকে প্রচন্ড ঘৃনা করে। বাবাকে দেখে মহুয়া অবাক হয়। এই পৃথিবীর তবে খারাপ বাবাও আছে? হুমায়ূন আহমেদ তবে কি ভুল ছিলেন?

আদর মহুয়ার জন্যে একটা বাসা ভাড়া করে দেয়। মহুয়া সেই বাসায় মাকে নিয়ে থাকে। আদর মহুয়াকে টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চায়। অথচ মহুয়া আদরের সাহায্য নিতে নারাজ। তার মতে, সে তার মাকে বুঝাতে চায়! শুধু ছেলেরা নয়। মেয়েরাও পারে তার বাবা মায়ের দায়িত্ত্ব কাধে তুলতে। মহুয়া টিউশনি করে নিজের এবং মায়ের খরচ চালায়।

মহুয়ার মায়ের চোখে আজ জল। আজ মহুয়া এবং আদরের বিয়ে! তার আদরের মেয়ে অবশেষে তার জীবনের আদরকে পেতে যাচ্ছে। নিজের মেয়েকে নিয়ে বিশাল স্বপ্ন ছিল মহুয়ার মায়ের। অবশেষে তার যেয়ে একজন সফল ডাক্তার। তার সংসার শুরু হতে যাচ্ছে। মহুয়াকে আদর সুখে রাখবে, ভাবকে জল ভরে মহুয়ার মায়ের চোখে!
আদর অবশেষে তার কথা রেখেছে। মহা ধুমধামে তার প্রেয়সীকে ঘরে তুলেছে।

মহুয়ার পেটে আদরের হাত বিচরন করছে। আদর পেছন থেকে মহুয়াকে জড়িয়ে রেখেছে। মহুয়া বুক সেই প্রথম বারের ন্যায় ধুকধুক ধুকধুক করছে। আদর অবশেষে মহুয়ার! মহুয়া আদরের দিকে ফিরে। আদরের সেই তথাকথিত তীক্ষ্ম দৃষ্টি মহুয়াকে নেশায় আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। আদর মহুয়ার কপালে চুমু খায়। মহুয়া চোখ খিচে নেয়। আদর মাথা সরিয়ে মহুয়ার দিকে চায়। বলে, ‘ আজ কিছু বলবি? ‘
মহুয়া মাথা নত করে হাসে। অতঃপর আদরের কপালে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে বলে, ‘ আপনি আমার প্রিয় ডাক্তার, আদর। ভালোবাসি। ‘
আদর হাসে। আজ মহুয়ার ন্যায় আদরও সুখে ভেসে যাচ্ছে। তার ছোট্ট মহু এই প্রথম তাকে ভালোবাসি বলেছে। সুখে উড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে আদরের! এত সুখ কোথায় রাখবে সে? বুকে? মহুয়াকে আদর বুকে টেনে নেয়। মহুয়ার চুলে বিলি কেটে বলে, ‘ অবশেষে আমার জীবন পূর্ন হল! :

#সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here