প্রিয়_তুই,০৫,০৬

0
245

#প্রিয়_তুই,০৫,০৬
#নূরজাহান_আক্তার_আলো
#পর্ব_০৫

ভোরের আসার কথা শুনে তিতাসের মা ও চাচী ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হলেন। ভোরকে দেখে উনারা হাসলেন, খুশি হলেন।
অবশেষে মেয়েটা আসল। তবে ভোর একবুক কষ্ট চেপে বসে আছে একথা উনারাও অবগত। তবুও মেয়েটা নিদারুণভাবে মুখে হাসি ফুটিয়ে রেখেছে। যেন এই পৃথিবীর একমাত্র সুখী ব্যক্তি সে। যার জীবনে নেই কোনো দুঃখ কষ্ট এবং বিষাদের ছাতছানি। অথচ ওর অভ্যন্তরও রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত। আর
সেটার উপলব্ধিদাতা কেবল সে নিজে। তারপর উনারা হাসি মুখে ভোরের পাশে বসলেন, কুশল বিনিময় করলেন। বাসার সকলের খোঁজ খবর নিলেন। এভাবেই দু’এক কথা হতে হতে গল্পে মেতে উঠলেন। ভোরও ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি এঁটে উনাদের সঙ্গ দিতে লাগল।একটুপরে, খিলখিল হাসির শব্দে মুখোরিত হলো চারিপাশ। সেই সঙ্গে তৈরি হলো আনন্দমুখর পরিবেশ। যেখানে সবাই উপস্থিত। আজকে প্রায় অনেকদিন পর বাসায় আড্ডা জমেছে, জমপেশ আড্ডা। তাই চাচী উঠে নিজে গিয়ে হরেক রকমের নাস্তা বানিয়ে আনলেন। তিতাস আর রোজা সেগুলোর উপর হামলে পড়ল। কাড়াকাড়ি করে যে যার পছন্দের জিনিস তুলে নিলো। তখন চাচী ওদেরকে ধমকে থামিয়ে আস্তে ধীরে খেতে বললেন।সবাই খেতে খেতে দুইদলে ভাগ হয়ে লুডু নিয়ে বসল।তিতাসের বাবা আর ভোর একদিকে আর চাচী আর ওর মা এদিকে। আর রোজা হচ্ছে রেফারি। কোন দল খুব ঝামেলা করছে সে দেখছে। যে বেশি ঝামেলা করবে তাকে লাল কার্ড দেখানো হবে।তারপর খেলা
অনুযায়ী শুরু হলো তাদের মধ্যে হাড্ডা-হাড্ডি লড়াই। প্রায়
দেড় ঘন্টা পর তাদের খেলা সমাপ্ত হলো। তিতাসের মা এবং চাচী জিতেছেন। উনারা পঁচাচ্ছেন ভোরদের। তখন ফোনে কল আসায় ভোর বলল,
-‘মা, আমি গেস্ট রুমে যাচ্ছি। একেবারে ফ্রেশ হয়ে আসব।”
-‘আচ্ছা।’
একথা বলে সে কল রিসিভ করে কথা বলতে বলতে প্রস্থান করল। পিয়াসের রুমে গিয়ে ক্ষত দগদগে করার ইচ্ছে তার নেই। সে এমনিতেই অদৃশ্য অনলে দগ্ধ হচ্ছে। বুকচাপা কষ্টে গুমড়ে মরছে। মনে পাথর চেপে সে এখানে উপস্থিত হয়েছে।শুধুমাত্র তিতাসের মায়ের কাছে করা ওয়াদা পালনের জন্য। নয়তো এ বাড়িমুখো হতো না সে। ভোর রুমে যাওয়ার পরেও তিতাস থমথমে মুখেই বসে রইল। কারণ ভোরের হঠাৎ করে এখানে আসাটা ব্যাপারটা তার বোধগম্য হচ্ছে না। তাছাড়া তাকে এখানে দেখলে অনেকেই বাঁকা নজরে দেখবে। হয়তো দু’একটা কটু কথাও শুনিয়ে দিতে পারে। আর না ভেবে হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো মেয়ে ভোর নয়। তবে ভোরকে নজরে রাখতে হবে নয়তো বিপদ অনিবার্য। তিতাস আর না বসে পিয়াসের রুমে তালা আঁটকে আসল। চাবিটাও নিজের কাছে রেখে দিলো। মূলত সে চাচ্ছে না ভোর ভুলেও সেখানে যাক। নতুবা অনেক কিছুর সম্মুখীন হতে হবে। ওর পরিবার সবার আগে ওর দিকে আঙুল তুলবে। অনেককিছুর জবাব তাকে দিবে। যা এই মুহূর্তে জানানো তার পক্ষে সম্ভবও নয়। এর চেয়ে সজাগ থাকা শ্রেয়। তবে সে নিশ্চিত, ভোর এখানে এমনি আসে নি। নিশ্চয়ই ওর মাথায় কিছু চলছে। নয়তো সে কিছু নিয়ে সন্দেহ করছে।

তারপর রাত বাড়লে সবাই একসঙ্গে খেতে বসলেন। টেবিল ভর্তি হরেক রকমের পদ। তিতাস নিজের মতো করে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। বাকিরা চুপচাপ। শুধু চামচের টংটাং শব্দ হচ্ছে। আর সবার মনে চলছে একটাই ভাবনা, একটাই নাম, পিয়াস। একপর্যায়ে পিয়াসের জন্য ওর মা শব্দ করেই কেঁদে ফেলছেন। পিয়াসের চেয়ারটা ফাঁকা দেখে উনি চোখে পানি আঁটকাতে পারলেন না। উনাকে কাঁদতে দেখে কেউই আর মুখে খাবার তুলতে পারলেন না। ভোরও চোখ মুছতে মুছতে উঠে চলে গেল। এমনিতেই এখানে আসার পর থেকে বিয়ের দিনে কথা বারংবার মনে পড়ে যাচ্ছে। কষ্টও বাড়ছে।
এই ড্রয়িংরুম, এই মানুষগুলো, এইসব সাজানো গোছানো আসবাবপত্র, সবই আছে। শুধু যার ভরসাতে এসেছিল সে নেই। ভোর রুমে গিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে শব্দ করে কেঁদেই ফেলল। একটা মেয়ের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ অলংকার তার স্বামী।
আর সেই অলংকার পাওয়ার পরপরই হারিয়েছে সে। কাতর হয়ে কাঁদতে কাঁদতে সে ভাবনায় ডুবে গেল।

ওদের বিয়ের দিনের ঘটনা……!

সাধারণ আর পাঁচটা মেয়ের মতো বিয়ের সাজে লাজে রাঙা হয়েছিল ভোর। ভাবি আর বান্ধবীদের দুষ্টু কথাবার্তায় গাল দু’টোতে ছড়িয়েছিল রক্তিম আভা। চোখে ছিল স্বামী নামক মানুষটাকে নিয়ে রঙিন একরাশ স্বপ্ন। হাতভর্তি মেহেদী দিয়ে মাঝে লিখেছিল পিয়াসের নাম। মেহেদী রং গাঢ় দেখে সবাই বলেছিল, সে বর সোহাগি হবে। বর তাকে ভালোবাসার শুভ্র চাদরে মুড়িয়ে রাখবে। একথা শুনে সে মনে মনে বলেওছিল, ‘আমিন, আমিন, আমিন।’
বিয়ের দিন বধূ বেশে যখন পিয়াসের পাশে বসেছিল। তখন ওর সব বন্ধুরা সিটি বাজিয়ে ওকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল।
সে লজ্জায় নতজানু হয়ে কাঁপছিল। ডাক্তারাও লজ্জা পায়,
এ কথা সে প্রমাণ করেছিল। ওর সকল অনুভূতি মিলেমিশে একাকার হয়ে সুখ উপলব্ধি করছিল। তখন পিয়াস মৃদু হেসে বলেছিল, ‘তুমি নামক পুতুলটা আজ থেকে আমার, একান্ত শুধুই আমার।’
পিয়াসের বলা কথাটা ভোরের কানে এখনো বাজে। মনে হয় সে তার আশেপাশেই আছে। তারপর বাবা- মা যখন বিদায় দিয়ে গাড়িতে তুলে দিয়েছিলেন। চলন্ত গাড়িতেও কাঁদছিল সে। তখনো ওই স্বামী নামক মানুষটা তাকে সযত্নে আগলে রেখেছিল। কতগল্প বানিয়ে হাসানোর বৃর্থা চেষ্টা করেছিল।
তারপর যখন নব্য স্বপ্ন সাজিয়ে এই বাসাতে পা রেখেছিল,
তখন নতুন বউ দেখতে অনেকেই ভীড় জমিয়েছিল। নিয়ম পালনে বড়রা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। তখন পিয়াস মৃদু স্বরে বলেছিল,
-‘একটু কষ্ট হলেও এসব জ্বালাতন সহ্য করে নাও। আমাকে এখানে থাকতে দিবে না, কি সব মেয়েলি নিয়ম কানুন আছে নাকি। আমি উপরে যাচ্ছি, প্রয়োজনে কল দিও। ”

পিয়াসের সঙ্গে ওইটুকু তার বলা শেষ কথোপকথন। এরপরে মানুষটাকে পেয়েছিল, তবে মৃত। যখন চেঁচামেচি শুনে সেও উপরে গিয়েছিল। তখন সুগন্ধযুক্ত ফুলে সজ্জ্বিত বিছানায় পিয়াস উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। পরণে ছিল বিয়ের পোশাক।
আর হাতের মুঠোয় ছিল একমুঠো লাল গোলাপের পাপড়ি।সেগুলো শক্ত হাতের মুঠোতে পিষ্ট হয়ে নেতিয়ে নিজস্ব সুগন্ধ হারিয়েছিল। তখনো তার অন্য হাত থেকে গড়িয়ে যাচ্ছিল, লালরঙা র’ক্তে’র ধারা। সেই র’ক্তে’ ভিজে গিয়েছিল বিছানায় চাদর, আর স্বযত্নে হলুদ গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লিখা তার নাম। কত্ত সুন্দর করে পাপড়ি দিয়ে লিখেও ছিল, ‘পিয়াসের ভোর থেকো চিরন্তন।’ আর ভোর নামটার উপরে ছিল তার ‘কা’টা হাতখানা। আর র’ক্তে’ ভিজে গিয়েছিল ভোরের নাম।
হলুদ পাপড়ির উপর লাল র’ক্ত’ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিল। তা দেখে শিউরে উঠেছিল তার পুরো শরীর। সেই মুহুর্তে থমকে গিয়েছিল ওর পৃথিবী আর হারিয়েছিল সে সুখ নামক রঙিন অনুভূতি। সেদিন পিয়াস লাল র’ক্তে’ শুধু তার নামই ভেজায় নি, উপহারস্বরুপ দিয়েছে বিধবার তকমা, সঙ্গে কেড়ে নিয়ে গেছে ওর মুখে হাসি।

পূর্বের কথা ভেবে ভোর এখনো কেঁদেই যাচ্ছে। তখন কেউ একজন বলে উঠল,

-”বেঁচে আছেন নাকি কাঁদতে কাঁদতেই মারা গেলেন?”
-”কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, এখান থেকে যা তিতাস।”
-”কফি বানিয়েছি, খাবেন?”
-”উফ, বিরক্ত করিস না, প্লিজ।”
-”ঝাল কিছু বানিয়ে দিবো?”
-”না।”
-”ফ্রিজে রসমালাই, আইসক্রিম, পেস্ট্রি আছে, আনি?”
-”বলছি তো না!”
-”তো কি খাবেন, আমার মাথা?”
-”দে।”
-”আগে বিয়ে করে নিলে ভালো হতো না? তৃপ্তিসহকারে খেতে পারতেন।”
-‘আমার ভালো লাগছে না। জ্বালাস না তো, রুমে যা।”
-‘আমি দিয়াশলাই নাকি যে জ্বালাব? আজব কথাবার্তা।”
-”তুই কি যাবি?”
-”নাহ।”
-‘এই তোরা দুইভাই আমাকে পেয়েছিসটা কি হ্যাঁ? আমি কি মানুষ না? আমার মন নেই, কষ্ট হয় না আমার? আমি কি খেলায় পুতুল?তোরা কেন আমাকে জ্বালাস, বলবি আমায়? কি রে বল, কি অপরাধে এভাবে পুড়ায় আমায়?”

একথা বলতে বলতে ভোর হাঁটুতে মুখ গুঁজে শব্দ করে কেঁদে ফেলল। তিতাস নিঃশব্দে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মৃদু হেসে বাড়িয়ে দিলো একমগ ধোঁয়া ওঠা কফি। ভোর নিলোও না, মুখ তুলে দেখলও না। সে কাঁদতে ব্যস্ত। আজ কেন জানি সে চোখের পানি আঁটকাতে পারছে না। হয়তো দগদগে ক্ষততে টান লেগেছে, ব্যথা বেড়েছে, এজন্য বোধহয়। তখন তিতাস মগটা পাশে রেখে বলল,

-”আপনি আসলেই খুব নোংরা প্রকৃতির মেয়ে ,ছিঃ!”

তিতাসের এ কথা শুনে ভোর অশ্রুসিদ্ধ চোখে মুখে তুলে তাকাল। চোখে বিষ্ময়! মানে কী? নোংরা, তাও আবার সে?
ভোর তড়িৎ গতিতে উঠে তিতাসের কলার ঝাঁকিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,

-‘কি? আবার বল? আমি কি?”
-”আপনি নোংরা।”
-”তোর সঙ্গে কি নোংরামী করলাম?”
-”একথা কখন বললাম?”
-”তাহলে নোংরা বললি কেন?”
-”এই যে নাক দিয়ে সর্দি বের হচ্ছে আপনার। সেটা পরিষ্কার না করে বার বার ফসফস করছেন, আবার তা টেনে গলায় নিয়ে কুত করে গিলে খেয়েও ফেলছেন। তাহলে আপনাকে নোংরা বলব না তো পরিষ্কার বলব?”

ভোর রাগে দুঃখে জবাব দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলল। না এই ছেলে, চরম পর্যায়ের বেয়াদব, অসভ্য। এর সঙ্গে কথা বলায় বৃর্থা। এজন্য সে তিতাসের কলার ছেলে হনহন করে বাইরে চলে গেল। তখন ড্রয়িংরুমে বাকিরাও ছিলেন। উনারা স্বাভাবিকভাবে ভোরকে নিয়ে পুনরায় খেতে বসলেন। এবার
হাসি ঠাট্টা করেই সবাই খেলেন। আর তিতাস অদূরে দাঁড়িয়ে
বুকে হাত রেখে বড় সড়ো নিঃশ্বাস ছাড়ল। পরদিন সকালে, সকাল আটটার দিকে তিতাস হন্তদন্ত হয়ে নিচে নামল। চট করে বসে গোগ্রাসে খাবার গিলতে লাগল। ওর খাওয়া দেখে ওর বাবা বললেন,
-”আস্তে খাও, গলায় আঁটকে যাবে।”
-”বাঁধার আগে পানি ঢেলে রেডি করে রাখো।”
ছেলের কাজে ওর বাবা যারপরনাই বিরক্ত হয়ে বললেন,
-‘সব সময় ছটপটানি, এই তুই কি ডাক্তার? ডাক্তার হতে হয় শান্ত স্বভাবের, নরম সরম। ”
-” না, আমি সুইপার। এখন যাচ্ছি, একজনের ওয়াশরুম পরিষ্কার করতে। তার নাকি অর্ধেক কাজ সারতেই কমোড ব্লক হয়ে গেছে। আমি গিয়ে সেটা পরিষ্কার করলে সে বাকি কাজ সারবে।”

খাবার টেবিলের এমন কথা শুনে ওর বাবা মুখ কুঁচকে বসে রইললেন। এটা দেখে তিতাস ভ্রু কুঁচকে পুনরায় বলল,

-“এমন ভাব দেখাচ্ছ, মনে হচ্ছে ওয়াশরুমে যাওই না। অথচ কোষ্ঠিকাঠিন্যের রোগী হয়ে দিনের অর্ধেক সময় সেখানেই কাটাও। একথা কাউকে কখনো বলিনি আর বলবোও না।
তোমার ছেলে হয়ে এসব গোপন রাখা আমার গুরু দায়িত্ব। তাছাড়া লোক লজ্জারও একটা ব্যাপার আছে। নয়তো সেই কবেই তোমার ছবি দিয়ে পোষ্টার লাগিয়ে বলতাম, ‘ এই দেখুন এই জেলার দীর্ঘমেয়াদী কোষ্ঠকাঠিন্য রোগী। তিনি
ওয়াশরুমে সময় কাটাতে স্বাচ্ছন্দোবোধ করেন। কমোড উনার একমাত্র প্রকৃত বন্ধু। আপনারা দোয়া করুন উনাদের বন্ধুত্ব যেন স্মরণীয় হয়ে থাকেন।”

ছেলের এমন লাগামহীন কথার তোড়ে ওর বাবা উঠে চলে গেলেন। মূলত যেতে বাধ্য হলেন। বাকিরা উচ্চশব্দে হেসে খেতে লাগলেন। ভোর এখানে নেই, তার বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলছে। তিতাস খেয়ে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে
হাঁটা ধরল। হঠাৎ’ই দাঁড়িয়ে গিয়ে প্যান্টের চেইন আঁটকে পা বাড়াতেই ভোরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ভোরকে মুখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তার মুখ কুঁচকানোর কারণ বুঝলও, আজব তাড়াহুড়োয় চেইন লাগাতে ভুলে গেছে। এখানে মুখটা এমন করার কী আছ?তিতাস কথা না বাড়িয়ে মেয়েদের মতো মুখ ভেংচিয়ে বেরিয়ে গেল।

To be continue……!!
#পর্ব_০৬

তিতাস হসপিটালে পৌঁছে দ্রুতপায়ে জরুরি বিভাগের দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ তাকে ফোন করে আসতে বলা হয়েছে। কেন, এখনো জানানো হয় নি। তিতাস কল পেয়েই তাড়হুড়ো করে এসেছে। হসপিটাল থেকে ডাকা মানেই জরুরি ব্যাপার, এতটুকু বোঝার ক্ষমতা তার আছে। এজন্য দ্বিমত করে নি। যে পেশা তার স্বপ্ন সেটাকে হেলা করার দুঃসাহসও তার নেই। সে এপ্রোন শরীরে জড়িয়ে জুরুরি বিভাগে যেতেই একজন নার্স এসে বললেন,
-”স্যার, রোগী বারবার আপনার কথা জিজ্ঞাসা করছে। শান্ত করা যাচ্ছে না। মুখে অক্সিজেন মাক্সটাও রাখতে চাচ্ছে না, অথচ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। এজন্যই আপনাকে জুরুরিভাবে ডাকা হয়েছে।।”
-”কোন রোগীর কথা বলছেন?”
-”ভোর ম্যামের সহকারী রবিন ভাইয়ের কথা বলছি।”
-”কি হয়েছে তার?”
-”গতকাল রাতে বাসার ফেরার পথে এক্সিডেন্ট করেছে।”

তিতাস আর কথা না বাড়িয়ে রবিনের কেবিনের দিকে গেল।
রবিনের কথা তাহলে ভোর জানে না। জানলে বাসায় থাকার মেয়ে সে না। তবে রবিন ভোরকে না জানিয়ে তাকে খোঁজার কারণ বুঝতে পারল না। যদি অহেতুক বকে সেও ছাড়বে না। নার্সের সামনে ওর পশ্চাদ্‌দেশে ইনজেকশন পুশ করে দিবে। ব্য’থা’তুর শব্দ করার আগেই আরো একটা দিবে। তখনই সে বুঝবে তিতাস কি জিনিস! এসব ভেবে তিতাস কেবিনে ঢুকে দেখে রবিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। বুকে আর মাথায় ‘চো’ট পেয়েছে। হঠাৎ কেবিনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে সে চোখ খুলে তাকাল। তড়িঘড়ি করে উঠতে গিয়ে ব্যথা পেয়ে পুনরায় শুয়ে পড়ল। তিতাস বিরক্ত নজরে তাকিয়ে রবিনের রিপোর্টে চোখ বুলিয়ে চেয়ার টেনে বসল। ওর মুখ বিরক্তিতে ছড়াছড়ি। যেন কেউ তাকে ধরে বেঁধে বসিয়ে রেখেছে। রবিন ওকে কিছু বলতে গেলে তিতাস বলল,

-”এই অবস্থা হলো কি করে? মেয়ের পিছু নিয়েছিলে?”
-”না, আসলে..!”
-”আসলে নকলে পরে শুনছি আগে ঝেড়ে কাঁশো।”
-”স্যার, যেভাবেই হোক ম্যামকে বাসা থেকে বের হতে দিবেন না, আগামী এক মাস।”
-”সে কী আমার বউ লাগে যে, রুমবন্দি করে রাখব?”
-”প্রয়োজনে বউ বানিয়ে আঁটকে রাখুন।”
-” তাকে কোন দুঃখে বউ বানাব?”
-” ম্যাম বাইরে সেইভ নয় স্যার।”
-‘তো আমি কী করব?”
-” আয়মান ম্যামকে কিডন্যাপ করার চক্রান্ত করছে। উদ্দেশ্য ম্যামকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার।’
-”আয়মান কে? ওই যে ডান ভ্রুঁ কাঁ/টা/ ছ্যাচড়টা? ভোরকে দেখলেই যে গদগদ করে ।”
-‘হ্যাঁ, উনি ম্যামের ফুপাতো ভাই।”
-‘বুঝলাম, তা এসব তুমি জানলে কী করে?”
-”গতরাতে আয়মানের বলা কথাগুলো শুনে ফলো করতে গিয়ে এক্সিডেন্টটা করেছি।”

তিতাস গম্ভীর হয়ে কিছু ভেবে রবিনের দিকে বিরক্ত চোখে তাকাল। এরা আর শান্তি দিলো না। তারপর নার্সকে ডেকে কিছু বলার আগেই রবিনের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল। বুকে হাত দিয়ে সে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে। তিতাস ঘুরে দ্রুত অক্সিজেন মাক্স লাগিয়ে শ্বাস নিতে ইশারা করল। ধীরে ধীরে রবিন শান্ত হলো। তারপর রবিনকে ধমকে ধামকে বেরিয়ে গেল। রবিন মুখে অক্সিজেন মাক্স নিয়ে মুচকি হাসল। কেন জানি তিতাসকে তার ভালো লাগে। আপনাআপনি তার প্রতি সন্মান চলে আসে। মনে হয়, মানুষ হিসেবে তার মতো হওয়া উচিত। তবে তিতাসের ব্যবহারে যে কেউ মুগ্ধ না হলেও তার উদারতায় হবে। ছেলেটা সর্বদায় মুখে বিরক্ত ঝুলিয়ে রাখে। অথচ এটা তার অভিনয়, নিজেকে আড়াল করার অভিনয়।
তাছাড়া ভোরকে নিরাপদে রাখতে তিতাসই যথেষ্ট। এজন্য সে কথাগুলো আগে তাকেই জানাল। এখন দেখা যাক, সে কতটুকু করে। তিতাস কেবিনের বাইরে গিয়ে ভোরকে কল দিলো। তিনবারের বেলায় ভোর কল রিসিভ করে বলল,

-”রেডি হচ্ছি পরে কথা কথা বলছি।”
-”কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?”
-”আয়মানের সঙ্গে দেখা করতে, তার নাকি জরুরি কথা আছে।”
-”লাগেজ নিয়ে একেবারে যাচ্ছেন নাকি আবার ফিরবেন?”
-”তুই কি আমাকে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছিস?”
-”চেষ্টা করে দেখুন যেতে পারেন কি না?”
-”চ্যালেঞ্জ করছিস?”
-”তিতাসের এত খারাপ সময় আসে নি যে বেয়াল ছেড়ে এই চুনোপুঁটিকে চ্যালেঞ্জ করবে? আর পুরুষরা সিংহের জাত।
জানেন বোধহয়, সিংহ চ্যালেঞ্জ করে না সরাসরি গিয়ে থাবা বসায়। আর হ্যাঁ, আজ নয় আগামী দুই মাস আপনি বাসার বাইরে যেতে পারবেন না। হসপিটাল থেকে আপনার ছুটিও নিয়ে নিয়েছি।”

তিতাসের কথায় ভোর চরম আশ্চর্যে কিছু বলতে পারল না। ওর ছুটি তিতাস নিয়েছে, এর মানে কি? তাছাড়া ছুটি নিবে কেন? আর কি যেন বলল, সে চুনোপুঁটি? বেয়াদবটার এত্ত সাহস! আবার পুরুষদের নিয়ে ভাষণও দেওয়া হচ্ছে। ভোর এবার রেগে বলে উঠল,
-‘পুরুষ শুধু সিংহের না গাধার জাতও হয়। যেমন তুই একটা গাধা, রাম ব’ল’দ।”
-”আচ্ছা, ধন্যবাদ।”
ভোর কল কেটে দ্রুতপায়ে বের হলো। তিতাসকে সে দেখিয়ে দিবে। কিন্তু সদর দরজা অবধি গিয়ে দরোয়ান ওকে আঁটকে দিলো। উনি কোনোভাবেই দরজা খুলে যেতে দিলেন না।বরং জানালেন, তিতাসের কড়া নিষেধ আছে। ভোর নিজের রাগ কনট্রোল করতে না পেরে তিতাসকে কল দিলো। কিন্ত কল রিসিভ হলো না। বরং অটো মেসেজে জানিয়ে দিলো ব্যস্ত আছে। ছেলেটা এবার অতিরিক্ত করছে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে তার। ভোর গিয়ে তিতাসের বাবা-মাকে বলেও কাজ হলো না। দারোয়ান একই জবাব দিলেন। ভোর রাগে দুঃখে রুমে গিয়ে লাগেজ গুছিয়ে রাখল, তিতাস ফিরলে আজই চলে যাবে। থাকার আর ইচ্ছেও নেই। তাছাড়া বন্দি জীবন কাটানো ওর পক্ষে সম্ভব নয়। একপ্রকার রেগেই সারাদিন রুম বন্দি থাকল ভোর।দুপুরে খেলো না, দরজাও খুলল না।
পরে তিতাসকে কল করতে দেখে ফোনটা সুইচ অফ করে রাখল। বে’য়া’দ’ব’টা’র সঙ্গে কথা বলবে না। তিতাসের বাবা রেগে তিতাসকে ইচ্ছেমতো বকাবকি করলেন। আর জবাবে তিতাস বলল,

-”বাবা, অহেতুক বকবে না। তুমি তোমার প্রাক্তনের সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথা বলো আম্মুকে কিন্তু জানিয়ে দিবো। তখন বুড়ো বয়সে বউছাড়া হলে আমাকে দোষ দিতে পারবা না।”

-‘” তোর আম্মুকে আমি ভয় পায় নাকি? তোরা মা ও ছেলে মিলে আমাকে জ্বালিয়ে মারলি। এরচেয়ে সুরভি’ই অনেক ভালো ছিলো। ”

একথা বলে উনি কল কেটে মাথায় পানি ঢালতে গেলেন।
রাগে উনার মাথা দপদপ করছে। প্রেসার বেড়েছে বোধহয়।
ছেলেটার সঙ্গে দু’দন্ড কথা বলেও শান্তি নেই। সেই খোঁচাবে নয়তো ফাঁসিয়ে দিবো। উনার মতো ভদ্রলোকের ছেলে এত অভদ্র, একথা ভাবলেই উনার বুক চিনচিন করে। ওদিকে,
তিতাস কল রেকর্ডটা ওর আম্মুকে পাঠিয়ে পুনরায় রোগী দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেল। বাকি কাহিনি বাসায় পৌঁছে স্বচক্ষে দেখবে।

আয়মান ঘন্টা দু’য়েক হচ্ছে রেস্টুরেন্টে বসে আছে। কোল্ড কফিতে চুমুক দিচ্ছে আর ফোন স্কল করছে। মুখে মৃদু হাসি। আজকে সে ভীষণ খুশি। কারণ ভোরকে মনের কথা বলবে।
তার প্রগাঢ় অনুভূতির কথা প্রকাশ পাবে। সে দেশে ছিলো না বিধায় ভোরের সঙ্গে পিয়াসের বিয়ে হয়েছিল। নতুবা কারো বুকের পাটা ছিল না এই কাজটা করার। ভাগ্যিস পিয়াস় মরেছিল নয়তো সেই’ই মেরে দিতো। ভোর তার, শুধু তারই থাকবে। তবে তার কানে পৌঁছে গেছে তিতাস নাকি ভোরকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। ছেলেটার বুকে পাটা আছে বলতে হবে। তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে থ্রেট দেওয়ার পরেও প্রস্তাবটা বহাল রেখেছে। এবার পাকাপোক্ত কিছু করতে হবে। যাতে বিয়ে করার স্বাদ একেবারে ঘুঁ’চে যায়। নয়তো ছেলেটা ওর আর ভোরের মধ্যে ঢুকে সাজানো পরিকল্পনা ‘ঘেঁ’চে দিবে।
আয়মান এবার অধৈর্য হয়ে ভোরকে কল দিতেই থাকল, ওই একই কথা, বন্ধ। তারপর সে আর না বসে বেরিয়ে পড়ল। ভোর একজন ডাক্তার। হয়তো জুরুরি কাজে আঁটকে গেছে।

__________________

এখন বাজে রাত সাড়ে দশটা। ড্রয়িংরুম থেকে চাচীর কথার শব্দ ভেসে আসছে। হয়তো রোজাকে খুব বকছেন। বাবা-মা উনাদের রুমে চলে গেছেন। ভোর গেস্ট রুমে। আর তিতাস অবসন্ন, ক্লান্ত, শরীরে বিছানায় শুয়ে আছে। তার শান্ত দৃষ্টি সিলিংয়ের দিকে নিবদ্ধ। সে ভাবতেই পারে নি, বাসায় এসে এমন চমকপ্রদ কিছু ঘটবে। তবে সে খুশি, খুব খুশি। এটাও
সত্যি তার পক্ষ থেকে জোরজবরদস্তি নেই। ভোর যা করল, স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে। অবশেষে সেও বৈধতার অধিকার পেয়েই গেল। তার শরীরে লাগল স্বামীর তকমা, এবং ঘাড়ে চাপল দায়িত্বের বোঝা। আজ থেকে ভোর তার বউ। সিনিয়র বউ!

To be continue……!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here